ছাত্রদের সঙ্গে আলোচনার পর পুলিশের সঙ্গে কথা কর্তৃপক্ষের, আইনি সুরক্ষার আশ্বাস, বৈঠকের পর জট কি কাটছে যাদবপুরে?

বিকেল থেকে দফায় দফায় ছাত্রদের সঙ্গে বৈঠক চলল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের। তবে সমঝোতা চূড়ান্ত হল না। কর্তৃপক্ষের তরফে পড়ুয়াদের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর আসার দিন বিশৃঙ্খলার ঘটনায় যাঁরা আহত হয়েছিলেন, তাঁদের চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করবে বিশ্ববিদ্যালয়। পাশাপাশি, তদন্তের স্বার্থে যে সব পড়ুয়াকে বার বার থানায় ডেকে পাঠানো হচ্ছে, তাঁদের বিষয়েও ভেবে দেখার আশ্বাস দিয়েছেন কর্তৃপক্ষ। প্রয়োজনে তাঁদের দেওয়া হবে আইনি সহায়তাও।

যাদবপুরের পড়ুয়াদের বেঁধে দেওয়া সময়সীমার মধ্যেই সোমবার সকাল সাড়ে ১১টা নাগাদ বৈঠক ডেকেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। পড়ুয়াদের তরফে দু’জন করে প্রতিনিধিকেও উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছিল সেই বৈঠকে। কিন্তু পড়ুয়ারা জানান, সোমবার থেকেই যে হেতু বিশ্ববিদ্যালয়ে ফের পঠনপাঠন শুরু হচ্ছে, শুরু হচ্ছে পরীক্ষাও, তাই পরীক্ষাশেষে একেবারে দুপুর ৩টে নাগাদ বৈঠকে যাবেন তাঁরা। বিকেল থেকে শুরু হয় বৈঠক। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন সহ-উপাচার্য অমিতাভ দত্ত, রেজিস্ট্রার কণিষ্ক সরকার, ডিন অফ স্টুডেন্টস রজত রায়-সহ বিভিন্ন বিভাগীয় প্রধান। ছিলেন ছাত্রদের প্রতিনিধিরাও। এর পর বিকেল গড়িয়ে রাত নামলেও বৈঠক শেষ হয়নি। দফায় দফায় ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক প্রধানেরা।

কী কী আলোচনা

সকাল সাড়ে ১১টা নাগাদ বৈঠক ডেকেছিলেন কর্তৃপক্ষ। যদিও শেষমেশ বৈঠক শুরু হয় বেলা ৩টেয়। পূর্বের দাবিসনদই আরও এক বার কর্তৃপক্ষের কাছে ডেপুটেশন আকারে জমা দেন ছাত্রেরা। তাতে ছিল আহত ছাত্রদের চিকিৎসার যাবতীয় খরচ বহন করা এবং যে সমস্ত পড়ুয়ার বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের হয়েছে, তা অবিলম্বে প্রত্যাহারের ব্যবস্থা করার মতো দাবিও। তবে সোমবার মূলত তিনটি দাবি নিয়েই কর্তৃপক্ষের কাছে গিয়েছিলেন পড়ুয়ারা। তাঁদের দাবি ছিল, তৃণমূল-ঘনিষ্ঠ অধ্যাপক ওমপ্রকাশ মিশ্রের ক্যাম্পাসে আসা বন্ধ করতে হবে। অবিলম্বে ইসি বৈঠক ডাকতে হবে কর্তৃপক্ষকে। পাশাপাশি, তদন্তের নামে পড়ুয়াদের পুলিশি ‘হেনস্থা’ থেকে আইনি সুরক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে কর্তৃপক্ষকেই। যাদবপুরকাণ্ডের পর পড়ুয়াদের বেশ কয়েক জনের বিরুদ্ধে যাদবপুর থানায় অভিযোগ দায়ের হয়। ৮টি এফআইআরে মামলা দেওয়া হয় বিভিন্ন জামিন অযোগ্য ধারায়। ওই দিনের পর থেকে এখনও পর্যন্ত একাধিক বার ওই পড়ুয়াদের থানায় ডেকে পাঠানো হয়েছে বলে দাবি। পড়ুয়াদের সঙ্গে কথা বলার পর এ বিষয়ে যাদবপুর থানার ভারপ্রাপ্ত আধিকারিকের সঙ্গে কথা বলেন সহ-উপাচার্য অমিতাভ দ‌ত্ত। সূত্রের খবর, তাঁকে বিষয়টি বিবেচনার করে দেখারও প্রস্তাব দেন তিনি।

