আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসক-পড়ুয়ার ধর্ষণ-খুনের মামলায় সিবিআইয়ের চার্জশিটে অভিযুক্ত হিসাবে নাম ছিল একমাত্র ধৃত সিভিক ভলান্টিয়ারেরই। সোমবার তাঁর বিরুদ্ধেই শিয়ালদহ আদালতে চার্জ গঠন করা হয়েছে। আগামী সোমবার থেকে ওই মামলার শুনানি শুরু হবে। চার্জ গঠনের পর আদালত থেকে বেরিয়ে প্রিজ়ন ভ্যানে উঠে অভিযুক্ত সিভিক ভলান্টিয়ার যদিও নিজেকে ‘নির্দোষ’ বলে দাবি করেছেন। তিনি এ-ও দাবি করেছেন যে, এই ঘটনায় তাঁকে ‘ফাঁসানো’ হয়েছে, যার নেপথ্যে রয়েছে সরকার। ধৃতের এই দাবির পরেই আবার আসরে নেমেছেন আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তারেরা। তাঁরা নিজেদের পুরনো অভিযোগে অনড় থেকে আবারও দাবি করেছেন, আরজি করের নির্যাতনের ঘটনা এক জনের পক্ষে ঘটানো সম্ভব নয়। তা হলে কেন সিবিআই গুরুত্ব দিয়ে দেখছে না, সেই প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা।
গত ৯ অগস্ট আরজি করের জরুরি বিভাগের চারতলার সেমিনার হল থেকে মহিলা চিকিৎসকের দেহ উদ্ধার হয়েছিল। তাঁকে ধর্ষণ এবং খুনের অভিযোগে কলকাতা পুলিশের ফোর্থ ব্যাটালিয়নের ব্যারাক থেকে গ্রেফতার হন অভিযুক্ত সিভিক ভলান্টিয়ার। চিকিৎসকের মৃত্যুর ৫৮ দিনের মাথায়, গত ৭ অক্টোবর ওই ধর্ষণ এবং খুনের মামলায় চার্জশিট জমা দেয় সিবিআই। তদন্তকারী সংস্থার সূত্রের দাবি, ধর্ষণ ও খুনের মামলায় মূল অভিযুক্ত হিসাবে এক জনের নামই উল্লেখ রয়েছে চার্জশিটে। সোমবার সেই অভিযুক্তের বিরুদ্ধেই শিয়ালদহ আদালতে চার্জ গঠনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে।
আদালত জানিয়েছে, আগামী ১১ নভেম্বর থেকে ওই মামলায় শুনানি শুরু হবে। শুনানি চলবে রোজ। সিবিআইয়ের আইনজীবী দাবি করেছেন, তাদের জমা দেওয়া প্রাথমিক চার্জিশিটের ভিত্তিতে বিচারপ্রক্রিয়া চলবে। চিকিৎসকের ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনায় প্রমাণ লোপাটের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছিল আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ এবং টালা থানার প্রাক্তন ওসি অভিজিৎ মণ্ডলকে। তাঁদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র এবং প্রমাণ লোপাটের অভিযোগের ভিত্তিতে এখনও তদন্ত চলছে। সেই তদন্তের ভিত্তিতে অতিরিক্ত চার্জশিট জমা দেওয়া হবে।
আদালত থেকে বেরিয়ে সোমবার অভিযুক্ত সিভিক ভলান্টিয়ার দাবি করেন, তাঁকে এই ঘটনায় ফাঁসানো হয়েছে। এ নিয়ে রাজ্য সরকারের দিকেও আঙুল তুলেছেন তিনি। এমনকি, ভারতীয় সংবিধানের প্রসঙ্গ তুলে ‘ন্যায়’ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। দাবি করেছেন, আদালতে তিনি বলতে চাইলে, তাঁকে সেই সুযোগ দেওয়া হয়নি।
সিভিক ভলান্টিয়ারের এই মন্তব্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তারেরা। তাঁদের তরফে জুনিয়র ডাক্তার কিঞ্জল নন্দ প্রশ্ন তুলেছেন, কারা, কোন উদ্দেশ্যে ফাঁসিয়েছেন অভিযুক্তকে? আন্দোলনকারীরা প্রথম থেকেই দাবি করে আসছেন, আরজি করের নির্যাতনের ঘটনায় একাধিক জন জড়িত। ধৃত সিভিক ভলান্টিয়ারের সোমবারের মন্তব্যের পর সেই দাবিই আরও জোরালো ভাবে তুলে ধরলেন তাঁরা। সিবিআইয়ের তদন্ত নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন কিঞ্জল। তাঁর প্রশ্ন, কেন এই বিষয়টিতে গুরুত্ব দিচ্ছে না কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা?
