টানা ছ’টি ইউরো কাপ। বিশ্বের কোনও খেলোয়াড়ের এই রেকর্ড নেই। মঙ্গলবার রাতে চেকিয়ার বিরুদ্ধে নামার সঙ্গে সঙ্গেই এই বিরল নজির জুড়ে গেল নামের পাশে। খেললেনও গোটা ৯০ মিনিট। কিন্তু ৩৯ বছরের ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো কি মন ভরাতে পারলেন? যে খেলোয়াড়কে দেখার জন্য সমর্থকেরা ফুটবল দেখতে বসেন, সেই রোনাল্ডোকে নিয়ে একই রকম আগ্রহ রয়েছে? মঙ্গলবারের ম্যাচের পর এই প্রশ্নগুলিতেই দ্বিধাবিভক্ত ফুটবলবিশ্ব।
গোটা চারেক শট, দু’-একটি হেড এবং একটি ফ্রিকিক। গোটা ম্যাচে পর্তুগালের হয়ে রোনাল্ডোর অবদান বলতে এটুকুই। গোল আসেনি কোনওটিতেই। ফুটবলবোদ্ধারা বলতেই পারেন, রোনাল্ডোর মতো আর কোনও ফুটবলার চেকিয়ার বিরুদ্ধে এতগুলি সুযোগ তৈরি করতে পারেননি। কিন্তু এই রোনাল্ডো যে আগের মতো ক্ষুরধার, তীক্ষ্ণ নন, এটা মেনে নেওয়া ছাড়া কোনও উপায় নেই। তাঁর গোলার মতো হেড এখন আর বলে বলে গোল খুঁজে নেয় না। তাঁর ফ্রিকিক এখন নিখুঁত ভাবে কোণ দিয়ে ঢুকে জাল কাঁপায় না। তাঁর গতিকে এখন থামিয়ে দিতে পারেন মাঝারি মানের কোনও ইউরোপীয় দেশের ফুটবলারও। যেমনটা বার বার দেখা গিয়েছে চেকিয়ার বিরুদ্ধে।
প্রথমার্ধে তবু রোনাল্ডোর কিছু পুরনো ঝলক দেখা গিয়েছে। ভিটিনহাকে ব্যাক হিলে দেওয়া পাসটার কথাই বলা যেতে পারে। কিন্তু যে রোনাল্ডোকে দেখতে সমর্থকেরা অভ্যস্ত তা চোখে পড়েনি। আগের দিন বেলজিয়াম ম্যাচে রোমেলু লুকাকু অদ্ভুতুড়ে সব মিস্ করার পর চারিদিকে সমালোচনার শিকার হচ্ছেন। রোনাল্ডোর ক্ষেত্রে এখনও তেমন না হলেও ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দাঁত-নখ বার করে নেমে পড়েছে ময়দানে।
মঙ্গলবার রাতে রোনাল্ডোর ফিনিশিং চিন্তায় রাখবে কোচ রবার্তো মার্তিনেসকে। বেলজিয়ামে সফল ভাবে কোচিং করানো মার্তিনেস পর্তুগালের দায়িত্ব নেওয়ার পরেই রোনাল্ডোকে বাড়তি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। এমনকি ইউরো শুরুর আগেও বলেছিলেন, “রোনাল্ডো নিজের ক্ষমতার জেরে দলে রয়েছে। শুধু নামের জোরে এই দলে কেউ সুযোগ পাবে না। ধারাবাহিক ভাবে গোল করে চলেছে। আমাদের কাছে ও-ই অন্যতম গোল স্কোরার। একটা টাচে বিপক্ষকে ছিটকে দিয়ে গোল করতে পারে। ওর পরিসংখ্যানই ওকে দলে নেওয়ার পক্ষে কথা বলে।” উল্লেখ্য, গত মরসুমে আল-নাসেরের হয়ে ৩১ ম্যাচে ৩৫ গোল করেছিলেন রোনাল্ডো।
মঙ্গলবারের পর মার্তিনেসকে ঢোঁক গিলতে হলে কিছু বলার নেই। সৌদি আরবের ক্লাব স্তরে এমনিতেই প্রতিযোগিতার মান ইউরোপের থেকে বেশ খারাপ। ফলে ইউরোপের সর্বোচ্চ প্রতিযোগিতায় খেলতে এসে রোনাল্ডোর খামতিগুলো ধরা পড়ে যাচ্ছে। কয়েকটি প্রস্তুতি ম্যাচ রোনাল্ডোকে আগের ফর্ম ফেরাতে অপারগ।
চেকিয়ার বিরুদ্ধে কোথায় ধরা পড়ল রোনাল্ডোর খামতি?
