কলাই ডাল বাটা দিয়ে গয়নার আদলে সুন্দর ডিজাইন করে পূর্ব মেদিনীপুরের মেয়েরা যে আলঙ্কারিক বড়ি দেয়, তাকে ‘গয়না বড়ি’ বলে। গয়না বড়িতে হরেকরকমের নকশা-চিত্রণ ব্যবহার হয় বলে, একে ‘নকশি বড়ি’ -ও বলা হয়। শিল্পী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর একে বলতেন। রবীন্দ্রনাথ, শিল্পাচার্য নন্দলাল বসু, চিত্রপরিচালক সত্যজিৎ রায়, অধ্যাপক দেবপ্রসাদ ঘোষ প্রমুখ ব্যক্তি গয়না বড়ির গুণগ্রাহী ছিলেন। গ্রামের দরিদ্র মানুষ অতি সামান্য আয়োজনে খাদ্যবস্তুকে যে অসামান্য শিল্পের অবয়ব দেন, তাতেই আশ্চর্য হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। একটি চিঠিতে (২১শে মাঘ, ১৩৪১: শরৎকুমারী দেবী ও হিরণ্ময়ী দেবীকে লেখা, তথ্যসূত্র: সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা, ১১১(৩-৪), ১৪১১: ১৫৬) তিনি লিখছেন, “…. ইহার শিল্পনৈপুণ্য বিস্ময়জনক।” শিল্পী নন্দলাল অন্য একটি চিঠিতে (৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯২৫) লিখছেন, “…. বড়ির নকসাগুলি সত্যিই শিল্পের একটি উৎকৃষ্ট নিদর্শন। বঙ্গমাতার ভাঙ্গা ঝাঁপিতে এই অমূল্যরত্নের সন্ধান পাইয়া আমরা মুগ্ধ হইলাম।” শিল্পী রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় অন্য একটি চিঠিতে (৩১ জানুয়ারি, ২০০৫, কাখুরিয়াবাড় গ্রামের পার্বতী সামন্তকে লেখা) লিখছেন, “… এসব সম্ভার দেখে শিল্পের জীবনে আলো পাই। তোমার এই গড়া — কেবল তোমারই আনন্দ নয়, আমাদেরও। শিল্পী যে শিল্প গড়ে তোলেন — সে যখন সবার হয়, তখনই তো সব চেয়ে ভালো লাগে।” প্রদত্ত তিনটি চিঠির সময়কাল হল জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাস, অর্থাৎ শীতের সময়। গয়না বড়ি দেবার প্রকৃষ্ট সময় এটাই; তখনই তা শিল্পীদের পাঠানো হয়েছিলো এবং গুণের খাতির করে তাঁরা চিঠি পাঠিয়েছিলেন। এত যে সৌন্দর্য, তবুও তার রসিকজন কয়জন? মেয়েলি এই শিল্পকে কেবল বাঁচানোর চেষ্টাই নয়, একে বিশ্ববাণিজ্যিকরণ করা দরকার। ভঙ্গুর এই বড়ি, তা যাতে অক্ষত অবস্থায় ভক্ষকের কাছে পৌঁছায়, তার বন্দোবস্ত করতে হবে। এটাই এখন সবচাইতে জরুরি। ‘লিটিল হার্ট’ বিস্কুট যেমন করে হাওয়া ভরে প্যাকেটে সংরক্ষণ করা হয়, তেমনভাবে প্যাকেজিং-এর মাধ্যমে গয়না বড়িও বিদেশে পাড়ি দিক। কোনো কীটনাশকের অবশেষ যেন বড়িতে না থাকে। জৈব চাষ পদ্ধতিতে কলাই ডালের চাষ হোক। উদর তৃপ্তি ও জিহ্বা-বিলাস হয়ে উঠুক আরও আরও নান্দনিক। গয়না বড়ির সৌন্দর্যের, সূক্ষ্মতার ইরোশন আটকাতেই হবে এবং প্রচার করতে হবে তার অপরূপ লাবণ্য। শিল্পের মুন্সিয়ানা যাতে আরও বাড়ে তারজন্য পূর্ব মেদিনীপুর সহ সারা বাংলার গাঁয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে গয়না বড়ি ভিত্তিক শিল্পস্থাপনে উৎসাহ দিতে হবে, বিদ্যালয়গুলি এই কাজে এগিয়ে আসুক। পড়াশোনা সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা উপার্জন করতে পারবে ছাত্র-ছাত্রীরা। তাদের শিল্পী-হাতে ডালের মণ্ডের ‘চোঙ-কলম’ ফুটিয়ে তুলবে আলপনার নানান ডিজাইন আর কলকা; শাঁখ, ফুলদানি, পদ্মফুল, পাতা, মুকুট, মাছ, প্রজাপতি, ময়ূরের নকশা প্রভৃতি। ভারত ও বিশ্ববাসীর ব্যঞ্জন সেজে আসুক চক্ষু বিলাসেও।
(চলবে)
তথ্যসূত্র : মনাঞ্জলি বন্দ্যোপাধ্যায় ও কল্যাণ চক্রবর্তী (১৪১১), গৃহিণীর বড়াই গহনা বড়ি, সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা ১১১(৩-৪): ১৫৩-১৬৯.
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী এবং শ্রী শীর্ষ আচার্য