বাংলার অভয় প্রথম অযোধ্যায় গিয়েছিলেন ১৯৯০ সালে। উঠেছিলেন বিতর্কিত সৌধের উপর। ১৯৯২ সালেও গিয়েছিলেন। তবে সে বার ক্রাচে ভর দিয়ে। এই ২০২৪ সালে আবার যাচ্ছেন। আগামী সোমবার, ২২ জানুয়ারি তিনি হাজির থাকবেন রামমন্দিরের প্রাণপ্রতিষ্ঠা অনুষ্ঠানের অতিথি হয়ে। রাজ্য থেকে যে ক’জন আমন্ত্রণ পেয়েছেন, তাঁদের অন্যতম আসানসোলের অভয় বার্নোয়াল।
বিহার থেকে বার্নোয়াল পরিবার পশ্চিমবঙ্গের আসানসোলে এসেছিল শ’খানেক বছর আগে। বাংলায় অভয়েরা তিন পুরুষের বাসিন্দা। বাচ্চাবেলা থেকে আরএসএস করতেন। প্রশিক্ষণও নিয়েছেন কলেজে ঢোকার আগেই। আর ১৯৮৯ সালে যখন রামজন্মভূমি আন্দোলন মাথাচাড়া দিচ্ছে, তখন থেকেই অভয় গেরুয়া শিবিরের লড়াকু সৈনিক। তখন তাঁর বয়স ২০ বছর। কলেজে পড়ছেন। সংগঠনের ডাক পেয়ে অযোধ্যার পথে রওনা দেন করসেবক হিসাবে। অনেক বাধা পেরিয়ে পৌঁছেও যান। উঠে যান একেবারে সৌধের মাথায়। পুলিশ গুলি চালিয়েছিল। মৃত্যু হয়েছিল ১২ জন করসেবকের। তাঁদের মধ্যে ছিলেন কলকাতার দুই ভাই রাম এবং শরদ কোঠারি। গুলিতে গুরুতর জখম হয়েছিলেন অভয়। বেশ কিছু দিন উত্তরপ্রদেশের হাসপাতালে চিকিৎসার পরে রাজ্যে ফিরেছিলেন। তবে সহজে বাড়ি যেতে পারেননি।
মাঝখানে ৩৩ বছর কেটে গেলেও সেই সব স্মৃতি গড়গড়িয়ে বলে গেলেন অভয়। জানালেন, তাঁর আর সবুর সইছে না। রামজন্মভূমি তীর্থক্ষেত্র ট্রাস্টের চিঠি আসার পর থেকেই তিনি অপেক্ষায় উদ্বোধনের দিনের জন্য, অযোধ্যায় পৌঁছনোর জন্য। রোজই এক বার চিঠিটায় হাত বুলিয়ে দেখেন। বললেন, ‘‘ঘুমের মধ্যেও অযোধ্যা দেখছি। স্বপ্নের রামমন্দির দেখার জন্য মুখিয়ে রয়েছি।’’
প্রথম বার করসেবক হয়ে যাওয়ার বর্ণনা দিতে গিয়ে আনন্দবাজার অনলাইনকে অভয় বললেন, ‘‘আমি ২১ অক্টোবর শিয়ালদহ থেকে জম্মু-তাওয়াই এক্সপ্রেসে উঠি। বারাণসী পৌঁছে দেখি, ট্রেনের সবাইকে নামিয়ে গ্রেফতার করছে পুলিশ। স্টেশনে আর কোনও লোক নেই। শুধুই পুলিশ!’’ প্রসঙ্গত, তখন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী মুলায়ম সিংহ যাদব আগেই প্রকাশ্যে বলে দিয়েছিলেন, ‘‘করসেবক কেন? একটা পাখিকেও গলতে দেওয়া হবে না অযোধ্যায়!’’
