একটা গোটা দিন ধরে ভারতীয় দলের বিশ্বকাপ জয়ের উৎসব চলল। সকাল ৬.০৭ মিনিটে দিল্লির ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামে রোহিত শর্মাদের বিশেষ বিমান। সেখান থেকে হোটেলে যেতেই সময় লাগে প্রায় দেড় ঘণ্টা। কিছু ক্ষণ বিশ্রাম নিয়েই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দেখা করতে যায় ভারতীয় দল। মোদী-সাক্ষাতের পর মুম্বই চলে যায় তারা। সেখানে হুডখোলা বাসে রোড শো এবং ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে বিশেষ অনুষ্ঠান। গোটা একটা দিন কার্যত ঘোরের মধ্যে কাটল ক্রিকেটারদের। দেশবাসীর অফুরান ভালবাসা পেলেন তাঁরা। দিলেন বিশ্বজয়ের স্বাদ।
উৎসব শুরু বিমানেই
বিমানের ভিতরে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল বিশ্বকাপের ট্রফি। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ক্রিকেটারদের হাতে ঘুরেছে সেই ট্রফি। কেউই পোজ় দিয়ে ছবি তোলার সুযোগ হাতছাড়া করতে চাননি। প্রথমে ঋষভ পন্থ ট্রফি হাতে নিয়ে নাচাতে থাকেন। এর পর যশপ্রীত বুমরা সন্তানকে কোলে নিয়ে ট্রফি দেখাতে থাকেন। অক্ষর পটেল এবং মহম্মদ সিরাজকে দেখা যায় ট্রফি নিজেদের আসনের পাশে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখতে। ব্যাটিং কোচ বিক্রম রাঠৌরকে দেখা যায় একটি জার্সিতে ভারতীয় ক্রিকেটারদের সই নিতে। রাহুল দ্রাবিড়ের সঙ্গে তাঁর মেয়াদও সম্ভবত শেষ হচ্ছে। তাই বিদায়ী মুহূর্তটাকে স্মরণীয় করে রাখলেন তিনিও।
৬.০৭ মিনিটে বিমানবন্দরে
গত শনিবার ট্রফি জিতলেও বার্বাডোজ়ে আটকে ছিল দল। সেখানে ঘূর্ণিঝড় বেরিলের কারণে বিমান চলাচল বন্ধ ছিল। তাই দেশে ফিরতে দেরি হয় রোহিতদের। বুধবার (ভারতীয় সময়ে) দুপুরে বার্বাডোজ় থেকে বিমানে ওঠেন তাঁরা। বৃহস্পতিবার সকালে দেশে ফেরেন রোহিতেরা। দিল্লির বিমানবন্দরে তখন অপেক্ষায় ছিল টিম বাস। সেই সঙ্গে ক্রিকেটারদের দেখা পাওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন সমর্থকেরা। বিশ্বজয়ীদের এক ঝলক দেখার জন্য ভোর থেকেই বিমানবন্দরে ভিড় করেছিলেন ভারতীয় সমর্থকেরা। বার্বাডোজ় থেকে পরিবারের সঙ্গেই দেশে ফেরেন ক্রিকেটারেরা। বিরাট বসেছিলেন বাসের সামনের আসনে। রোহিত ট্রফি হাতে বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে এসে তা তুলে ধরেন সমর্থকদের উদ্দেশে।
হোটেলের সামনে নাচ
হোটেলে পৌঁছে বাস থেকে মাটিতে পা দিয়েই নেচে ওঠেন বিশ্বজয়ী অধিনায়ক। ভাংড়ার তালে নাচেন মুম্বইয়ের রোহিত। গলায় দুলছিল সোনার পদক। এক হাতে ধরে রাখেন ব্যাগ। কিন্তু নাচে খামতি ছিল না। একগাল হাসি নিয়ে নেচে চলেন অক্লেশে। দিল্লির হোটেলে উপস্থিত ছিল ব্যান্ড। রোহিতদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্যই এই ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু রোহিতেরা যে সেখানে নাচতে শুরু করে দেবেন, তা ভাবা যায়নি। শুধু রোহিত নন, নাচের তালে পা মেলান সূর্যকুমার যাদব, যশস্বী জয়সওয়াল, হার্দিক পাণ্ড্যেরাও। হার্দিককে নাচতে দেখে মিটিমিটি হেসে পাশ কাটিয়ে চলে যান বিরাট কোহলি। তাঁর পিছনে কোচ রাহুল দ্রাবিড়। তাঁরা না নাচলেও কারও মুখে ক্লান্তির কোনও ছাপ ছিল না।