ওমপ্রকাশ মিশ্রকে ঘিরে বিক্ষোভ

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনার ন’দিনের মাথায় সোমবার সকালে ক্যাম্পাসে এসেছিলেন যাদবপুরের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তথা তৃণমূল প্রভাবিত অধ্যাপক সংগঠন ওয়েবকুপার সদস্য ওমপ্রকাশ মিশ্র। বিভাগে ঢোকার মুখেই তাঁকে ঘিরে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন পড়ুয়ারা। তাঁদের অভিযোগ, ঘটনার দিন দু’জন ছাত্রীর শ্লীলতাহানি করেছেন ওমপ্রকাশ। পড়ুয়াদের সঙ্গে অভব্য আচরণও করেছেন। ছাত্রছাত্রীদের আরও দাবি ছিল, ‘‘ওঁর আচরণ শিক্ষকসুলভ নয়। ওমপ্রকাশের মতো অধ্যাপকেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে এলে ক্যাম্পাসে এ ধরনের আরও ঘটনা ঘটবে।’’ যদিও এ সব অভিযোগ অস্বীকার করেন অধ্যাপক। ওমপ্রকাশের কথায়, ‘‘আমি বর্ষীয়ান একজন অভিজ্ঞ অধ্যাপক। আমাকে ঘটনার দিন আটকানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। কেন তাঁরা একজন অধ্যাপককে মারধর করেছিলেন, আটকানোর চেষ্টা করেছিলেন, তার জবাব ওঁদেরকে দিতে হবে। আমাকে কালিমালিপ্ত করতে এই ধরনের ঘটনা ঘটানো হচ্ছে।’’ তবে এ সব যুক্তিতে টলেননি ছাত্রীরা। ওমপ্রকাশের ঘরের সামনে প্ল্যাকার্ড হাতে মাটিতে বসে পড়েন তাঁরা। বলেন, ঢুকতে হলে তাঁদের মাড়িয়ে বিভাগে ঢুকতে হবে অধ্যাপককে। ওমপ্রকাশের অফিসে তালা ঝুলিয়ে গালা দিয়ে তালার মুখ বন্ধ করে দেন পড়ুয়ারা। গোটা ঘটনার সময় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ভিতরে ও বাইরে মোতায়েন ছিল সাদা পোশাকের পুলিশবাহিনী। ছিলেন উর্দিধারীরাও। শেষমেশ কোনও মতে বিভাগে ঢোকেন ওমপ্রকাশ। তালা খুলে ঢোকেন নিজের ঘরে। তার পর দিনশেষে বিকেল ৫টা নাগাদ ক্যাম্পাস ছেড়ে বেরিয়ে যান।

ক্যাম্পাসে পুলিশ

গত শনিবার খোদ শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু জানিয়েছিলেন, তিনি শিক্ষাঙ্গনে পুলিশি নিরাপত্তা চান না। অথচ, ওমপ্রকাশ বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার দিন বদলে যায় সেই চিত্র। বিশৃঙ্খলা এড়াতে সকাল থেকেই কড়া পুলিশি নিরাপত্তায় ঘিরে ফেলা হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর। ওমপ্রকাশ ঢোকার মুখে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের আশপাশে সাদা পোশাকেও প্রচুর পুলিশকর্মী ছিলেন। যদিও ওমপ্রকাশ দাবি করেন, তিনি পুলিশ ডাকেননি। কর্তৃপক্ষও পুলিশ ডাকেননি বলে দাবি। তা হলে কে ডাকল পুলিশ, তা নিয়ে জল্পনা শুরু হয়। শিক্ষাঙ্গনে কেন পুলিশি প্রহরার প্রয়োজন হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেন পড়ুয়ারাও। এর পরেই সহ-উপাচার্যের কাছে ক্যাম্পাস থেকে পুলিশকে বার করে দেওয়ার অনুরোধ জানান আন্দোলনরত পড়ুয়াদের একাংশ। পড়ুয়ারা স্পষ্ট জানিয়ে দেন, যত ক্ষণ পর্যন্ত পুলিশ না বেরোচ্ছে, তত ক্ষণ বৈঠক হবে না। বিভাগীয় প্রধানেরাও পুলিশকে ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যেতে অনুরোধ করেন। শেষমেশ নানা টালবাহানার পর দুপুর ৩টে নাগাদ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর ছেড়ে বেরোন উর্দিধারী ও সাদা পোশাকের পুলিশকর্মীরা। এ বিষয়ে দুপুরেই সহ-রেজিস্ট্রার সঞ্জয়গোপাল সরকার বলেন, ‘‘আমরা কোনও পুলিশ ডাকিনি। উপাচার্য বা ওমপ্রকাশ মিশ্রের সঙ্গে আমাদের কথা হয়নি। উপাচার্যকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে অধ্যাপকেরাই পুলিশকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছেন।’’ কর্তৃপক্ষ যদি সত্যিই পুলিশ না ডেকে থাকেন, তা হলে সোমবার সকালে কে বা কারা ক্যাম্পাসে পুলিশ ডেকেছিলেন, তা নিয়ে ধোঁয়াশা এখনও কাটেনি। তবে ছাত্র থেকে অধ্যাপক— সকলেই একবাক্যে বলছেন, ২০১৪ সালের ‘হোক কলরবে’র দীর্ঘ এক দশক পর এই প্রথম ক্যাম্পাসে পা পড়ল পুলিশের।

