বিদেশ থেকে কয়লা আমদানির খরচ ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখিয়ে বিপুল মুনাফা করেছে আদানি: রিপোর্ট

আবার প্রশ্নের মুখে নরেন্দ্র মোদীর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত শিল্পপতি গৌতম আদানির সংস্থা। এ বার কয়লা আমদানি নিয়ে।

বিদেশি সংবাদমাধ্যমের নতুন তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী, আদানি গোষ্ঠী বিদেশ থেকে কয়লা আমদানির খরচ ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখিয়ে বিপুল মুনাফা করেছে। তার মূল্য চোকাতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে, দেশের শিল্পমহলকে। বিদ্যুতের মাসুলের মাধ্যমে।

লন্ডনের একটি পত্রিকা আজ ‘আদানির দ্বিগুণ দামে কয়লা আমদানির রহস্য’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদনে জানিয়েছে, আদানি গোষ্ঠী বিদেশ থেকে ৫০০ কোটি ডলার মূল্যের কয়লা আমদানি করেছিল। বাজারদরের তুলনায় দ্বিগুণ দামে। বিদেশি একটি সংস্থার মাধ্যমে এই কয়লা আমদানি করা হয়েছিল। ওই সংস্থায় আবার অন্যতম অংশীদার তাইওয়ানের এক ব্যবসায়ী, যিনি আদানিদের সংস্থারও অংশীদার।

সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ, বিশেষত কয়লার খরচের উপরেই বিদ্যুতের মাসুল ঠিক হয়। তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী, আদানি গোষ্ঠী তার বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কাগজে-কলমে কয়লার খরচ ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখিয়েছিল। ইন্দোনেশিয়া থেকে কয়লার জাহাজ ছাড়ার সময় তার যা মূল্য ছিল, গুজরাতের মুন্দ্রায় আদানিদের বন্দরে সেই জাহাজ পৌঁছনোর পরে সেই কয়লার দামই কাগজে-কলমে দ্বিগুণ হয়ে যায়! কয়লার এই দ্বিগুণ দামের ভিত্তিতেই চড়া বিদ্যুতের মাসুল ঠিক হয়। তা মেটাতে হয় আমজনতাকে, কারখানার মালিক শিল্পপতিদের। এর সুবাদে খরচের তুলনায় ৫২ শতাংশ মুনাফা করে আদানি গোষ্ঠী।

এই রিপোর্টের পরে কংগ্রেস নেতা, ছত্তীসগঢ়ের মুখ্যমন্ত্রী ভূপেশ বঘেল কটাক্ষ করেছেন, ‘‘বিধানসভা নির্বাচনে পদ্মফুলে বোতাম টিপলে ভিভিপ্যাট-এ দেখা যাবে আদানি-তে ভোট পড়েছে।’’ তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ জহর সরকারের মন্তব্য, তিনি কয়লা আমদানিতে আদানিদের কালো হাত নিয়ে সংসদে প্রশ্ন করলেও কেন্দ্রের কয়লা ও বিদ্যুৎমন্ত্রী তার জবাব এড়িয়ে গিয়েছেন। এখন আদানিদের অপ্রয়োজনীয় কয়লা আমদানি ও দেশের মানুষের থেকে বিদ্যুৎ মাসুল আদায়ের খেলা প্রকাশ্যে এসে গিয়েছে। জহরের প্রশ্ন, ‘‘নরেন্দ্র মোদী কী করছেন?”

এর আগে হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের তদন্তে আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে শেয়ার দরের কারচুপি, নিজের টাকা বিদেশে পাচার করে, তা ঘুরপথে ভারতে এনে নিজের সংস্থার শেয়ার কিনে দর বাড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল। মাস দেড়েক আগে একাধিক বিদেশি সংবাদমাধ্যমে আদানি গোষ্ঠীর কারবার নিয়ে তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। তাতে অভিযোগ ছিল, আদানি গোষ্ঠীর টাকা দেশের বাইরে কর ফাঁকির স্বর্গরাজ্য মরিশাসে পাচার করা হয়েছে। যার পরিমাণ ১০০ কোটি ডলার। পরে আবার তা ঘুরপথে আদানির সংস্থার শেয়ারেই লগ্নি করা হয়েছে। যার ফলে আদানি গোষ্ঠীর সংস্থার শেয়ারদর ফুলে ফেঁপে উঠেছে। গোটা কারবারে গৌতম আদানির ভাই বিনোদ আদানি ও দু’জন বিদেশি ব্যক্তি জড়িত। যার মধ্যে একজন চিনের নাগরিক।