দিল্লিতে প্রাতরাশ
হোটেল সূত্রে খবর, কোহলির জন্য ছিল অমৃতসরি ধাঁচের ছোলে-ভাটুরে। এই খাবার বিরাটের খুব প্রিয়। নিজেই বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন যে, ক্রিকেটার হওয়ার পরে ডায়েটের কথা ভেবে এই খাবার তাঁকে বাদ দিতে হয়েছে। কিন্তু সুযোগ পেলে মাঝেমাঝে খান তিনি। ম্যাচ চলাকালীনও বিরাটকে ছোলে-ভাটুরে খেতে দেখা গিয়েছে। সেই কারণে তাঁর জন্য এই বিশেষ খাবার ছিল। মুম্বইকর রোহিত শর্মা খেতে ভালবাসেন বড়া পাও। তাঁর জন্য বড়া পাও রাখা হয়েছিল মেনুতে। এ ছাড়া নান খাটাই, সিনামন সুগার পামেইর, চারোলি ও পাপরিকা চিজ় টুইস্ট ছিল প্রাতরাশের মেনুতে। ক্রিকেটারদের ঘরে ব্যাট, বল, উইকেট ও পিচের আকারের ছোট ছোট চকোলেট রাখা হয়েছিল।
কেক কেটে উৎসব
দিল্লির হোটেলে রোহিতদের জন্য ছিল বিশেষ কেক। ভারতীয় দলের জার্সির রঙে তৈরি করা হয়েছিল তিন তলা কেকটি। তার উপরে বিশ্বকাপ ট্রফির আদলে তৈরি একটি কেকের মূর্তি বসানো ছিল। দিল্লির হোটেলের শেফরা ওই কেক বানিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার আগে ওই কেক কাটেন রোহিত।
রোহিতদের বিশেষ জার্সি
বৃহস্পতিবার সকালেই নতুন জার্সি হাতে পান রোহিতরা। সেই জার্সি পরেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দেখা করতে যান ভারতীয় দলের সদস্যেরা। বিশ্বকাপের জার্সির সঙ্গে নতুন জার্সির খুব বেশি পার্থক্য নেই। একই রং ব্যবহার করা হয়েছে। জার্সির নকশাতে সামান্য পরিবর্তন হয়েছে। বাঁ দিকে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিসিআই) লোগোর উপর তারার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে দু’টি। যা ভারতের দু’বার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়ের প্রতীক। এ ছাড়া দেশের নামের নিচে লেখা হয়েছে ‘চ্যাম্পিয়ন্স’। দিল্লির হোটেলে গিয়ে নতুন জার্সি হাতে পান ক্রিকেটারেরা। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার আগে নতুন জার্সির ছবি ক্রিকেটপ্রেমীদের সঙ্গে ভাগ করে নেন বিশ্বজয়ী দলের অন্যতম সদস্য সঞ্জু স্যামসন। ‘চ্যাম্পিয়ন’ লেখাটি অবশ্য ভারতের টি-টোয়েন্টি জার্সিতে পাকাপাকি ভাবে থাকবে না।
মোদীর সঙ্গে সাক্ষাৎ
দিল্লির হোটেলে কিছু ক্ষণ বিশ্রাম নিয়েই ভারতীয় দল রওনা দেয় ৭ নম্বর লোক কল্যাণ মার্গের উদ্দেশে। প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দেখা করেন রোহিতেরা। সঙ্গে ছিলেন বোর্ড প্রধান রজার বিন্নী এবং সচিব জয় শাহ। তাঁরা প্রধানমন্ত্রীকে ‘নমো’ লেখা বিশেষ একটি জার্সিও উপহার দেন। ক্রিকেটারদের সঙ্গে ছবি তোলেন মোদী। তাঁদের সঙ্গে বেশ কিছু ক্ষণ কথাও হয় প্রধানমন্ত্রীর।
কী বললেন মোদী?