আট মিনিটের মাথায় রাফায়েল লিয়াও বাঁ দিক থেকে ভেতরে ঢুকে অরক্ষিত রোনাল্ডোকে পাস দিয়েছিলেন। অভিজ্ঞ রোনাল্ডোর বুঝে গিয়েছিলেন লিয়াওয়ের ভাবনা। তবু তাঁর হেডের সময় বল-মাথার সংযোগ ঠিকঠাক হয়নি। গোলের অনেকটা দূর দিয়ে চলে যায়।
৩২ মিনিটে রোনাল্ডো পাস পেয়েছিলেন ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের প্রাক্তন সতীর্থ ব্রুনো ফের্নান্দেসের। সামনে একা চেকিয়ার গোলকিপার ছিলেন। কিন্তু রোনাল্ডোর শট বাঁচিয়ে দেন জিনদ্রিচ স্তানেক। প্রথমার্ধের সংযুক্তি সময়ে আবার রোনাল্ডোর নিচু শট বাঁচিয়ে দেন স্তানেক।
দ্বিতীয়ার্ধেও তার বদল হয়নি। শুরুর দিকে একটি ক্রস থেকে রোনাল্ডোর হেড বারের উপর দিয়ে উড়ে যায়। কয়েক মিনিট পরে একটি ফ্রিকিক পেয়েছিলেন। ৩০ গজ দূর থেকে রোনাল্ডোর শট সরাসরি গোলকিপারের হাতে যায়। অতীতে রোনাল্ডোর অভ্যাস ছিল কোণ দিয়ে বল ঢোকানোর। হাওয়ার সাহায্যে বাঁকানো বল গোলকিপারের কাছে আটকানোর সুযোগ থাকত না। ইদানীং ফ্রিকিকেও রোনাল্ডোর দুর্বলতা ধরা পড়ছে। পরের দিকে তাঁর একটি হেড বারে লাগে। ফিরতি বলে দিয়েগো জোটা গোল করলেও সেটি অফসাইডে বাতিল হয়ে যায়। সে ক্ষেত্রে রোনাল্ডো অফসাইডে ছিলেন। কিন্তু আগের রোনাল্ডো ওই জায়গা থেকে কোনও মতেই বারে মারতেন না।
কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিয়েছেন পর্তুগালের প্রাক্তন কোচ লুই ফিলিপে স্কোলারি। প্রথম ইউরোয় তাঁর কোচিংয়ে খেলেছিলেন রোনাল্ডো। সেই স্কোলারি মঙ্গলবারের ম্যাচ দেখার পর বলেছেন, “ওকে কোচিং করানোর সময়েই বুঝেছিলাম ছেলেটার মধ্যে অনেক প্রতিভা রয়েছে। কিন্তু রোনাল্ডোকে আমার কোচিং করানো সেরা ফুটবলার বলতে রাজি নই। সেই সময় অনেক ভাল ফুটবলারই ছিল।”
২০২২ বিশ্বকাপের নকআউটে দু’টি ম্যাচের কোনওটিতেই রোনাল্ডোকে প্রথম একাদশে রাখেননি তৎকালীন কোচ ফের্নান্দো সান্তোস। পরিবর্ত হিসাবে নামিয়েছিলেন। এখনকার কোচ মার্তিনেস দুম করে রোনাল্ডোকে বসানোর মতো সাহস না দেখালেও, আগামী দিনে এটা নিয়ে ভাবতেই হবে। মঙ্গলবার রোনাল্ডো পুরো ম্যাচে খেললেও গ্রুপে তুরস্ক, জর্জিয়ার মতো ছটফটে, চনমনে দল রয়েছে। পর্তুগালকে ট্রফিজয়ের স্বপ্ন দেখতে হলে শুধু রোনাল্ডোর উপরে আর ভরসা রাখলে চলবে না।