শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা। ওড়িশার বাহানগা বাজার স্টেশনের কাছে ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনার কবলে পড়ে চেন্নাইমুখী করমণ্ডল এক্সপ্রেস। সময় যত গিয়েছে, ততই বেড়েছে মৃত নিহত এবং আহতের সংখ্যা। মঙ্গলবার পর্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যা এসে ঠেকেছে ২৮৮-তে। উদ্ধারকাজের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছিল রেললাইন ঠিক করার কাজ। দুর্ঘটনার ৫ দিনের মাথায় রেল জানাল আবার চলবে আপ করমণ্ডল এক্সপ্রেস। প্রায় ১১৬ ঘণ্টা পর, বুধবার দুপুর ৩টে ২০ মিনিটে শালিমার থেকে ছাড়বে আপ করমণ্ডল এক্সপ্রেস। আবার সেই একই পথেই ছুটবে রেল। বালেশ্বরের অদূরে বাহানগার দুর্ঘটনাস্থল পেরোবে সেই একই সময়ে। মঙ্গলবার দক্ষিণ-পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক আদিত্য চৌধরি এ আনন্দবাজার অনলাইনকে বলেন, ‘‘রেলপথ সারাইয়ের কাজ হয়ে গিয়েছে। আগের রুট ধরেই এগিয়ে যাবে করমণ্ডল এক্সপ্রেস।
ডাউন লাইনে করমণ্ডলের পরিষেবা অবশ্য চালু রয়েছে। রেল সূত্রে খবর, মঙ্গলবার সকালেই হাওড়ার শালিমার স্টেশনে পৌঁছেছে করমণ্ডল এক্সপ্রেস। শুক্রবার রেল দুর্ঘটনার অনতিবিলম্বে শুরু হয়েছিল উদ্ধারকাজ। একই সঙ্গে শনিবার থেকে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় চলছিল রেললাইন উদ্ধারের কাজ। কারণ, ওই গুরুত্বপূর্ণ রুটে একাধিক দূরপাল্লার ট্রেন চলাচল করে। প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর পরীক্ষামূলক ভাবে প্রথমে একটি মালগাড়ি চালানো হয় সংশ্লিষ্ট লাইনে। রবিবার সময় তখন রাত ১০টা ৪০ মিনিট। প্রায় এক ঘণ্টা বাদে রাত ১১টা ৩৯ মিনিটে চালানো হয় আরও একটি মালগাড়ি। তবে আপ লাইনে প্রথম ট্রেনটি চালানো হয় রবিবারই রাত ১২টা ৫ মিনিটে। সেই সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব।
রেল সূত্রে খবর, ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্ট রেলপথে ছুটে গিয়েছে একাধিক ট্রেন। সোমবার গিয়েছে বন্দে ভারত এক্সপ্রেস। তার পরে আপ লাইন দিয়ে চালানো হেয়েছে ফলকনুমা এক্সপ্রেসও। সোমবারই ওই লাইন দিয়ে ৪০টির বেশি ট্রেন চলাচল করেছে। কিন্তু বালেশ্বরের কাছে ট্রেনের গতি ছিল কম। যেহেতু সদ্য রেলপথ মেরামত হয়েছে, তাই ওই জায়গা দিয়ে যাওয়ার সময় ট্রেনগুলির গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় মোটামুটি ১০ কিলোমিটার। তার পর মঙ্গলবার আবার বেশ কিছু ট্রেন বাতিল হয়ে যায়। বুধবারও বাতিল হয়েছে ট্রেন।
করমণ্ডল ছাড়াও বাহানগা বাজার পেরোবে আরও ট্রেন :