এর আগে কেন্দ্রীয় সরকারের রাজস্ব গোয়েন্দা দফতরের তদন্তে দেখা গিয়েছিল, আদানি সংস্থা বিদ্যুৎ উৎপাদন যন্ত্র বেশি দামে কিনছে। তবে তারা সরাসরি বিদেশের উৎপাদনকারী সংস্থা থেকে কিনছে না। মাঝে অন্য একটি সংস্থা থাকছে। সেই সংস্থাই বাজারদরে যন্ত্রাংশ কিনে আদানিকে বিক্রি করছে। তারা মুনাফা করছে। ওই সংস্থাটি আসলে আদানিদেরই সংস্থা। তারা নানা ভুয়ো সংস্থার হাত ঘুরিয়ে সেই টাকা ভারতে আদানি গোষ্ঠীর শেয়ারে লগ্নি করছে। উল্টো দিকে বেশি দামে বিদ্যুৎ উৎপাদনের যন্ত্রাংশ কিনতে হচ্ছে বলে আদানিদের বিদ্যুতের মাসুল বেড়ে যাচ্ছে। গুজরাতে কংগ্রেস অভিযোগ করেছিল, আদানি গোষ্ঠী গুজরাতে বিদ্যুৎ জোগান দিয়ে মুনাফা করেছে। গুজরাতের মানুষকে চড়া হারে বিদ্যুতের মাসুল গুণতে হয়েছে। ফিনান্সিয়াল টাইমসের তদন্তে ২০১৯ থেকে ২০২১-এর মধ্যে আদানিদের কয়লা আমদানির খরচ অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে যাওয়ার তথ্য উঠে এসেছে। উদাহরণ হল, ২০১৯-এর জানুয়ারিতে ইন্দোনেশিয়ার কালিওরং থেকে জাহাজে চেপে ৭৪,৮২০ টন কয়লা রওনা হয়। গন্তব্য ভারতের বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। জাহাজ ছাড়ার সময় কয়লার রফতানি মূল্য ছিল ১৯ লক্ষ ডলার। তার সঙ্গে ৪২ হাজার ডলার পরিবহণ ও বিমার খরচ। আদানি পরিচালিত গুজরাতের মুন্দ্রায় সেই কয়লা পৌঁছনোর সময় আমদানি মূল্য দেখানো হয় ৪৩ লক্ষ ডলার।

আদানি গোষ্ঠী দু’দিন আগেই জানিয়েছিল, একটি বিদেশি সংবাদপত্র পুরনো ভিত্তিহীন অভিযোগ খুঁচিয়ে তুলে সংস্থার ভাবমূর্তি নষ্ট করে শেয়ারদরে ধস নামাতে চাইছে। প্রসঙ্গত, হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের রিপোর্টের পরে আদানিদের শেয়ারদরে ধস নেমেছিল। আমেরিকার এই শেয়ার গবেষণা সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা নেট আন্ডারসন আজ এক্স (সাবেক টুইটার)-এ লিখেছেন, ‘আমাদের রিপোর্টের পরে আদানি এন্টারপ্রাইজের কয়লা বেচাকেনার শাখার মুনাফা ৪২% বেড়েছিল। কয়লার দর ৫৬% পড়ে যাওয়া সত্বেও। আদানি বেশি পরিমাণে কেনাবেচা ও খরচ কমানোর যুক্তি দিয়েছিল। যদিও তার অর্থ বোঝা যায়নি। নতুন রিপোর্ট আদানির সাম্প্রতিক লাভক্ষতি নিয়েও প্রশ্ন তুলল।’’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.