চার বছরে ৪২টি মামলা, চার্জশিট ৪১টিতে! তবুও শাহজাহানকে ‘পলাতক’ তকমা দেয়নি পুলিশ

চার বছরে ৪২টি মামলা, এর মধ্যে ৪১টির চার্জশিটও দাখিল হয়ে গিয়েছে। তখনও শেখ শাহজাহানকে ‘পলাতক’ তকমা দেয়নি পুলিশ। সূত্রের খবর, চার বছরে একটি মামলাতেও (জামিন অযোগ্য ধারাও আছে) শাহজাহানকে গ্রেফতার করা তো দূর, অভিযোগকারীকেই নিগৃহীত হতে হয়েছে, মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে ভিটেমাটিটুকুও খোয়াতে হয়েছে বলে হাই কোর্টে জানিয়েছেন আইনজীবীরাই। বহু অভিযোগের ক্ষেত্রে কৌশলে শাহজাহানের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ।

তা হলে কি পুলিশ জেনে-বুঝেই শাহজাহানকে এত দিন গ্রেফতার করেনি— প্রশ্ন উঠেছে আদালতেও। বসিরহাটের পুলিশ সুপার হোসেন মেহেদি রহমানকে এই সব বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি কোনও মন্তব্য করতে চাননি। ফোন কেটে দেন।

তবে হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি সোমবার শাহজাহানকে গ্রেফতার করায় বাধা নেই বলে জানিয়ে দেওয়ার পরে তৃণমূলের একটি অংশের দাবি, আগামী সাত দিনের মধ্যে ধরা পড়বেন শাহজাহান। দলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ সোমবারই সে কথা বলেছিলেন। মঙ্গলবার একই দাবি করলেন তৃণমূলের দুই সাংসদ সাকেত গোখেল এবং সুস্মিতা দেব। দিল্লিতে সাকেত বলেন, ‘‘হাই কোর্টের ৭ ফেব্রুয়ারির নির্দেশে একটা স্থগিতাদেশ ছিল। হাই কোর্টই এখন বিষয়টা স্পষ্ট করেছে। আশা করছি, কয়েক দিনের মধ্যেই শাহজাহান গ্রেফতার হবেন।’’ বিরোধীদের প্রশ্ন, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন সন্দেশখালি যাচ্ছেন না? সাকেত, সুস্মিতাদের দাবি, মুখ্যমন্ত্রী নিশ্চয়ই যাবেন। তিনি মোদীর মতো ‘পলায়নবাদী’ (ভাগোড়া) নন!

সন্দেশখালির অসীমা দাস, নয়ন সর্দাররা অবশ্য বলছেন, ‘‘হাই কোর্ট অবধি ভাবতে পারি না আমরা। আমাদের সব কিছুর বিচার এত দিন শাহজাহান করে এসেছে। ওর রক্তচক্ষুর রোষে কত মানুষ যে নিঃস্ব হয়েছে, তা শুধু এখানকার বাসিন্দারাই জানেন।’’

ন্যাজাট থানার ভাঙ্গিপাড়াতে ২০১৯ সালের ৮ জুন গুলিতে খুন হন প্রদীপ মণ্ডল, সুকান্ত মণ্ডল, দেবদাস মণ্ডলেরা। মৃতের পরিবারের তরফে ন্যাজাট থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের হয়। নিহত প্রদীপের স্ত্রী পদ্মা বলেন, ‘‘শাহজাহানের নাম দিয়েই অভিযোগ করেছিলাম। সেই মামলা সিআইডি নিল। আদালতে চার্জশিট যখন পেশ করল, তখন জানলাম শাহজাহানের নামটিই বাদ দেওয়া হয়েছে। আমরা সিবিআই তদন্তের জন্য আদালতের দ্বারস্থ হয়েছি।’’

ন্যাজাট থানার সুন্দরীখালি গ্রামের বাসিন্দা অরুণ লস্করের দাবি, ‘‘আমার সম্পত্তি নিয়ে ২০১৭ সালে বিবাদ চলাকালীন রাজবাড়ি ফাঁড়ির কাছে আমার স্ত্রীর প্রতি অশালীন ব্যবহার করে শেখ শাহজাহানের ঘনিষ্ঠ জিয়াউদ্দিন। প্রতিবাদ করায় স্ত্রীকে মারধর করা হয়।’’ এর প্রতিবাদে মিছিল হলে শাহজাহানের নেতৃত্বে গুলি চলে, এক মহিলা গুলিতে জখম হন বলে তাঁর দাবি। তাঁর আরও দাবি, শাহজাহানের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দায়ের করা হলেও কোনও পদক্ষেপ করেনি পুলিশ। উল্টে অভিযোগকারীদেরই মামলায় জড়ানো হয়। ২০০৯ সালে বাম আমলেও শাহজাহানের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল সরবেড়িয়ায় একটি অনুষ্ঠানে হামলা ও মারধরের। তখনও শাহজাহানের নামে অভিযোগ দায়ের হয়েছিল এবং পুলিশ পদক্ষেপ করেনি, দাবি এলাকাবাসীর।