বুধবার দক্ষিণ-পূর্ব রেলের তরফে বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়েছে, বাহানগা বাজার স্টেশনে লাইন মেরামতির কারণে ৯টি ট্রেন বাতিল করতে হচ্ছে। তবে বুধবার থেকে দূরপাল্লার গুরুত্বপূর্ণ ট্রেনগুলি চালানো যাবে বলে আশাপ্রকাশ করেছে রেল। বুধবার করমণ্ডল ছাড়াও বেশ কয়েক’টি ট্রেন বাহানগা বাজার স্টেশন দিয়ে ছুটে যাবে। তার মধ্যে রয়েছে ২২৮৫৪ বিশাখাপত্তনম-শালিমার এক্সপ্রেস, ১২৮৮২ পুরী-শালিমার এক্সপ্রেস, ১৮৪১০ পুরী-শালিমার শ্রী জগন্নাথ এক্সপ্রেস, ১২৮৪২ এমজিআর চেন্নাই সেন্ট্রাল এক্সপ্রেস, ২২৮৪২ তাম্বারাম-সাঁতরাগাছি এক্সপ্রেস, ১৮০৪৬ হায়দরাবাদ-শালিমার ইস্টকোস্ট এক্সপ্রেস, ২২৬০৬ ভিল্লুপুরম-পুরুলিয়া এক্সপ্রেস, ১২৮৪০ এমজিআর চেন্নাই সেন্ট্রাল-হাওড়া মেল, ১২৮৬৮ পুদুচেরি-হাওড়া এক্সপ্রেস।
করমণ্ডলের মৃতের সংখ্যা সংশোধন হল:
রেল বলছে, এ পর্যন্ত বালেশ্বরে ট্রেন দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন ২৮৮ জন। ওড়িশা সরকার অবশ্য পরিসংখ্যান নিয়ে প্রথমে রেলের সঙ্গে একমত হয়নি। রবিবার তারা জানিয়েছিল বালেশ্বরের কাছে ট্রেন দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ২৭৫ জন। ওড়িশা সরকার এবং রেল, মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে কেন্দ্র এবং রাজ্যের দু’রকমের তথ্যে বিভ্রান্তি শুরু হয়। তবে মঙ্গলবার মৃত্যুর সংখ্যা ‘পর্যালোচনা’ করল নবীন পট্টনায়েক সরকার। তারা রেলের সঙ্গেই একমত হল। দুই তরফ থেকেই জানানো হল মৃতের সংখ্যা ২৮৮।
করমণ্ডল দুর্ঘটনার তদন্তে সিবিআই:
সিবিআইয়ের হাতে আবার ১টি তদন্তভার। এ বার কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা হাতে পেল করমণ্ডল ট্রেন দুর্ঘটনার মামলা। দুর্ঘটনার পরে কেন্দ্রের কাছে সিবিআই তদন্তের জন্য সুপারিশ করে রেল বোর্ডই। সেই অনুযায়ী, মঙ্গলবার ১০ সদস্যের সিবিআইয়ের একটি দল ঘটনাস্থলে যায়। সরেজমিনে দুর্ঘটনাস্থল খতিয়ে দেখার পর বেশ কয়েক জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। পরে একটি এফআইআরও দায়ের করেছে তারা।
একযোগে তদন্ত করছে সিবিআই এবং সিআরএস:
করমণ্ডল এক্সপ্রেসে দুর্ঘটনার কারণ খুঁজতে তদন্ত করছে রেল সুরক্ষা কমিশনার (সিআরএস দক্ষিণ-পূর্ব সার্কল)। অন্য দিকে, কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা (সিবিআই)-ও এই ঘটনার তদন্ত শুরু করছে। তবে দুই সংস্থার তদন্তের মধ্যে বিরোধের কোনও আশঙ্কা দেখছেন না দক্ষিণ-পূর্ব সার্কলের রেল সুরক্ষা কমিশনার এএম চৌধুরী। মঙ্গলবার তিনি জানান, ২টি তদন্তের ধরন ২ রকম। তার নিজস্ব কিছু প্রক্রিয়া রয়েছে। করমণ্ডলকাণ্ডে অন্তর্ঘাতের সম্ভাবনার কথাও উঠে এসেছে। এ নিয়ে রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব ইঙ্গিত দেন, ‘ত্রুটি’র নেপথ্যে হাত রয়েছে মানুষেরই। কিছু কি তদন্তে উঠে এল? চৌধুরী জানান, তদন্ত চলছে। আরও সময় লাগবে।
মমতা বললেন সত্য সামনে আসুক:
করমণ্ডল এক্সপ্রেসে দুর্ঘটনায় মৃতদের প্রায় অর্ধেকই বাংলার মানুষ। ইতিমধ্যে বাংলার শতাধিক মানুষের দেহ চিহ্নিত হয়েছে। করমণ্ডল দুর্ঘটনার পর মঙ্গলবার দ্বিতীয়বার ওড়িশা যান বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কটকের হাসপাতালে ভর্তি বাংলার বাসিন্দাদের দেখতে যান তিনি। এখনও বাংলার ৯৭ জন মানুষ করমণ্ডল দুর্ঘটনায় আহত হয়ে ওড়িশায় চিকিৎসাধীন রয়েছেন। সহায়তার জন্য ওড়িশা সরকার-সহ চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীদের ধন্যবাদ জানান মুখ্যমন্ত্রী মমতা। সেখান থেকেই সংশ্লিষ্ট রেল দুর্ঘটনায় সিবিআই তদন্ত নিয়ে মন্তব্য করেছেন মমতা। তাঁর কথায়, ‘‘সত্য ধামাচাপা দেওয়া উচিত নয়। আমি চাই, সত্যিটা সামনে আসুক। শুভবুদ্ধির উদয় হোক।’’
