অভীকের নৈশপার্টিতে রাতভর মদ্যপান! হুমকি দিয়ে ডেকে পাঠানো হত ছাত্রীদের, কমিটিতে নালিশ

বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজের প্রশাসনিক ভবনের উপরের তলায় কলেজের গেস্ট হাউস। সেখানে তিন-চারটি ঘর পাকাপাকি ভাবে কব্জায় ছিল আর জি কর কাণ্ডে ধৃত সন্দীপ ঘোষের ঘনিষ্ঠ অভীক দে এবং তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের। সেখানে রাতভর চলত পার্টি, মদ্যপান। সেখানে হস্টেল থেকে প্রথম, দ্বিতীয় বর্ষের ডাক্তারি ছাত্রীদের জোর করে এবং ভয় দেখিয়ে ডেকে আনা হত এবং তাঁদের দিয়ে খাবার ও মদ পরিবেশন করানো হত, এবং অতিথিদের মনোরঞ্জনের নির্দেশও দেওয়া হত বলে অভিযোগ। নির্দেশ না মানলে পরীক্ষায় বসতে না দেওয়া এবং রেজিস্ট্রেশন আটকানোর হুমকি দেওয়া হত। এমনই সব লিখিত অভিযোগ এসেছে স্বাস্থ্য দফতরের চার সদস্যের কমিটির কাছে। পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ট্রেনি অভীকের কাজকর্ম খতিয়ে দেখতে গঠিত হয়েছে এই কমিটি।

তদন্ত কমিটির কাছে লিখিত অভিযোগ এসেছে, মেডিক্যাল পড়ুয়াদের ব্যক্তিগত ফোন নম্বর জোর করে নিজেদের কাছে রাখতেন অভীক। তার পরে সেই নম্বর চলে যেত ‘রাজনৈতিক প্রভাবশালী’দের কাছে। এমনকি, রাতে তাদের সঙ্গ দিতে ডাক পড়ত সেই শিক্ষানবিশদের। সম্মত না হলে চলত ভয় দেখানো, হেনস্থা এবং পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দেওয়ার হুমকি— এমনই লিখিত অভিযোগ গিয়েছে তদন্তকারীদের কাছে।

দুর্নীতি, দাদাগিরি, তোলাবাজি, ‘থ্রেট কালচার’-সহ একাধিক অভিযোগে বিদ্ধ অভীক। তিনি ছিলেন বর্ধমান মেডিক্যালে আরএমও। পরে সার্ভিস কোটায় এসএসকেএমে সার্জ়ারি বিভাগে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ট্রেনি হন। আর জি কর কাণ্ডের জেরে তাঁকে এসএসকেএম থেকে সাসপেন্ড করা হয়। পাশাপাশি কলেজ ও হস্টেলে ঢোকায় জারি হয় নিষেধাজ্ঞা। রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর নির্দেশিকা দিয়ে চার চিকিৎসকের বিশেষজ্ঞ কমিটি গড়ে।

এই কমিটিতে রয়েছে‌ন নীলরতন মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ ডাক্তার পীতবরণ চক্রবর্তী, ডায়মন্ড হারবার মেডিক্যালের অধ্যক্ষ উৎপল দাঁ, এসএসকেএমের ডিন ও অধ্যাপক ডাক্তার অভিজিৎ হাজরা ও আরামবাগ মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসক রামপ্রসাদ রায়। সাত দিনের মধ্যে কমিটিকে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু কমিটিতে এত বিপুল চিঠি, তথ্য জমা পড়ছে যে, রিপোর্ট দিতে আরও ১৪ দিন সময় চেয়েছেন তাঁরা। এই চিঠি এবং তথ্যের বিশাল অংশ বর্ধমান মেডিক্যালের। সেখানকার বহু শিক্ষানবিশ চিকিৎসক, জুনিয়র ডাক্তার নিজেদের নাম-ফোন নম্বর দিয়েই অভীক ও তার দলের কীর্তি জানিয়েছেন। বহু ছাত্রী তদন্ত কমিটিকে জানিয়েছেন, সরস্বতী পুজোর আগে বেছে বেছে ছাত্রীদের ডেকে‌ বলা হত, পুজোর দিন অভীকের ঘনিষ্ঠ সিনিয়রদের সঙ্গিনী হয়ে ঘুরতে হবে।

