কথা ছিল, মুখ্যমন্ত্রীকে লেখা চিঠি তিনি তুলে দেবেন শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর হাতে। বুধবার দুপুরে তাঁর দফতরে গিয়ে। কিন্তু তার আগেই প্রকাশ্যে সে চিঠি ছিঁড়ে ফেললেন কলকাতা হাই কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি তথা বিজেপি সাংসদ অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়।
প্রকাশ্য কারণ, কসবায় চাকরিহারা শিক্ষকদের উপর পুলিশি লাঠিচার্জের প্রতিবাদ। কিন্তু সে তো প্রকাশ্য কারণ। বিজেপির অন্দরের খবর, দলের সঙ্গে কোনও আলোচনা ছাড়াই সম্পূর্ণ একার সিদ্ধান্তে শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে দেখা না-করার মর্মেই রাজ্য বিজেপির দুই শীর্ষনেতার বার্তা গিয়েছিল অভিজিতের কাছে। বিশেষত, দলের বাকি সদস্যেরা যখন রাজ্য সরকার তথা মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কড়া রাজনৈতিক আক্রমণে যাচ্ছেন।
অভিজিৎ যা করতে চেয়েছিলেন, তাতে বিরোধী দলের ‘রণং দেহি’ মনোভাবটাই মিইয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। অন্তত তেমনই মনে করেন রাজ্য বিজেপির বড় অংশ। কারণ, যে মমতাকে গোটা দল চাকরিহারা শিক্ষকদের দুর্গতির জন্য কাঠগড়ায় তুলছে, সেই মমতাকেই কমিটি গঠনের অনুরোধ জানিয়ে চিঠি লিখে বসেছেন অভিজিৎ। শুধু লেখাই নয়। শিক্ষামন্ত্রীর মারফত সেই চিঠি মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পাঠানোরও ব্যবস্থা করে ফেলেছেন! সেই মর্মে শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের সময়ও নির্ধারিত হয়ে গিয়েছে। বস্তুত, অভিজিৎ যখন তাঁর পূর্বঘোষিত এবং একক কর্মসূচি অনুযায়ী এসএসসি দফতর হয়ে বিকাশ ভবনে শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে বেরিয়েছেন, তখন রাজ্য বিধানসভায় তাঁর সতীর্থেরা লালবাজারে কলকাতা পুলিশের সদর দফতরের সামনে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। পথ অবরোধ করছেন। অভিজিৎ যখন মমতার মন্ত্রিসভার সদস্য ব্রাত্যের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন, প্রায় তার পিঠোপিঠি সময়ে পূর্ব মেদিনীপুরের রেয়াপাড়ায় একটি সভায় শুভেন্দু অধিকারী বলছেন, ‘‘উনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নন। চোর বন্দ্যোপাধ্যায়!’’
দু’টি ঘটনাপ্রবাহ পরস্পরের সম্পূর্ণ বিপরীত! যা বিজেপির পক্ষে ‘অস্বস্তিজনক’।
কিন্তু অভিজিৎ তত ক্ষণে এগিয়ে পড়েছেন। সঙ্গে রয়েছে সংবাদমাধ্যম। রয়েছেন চাকরিহারা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের একটি অংশ। পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যেতে বসেছে বুঝে রাজ্যের দুই শীর্ষনেতার হস্তক্ষেপেই শেষরক্ষার (বা মুখরক্ষা) পথ খোঁজা শুরু হয়। যার উপসংহার মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠিটি সর্বসমক্ষে ছিঁড়ে ফেলায়। প্রসঙ্গত, চাকরিহারাদের নিয়ে অভিজিৎ বুধবারও এসএসসি দফতরে গিয়ে চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করেন। বেরিয়ে এসে তিনি দাবি করেন, এখনও যে যোগ্যদের চাকরি বাঁচানো সম্ভব, সে কথা চেয়ারম্যানকে তিনি জানিয়ে এসেছেন। তবে এসএসসি দফতর থেকে বেরোনোর পরে অভিজিতের সবচেয়ে বড় ঘোষণা ছিল, তিনি শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে আর দেখা করতে যাচ্ছেন না। যা নিয়ে ব্রাত্য পরে তাঁকে কটাক্ষ করেছেন। বলেছেন, বিকাশ ভবনের মতো এসএসসি-ও তো ‘সরকারি দফতর’। কসবা-কাণ্ডের প্রতিবাদে সেখানে যাওয়া কেন অভিজিৎ বয়কট করলেন না?
