আবার প্রমাণিত কোহলির সেরা খাদ‍্য পাকিস্তানি বোলিং, ম‍্যাচ জেতানো ১০০ করে বোঝালেন, ‘ম‍্যায় হুঁ না!’

খুশদিল শাহকে কভারের উপর দিয়ে চার মেরে দেশকে জেতানোর পর বুকে বার বার হাত ঠেকিয়ে বিশেষ একটি ভঙ্গি করতে দেখা গেল তাঁকে। যেন গ্যালারির দিকে তাকিয়ে বলতে চাইছেন, “ম‍্যায় হুঁ না!”

২০১২ এশিয়া কাপে ১৮৩। ২০১৫ এক দিনের বিশ্বকাপে ১০৭। ২০২৩ এশিয়া কাপে ১২২। ২০২৫ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে অপরাজিত ১০০। সঙ্গে টি-টোয়েন্টির অসংখ্য স্মরণীয় ইনিংস।

তিনি সত্যিই আছেন। তিনি নিশ্চিত ভাবেই আছেন। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারত খেলতে নামবে আর তাঁর ব্যাটে রান দেখা যাবে না, এমন খুব কমই হয়েছে। ফর্ম, অবসর, শেষ আইসিসি প্রতিযোগিতা ইত্যাদি যাবতীয় আলোচনা ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে বিরাট কোহলি আরও এক বার বুঝিয়ে দিলেন, তিনি ফুরিয়ে যাননি। তিনি আছেন। আর বিপক্ষের নাম পাকিস্তান হলে, আরও বেশি করে আছেন।

পাকিস্তানের সঙ্গে খেলতে নামলে কোহলির ব্যাটে রান দেখা যাবে না তা কি হয়! পড়শি দেশের বিরুদ্ধে একটু বেশিই ভাল খেলার তাগিদ থাকে তাঁর মধ্যে। রবিবার দুবাইয়ে সেটা আরও এক বার দেখা গেল। অপরাজিত শতরান করে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দেশকে জেতালেন কোহলি। শুধু জেতালেন বললে ভুল বলা হবে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যে ভাবে কর্তৃত্ব নিয়ে তিনি খেলেছেন, তাতে মাথা তোলার কোনও সুযোগই পায়নি পাকিস্তান। এক দিনের ক্রিকেটে ৫১টি শতরান হয়ে গেল তাঁর। সব মিলিয়ে ৮২টি। সঙ্গে ১৪ হাজার রানে পৌঁছনোর বিশ্বরেকর্ড তো রয়েছেই।

সেলিম মালিক, সইদ আনোয়ার, ইনজামাম উল হক, সচিন তেন্ডুলকর, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, রোহিত শর্মা— ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচের ইতিহাসে সফলদের তালিকায় দু’দেশেরই বেশ কিছু ক্রিকেটার পাকাপাকি ভাবে নাম লিখিয়েছেন। সেই তালিকায় রবিবার কোহলির নামও যে ঢুকে গেল তাতে সন্দেহ নেই। কোহলি নিজেও বরাবর এই ম্যাচে নিজের সেরাটা দিতে মরিয়া থাকেন। সে কারণেই ম্যাচের আগের দিন দু’ঘণ্টা আগে অনুশীলনে চলে এসেছিলেন। ৩৬ বছর বয়সেও তাঁর এই দায়বদ্ধতা অনুপ্রেরণাও না দিলে, আর কী দেবে! সঞ্চালক ইয়ান বিশপ ম্যাচের পর প্রশ্ন করেছিলেন, এক সপ্তাহ ছুটি পেয়ে কেমন লাগছে? হাসতে হাসতে কোহলির উত্তর, “৩৬ বছর বয়সে এসে ভালই লাগছে। যদি ২০-২৫ বছর বয়স হত তা হলে অন্য কিছু ভাবতাম। আপাতত কয়েক দিন নিজেকে বিশ্রাম দেব। কারণ এই ধরনের ম্যাচ খেলার সময় নিজেকে নিংড়ে দিতে হয়।”