তা সত্ত্বেও অভয় বা কোঠারি ভাইদের মতো অনেকেই পৌঁছে গিয়েছিলেন। অভয় বললেন, ‘‘পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে স্টেশন থেকে বেরিয়ে যাই। তার পরে হাঁটতে শুরু করি। রাস্তায় রাম আর শরদের সঙ্গে দেখা। হাঁটতে হাঁটতে জৌনপুর পৌঁছই ২২ অক্টোবর। বিহারে লালকৃষ্ণ আডবাণীকে যে দিন গ্রেফতার করা হল, সে দিন আমি জৌনপুরে।’’ প্রসঙ্গত, তার মাসখানেক আগে ২৫ সেপ্টেম্বর আডবাণী গুজরাতের সোমনাথ মন্দির থেকে শুরু করেন রামরথ যাত্রা। উত্তরপ্রদেশ যেতে চাওয়া সেই যাত্রা আটকে দেন বিহারের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদব।
আডবাণীকে গ্রেফতার করা হলেও করসেবকদের অযোধ্যায় ঢোকা পুরোপুরি আটকানো যায়নি। অভয় বললেন, ‘‘জৌনপুরে এক দিন লুকিয়ে থেকে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে আমরা হাঁটতে শুরু করি। এমনিতে ২০০ কিলোমিটার রাস্তা হলেও ভিতর ভিতর দিয়ে প্রায় সাড়ে ৩০০ কিলোমিটার হাঁটতে হয়েছিল। তবে ঠিক সময়ে ৩০ অক্টোবরের আগেই অযোধ্যায় পৌঁছে গিয়েছিলাম। তবে শহরে না ঢুকে স্বয়ম্বরনগরে আখের ক্ষেতে লুকিয়ে ছিলাম। তিন দিন জল ছাড়া কিছু মুখেও দিতে পারিনি।’’
বিতর্কিত সৌধ পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়ার কাহিনি রোমহর্ষক। অভয় বলে চলেন, ‘‘অযোধ্যায় পৌঁছে দেখি, পুলিশ আর পুলিশ। লুকিয়ে লুকিয়ে সরযূ নদীর দিকে চলে গেলাম আলাদা আলাদা ভাবে। দেখি অনেকে সাঁতরে অযোধ্যায় আসছেন।’’ সে দিন সকাল ১০টা নাগাদ নাকি মহন্ত নৃত্যগোপাল দাস এবং অশোক সিঙ্ঘল মিছিল শুরু করে দেন। পুলিশও পাল্টা বাধা দেয়। সেই সময়ে পুলিশের লাঠিতে সিঙ্ঘলের মাথা ফাটে। সেটা নিয়ে হইচই চলার মধ্যেই পুলিশের বাস ‘লুট’ করে নেন এক সাধু। অভয় বলেন, ‘‘এক জন গেরুয়া পোশাক পরা সাধু বাসের চালকের আসনে বসে সবাইকে উঠে পড়তে বলেন। আমরা বাসের ছাদে উঠে পড়ি। রাম আর শরদও ছিল ওই বাসে। সাধুবাবা একের পর এক ব্যারিকেড ভেঙে রামজন্মভূমির একেবারে কাছে পৌঁছে যান। আমরা সবাই বাস থেকে নেমে সৌধে উঠতে শুরু করি। একেবার চূড়ায় উঠে গেরুয়া পতাকা লাগিয়ে দিই।’’
এর পরেই পুলিশ গুলি চালাতে শুরু করে। অভয় বলেন, ‘‘সৌধ থেকে নেমেই দেখি গুলি চলছে। মাথা লক্ষ্য করে গুলি চালাচ্ছিল পুলিশ। একের পর এক করসেবক মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে। গুলি খাওয়া এক জনকে ধরার জন্য আমি বসে পড়েছিলাম বলে আমার মাথায় গুলি লাগেনি। ডান ঊরুতে গুলি ঢুকে যায়। এ-ফোঁড় ও-ফোঁড় হয়ে যায়।’’
