“………..কোথায় অযোধ্যা কোথা সেই রাম
কোথায় হারালো গুণধাম,
এ কি হল এ কি হল,
পশু আজ মানুষেরই নাম।
সাবিত্রী সীতার দেশে দাও দেখা তুমি এসে
শেষ করে দাও এই অনাচার।
তোমার ভুবনে মাগো এত পাপ,
এ কি অভিশাপ,নাই প্রতিকার ?………”
………..(ছায়াছবি-মরুতীর্থ হিংলাজ – কথা-গৌরিপ্রসন্ন মজুমদার – শিল্পী-হেমন্ত মুখোপাধ্যায়)।
১৯৫৯ সালে মুক্তি পায় এই অতি বিখ্যাত ছায়াছবি, বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে যার স্থান শ্রেষ্ঠত্ব ও সাফল্যের নিরিখে কিংবদন্তী সুলভ আকার ধারণ করেছে। এবং তার সাথে কিংবদন্তীসুলভ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে ছায়াছবির “তোমার ভুবনে মাগো এতো পাপ” নামক গানটি। আশ্চর্য ও মুগ্ধতার বিষয় এই শ্ৰেষ্ঠ রাজা যিনি ধর্মাচরণে প্রবৃত্ত, যাঁর নেতৃত্বে রাষ্ট্র ও ধর্ম সুরক্ষিত – তার শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত রূপে উপস্থাপিত হয়েছেন মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রী শ্রী রামচন্দ্র, যাঁর ত্যাগব্রতী জীবনচর্যা, স্ত্রীর প্রতি অমলিন প্রেম ও কর্তব্য সম্পাদনে আক্ষরিক নিষ্ঠা, অশুভকে পরাস্ত করে শুভ/ধর্মের পুনরুত্থানে তাঁর তেজোদৃপ্ত ভূমিকা বাঙ্গালী হিন্দু সমাজকে মুগ্ধ ও শ্রদ্ধায় আপ্লুত করেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। এ এক অপূর্ব গাথা যা প্রবাহিত হচ্ছে যুগের পর যুগ, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ও তার অভিব্যক্তির মধ্য দিয়ে। এবং তা এক সুগভীর ছাপ রেখেছে বঙ্গের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে। কপট, অভিসন্ধিমূলক চিন্তা প্রমাণ করতে চায় শ্রী শ্রী রামচন্দ্রের সাথে বাঙ্গালীর হৃদয়ের কোন সংযোগ নেই। তিনি এক বিশেষ অঞ্চলেই পূজিত। অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করীর পদানুসরণকারীদের বঙ্গের ইতিবৃত্ত, বাঙ্গালী হিন্দুর ক্রমবিকাশ সম্পর্কে যে কোন ধারণাই নেই তার পরিচয় এর থেকে ভালো আর কিছু হতে পারেনা।