ক্রিকেটারদের সঙ্গে অনেক ক্ষণ গল্প করেন প্রধানমন্ত্রী। ফাইনালে জেতার পর বার্বাডোজ়ের পিচের মাটি খেতে দেখা গিয়েছিল রোহিতকে। সে কথা মনে করিয়ে অধিনায়ককে মোদী প্রশ্ন করেন, মাটি খেতে কেমন লাগে? গোটা প্রতিযোগিতায় সে ভাবে রান না পেলেও ফাইনালে ভাল খেলেছিলেন কোহলি। ভারতীয় ক্রিকেটারকে মোদী প্রশ্ন করেন, বড় ম্যাচের আগে কী ধরনের ভাবনাচিন্তা নিয়ে মাঠে নামেন। অক্ষর পটেলকে প্রশ্ন করা হয়, ফাইনালে কঠিন সময়ে যখন তাঁকে উপরের দিকে ব্যাট করতে নামানো হয়েছিল, তখন কী ভাবছিলেন তিনি? ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকার জিততে ৩০ বলে ৩০ রান দরকার ছিল। সেই সময় মাথা ঠান্ডা রেখে বল করেছিলেন যশপ্রীত বুমরা। সেই সম্পর্কে মোদী বুমরাকে প্রশ্ন করেন, সেই পরিস্থিতিতে বুমরার মাথায় কী ঘুরছিল। হার্দিক পাণ্ড্যকে তাঁর সার্বিক পারফরম্যান্স নিয়ে জিজ্ঞাসা করা হয়। পাশাপাশি কী ভাবে শেষ ওভারে মাথা ঠান্ডা রেখে বল করেছিলেন তা-ও জানতে চান মোদী। নাটকীয় মুহূর্ত আসে সূর্যকুমার যাদবের বেলায়। প্রধানমন্ত্রী এবং বাকি সকলের সামনেই ক্যাচ ধরার সেই সাত সেকেন্ডের মুহূর্তের বর্ণনা দিতে হয়। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ক্রিকেটারদের সাক্ষাতের একটি ভিডিয়ো সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। কোনওটিতেই ক্রিকেটারদের সঙ্গে কথাবার্তার শব্দ শোনা যায়নি।
বিশেষ বিমানে মুম্বইয়ে
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষ হতেই বিমান সংস্থা ভিস্তারার বিমানে দিল্লি থেকে মুম্বই রওনা দেন রোহিতেরা। সেই বিমানের ‘কল সাইন’ রাখা হয় ‘ভিটিআই ১৮৪৫’। বিমানের ‘ফ্লাইট নম্বর’ ছিল ‘ইউকে১৮৪৫’। কোহলি ১৮ নম্বর জার্সি পরে খেলেন। রোহিতের জার্সি নম্বর ৪৫। দুই ক্রিকেটারকেই সম্মান জানানো হয়।
মুম্বই বিমানবন্দর থেকে বেরনোর পর
বিমান মাটি ছোঁয়ার প্রায় এক ঘণ্টা পরে বেরোতে দেখা যায় রোহিতদের। মুম্বই বিমানবন্দর থেকে বার হওয়ার সময় দেখা যায়, ট্রফি হার্দিক পাণ্ড্যের হাতে। বাসেও সামনের আসনে ট্রফি হাতে বসেছিলেন তিনি। বাস এগিয়ে যেতে থাকে নরিম্যান পয়েন্টের দিকে। সেখান থেকে হুডখোলা বাসে ওয়াংখেড়ের দিকে যেতে থাকেন ভারতীয় ক্রিকেটারেরা। বিশ্বকাপ জয়ের উৎসবে যোগ দিতে ক্রিকেটপ্রেমীদের আহ্বান জানিয়েছিলেন রোহিত। ভারত অধিনায়কের আহ্বানে সাড়া দিয়ে অসংখ্য মানুষ রাস্তায় নেমেছিলেন। ভারতীয় ক্রিকেটারদের বিমান নামার অনেক আগে থেকে রাস্তার দখল নিয়েছিলেন তাঁরা। জনসমুদ্র পেরিয়ে হুডখোলা বাসে ওঠেন ভারতীয় ক্রিকেটারেরা। রাস্তা জুড়ে ছিল প্রচুর মানুষ। তাঁদের সরিয়ে রাস্তা ফাঁকা করার চেষ্টা করতে থাকে পুলিশ। জনসমুদ্রের মধ্যে দিয়ে রোহিতদের হুডখোলা বাসের এগোতে সমস্যা হচ্ছিল। ধীর গতিতে বাস এগোচ্ছিল। বাসের মাথায় ট্রফি নিয়ে উল্লাস করছিলেন ভারতীয় ক্রিকেটারেরা। রোহিতদের দেখতে রাস্তার ধারে গাছের উপরেও লোক উঠে পড়েছিলেন।
ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে
ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে গিয়ে নাচেন ভারতীয় ক্রিকেটারেরা। গানের তালে কোমর দোলান রোহিত, বিরাট, হার্দিকেরা। মাঠের মাঝে একটি মঞ্চ করা হয়েছিল। তার সামনে চেয়ারে বসে ক্রিকেটারেরা। ছিলেন ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের আধিকারিকেরা। ট্রফি রেখে জাতীয় সঙ্গীত গান তাঁরা। তাতে গলা মেলান দর্শকেরা। এর পর একে একে রোহিত, রাহুল দ্রাবিড়, বিরাট কোহলি এবং যশপ্রীত বুমরাকে ডেকে নেন সঞ্চালক। প্রত্যেকে বিশ্বজয়ের মুহূর্তের কথা তুলে ধরেন। শেষে ট্রফি নিয়ে মাঠ প্রদক্ষিণ করে গোটা দল। র্যাকেটে করে বল ছুড়ে দেওয়া হয় দর্শকদের দিকে।