আসন্ন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের জন্য ১৫ সদস্যের ভারতীয় দল ঘোষণা করা হয়েছে। প্রত্যাশা মতোই জাতীয় দলে ফিরেছেন ঋষভ পন্থ। রয়েছেন বিরাট কোহলিও। দলে বড় কোনও চমক নেই। তবে একাধিক ক্রিকেটারের নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন উঠছে ক্রিকেট মহলে। আইপিএলের পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে বিশ্বকাপের দলে একাধিক ক্রিকেটার সুযোগ পেয়েছেন। আবার এমন ক্রিকেটারেরাও আছেন, যাঁরা আইপিএলে তেমন কিছু করতে পারেননি এখনও পর্যন্ত।
১) হার্দিক পাণ্ড্য: টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দলে সহ-অধিনায়ক করা হয়েছে হার্দিককে। ক্রিকেট বিশেষজ্ঞদের একাংশ বরোদার অলরাউন্ডারকে দলে রাখারই পক্ষে ছিলেন না। গত এক দিনের বিশ্বকাপে চোট পাওয়ার পর থেকে মাঠের বাইরে ছিলেন হার্দিক। আইপিএলে মাঠে ফিরেছেন। দল বদল করে গুজরাত টাইটান্স থেকে এসেছেন মুম্বই ইন্ডিয়ান্সে। পেয়েছেন নেতৃত্বের দায়িত্ব। তবে চোট সারিয়ে মাঠে ফেরা হার্দিক এখনও তেমন কিছু করে দেখাতে পারেননি। প্রথম ম্যাচ থেকেই তাঁর নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। ব্যাট বা বল হাতেও মুম্বইকে ভরসা দিতে পারছেন না অধিনায়ক। ফর্মে নেই বোঝা যাচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে হার্দিকের ফিটনেস নিয়েও।
দল নির্বাচন পর্যন্ত ন’টি ম্যাচ খেলে হার্দিক করেছেন ১৯৭ রান। সর্বোচ্চ ৪৬। গড় ২৪.৬৩। স্ট্রাইক রেট ১৫১.৫৩। বোলার হার্দিক ১৯ ওভার বল করে নিয়েছেন ৪টি উইকেট। ওভার প্রতি খরচ করেছেন ১১.৯৪ রান। এই পারফরম্যান্স নিয়েই তিনি বিশ্বকাপের দলে। তাঁকে আবার দেওয়া হয়েছে সহ-অধিনায়কের দায়িত্বও। অর্থাৎ সব ম্যাচেই হার্দিকের প্রথম একাদশে থাকা কার্যত নিশ্চিত। বিশ্বকাপের আগে তিনি সেরা ফর্মে ফিরবেন এমন নিশ্চয়তা কোথায় পেলেন জাতীয় নির্বাচকেরা? বিশ্বকাপের দলে হার্দিকের নির্বাচন নিয়ে উঠছে প্রশ্ন। ইরফান পাঠান, লক্ষ্মীরতন শুক্লর মতো ভারতীয় দলের প্রাক্তন অলরাউন্ডারেরা হার্দিকের নির্বাচনের বিরোধী। আনন্দবাজার অনলাইনে লক্ষ্মী লিখেছেন, ‘‘আইপিএলে যে ফর্মে হার্দিক রয়েছে তাতে দলে জায়গা পাওয়াই উচিত নয়। হার্দিককে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দলে রাখা হলে দলেরই ক্ষতি হবে। এত বছরে হার্দিক খুব বেশি ম্যাচ একার হাতে জেতাতে পারেনি। বল হাতে উইকেট নিতে পারছে না। রান দিচ্ছে। ব্যাট হাতে রান পাচ্ছে না। খুব মন্থর ইনিংস খেলছে। ওকে দলে রেখে কোনও উপকার হবে না।’’