মূল সমস্যাটি কোথায়? সমস্যা সৃষ্টি হয় যখন কিছু বিশেষ ব্যক্তি তাঁদের বিশেষ বিষয়ের পান্ডিত্যের অধিকারে নিজেদের সর্বজ্ঞানী রূপে ধারণা করতে শুরু করেন। সম্প্রতি বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিবিদ, ভারতরত্ন ডঃ অমর্ত্য সেনের বক্তব্য, জয় শ্রীরাম ধ্বণি এক সাম্প্রতিক সৃষ্টি মাত্র, আক্রমণাত্মক চিন্তার প্রতীক ও তার উৎপত্তি শুধুমাত্র সমাজের অভ্যন্তরে সমস্যা ও ত্রাস সৃষ্টির জন্যই। ডঃ সেন প্রবীণ ব্যক্তি; কিন্তু তাঁর স্মৃতিশক্তি কি এতই দুর্বল হয়ে পড়েছে যে তিনি তাঁর বাল্যকালের বাঙ্গালীর সংস্কৃতি সম্পর্কে বিস্মৃত হয়েছেন? সেই যুগ যখন সন্ধ্যে ঘনিয়ে আসলে ভদ্রপল্লী থেকে ভেসে আসতো এক মৃদু গুঞ্জন, কৃত্তিবাসী রামায়ণের পংক্তি,
“কৌশল্যার সনে রাজা করি অনুমান।
তোমার পুত্রের নাম থুইল শ্রীরাম।।
কৈকয়ীর পুত্র দেখিয়া রাজা হরিষ অন্তর।
ভরত নাম থুইল তার দেখি মনোহর।।
সুমিত্রার তনয় জমজ দুইজন।
দুজনার নাম থুইল লক্ষণ শত্রুঘ্ন।।
একই দিবসে কৈল চারিজনের নামকরণ।
রাম লক্ষণ আর ভরত শত্রুঘ্ন।।”
কিন্তু ডঃ সেন কি রবীন্দ্রনাথের চিন্তা ও রামায়ণে তাঁর মুগ্ধতাও অস্বীকার করবেন? ঠাকুরবাড়ির অত্যুত্তম আশ্চর্য এই ব্যক্তি এমন এক আবহাওয়ায় জন্মগ্রহণ ও মানুষ হয়েছিলেন যার মূল বাণী ছিল – আনো ভদ্রা ক্রতাভ য়ন্তু বিশ্বতঃ – পৃথিবীর সমস্ত প্রান্ত হইতে সুমহতী চিন্তা আমার মননে প্রবেশ করুক। তাই পাঁচালী গায়ক শ্রী কিশোরী চট্টপাধ্যায়ের জোঁড়াসাঁকোয় গান গাওয়ার সম্বন্ধে কবি লিখছেন, “কৃত্তিবাসী সরল পয়ারের মৃদুমন্দ কলধ্বনি কোথায় বিলুপ্ত হইল — অনুপ্রাসের ঝকমারি ও ঝংকারে আমরা একেবারে হতবুদ্ধি হইয়া গেলাম।” ‘ছেলেবেলা’ (১৩৪৭) নামক আত্মনিষ্ঠ প্রবন্ধেও উল্লেখ করেছেন রামায়ণে মজে থাকার কথা, “ব্রজেশ্বরের কাছে সন্ধেবেলায় দিনে দিনে শুনেছি কৃত্তিবাসের সাতকাণ্ড রামায়ণটা।” রামায়ণ পড়ে কান্নার কথা ‘শিক্ষার হেরফের’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, “কৃত্তিবাসের রামায়ণ ও কাশিরামদাসের মহাভারত পড়িতে বসিতাম। রামচন্দ্র ও পাণ্ডবদিগের বিপদে কত অশ্রুপাত ও সৌভাগ্যে কী নিরতিশয় আনন্দলাভ করিয়াছি তাহা আজও ভুলি নাই।”
আকাশ প্রদীপ’ কাব্যের ‘যাত্রাপথ’ কবিতায় তাঁর লেখা, “কৃত্তিবাসী রামায়ণ সে বটতলাতে ছাপা/দিদিমায়ের বালিশ-তলায় চাপা,/আলগা মলিন পাতাগুলি, দাগি তাহার মলাট/দিদিমায়ের মতোই যেন বলি-পড়া ললাট” কি বাঙ্গালীর বিস্মরণ হবে? হওয়া সম্ভব কোন কালে? শ্রী শ্রী রামচন্দ্রের প্রতি বাঙ্গালীর আজন্ম শ্রদ্ধা, তাঁর ক্ষাত্রবীর্যের প্রতি বাঙ্গালীর মুগ্ধতা, তাঁর প্রজ্ঞা, পত্নীর উদ্ধারের মধ্য দিয়ে কর্তব্যেহস্মিন – এর শ্রেষ্ঠ নিদর্শনের প্রতি বাঙ্গালীর প্রণতি কোন ব্যক্তি বা যুগধর্মের বিকাশ নয়। এক অঙ্গাঙ্গীভাবে বিরাজিত সম্পর্কের আধার মাত্র।
একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল ‘উদ্বোধন’ পত্রিকার আশ্বিন ১৩৪৫ বঙ্গাব্দে, প্রসঙ্গ “রাম ও তাঁহার চরিত্র” যা সেই সময়ের পাঠক মহলে প্রভূত জনপ্রিয়তা লাভ করে। মূল বিষয় ছিল কিভাবে শ্রী শ্রী রামচন্দ্রের চরিত্র ও তার মাধুর্য জনসাধরণের মধ্যে ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছিল। লেখক? প্রখ্যাত পন্ডিত, তৎকালীন বঙ্গের অগ্রগণ্য বুদ্ধিজীবী শ্রী ক্ষিতিমোহন সেন; বঙ্গের সাংস্কৃতিক জ্যোতিষ্কদের মধ্যে তিনি অন্যতম ও অধিকতর পরিচিত আচার্য ক্ষিতিমোহন শাস্ত্রী রূপে এবং ডঃ অমর্ত্য সেনের মাতামহ বটে। সমস্যা হল দাদামশাইয়ের প্রভাব তাঁর দৌহিত্রের মননে কার্যত অনুপস্থিত রয়েছে। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, শ্রী শ্রী রামচন্দ্রের প্রভাব কোন রূপেই আঞ্চলিক নয়। তা বহুদূর বিস্তৃত। উক্ত প্রবন্ধে তিনি আলোচনা করেছেন উদাহরণ রূপে যবদ্বীপ, বালিদ্বীপ, কম্বোডিয়া, শ্যামদেশ, ব্রহ্মদেশের কথা – যেস্থানে বিভিন্ন প্রকারের রামায়ণের কাহিনী জনগণের মধ্যে প্রচলিত আছে। যবদ্বীপের মন্দিরে ও লোকমধ্যে যে রামায়ণ কথা আছে তাহা ৫টি কাব্যের সঙ্গে অভিন্নতা রয়েছে এবং তার সাথে আছে বঙ্গভূমির সম্পর্কও। এই বিশাল ভূমি ভারতবর্ষের পূর্ব ভাগে অবস্থিত। অতএব, যার চর্চা এখানে থাকেনা স্বতঃস্ফূর্ত রূপে তার প্রসার এই সমস্ত দুরবর্তী অঞ্চলে কার্যত অসম্ভব বলে পন্ডিতমহলের স্থির ধারণা। আশা করা যায়, প্রাচীন ও মধু যুগে এই সম্পর্ক তাম্রলিপ্ত বন্দরকে অগ্রাহ্য করে হতোনা।
শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের গৃহদেবতাই যে রঘুবীর তা কি আর নতুন করে বলতে হবে? স্বামী বিশ্বাশ্রয়ানন্দ দ্বারা লিখিত “শিশুদের রামকৃষ্ণ” পড়লে জানা যায় কিভাবে এক বৈষ্ণব সন্ন্যাসীর রামলালা বিগ্রহ ঠাকুরকে আচ্ছন্ন করেছিল। স্বামীজী এক স্থানে লিখছেন, “…..লোকে দেখে ধাতুর মূর্তি; সাধুটি কিন্তু সত্যি সত্যি জীবন্ত রামলালাকে দেখতে পেতেন। শ্রীরামকৃষ্ণও তাই দেখলেন।’…..