অভিজিৎ-ব্রাত্য প্রস্তাবিত সাক্ষাতের ‘মাধ্যম’ মঙ্গলবার রাতে এবিপি আনন্দের একটি শো। ওই শোয়ে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অভিজিৎ (কারণ, চাকরি বাতিলের ওই মামলার সঙ্গে তিনি বিচারপতি থাকাকালীন অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত ছিলেন। বস্তুত, কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি থাকাকালীন তিনিই প্রথম চাকরি বাতিলের নির্দেশ দিয়েছিলেন)। তিনি শোয়ে তাঁর বক্তব্য বলতে বলতেই সেখানে ফোন আসে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্যের।
সুপ্রিম কোর্ট প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষকের চাকরি বাতিল করার পর সাংসদ অভিজিৎ বলেছিলেন, সমস্যা সমাধানে মুখ্যমন্ত্রীর একটি কমিটি গঠন করা উচিত। ব্রাত্য তাঁকে প্রশ্ন করেন, তিনি ওই কথা কাকে জানিয়েছেন? অভিজিৎ জানান, তিনি হাওয়ায় বা ইথার তরঙ্গে তাঁর বক্তব্য ভাসিয়ে দিয়েছেন। ব্রাত্য তাঁকে বলেন, তিনি কেন মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি লিখছেন না? অভিজিৎ বলেন, এটি ‘উত্তম প্রস্তাব’। তিনি বুধবারই চিঠি নিয়ে নবান্নে যেতে পারেন। ব্রাত্য যেন তাঁর সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর সাক্ষাতের বন্দোবস্ত করে দেন। শিক্ষামন্ত্রী পাল্টা বলেন, মুখ্যমন্ত্রীর কর্মসূচি সম্পর্কে তিনি অবগত নন। তিনি কখন নবান্নে থাকবেন, তা তাঁর সেই মুহূর্তে জানা নেই। অভিজিৎ শিক্ষামন্ত্রীকে বলেন, তিনি চিঠিটি শিক্ষামন্ত্রীকে দিলে তিনি কি সেটি মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পৌঁছে দিতে পারেন? ব্রাত্য রাজি হয়ে যান। বৃহস্পতিবার দুপুরে সাক্ষাতের সময়ও ঠিক হয়ে যায় তখনই।
এই পুরো বিষয়টি সম্পর্কে টিভির দর্শক বিজেপি নেতারা অবহিত ছিলেন নিশ্চয়ই। কিন্তু দলীয় ভাবে কেউই বিষয়টি জানতেন না। যা বিজেপির মতো একটি দলে কার্যত অভাবনীয়! অভিজ্ঞদের মতে, তৃণমূল বা কংগ্রেসের মতো দলে এমন ‘একক উদ্যোগী’ (হাতের কাছে উদাহরণ: কুণাল ঘোষ) আকছার দেখা যায়। কিন্তু বিজেপি বা সিপিএমের মতো দল এ ভাবে চলে না।
বিজেপি সূত্রের দাবি, একজন সাংসদের ‘আগ বাড়িয়ে’ এমন একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলাকে নেতৃত্ব ভাল চোখে দেখেননি। নিয়োগ বাতিলের প্রেক্ষিতে বিজেপি কোন পথে এগোবে, সে বিষয়ে দলের রাজ্য নেতৃত্ব এখন প্রতিটি পদক্ষেপ করছেন নিজেদের মধ্যে আলোচনার সাপেক্ষে। কবে পথে নামা হবে, কবে নবান্ন অভিযান হবে, চাকরিহারাদের পাশে দল কী ভাবে দাঁড়াবে, সে সব বিষয়ে সংবাদমাধ্যমে কী বলা হবে এবং কী বলা হবে না— সব বিষয়েই বঙ্গ বিজেপির শীর্ষনেতারা নিজেদের মধ্যে সমন্বয় রেখে চলছেন। বিজেপি যে রাজ্য সরকারের সঙ্গে এখন সম্মুখসমরেই যাবে, সে বিষয়ে সুকান্ত মজুমদার এবং শুভেন্দু-সহ গোটা রাজ্যনেতৃত্ব একমত। সেই আবহে দলেরই সাংসদ অভিজিৎ কী করে শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বসার ‘একতরফা’ সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন, তা নিয়ে স্বভাবতই দলের অন্দরে প্রশ্ন ওঠে। অস্বস্তিও তৈরি হয়। অস্বস্তিটি শেষমেশ এড়ানো গিয়েছে অভিজিৎ শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্যের মুখোমুখি না হওয়ায়। কিন্তু পাশাপাশিই অভিজিৎ এমন কাণ্ড পরে আবার ঘটাবেন কি না, তা নিয়েও দলের অন্দরে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
রাজ্যের এক অভিজ্ঞ বিরোধী নেতা তথা প্রাক্তন সাংসদের কথায়, ‘‘বিচারপতি থাকাকালীন অভিজিৎ অনেক সময়েই এমন মন্তব্য করেছেন, যা সামগ্রিক ভাবে রাজ্যের রাজনীতি বা সমাজে ঝড় তুলে দিয়েছে। কিন্তু এখন তিনি একটি দলের সাংসদ। তিনি একটি রাজনৈতিক দলের কর্মীও বটে। ফলে তিনি আগের মতো নিজস্ব ভঙ্গিতে বা নিজের মতো করে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতে পারেন না। সেটা তাঁকে বুঝতে হবে। নইলে তাঁকে নিয়ে বিজেপি আবারও বিড়ম্বনায় পড়বে। আবার মুখরক্ষার উপায় খুঁজতে বসতে হবে!’’