সন্দেশখালির সাধারণ মানুষের এই প্রতিবাদকে কুর্নিশ জানিয়েছেন বামপন্থী বিশিষ্ট জনেরা। এ দিন অভিনেতা বাদশা মৈত্র, দেবদূত ঘোষ-সহ বেশ কয়েক জন সন্দেশখালি পঞ্চায়েত এলাকার পাত্র পাড়া, সিংহ পাড়া, মাঝের পাড়ায় মহিলাদের সঙ্গে কথা বলেন। বাদশা গ্রামবাসীদের বলেন, ‘‘কোনও ধর্মীয় ভেদাভেদ করবেন না। আন্দোলনের মধ্যে কোনও রাজনৈতিক রং লাগতে দেবেন না। সবাই যেন এখানে আসতে পারেন।’’ এ দিন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমও দাবি করেন, ‘‘সন্দেশখালিতে মানুষ লড়াই করছেন। সাম্প্রদায়িক শক্তি তাঁদের ভাগ করতে চায়। তার বিরুদ্ধেও লড়ছেন বামপন্থীরাই।’’

এ দিন ধামাখালির পথ ধরেই সন্দেশখালি পৌঁছন বাদশারা। ১৪৪ ধারা থাকায় চার জন করে গ্রামে ঘুরেছেন। পুলিশ আটকায়নি, বরং অভিনেতাদের সঙ্গে সন্দেশখালি খেয়াঘাটে নিজস্বী তুলতে দেখা গেল এক পুলিশ আধিকারিককে। কিন্তু তাঁদের মতো ভাগ্য হয়নি আইএসএফ নেতা নওসাদ সিদ্দিকী ও কংগ্রেসের এক প্রতিনিধিদলের। নওসাদকে সন্দেশখালি থেকে ৬২ কিলোমিটার আগেই আটকে গ্রেফতার করে পুলিশ। দুপুরে সৌম্য আইচ রায়-সহ কংগ্রেসের প্রতিনিধিদলটিকেও ন্যাজাট থানার পুলিশ দক্ষিণ আখড়াতলায় আটকায়। সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, হরিপদ বিশ্বাসদের নেতৃত্বে ফরওয়ার্ড ব্লকের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা প্রতিনিধিদলকে তিন দফায় আটকানো হয় মালঞ্চ, রামপুর ও ধামাখালিতে। জামা খুলে বিক্ষোভ-অবস্থানে বসেন তাঁরা। এডিজি (দক্ষিণবঙ্গ) সুপ্রতিম সরকারের নেতৃত্বে পুলিশ বাধা দেওয়ার সময়ে সুভাষচন্দ্র বসুর ছবি দেওয়া ব্যাজকে অবমাননা করেছে, এই অভিযোগে আইনের পথে যাওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন সঞ্জীবেরা।

সন্দেশখালি-কাণ্ডের আবহে মঙ্গলবার সেখানে গিয়ে সাধারণ মানুষের পাশে থাকার বার্তা দিল কয়েকটি মানবাধিকার, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের একটি দল। প্রতিনিধিদলটি সন্দেশখালি ও জেলিয়াখালিতে গিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে। তবে ১৪৪ ধারা থাকায় বেড়মজুরে পুলিশ প্রতিনিধিদলের সদস্যদের ঢুকতে দেয়নি। দলটিতে ছিলেন নারী নিগ্রহ বিরোধী নাগরিক কমিটির সম্পাদক কল্পনা দত্ত, সিপিডিআরএস-এর রাজ্য সম্পাদক রাজকুমার বসাক, সঙ্গীতশিল্পী পল্লব কীর্তনিয়া, চিকিৎসক নীলরতন নাইয়া প্রমুখ।

কেন এক দলকে আটকানো হল না, অন্য দলগুলিকে রুখে দিল পুলিশ, এই নিয়ে প্রশাসনের কেউ কিছু বলতে চাননি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.