এই ম্যাচের আগে সম্প্রচারকারী চ্যানেলে কোহলির একটি ইনিংস বার বার দেখানো হচ্ছিল। ২০২২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ম্যাচ জেতানো সেই ৮২ রানের ইনিংস। বার বার সম্প্রচারিত হচ্ছিল হ্যারিস রউফকে মারা তাঁর জোড়া ছক্কা। যতই সেটা হোক অন্য ফরম্যাট, যতই হোক ধুমধাড়াক্কা ক্রিকেট। কোথাও একটা ফিনিশার কোহলিকে দেখার অপেক্ষা ছিল সমর্থকদের মধ্যে। দুবাই সেই প্রত্যাশা পূরণ করে দিল। অধিনায়ক রোহিত শর্মা বলেই দিলেন, “দেশের হয়ে ও খেলতে কতটা ভালবাসে সেটা সবাই জানে। এত বছর ধরে ওকে দেখছি। আর ওকে দেখে অবাক হই না।”

তখন সবে রোহিত শর্মাকে হারিয়েছে ভারত। ফলে শুরুতেই নেমে পড়তে হয়েছিল কোহলিকে। সেই সময় তাঁর দরকার ছিল ধরে খেলার। ঠিক সেটাই করলেন। কোনও তাড়াহুড়ো করতে গেলেন না। প্রতিটি বল দেখেশুনে খেললেন। ম্যাচের আগাগোড়া কোহলির সেই পরিণত মনোভাব দেখা গেল। এক বারও পাকিস্তানের বোলারদের সুযোগ দেননি। এক বারও ঝুঁকিপূর্ণ শট খেলেননি। দুবাইয়ে পিচে বল আসছিল থেমে থেমে। তাই অকারণ তাড়াহুড়ো করার অর্থ যেচে উইকেট খোয়ানো। কোহলি সেই রাস্তাতেই হাঁটলেন না।

ম্যাচের পর ঠিক সেটাই শোনা গেল কোহলির মুখে। বললেন, “সত্যি বলতে, যে ভাবে খেলেছি সেটা এই ধরনের ম্যাচে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। রোহিতকে শুরুতেই হারানোর পর ম্যাচ জেতানোর পিছনে নিজে অবদান রাখতে পেরে ভাল লাগছে। আগের ম্যাচ থেকে অনেক কিছু শিখেছি। আমার কাজ ছিল মাঝের দিকের ওভারগুলোয় স্পিনারদের বিরুদ্ধে কোনও ঝুঁকি না নিয়ে খেলা। শেষের দিকে আমি আর শ্রেয়স একটু চালিয়ে খেলে কয়েকটা বাউন্ডারি মেরেছি।”

এক দিনের বিশ্বকাপের ফাইনালে হার, অস্ট্রেলিয়ার কাছে টেস্ট সিরিজ় হারের পর কোহলির উপর চাপ বেড়েই চলেছে। বেশির ভাগ ক্রিকেট বিশেষজ্ঞেরা আশাই দেখছেন না ২০২৭ বিশ্বকাপ খেলার। তাঁদের মতে, এটাই কোহলি এবং রোহিতের শেষ আইসিসি প্রতিযোগিতা।

কোহলি নিজে যে সে সবে পাত্তাই দেন না, সেটা পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছেন ম্যাচের পরে। তাঁর সাফ কথা, “আমি নিজের খেলার ধরন জানি। তাই বাইরের কোনও আওয়াজ শুনি না। নিজের মতো থাকি, নিজের শক্তি এবং ভাবনাচিন্তার খেয়াল রাখি। প্রত্যাশার চাপে মাথা ঘুরে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক। তাই আমি বর্তমানে বাঁচতে ভালবাসি এবং প্রতিটা সুযোগে দলের জন্য কিছু করতে চাই। প্রতিটা বলে ১০০ শতাংশ দেওয়ার আমার লক্ষ্য।”

সমালোচনায় তিনি কুঁকড়ে যান না। বাইরের আওয়াজকে দূরে রাখতে পারেন। এক মনে নিজের কাজটা করতে পারেন। তাই তিনি পাকিস্তানের ত্রাস। তাই তিনি বিরাট কোহলি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.