ওড়িশা থেকে মুখ্যমন্ত্রী চলে আসেন মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে। সেখানে করমণ্ডল দুর্ঘটনায় আহতদের সঙ্গে দেখা করে চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের ধন্যবাদ জানান। পাশাপাশি মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, ট্রেন দুর্ঘটনায় এখনও পর্যন্ত বাংলার ১০৩ জনের দেহ শনাক্ত করা গিয়েছে।
‘বিতর্কে’ ২,০০০ টাকার নোট:
২ হাজারের সমস্ত নোট প্রত্যাহারের ঘোষণা করে দিয়েছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। যাঁদের কাছে এই নোট আছে, তাঁদের সেপ্টেম্বরের মধ্যে বদলে নিতে বলা হয়েছে। কিন্তু, নোট প্রত্যাহার ঘোষণার পরও কেন রেল দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের পরিবারের হাতে এই নোট দেওয়া হচ্ছে? এমনই প্রশ্ন তুলে শাসকদলকে নিশানা করেছেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। মঙ্গলবার ২টি টুইট করেন তিনি। লেখেন, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে তৃণমূল দলের পক্ষ থেকে নিহতদের পরিবারকে ২ লক্ষ টাকার আর্থিক সাহায্য করছেন রাজ্যের একজন মন্ত্রী। সাধুবাদ জানাই। কিন্তু এ প্রসঙ্গে এই প্রশ্নটাও রাখছি, একসঙ্গে ২০০০ টাকার নোটে ২ লক্ষ টাকার বান্ডিলের উৎস কী?”
করমণ্ডল দুর্ঘটনায় বাসন্তীর উত্তর মোকামবেড়িয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের ছড়ানেখালি গ্রামের ৩ ভাই হারান গায়েন (৫১), নিশিকান্ত গায়েন (৪০), দিবাকর গায়েন (৩৩) প্রাণ হারিয়েছেন। ওই ৩ ভাইয়ের সঙ্গে ছিলেন গ্রামেরই সঞ্জয় হালদার(২৪) ও বিকাশ হালদার (২৬ ) নামের আরও দুই পরিযায়ী শ্রমিক। তাঁরাও প্রাণ হারিয়েছেন এ ঘটনায়। মৃত ৫ জনের পরিবারের হাতে মঙ্গলবার ২ লক্ষ টাকা করে আর্থিক সাহায্য তুলে দেওয়া হয়েছে তৃণমূলের তরফ থেকে। সুকান্তের দাবি, যে টাকা তাঁদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে সিংহভাগই ২ হাজার টাকার নোট। তবে এ নিয়ে সুকান্তকে কটাক্ষ ছুড়ে দিয়েছেন তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক তথা মুখপাত্র কুণাল ঘোষ। তাঁর কথায়, ‘‘২ হাজার টাকার নোট কি অবৈধ? এখনও দেশের আইনে এই নোট বৈধ। কিন্তু দেখতে হবে যিনি বা যাঁরা এই টাকা দিচ্ছেন, তিনি বা তাঁরা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে তাঁর হিসেব দেখাচ্ছেন কি না।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘২,০০০ টাকার নোট মানেই কালো টাকা, এটা কে বলল? মানুষকে কি পাগল ভাবেন?’’ এ নিয়ে তিনি আবার সারদাকাণ্ড টেনে শুভেন্দু অধিকারীকে কটাক্ষ করেছেন।