বাড়ি ফিরলেন ইন্দ্রানুজ

বিকেলে হাসপাতাল থেকে ছাড়া হয় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের জখম পড়ুয়া ইন্দ্রানুজ রায়কে। ঘটনার ১০ দিন পর হাসপাতাল থেকে ছাড়া পান তিনি। আহত ছাত্রের পরিবার জানিয়েছে, এখন বাড়িতেই বাকি চিকিৎসা হবে। তাঁর হাতের কব্জি, বাঁ চোখ এবং পায়ে এখনও সমস্যা রয়েছে। পুরোপুরি সুস্থ হতে আরও মাসখানেক লাগবে বলে জানিয়েছে পরিবার। গত শনিবার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃণমূলপন্থী অধ্যাপকদের সংগঠন ওয়েবকুপার বার্ষিক সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু গিয়েছিলেন। তাঁকে ঘিরে বিক্ষোভ দেখানোর সময়েই জখম হন ইন্দ্রানুজ। অভিযোগ ওঠে, শিক্ষামন্ত্রীর গাড়ির ধাক্কায় তিনি আহত হয়েছেন। তার পর থেকেই হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন প্রথম বর্ষের ওই ছাত্র। তাঁর শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য ছয় সদস্যের মেডিক্যাল দলও গঠন করা হয়েছিল।

প্রথমে শোনা গিয়েছিল, শনিবার হাসপাতাল থেকে ছাড়া হতে পারে ইন্দ্রানুজকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। আরও এক দিন পর্যবেক্ষণে রেখে শেষমেশ সোমবার তাঁকে হাসপাতাল থেকে ছুটি দেওয়া হয়। অন্য দিকে, যাদবপুরকাণ্ড নিয়ে বিতর্কের আবহে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ভাস্কর গুপ্তকেও। তাঁকে রবিবার হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

‘পুলিশি হেনস্থার’ বিরুদ্ধে হাই কোর্টে পড়ুয়ারা

যাদবপুরকাণ্ডে নতুন মামলা দায়ের করতে চেয়ে সোমবারই কলকাতা হাই কোর্টে আবেদন জানিয়েছিলেন এক পড়ুয়া। উদ্দীপন কুন্ডু নামে ওই পড়ুয়ার দাবি, তিনি এসএফআইয়ের সমর্থক। পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে পাঠিয়ে পড়ুয়াদের হেনস্থার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ জানান তিনি। মামলাকারীর আরও অভিযোগ, তাঁদের মোবাইল চাওয়া হচ্ছে। মোবাইল না-দেওয়ায় পড়ুয়াদের বিভিন্ন ভাবে হেনস্থার চেষ্টা হচ্ছে। সোমবার হাই কোর্টে এই বিষয়ে দ্রুত শুনানির আর্জিও জানান উদ্দীপন। যদিও তা গ্রহণ করেনি আদালত। মামলাকারীকে মঙ্গলবার এই বিষয়ে ফের আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বলেছে হাই কোর্ট। তার পরে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেবে আদালত। তাঁর বক্তব্য, সোমবার আবার পড়ুয়াদের তলব করা হয়েছে। এই অবস্থায় আদালতে দ্রুত শুনানির আর্জি জানান ওই মামলাকারী। তবে সেই আর্জি খারিজ করে দিয়েছেন হাই কোর্টের বিচারপতি তীর্থঙ্কর ঘোষ। বিচারপতি জানিয়ে দেন, এখনই দ্রুত শুনানি নয়। মঙ্গলবার ওই বিষয়টি নিয়ে আবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে। তার পরেই আদালত মামলার বিষয়টি বিবেচনা করবে।

তবে, শুরু হল পঠনপাঠন

সোমবার থেকে যাদবপুরের অচলাবস্থা কিছুটা হলেও কেটেছে। স্বাভাবিক ছন্দে শুরু হয়েছে পঠনপাঠন। বিভিন্ন বিভাগে পরীক্ষাও সুষ্ঠু ভাবেই হয়েছে বলে খবর। সোমবার পরীক্ষা দিয়েছেন বিক্ষোভকারী ছাত্রেরাও। এ জন্য কর্তৃপক্ষের ডাকা বৈঠকও পিছিয়ে দেন তাঁরা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.