চার্জ গঠন
আরজি করে চিকিৎসককে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় একমাত্র অভিযুক্তের বিরুদ্ধে শিয়ালদহ আদালতে চার্জ গঠনের প্রক্রিয়া শেষ হল সোমবার। আরজি কর-কাণ্ডের ৮৭ দিন এবং সিবিআইয়ের চার্জশিট গঠনের ২৮ দিনের মাথায় ওই মামলায় চার্জ গঠনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। আদালত জানিয়েছে, আগামী ১১ নভেম্বর থেকে ওই মামলায় শুনানি শুরু হতে চলেছে। শুনানি চলবে রোজ। যদিও সিবিআইয়ের আইনজীবী জানিয়েছেন, প্রাথমিক চার্জশিটের ভিত্তিতে আপাতত বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে। এখনও পর্যন্ত ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনায় ধৃত সিভিক ভলান্টিয়ারের বিরুদ্ধেই চার্জশিট গঠন হয়েছে। এই ঘটনায় তথ্যপ্রমাণ লোপাটের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে সন্দীপ এবং অভিজিৎকে। তাঁদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র এবং প্রমাণ লোপাটের অভিযোগের ভিত্তিতে এখনও তদন্ত চলছে। সিবিআইয়ের চার্জশিটে দাবি করা হয়েছিল, গোটা ঘটনার নেপথ্যে কোনও বৃহত্তর ষড়যন্ত্র রয়েছে কি না কিংবা আর কেউ জড়িত কি না, সেই দিকগুলি খতিয়ে দেখতে সন্দীপ এবং অভিজিতের বিরুদ্ধে তদন্ত জারি রয়েছে। সেই তদন্ত শেষ হলেই অতিরিক্ত চার্জশিট জমা দেওয়া হবে বলে জানায় কেন্দ্রীয় তদন্তকারী দল।
ধৃতের দাবি
সোমবার আদালত থেকে বার করে প্রিজ়ন ভ্যানে তোলার পর ভিতর থেকে ধৃত সিভিক ভলান্টিয়ার দাবি করেন, তিনি নির্দোষ। তাঁকে ফাঁসানো হয়েছে। প্রিজ়ন ভ্যানের জানলার কাছে মুখ এনে অভিযুক্ত বলেন, “আসলদের বাঁচানোর জন্য আমায় ফাঁসিয়েছে।” আর এ সবের জন্য তিনি আঙুল তুলেছেন সরকারের দিকেও। তাঁর কথায়, “আমি এত দিন চুপচাপ ছিলাম। আমি কিন্তু রেপ (ধর্ষণ) অ্যান্ড (এবং) মার্ডার (খুন) করিনি। আমার কথা শুনছে না। সরকারই আমাকে ফাঁসাচ্ছে। আমি এত দিন চুপচাপ ছিলাম।” ভারতীয় সংবিধানের প্রসঙ্গ তুলে ‘ন্যায়’ নিয়েও প্রশ্ন তুলতে দেখা যায় ধৃত ওই সিভিককে। চিৎকার করে তিনি বলতে থাকেন, “আমি জজসাহেবকে বলছি যে স্যর, আমি কিছু করিনি। আমায় উপর থেকে নীচে নামিয়ে দিল। এটা কি ন্যায়? ভারতীয় সংবিধানের ন্যায়?”
