বাঁশের তৈরি দাঁত মাজার ব্রাশ বানিয়ে তাক লাগিয়ে দিলেন কলকাতার তরুণ, বিক্রিতেও চমকের ভাবনা

এটাই যে প্রথম তা নয়। তবে কলকাতার যুবক যা বানিয়েছেন, তাকে অনন্য বলতেই হবে। কারণ, অতীতে অনেক জায়গায় বাঁশের তৈরি পরিবেশবান্ধব দাঁত মাজার ব্রাশ তৈরি হলেও তাতে যে অংশ দাঁতে লাগে, মানে ব্রাশের দাঁড়া, সেগুলি বাঁশের ছিল না। কলকাতার শুভজিৎ সাহা যে ব্রাশ তৈরি করেছেন তাতে নাইলনের সামান্য ব্যবহার থাকলেও দাঁড়াগুলিও মূলত বাঁশের চোঁচ দিয়েই তৈরি।

এর আগে কাগজের কলম তৈরি করে তাক লাগিয়েছিলেন শুভজিৎ। তবে এখানেই থামতে চান না তিনি। বললেন, ‘‘আরও অনেক কিছু করার ইচ্ছা রয়েছে। করেও ফেলব। নিজের সঙ্গে আরও অনেককে নিয়ে চলতে চাই আমি। আসলে আমি চাই, যা যা বানাব সেগুলি তৈরি করবেন প্রতিবন্ধীরা, বিক্রিও করবেন মূলত তাঁরাই।’’

এই আবিষ্কারের পিছনে পরিবেশ ভাবনা যেমন রয়েছে, তেমনই আছে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার লড়াই। সেই সঙ্গে আরও একটা উদ্দেশ্য রয়েছে শুভজিতের। নোয়াপাড়ার যুবক নিজের সঙ্গে সঙ্গে আরও অনেকের ‘অচ্ছে দিন’ দেখতে চান। তাই ব্রাশের গল্প জানার আগে শুভজিতের সঙ্গে পরিচয় হওয়া দরকার।

বাংলাদেশ থেকে আসা উদ্বাস্তু পরিবারের শরিকি বাড়ি নোয়াপাড়ার বঙ্গলক্ষ্মী বাজার এলাকায়। বেসরকারি চাকরি করে বাবা ব্রজবল্লভ সাহা সংসার চালিয়ে নিচ্ছিলেন। তবে স্কুল জীবন থেকেই নিজের কিছু একটা করার ইচ্ছা ছিল শুভজিতের। ওঁকে আবার বেশি টানে ইলেকট্রনিক্সের জগৎ। মাঝে সেই ব্যবসাও করতে গিয়েছিলেন। আসলে তখন প্রয়োজনটা তৈরি করে দেয় করোনা। সেই সময়ে প্রথম তিন মাস বেতন পেলেও একটা সময় বাবার আয় বন্ধ হয়ে যায়। পরে চাকরি থাকলেও কমে যায় বেতন। কিছু একটা করার ইচ্ছাটা রাতারাতি শুভজিতের কাছে বাধ্যতামূলক হয়ে ওঠে।

এই সময়েই স্যানিটাইজারের ব্যবসা করে সুরাহার চেষ্টা করেছেন শুভজিৎ। কিন্তু সবই তো সাময়িক। করোনা কমতে থাকায় স্যানিটাইজারের চাহিদা এবং বাজারও কমে যায়। কিন্তু স্থায়ী কিছু করার চিন্তাটা শুভজিতের মাথা থেকে যায় না। তখন প্রথম শুরু করেন কাগজের পেন তৈরি। এমন পেন বাজারে আগেই এসেছে। শুভজিত নতুন পরিকল্পনা করেন। কাগজের পেনের ভিতরে ঢুকিয়ে দেন ফুল, ফলের বীজ। ফোনের ইউএসপি তৈরি হয়ে যায়। শুভজিতের সংস্থা ‘রোহিত ইকো ফ্রেন্ডলি’-র কলমে প্রাণ রয়েছে বলে দাবি করা হয়। কালি শেষ হয়ে গেলে মাটিতে ফেললে সেখানে গাছ গজায়।

এখন কলমের ব্যবসা ভালই চলছে। কিন্তু নতুন কিছু করার চিন্তা থেকেই নতুন উদ্যোগ নেন শুভজিৎ। তা ছাড়া কলমের বাজার নাকি সারা বছর সমান থাকে না। বিশেষ করে পুজোর সময়ে সাধারণত কেউ কলম কিনতে চান না। আর ভাল বিক্রির সময়টা হল কলকাতা বইমেলা। তবে খারাপ সময়টায় কর্মীদের কাজ চালিয়ে যাওয়ার তাগিদ থেকেই তৈরি করে ফেলেছেন বাঁশের ব্রাশ। কারণ, ব্রাশের চাহিদা সারা বছর সমান থাকে।