শহর কলকাতা থেকে বহুদূরে অবস্থিত বাঁকুড়া শহর লাগোয়া পশ্চিম সানাবাঁধ গ্রামের রামপাড়ার সবকিছুই রামময়।শুধুমাত্র স্থানীয় অঞ্চলের নাম নয়, সব পুরুষের নাম থেকে পুকুর ও প্রতিষ্ঠানগুলোও রাম নামে ভূষিত। হাওড়ার বিখ্যাত রামরাজাতলার উল্লেখ কি প্রয়োজন আছে? কথিত আছে, স্থানীয় প্রতাপশালী জমিদার শ্রী অযোধ্যারাম চৌধুরী মহাশয় স্বপ্নাদেশ পান শ্রী শ্রী রামচন্দ্রকে পূজা করার জন্য। পরম ধার্মিক জমিদার মহাশয় শ্রী শ্রী রামচন্দ্রের এক সুবিশাল বারোয়ারী পূজা শুরু করেন যা থেকে এই অঞ্চলের নাম হয় রামরাজাতলা। বহু লোকের মতানুযায়ী, এইসব কোন সংক্ষিপ্ত দৃষ্টান্ত নয়। সমগ্র রাজ্য জুড়েই এইরূপ নিদর্শনের সম্ভার রয়েছে। রামচন্দ্রের মহিমা জড়িত অকাল বোধন যে এই ভূমে জাতীয় উৎসবে পরিণত হবে তাতে বিশেষ আশ্চর্যের কিছু নেই। কথিত আছে, মহারাজ রাবণের বধের পূর্বে তিনি দেবী দুর্গার কাছে আশীর্বাদ প্রার্থনা করে বিল্ববৃক্ষতলে বোধনপূর্বক দুর্গাপূজা করেছিলেন। ও সেই একই পূজার অষ্টমী তিথি ও নবমী তিথির সন্ধিক্ষণে অনুষ্ঠিত সন্ধি পূজাও বাঙ্গালীর মধ্যে ভক্তিভাবের এক প্রাবল্য সৃষ্টি করে।
অতঃপর শ্রী শ্রী রাম জন্মভূমি আন্দোলন যে বাঙ্গালীর দৃষ্টি আকর্ষণ করবে তার উপরে সন্দেহ করার কোন অবকাশই থাকতে পারেনা। সেই কোন বিস্মৃত ১৮৮৫ সালে মচবুতরার উপরের অস্থায়ী আচ্ছাদনকে স্থায়ী করার অভিপ্রায়ে নির্মোহী আখড়া কর্তৃক ফৈজাবাদ জেলার ব্রিটিশ বিচারককে পেশ করা পত্র থেকে যে সংগ্রামের প্রারম্ভ তা আজ এক মহীরুহ আকার ধারণ করেছে। ১৯৮৪ সালের ৭ই ও ৮ই এপ্রিল, দিল্লীস্থিত বিজ্ঞান ভবনে অনুষ্ঠিত প্রথম ধর্ম সংসদে র্যাম জন্মভূমি মুক্ত করার গৃহীত সিদ্ধান্ত, ৮০-এর দশকে সমগ্র ভারত জুড়ে উত্তাল হিন্দু জন আবেগের বিস্ফোরণে, সুমহান আবেগ ও রক্তস্রোত দ্বারা প্রতিষ্ঠিত রাম মন্দির আন্দোলন যা ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও এক যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করেছে, আজ আক্ষরিক অর্থেই এই ঐতিহাসিক লগ্নে পদার্পণ করেছে। রাষ্ট্রবাদী, দেশপ্রেমিক সংগ্রামের এক দৃষ্টান্ত রূপে প্রতিষ্ঠিত রাম মন্দির আন্দোলনকে হাঁটতে হবে দীর্ঘ পথ এখনো।
ব্রাহ্মণের জ্ঞান, ক্ষত্রিয়র ক্ষত্রবীর্য, বৈশ্যের সম্প্রসারণতা, শূদ্রের কর্মকুশলতাকে এক করে নব হিন্দুর জন্ম হোক প্রত্যেক গৃহে, হিন্দুর রাষ্ট্র ও তার ভাবীকাল উদ্ভাসিত হোক এক নব প্রাণস্পন্দনে।
অযোধ্যাতে শ্রী শ্রী রামচন্দ্রের মন্দিরের প্রতিষ্ঠাই হোক সেই চির আকাঙ্খিত নব রাষ্ট্র নির্মাণের প্রথম সোপান।