জুনিয়র ডাক্তারদের প্রশ্ন
ধৃতের এই মন্তব্যের পরেই জুনিয়র ডাক্তারেরা সরব হয়েছেন। তাঁদের হয়ে ভিডিয়ো বার্তায় আন্দোলনকারী চিকিৎসক কিঞ্জল প্রশ্ন তুলেছেন, কারা ফাঁসিয়েছেন অভিযুক্ত সিভিককে? কেন ফাঁসানো হয়েছে, সেই প্রশ্নও তুলেছেন তিনি। প্রসঙ্গত, আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তারেরা বার বার অভিযোগ করেছেন, আরজি করে চিকিৎসক-পড়ুয়াকে ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনায় জড়িত রয়েছেন একাধিক জন। সোমবার আদালতের বাইরে প্রিজ়ন ভ্যান থেকে ধৃতের ওই মন্তব্যের পর আবার নিজেদের অভিযোগ তুলে ধরলেন আন্দোলনকারীরা। সিবিআইয়ের তদন্ত নিয়েও প্রশ্ন তুললেন তাঁরা। আন্দোলনকারীদের তরফে কিঞ্জল বলেন, ‘‘প্রায় তিন মাস হতে চলল, এই ঘটনায় এক জন ছাড়া কেউ গ্রেফতার হননি। আমরা প্রত্যেকেই জানি, যে নারকীয় ঘটনা ঘটেছে, তা কোনও এক জনের পক্ষে ঘটানো সম্ভব নয়। তা হলে সিবিআই এত দিন ধরে কী করছে? কেন গুরুত্ব দিয়ে দেখছে না?’’ আরজি কর-কাণ্ডে সিবিআই যে প্রাথমিক চার্জশিট জমা দিয়েছে, তাতে উল্লেখ করা হয়েছে, খুন এবং ধর্ষণের ঘটনায় জড়িত এক জনই।
আর্থিক দুর্নীতি মামলা
আরজি করে আর্থিক দুর্নীতি মামলায় অন্যতম অভিযুক্ত বিপ্লব সিংহের জামিনের আর্জির শুনানিও সোমবার আলিপুর আদালতে ছিল। আদালতে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার দাবি, আরজি কর ছাড়াও একাধিক হাসপাতালে চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহ করেছে বিপ্লবের সংস্থা ‘মা তারা ট্রেডার্স’। তদন্তকারী আধিকারিকদের সন্দেহ, বিপ্লব আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের ‘ঘনিষ্ঠ’। আরজি করের প্রাক্তন ডেপুটি সুপার আখতার আলিও সেই অভিযোগই করেছিলেন। যদিও বিপ্লবের আইনজীবীর দাবি, তাঁর মক্কেলকে ফাঁসানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। বিপ্লবের আইনজীবী আদালতে দাবি করেন, আরজি কর হাসপাতাল থেকে এখনও ব্যবসায়িক কাজের জন্য ৭ লাখ ৬০ হাজার টাকা বকেয়া রয়েছে তাঁর মক্কেলের। সন্দীপের সঙ্গে তাঁর সত্যিই ঘনিষ্ঠতা থাকলে এত টাকা কী ভাবে বকেয়া রইল? সোমবার মামলার শুনানিতে বিপ্লব ছাড়াও সুমন হাজরা এবং আশিস পাণ্ডের জামিনের আবেদন জানানো হয় আলিপুর আদালতে। আগামী ১২ নভেম্বর তাঁদের জামিনের আবেদনের শুনানি হবে। তার আগে তাঁদের সিবিআইকে লিখিত ভাবে নিজেদের বক্তব্য জমা দিতে হবে আদালতে।