কমিটির তদন্তে এ-ও জানা গিয়েছে যে, নিয়মিত বর্ধমানের মর্গ থেকে মৃতদেহের ভিসেরা ও হাড় ৭-১৫ লক্ষ টাকার বিনিময়ে বিহার, উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজে পাচার করা হত এবং এর পিছনেও ছিল অভীক বাহিনী। বর্ধমান মেডিক্যালের অধ্যক্ষ মৌসুমী বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘তদন্ত কমিটির কাজ চলছে। তাদের যা জানানোর জানাচ্ছি। এর বাইরে কিছু বলা যাবে না।’’

তদন্ত কমিটির কাছে এই তথ্যও লিখিত ভাবে এসেছে যে, অভীক ও তাঁর ডান হাত হিসাবে পরিচিত বর্ধমানের চিকিৎসক বিশাল সরকার ও উমর ফারুখের জন্য হাসপাতালের গেস্ট হাউসে তিনটি ঘর রাখা থাকত। চাবি থাকত তাঁদের কাছেই। বহু রাতে তাঁরা সেখানে থাকতেন। অভীকও সেখানে রাত কাটাতেন। প্রয়োজনে গভীর রাতে বাড়ি থেকে জিনিস আনতেও পাঠানো হত হস্টেলের পড়ুয়াদের। হাসপাতালের গেস্ট হাউস ও লেকচার রুমে অভীক বাহিনীর বিভিন্ন পার্টি, জন্মদিন উদ্‌যাপন চলত। ২০২২-২৩ সালের ছাত্রীরা সেই পার্টিতে যাওয়ার নির্দেশ না মানায় অভীক-সঙ্গী বিশাল ওই ব্যাচের পরীক্ষা পিছিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ। এ-ও অভিযোগ, পরীক্ষায় কারা গার্ড দেবেন সেই তালিকাও অভীকের তত্ত্বাবধানে ঠিক করতেন চিকিৎসক বিশাল ও অমলেন্দু দাস। বর্ধমানের এক চিকিৎসক তদন্ত কমিটিকে জানিয়েছেন, তিনি অভীক বাহিনীর কথা শোনেননি বলে প্রতি বর্ষে এক বার করে তাঁকে ফেল করানো হয়েছে। চূড়ান্ত হতাশ হয়ে তিনি আত্মহননের চেষ্টাও করেছিলেন।

বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ সূত্রের খবর, অভীকের ঘনিষ্ঠ বিশাল ২০২১-২২ এবং ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের মেডিক্যালের শিক্ষানবিশ ছাত্রীদের অশালীন মেসেজ পাঠাতেন, রাতে ঘরে ডেকে পাঠাতেন ও ঘুরতে যেতে চাপ দিতেন। পরীক্ষার হলে ছিল তাঁর অবাধ গতিবিধি। পছন্দের ছাত্রছাত্রীদের কাছে গিয়ে উত্তর বলে দিতেন প্রকাশ্যেই। কারা কারা অনার্স পাবে সেটাও অভীক, বিশাল ও অমলেন্দু কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বসে ঠিক করতেন বলে অভিযোগ জমা পড়েছে। ২০১৯-২০ এবং ২০২২-২৩ বর্ষের বহু মহিলা চিকিৎসকের অভিযোগ, অমলেন্দু তাঁদের রাতে কলেজের গেস্ট হাউসে ডাকতেন, মোবাইলে অশালীন মেসেজ পাঠাতেন। এ ব্যাপারে জানতে বিশালকে বহু বার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। আর অমলেন্দু বলেন, “এই সবই মিথ্যা অভিযোগ, চক্রান্ত।”

গত লোকসভা ভোটে অভীক-বাহিনী বর্ধমান মেডিক্যালের সুপারের ঘরে পূর্ব বর্ধমানের তৃণমূল প্রার্থী চিকিৎসক শর্মিলা সরকারের নির্বাচনী সভার আয়োজন করেছিল এবং সেখানে সব জুনিয়রের উপস্থিত থাকার ফতোয়া দিয়েছিল বলেও অভিযোগ জমা পড়েছে। সন্দীপ ঘোষকে আর জি কর থেকে বদলির পরে বর্ধমান থেকে বহু ছাত্রছাত্রীকে অভীক ও তাঁর সঙ্গীরা জোর করে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে বিক্ষোভ-মিছিল করতে বাধ্য করেছিলেন বলেও অভিযোগ পেয়েছে কমিটি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.