এর পরে করসেবকরাই লুকিয়ে অভয়ের চিকিৎসা চালান অযোধ্যার এক মন্দিরে। পরে সেখানকারই শ্রীরাম হাসপাতালে তাঁকে ভর্তি করানো হয়। কিন্তু ক্ষতটা এতটাই বেশি ছিল যে, পরে ফৈজাবাদের হাসপাতালে পাঠানো হয় তাঁকে। তত ক্ষণে আসানসোলে খবর পৌঁছে যায়, স্বয়ংসেবক অভয়ের গুলি লেগেছে। রাম আর শরদ কোঠারির মৃত্যু হলেও অভয় গুরুতর ক্ষত নিয়ে হাসপাতালে লড়াই করছেন।
খবর পেয়ে ৩০ অক্টোবরই বাংলা থেকে গেরুয়া শিবিরের কর্তাদের সঙ্গে অভয়ের বাবা শিবশঙ্কর প্রসাদ অযোধ্যার উদ্দেশে রওনা দেন। অভয় বলেন, ‘‘আমার ৭২ ঘণ্টা জ্ঞান ছিল না। এক দিন দেখি, বাবা মাথায় হাত রেখে ‘সাবাশ’ বলছেন। আমার মনে হয়েছিল, রামের জন্য লড়াইয়ের সেরা পুরস্কারটাই পেয়ে গেলাম। বাবাও ইলাহাবাদ থেকে হেঁটে অযোধ্যায় গিয়েছিলেন।’’ বাবার সঙ্গেই বাংলায় ফেরেন অভয়। কিন্তু বাড়িতে ফেরা হয়নি। ছ’মাস ভর্তি ছিলেন কালনা হাসপাতালে। সেখানেই অস্ত্রোপচার হয় পায়ে। পরে ‘ট্র্যাকশন’ দিয়ে রাখা হয়েছিল তাঁকে। তখন আসানসোলের অভয় গেরুয়া শিবিরের ‘নায়ক’। নাগপুর থেকে আরএসএসের তৎকালীন সর-সঙ্ঘচালক রাজেন্দ্র সিংহ (‘রজ্জুভাইয়া’ নামে যিনি প্রসিদ্ধ) হাসপাতালে অভয়কে দেখতে এসেছিলেন।
অভয় ১৯৯২ সালে আবার যান অযোধ্যায়। ক্রাচে ভর দিয়েই পৌঁছে যান সৌধের কাছে। তাঁর কথায়, ‘‘যখন সৌধ ভাঙা হচ্ছিল, তখন আমি সেখানে ছিলাম। পরে রামলালার ছাউনি তৈরির সময়েও ছিলাম। আমিও হাত লাগাই কাজে।’’ এর পরে আরএসএস নিষিদ্ধ হয়ে যায়। বাড়ি ফিরে আত্মগোপন করে ছিলেন অভয়। তবে নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পরে আরও এক বার গিয়েছিলেন অযোধ্যা নগরীতে। তিনি বলেন, ‘‘সুস্থ হলেও আমার ডান পা বাঁ পায়ের থেকে আড়াই ইঞ্চি ছোট। তবু ব্যবসা শুরু করার আগে ১৯৯৩ সালে অযোধ্যায় গিয়ে রামলালাকে পুজো দিয়ে আশীর্বাদ নিয়ে এসেছিলাম।’’
বৈদ্যুতিন যন্ত্রপাতি সরবরাহের ব্যবসায়ী অভয় আবার যাচ্ছেন অযোধ্যা। এ বার রামজন্মভূমি আন্দোলনের ‘বীর সৈনিক’ মর্যাদা দিয়ে আমন্ত্রণ এসেছে অযোধ্যা থেকে। তিনি বললেন, ‘‘খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়েও মন্দিরে উঠব। গর্ভগৃহে রামলালার কাছে যাব। তাঁর জন্যই তো এত কিছু। আমি তো তবু প্রাণে বেঁচে আছি। আমরা সামনেই যাঁরা প্রাণ দিয়েছেন তাঁদের স্মরণ করব।’’
অযোধ্যায় অভয় থাকবেন তিন দিন। সব ব্যবস্থা করছে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ। তবে নিজেই যাওয়া-আসার টিকিট কেটে নিয়েছেন। সেই গুলি খাওয়ার বছরের মতো এ বারেও কলকাতা থেকে জম্মু-তাওয়াই এক্সপ্রেসই ধরবেন অভয়।