২) মহম্মদ সিরাজ: ভারতের জোরে বোলিং বিভাগ তেমন শক্তিশালী নয় মহম্মদ শামির অনুপস্থিতিতে। হয়তো কিছুটা বাধ্য হয়ে অভিজ্ঞতার জন্য সিরাজকে দলে রেখেছেন আগরকরেরা। সিরাজের নাম চূড়ান্ত তালিকায় লেখার ক্ষেত্রে নিশ্চিত ভাবেই বিবেচনা করা হয়নি আইপিএলের পারফরম্যান্স। যে ক্রিকেটার নিজেই নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারছেন না, তাঁর উপর বিশ্বকাপের প্রতিযোগিতায় ভরসা রাখলেন নির্বাচকেরা! ব্যাটিং এবং ফ্লিডিংয়ের কথা বাদ দিয়ে শুধু বোলিং বিবেচনা করলেও সিরাজ এই মুহূর্তে ভারতীয় দলে থাকার মতো ফর্মে নেই। রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর হয়ে এখনও পর্যন্ত ন’টি ম্যাচ খেলে সিরাজ পেয়েছেন ৬টি উইকেট। ম্যাচ প্রতি এক জন ব্যাটারকেও আউট করতে পারেননি। ওভার প্রতি খরচ করেছেন ৯.৫ রান।
সিরাজকে দলে নিয়ে তুলনায় ফর্মে থাকা খলিল আহমেদকে রাখা হয়েছে রিজার্ভ হিসাবে। যিনি দিল্লি ক্যাপিটালসের হয়ে ১১টি ম্যাচ খেলে নিয়েছেন ১২টি উইকেট। ওভার প্রতি রান দিয়েছেন ৯.৪৭। ন’টি ম্যাচে ১৪টি উইকেট পাওয়া হর্ষল পটেলেরও জায়গা হয়নি। সাত ম্যাচে ১৩ উইকেট পাওয়া টি নটরাজনের কথাও ভাবা হয়নি। আবার ন’ম্যাচে ৯টি উইকেট নেওয়া আবেশ খানকেও রাখা হয়েছে রিজার্ভ হিসাবে।
৩) জশস্বী জয়সওয়াল: আইপিএলের পারফরম্যান্স গুরুত্ব না পাওয়ার অন্যতম উদাহরণ মুম্বইয়ের তরুণ ব্যাটারও। একটা অপরাজিত ১০৪ রানের ইনিংস ছাড়া আইপিএলে এখনও পর্যন্ত ব্যর্থ যশস্বী। ন’টি ম্যাচ খেলে করেছেন ২৪৯ রান। স্ট্রাইক রেট ১৫৪.৬৫। ওপেনার যশস্বীর পরিবর্তে দলে রাখা যেত ফিনিশার রিঙ্কু সিংহকে। কারণ ওপেন করতে পারেন এমন পাঁচ জন ব্যাটারকে রাখা হয়েছে দলে। বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মা, ঋষভ পন্থ, সঞ্জু স্যামসন ওপেন করতে পারেন। অথচ ইনিংসের শেষ দিকে নেমে দ্রুত রান তোলার মতো কোনও ব্যাটার রাখা হয়নি বিশ্বকাপের দলে। বিশ্বকাপে ফিনিশারের অভাবে ভুগতে পারে ভারতীয় দল। রিঙ্কুকে রিজার্ভ হিসাবে না রেখে মূল দলে রাখলে সুবিধা হতে পারত। সে ক্ষেত্রে যশস্বী থাকতেন রিজার্ভ হিসাবে। পাঁচ জন ওপেনার নিয়ে ২০ ওভারের ক্রিকেটের দল গঠন নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন ক্রিকেট পণ্ডিতেরা। ওপেনারই হলে ফর্মে থাকা রুতুরাজ গায়কোয়াড়ের কেন জায়গা হল না, তা নিয়েও প্রশ্ন থাকবে।
