নদীকে জিজ্ঞাসা করিতাম, ‘তুমি কোথা হইতে আসিতেছো?’
নদী উত্তর করিত, ‘মহাদেবের জটা হইতে।’
তখন ভগীরথের গঙ্গা আনয়ন বৃত্তান্ত স্মৃতিপথে উদিত হইত।
(অব্যক্ত: ভাগীরথীর উৎস-সন্ধানে)
‘অব্যক্ত’ যখন পড়ি মনে হয়, জগদীশ চন্দ্র-ই বুঝি ভগীরথ! তিনি গবেষণাগারের জটিল জটা থেকে ‘গঙ্গা’ নামক জ্ঞানসমুদ্রকে মর্ত্যবাসী মানুষের কল্যাণে বইয়ে দিয়েছেন। তিনি তো বলেইছেন, “The true Laboratory is the mind where behind illusions we uncover the laws of truth.” বসু বিজ্ঞান মন্দিরের আখ্যায়িকা পত্রে তিনি ঘোষণা করেছিলেন, “I dedicate today this Institute — not merely a laboratory but a temple.” এটি মন্দির-ই বটে! মন্দিরের সুবাস, সৌন্দর্য, সৌকর্য এর পরতে পরতে বিদ্যমান; এক ধ্যানমগ্ন শৈব-সাধকের উপাসনালয়। লিখছেন, “ভারতের গৌরব ও জগতের কল্যাণ কামনায় এই বিজ্ঞান মন্দির দেব চরণে নিবেদন করলাম”। ১৯১৭ সালের ৩০ শে নভেম্বর প্রতিষ্ঠা হল বোস ইন্সটিটিউট। ভারতীয় অস্মিতার এক জগতজ্যোতি, পরাধীন ভারতে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার এক জাতীয়তাবাদী নাম।


জগদীশ চন্দ্র লিখিত বিজ্ঞান ও দার্শনিক গ্রন্থ ‘অব্যক্ত’। তার চেয়েও বড় পরিচয় হল, ‘অব্যক্ত’ বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে এক অন্যতম রত্ন রাশি। এর লেখ্যরূপ রবীন্দ্রনাথের কাছে পাঠিয়ে তিনি লিখলেন, “সুখে দুঃখে কত বৎসরের স্মৃতি তোমার সহিত জড়িত। অনেক সময় সেসব কথা মনে পড়ে। আজ জোনাকির আলো রবির প্রখর আলোর নিকট পাঠাইলাম (৩ রা অগ্রহায়ণ, ১৩২৮)।” উত্তরে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, “এগুলি পড়িয়া অনেকবারই ভাবিয়াছি যে যদিও বিজ্ঞান বাণীকেই তুমি তোমার সুয়োরাণী করিয়াছ তবুও সাহিত্যসরস্বতী সে পদের দাবী করিতে পারিত — কেবল তোমার অনবধানেই সে অনাদৃত হইয়া আছে (২৪ শে নভেম্বর, ১৯২১)। গ্রন্থখানি প্রকাশের প্রায় শতবর্ষ হতে চললো তবুও তার ভাব-ভাষা-ব্যঞ্জনা কোনো অংশেই আজ অপ্রাসঙ্গিক নয়। গ্রন্থের ‘আহত উদ্ভিদ’ প্রবন্ধে তিনি বললেন, কি শক্তিবলে উদ্ভিদ আহত হয়েও বেঁচে থাকে; ধৈর্য, দৃঢ়তায় স্বস্থান দৃঢ়ভাবে আলিঙ্গন করে থাকে; তার পরেই সেই চিরায়ত উপসংহার – যা হতভাগ্য হিন্দুদেরই উদ্দেশ্যেই অব্যক্ত-বাণী বলে প্রতীয়মান হয়, ” যে হতভাগ্য আপনাকে স্বস্থান ও স্বদেশ হইতে বিচ্যুত করে, যে পর-অন্নে পালিত হয়, যে জাতীয় স্মৃতি ভুলিয়া যায়, সে হতভাগ্য কি শক্তি লইয়া বাঁচিয়া থাকিবে? বিনাশ তাহার সম্মুখে, ধ্বংসই তাহার পরিণাম।”
আঘাতে-উত্তেজনায়-অবসাদে যে উদ্ভিদ আর প্রাণীর একই সাড়া, সেই আবিষ্কারের সূত্রেই জগদীশ চন্দ্র ভারতীয় চিন্তাপ্রণালীর একত্বের সন্ধানে পৌঁছে গেলেন। বিভিন্নতার মধ্যে সাম্য, জড়-জীব-উদ্ভিদের মধ্যে সেতু-বন্ধন। পদার্থবিদ্যা এবং উদ্ভিদবিদ্যা চর্চার আলোকে তিনি সেই ভারতীয় সাধক, যিনি অব্যক্ততার বিশ্বরূপকে, তার অসীমতাকে পরীক্ষাপ্রণালীতে প্রতিষ্ঠা দিলেন। যা ছিল একান্তই চোখের বাহিরে, তাই এলো চোখের আলোয়। ‘নিবেদন’ প্রবন্ধে তিনি লিখছেন, “বিধাতা যদি বিজ্ঞানের কোনো বিশেষ তীর্থ ভারতীয় সাধকের জন্য নির্দেশ করিয়া থাকেন, তবে এই চতুর্বেণী সংগমেই (পদার্থবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা, প্রাণীবিদ্যা, মনস্তত্ববিদ্যা) সেই মহাতীর্থ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.