কলকাতা হাই কোর্টে পর পর দুই রায়। দু’টিই মঙ্গলবার দুপুরের। কয়েক মিনিটের ব্যবধানে দু’টি রায়ই দিলেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। এবং শিক্ষকের চাকরি সংক্রান্ত দু’টি রায়ই তাঁর নিজের দেওয়া আগের রায়কে সংশোধন, পরিমার্জন বা পরিবর্তন করল। একটি মামলায় জড়িয়ে হাজার হাজার শিক্ষকের ভবিষ্যৎ। দ্বিতীয়টিতে, একটি শিক্ষক পদে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশেই চাকরি পাওয়া প্রার্থীকে (ববিতা সরকার) এক বছর পর সরিয়ে দিলেন তিনিই। সেই চাকরি দিলেন আর এক জনকে।
অনিয়মের অভিযোগে গত শুক্রবার (১২ মে) এক ধাক্কায় ৩৬ হাজার প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরি বাতিলের নির্দেশ দিয়েছিলেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। আলোড়ন ফেলে দেওয়া ওই রায়ের বিরুদ্ধে ডিভিশন বেঞ্চে আবেদন করেছে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ। আবার ওই রায়ে মুদ্রণজনিত ত্রুটির কারণে ‘ভুল’ তথ্য রয়েছে জানিয়ে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের এজলাসে পৃথক একটি আবেদন জমা পড়েছিল সোমবারই। মঙ্গলবার বেলা ১১টা ৪৩ নাগাদ সেই সংশোধনীর আবেদন শুনতে শুরু করেন বিচারপতি। বিচারপতির পর্যবেক্ষণ— দু’টি ভুলের কথা বলা হয়েছিল। দু’টি ভুলই সংশোধন করা হবে। রায়ের ‘টাইপোগ্রাফিক্যাল’ ভুল নিয়ে আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন মামলকারীদের আইনজীবী তরুণজ্যোতি তিওয়ারি। প্রথমটি ছিল, প্যানেলের সর্বনিম্ন নম্বর রায়ে লেখা হয়েছে ১৪.১৯১। দ্বিতীয় ভুলটি ছিল, ’৩৬’ হাজারে। আবেদনকারী জানান, সংখ্যাটা ৩০ হাজারের কিছু বেশি। বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় জানিয়েছেন, চাকরি বাতিলের সংখ্যাটি ৩২ হাজারের কাছাকাছি হবে। আর সর্বনিম্ন নম্বর সংশোধন করে হবে ১৩.৭৯৬। ১১টা ৫৪ মিনিটে এই রায় সংশোধন পর্ব শেষ হয়।
অন্য দিকে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘৩৬ হাজার’ চাকরি বাতিলের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতের ডিভিশন বেঞ্চে যে মামলা করেছে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ, সোমবার বিচারপতি সুব্রত তালুকদার এবং বিচারপতি সুপ্রতিম ভট্টাচার্যের ডিভিশন বেঞ্চে তার শুনানি শুরু হয়েছে। বুধবারও শুনানি হবে। মঙ্গলবারের শুনানির ঠিক আগেই বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর শুক্রবারে দেওয়া রায়টি সংশোধন করলেন।
এর পরই ববিতা সরকারের চাকরি নিয়ে রায় দিতে শুরু করেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। তখন দুপুর ১২টা বাজতে মিনিট পাঁচেক বাকি। রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী পরেশ অধিকারীর কন্যা অঙ্কিতা অধিকারীর চাকরি গত বছর ২০ মে বাতিল করেছিলেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। কোচবিহারের মেখলিগঞ্জ ইন্দিরা উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে অঙ্কিতার বদলে চাকরি পান ববিতা সরকার। অঙ্কিতার বেতন হিসেবে পাওয়া টাকাও ববিতাকে দেওয়ার নির্দেশ দেন তিনি। ঘটনাচক্রে, সেটিই ছিল তাঁর চাকরি বাতিলের প্রথম রায়। মঙ্গলবার ববিতার সেই নিয়োগও বাতিল করে তাঁর জায়গায় আর এক চাকরিপ্রার্থী অনামিকা রায়কে নিয়োগপত্র দেওয়ার নির্দেশ দিলেন বিচারপতি।
ববিতার বিরুদ্ধে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন তাঁরই শহরের আর এক স্কুল সার্ভিস কমিশন (এসএসসি) পরীক্ষার্থী অনামিকা। তাঁর অভিযোগ ছিল, এসএসসি পরীক্ষার আবেদন জানানোর সময় ববিতা স্নাতকস্তরের শতকরা নম্বর বাড়িয়ে দেখিয়েছিলেন। যার ফলে তাঁর ‘অ্যাকাডেমিক স্কোর’ বেড়ে গিয়েছে। ববিতার আবেদনপত্র অনুযায়ী, স্নাতক স্তরে ৮০০ নম্বরের মধ্যে ৪৪০ নম্বর পেয়েছিলেন ববিতা। অর্থাৎ, শতকরা হিসাবে ৫৫ শতাংশ। অথচ, স্নাতক স্তরের প্রাপ্ত নম্বরের শতকরা হিসাব ৬০ শতাংশ বা তার বেশি উল্লেখ করা হয়েছে আবেদনপত্রে। ভুল সেখানেই।
এই ভুলের ফলেই ববিতার ‘অ্যাকাডেমিক স্কোর’ ৩১-এর বদলে হয়ে যায় ৩৩। তালিকার ২১ নম্বরে থাকা অনামিকা বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের বেঞ্চকে জানিয়েছিলেন, ববিতার র্যাঙ্কিং পিছিয়ে গেলে যোগ্য প্রার্থী হিসাবে ২০ জনের তালিকার ২০ নম্বরে উঠে আসবে তাঁর নাম। ফলে চাকরি তাঁরই পাওয়ার কথা। বিষয়টি পর্যালোচনা করে অনামিকার দাবির সারবত্তা মেনে নিয়েছেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। ববিতার জায়গায় অনামিকাকে চাকরির সুপারিশপত্র দেওয়ার জন্য এসএসসি কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।
পাশাপাশি, পরেশ-কন্যা অঙ্কিতার থেকে পাওয়া ১৫ লক্ষ ৯২ হাজার ৮৪৩ টাকা হাই কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কাছে জমা দেওয়ার জন্যও ববিতাকে নির্দেশ দিয়েছেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। গত ২০ মে বেতন বাবদ পাওয়া অঙ্গিতার পাওয়া ওই অঙ্কের টাকা ববিতাকে দিতে হবে বলে নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। তবে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় জানিয়েছেন, গত জুন মাসে চাকরিতে যোগদানের পরে ববিতা যে বেতন পেয়েছেন, তা তাঁকে ফেরত দিতে হবে না।
বস্তুত মামলার শুনানি চলাকালীনই বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় এমন রায়ের আঁচ মিলেছিল। তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন, অঙ্কিতার বেতনের যে টাকা তাঁকে দেওয়া হয়েছিল, তা যেন ববিতা আলাদা করে সরিয়ে রাখেন। ভবিষ্যতে তা তাঁকে ফেরত দিতে হতে পারে বলেও জানিয়েছিলেন বিচারপতি। যদিও মঙ্গলবার রায় ঘোষণার পরে সজল চোখে ববিতা জানিয়েছেন, ইতিমধ্যেই পাওয়া টাকার একাংশ খরচ করে একটি গাড়ি কিনে ফেলেছেন তিনি! পুরো টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে কিছু বাড়তি সময় চেয়েছেন ববিতা। বিচারপতি তা মঞ্জুরও করেছেন।