ঝাড়খণ্ড থেকে আসছে বাঁশ। পরীক্ষানিরীক্ষাও শেষ। প্রাথমিক ভাবে বাজারে এনে চাহিদা কতটা তা-ও দেখা হয়ে গিয়েছে। এ বারে পাকাপাকি ভাবে বিক্রি শুরুর অপেক্ষা। শুভজিৎ জানিয়েছেন, তিনি অফলাইনের পাশাপাশি অনলাইনেও এই ব্রাশ বিক্রি করতে চান। দামও রাখতে চান যে দামে বাজারে সাধারণ ব্রাশ পাওয়া যায় তার থেকে কম। প্রথমে ইচ্ছা ছিল, ব্রাশের সব দাঁড়ই হবে বাঁশের চোঁচ দিয়ে। কিন্তু দেখা যায়, তাতে খুব তাড়াতাড়ি সেগুলি বসে যাচ্ছে। তাই প্রতিটি গোছার মধ্যে কয়েকটি নাইলনের দাঁড় রাখতে হয়েছে পরে। এ নিয়ে শুভজিৎ বলেন, ‘‘এখন এই ভাবেই বাজারে আনলেও হাল ছাড়ছি না। সবটাই যাতে বাঁশ দিয়ে করা যায় সেই চেষ্টা চলছে।’’

বাঁশের যে তৈরি, তা অবশ্য দেখে বোঝা যায় না। পালিশের গুণে মনে হয় কাঠের। শুভজিৎ বলেন, ‘‘হাত দিলেও অন্য কাঠ মনে হবে। তবে গন্ধ শুঁকলে বোঝা যাবে বাঁশের। তবে মনে করবেন না যেন, গন্ধের জন্য কিছু ব্যবহার করা হয়েছে। এটা একেবার স্বাভাবিক বাঁশের গন্ধ। তাই নষ্ট না হয়ে, থেকেও যাবে।’’

পেন কিংবা ব্রাশ, শুভজিতের কাছে কাজ করেন মূলত প্রতিবন্ধীরা। তিনি বলেন, ‘‘আসলে এই কাজগুলি ঘরে বসেই করা যায়। এমনকি, যাঁকে হুঁইল চেয়ারে বসে থাকতে হয় তিনিও বানাতে পারেন। সেই কারণে আমি প্রতিবন্ধীদের উপরে নির্ভর করি। তাঁদেরও রোজগার হয়। আবার অনেক বৃদ্ধ, বৃদ্ধা রয়েছেন যাঁরা কঠিন কাজ করতে পারেন না, তাঁদের শিখিয়ে নিয়ে কাজে লাগিয়েছি। সব মিলিয়ে আমার সংস্থায় প্রায় শ’তিনেক মানুষ যুক্ত।’’

উৎপাদনের ক্ষেত্রেই শুধু নয়, বিক্রির জন্যও মূলত প্রতিবন্ধীদের উপরে নির্ভর করেন শুভজিৎ। এ ব্যাপারে আবার তাঁর ভাবনা অন্য রকম। তিনি বলেন, ‘‘আমি প্রতিবন্ধী মনে করি না। আমি ভাবি ওঁরা সাধারণ নন। ওঁরা ‘ইউনিক’। আর আমাদের পেন বা ব্রাশও ইউনিক। তাই ঠিক করেছি, ইউনিক জিনিস ইউনিক মানুষরাই বিক্রি করবেন। ট্রেনে, বাসে, মেলায় দেখবেন আমাদের ‘সেলসম্যান’রা কী সুন্দর কাজ করছেন। হাত না পেতে রোজগার করছেন।’’

এখন শ্রীরামকৃষ্ণ ইন্সটিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির ছাত্র শুভজিৎ। পড়ছেন ইলেকট্রনিক্স অ্যান্ড টেলি কমিউনিকেশন নিয়ে। তবে মাথার মধ্যে অনেক ভাবনা। বললেন, ‘‘অনেক কাজ বাকি। আগামী দিনে এমন মানুষের চাহিদা বদলে যাবে। তাই তো কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়ছি।’’ ইলেক্ট্রনিক্স সামগ্রী তৈরির স্বপ্নও রয়েছে শুভজিতের চোখে। তবে আপাতত ভাবনা, তাঁর তৈরি কাগজের কলমে কী করে ক্লিপ লাগানো যায়। মানুষ যে সেটা পকেটে রাখতে পারছেন না, তা নিয়ে বড়ই চিন্তিত শুভজিৎ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.