লক্ষ্মীরতনও আনন্দবাজার অনলাইনে লিখেছেন, ‘‘যশস্বী জয়সওয়াল ভাল ক্রিকেটার। টেস্টে রান করেছে। তবে আমি বলব টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে রোহিতের সঙ্গী হিসাবে নেওয়া হোক রুতুরাজ গায়কোয়াড়কে। যশস্বী দলে থাকুক তৃতীয় ওপেনার হিসাবে। আইপিএলে এখনও পর্যন্ত ৯ ম্যাচে ৪৪৭ রান করেছে রুতুরাজ। একটি শতরান করেছে। স্ট্রাইক রেট ১৪৯.৫০। সেখানে ৯ ম্যাচে যশস্বী করেছে ২৪৯ রান। ধারাবাহিকতার অভাব রয়েছে যশস্বীর।’’
৪) রবীন্দ্র জাডেজা: এখনকার জাডেজা অনেকটাই অতীতের ছায়া। সাদা বলের ক্রিকেটে তেমন মনে রাখার মতো পারফরম্যান্স সাম্প্রতিক অতীতে নেই বাঁ হাতি অলরাউন্ডারের। এ বারের আইপিএলেও তেমন কিছু করতে পারছেন না। এখনও পর্যন্ত চেন্নাই সুপার কিংসের হয়ে ন’টি ম্যাচ খেলে করেছেন ১৫৭ রান। সর্বোচ্চ অপরাজিত ৫৭। স্ট্রাইক রেট ১৩১.৯৩। ১১৯টি বল খেলে ১৪টি চার এবং ২টি ছয় মারতে পেরেছেন তিনি। বোলার হিসাবেও বলার মতো কিছু করতে পারেনি জাডেজা। ন’টি ম্যাচে ৩১ ওভার বল করে পেয়েছেন ৫টি উইকেট। ওভার প্রতি খরচ করেছেন ৭.৫৪ রান। প্রতিপক্ষের রান তোলার গতি কিছুটা আটকানো ছাড়া আর তেমন কিছু করতে পারেনি। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দল নির্বাচনে আইপিএলের পারফরম্যান্সকে গুরুত্ব দেওয়া হলে সুযোগ পাওয়ার কথা নয় জাডেজারও। যদিও যুজবেন্দ্র চহাল বা সঞ্জু স্যামসনরা জায়গা পেয়েছেন ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি লিগের পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে। তাই দল নির্বাচনের মাপকাঠি নিয়ে প্রশ্ন উঠছেই।
৫) অক্ষর পটেল: জাডেজার মতোই আর এক বাঁ হাতি অলরাউন্ডার অক্ষরের দলে থাকা নিয়েও প্রশ্ন থাকছে। অক্ষরও ফর্মে নেই। আইপিএলে এখনও পর্যন্ত ১১টি ম্যাচ খেলে করেছেন ১৪৯ রান। স্ট্রাইক রেট ১২৪.১৬। বল হাতেও তেমন কিছু করতে পারেননি দিল্লি ক্যাপিটালসের হয়ে। ৯টি উইকেট নিয়েছেন তিনি। ওভার প্রতি রান দিয়েছেন ৭.২৪। বাঁ হাতি স্পিনার অলরাউন্ডার হিসাবে জাডেজা এবং অক্ষরের মধ্যে এক জনকে রাখা যেত। তা হলে ১৫ জনের দলে বৈচিত্র আরও বৃদ্ধি করতে পারতেন নির্বাচকেরা। ফর্মে না থাকা অক্ষরের নির্বাচন নিয়েও প্রশ্ন থাকছে। অন্তত আইপিএলের পারফরম্যান্সকে গুরুত্ব দেওয়া হলে সেই প্রশ্ন আরও বড় হবে।
১৫ জনের দল: রোহিত শর্মা (অধিনায়ক), যশস্বী জয়সওয়াল, বিরাট কোহলি, সূর্যকুমার যাদব, ঋষভ পন্থ (উইকেটরক্ষক), সঞ্জু স্যামসন (উইকেটরক্ষক), হার্দিক পাণ্ড্য (সহ-অধিনায়ক), শিবম দুবে, রবীন্দ্র জাডেজা, অক্ষর পটেল, কুলদীপ যাদব, যুজবেন্দ্র চহাল, আরশদীপ সিংহ, যশপ্রীত বুমরা, মহম্মদ সিরাজ।