দেশের উপরাষ্ট্রপতি বেঙ্কাইয়া নাইডু অত্যন্ত সময়োপযোগী মনে করে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ও জাতীয় জনসংখ্যার তথ্য সংরক্ষণ সংক্রান্ত বিষয় দুটি নিয়ে তীব্র চুলচেরা বিতর্কে অংশ গ্রহণ করার এক আবেগঘন আহ্বান জানিয়েছেন। নজর দিলেই দেখা যাচ্ছে উল্লেখিত বিষয় দুটি নিয়ে বিক্ষোভ নিছক কুমতলবের রাজনীতি প্রণোদিত। দেশের নাগরিকদের বিশাল অংশের এ বিষয়ে অজ্ঞতা বিক্ষোভকারীদের প্রয়াসে সার জল দিয়েছে। যার ফলে এঁরা মানুষের মনে অনাবশ্যক ভীতি ও এক ধরনের অনির্ণেয় মানসিক আতঙ্কের সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু এই উন্মাদনারও একটি নির্দিষ্ট ছক রয়েছে। এই বিলকে ঘিরে কংগ্রেস ও অন্যান্য বিরোধী দলগুলি হঠাৎ সেই পুরনো ছদ্ম ধর্মনিরপেক্ষতার জিগির তোলার একটা মওকা পেয়ে গেছে বলে ধরে নিয়েছে। একটা সময়ে এই ধর্মনিরপেক্ষতার কৌশল প্রয়োগ করে তারা ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতির দক্ষ খেলোয়াড় হয়ে উঠেছিল।
কিন্তু বিখ্যাত সাহবানু খোরপোশ মামলা’ ও অযোধ্যা আন্দোলনের পর কংগ্রেস ও অন্য দলগুলির মধ্যে একটা আবছা ভিন্ন সংকেত দেওয়া শুরু হয়। ৯০-এর দশকের শেষাশেষি যখন সমাজতন্ত্রের রমরমা ঝিমিয়ে পড়ল সে সময় কংগ্রেসের দলছুট নেতা শরদ পাওয়ার যিনি তার নতুন গোষ্ঠীর নাম সমাজবাদী কংগ্রেস রেখেছিলেন তা বদলে ১৯৯৯-এ জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস (এনসিপি) করে দেন। মূল কংগ্রেস দল পরিস্থিতি দেখে শুনে মিডিয়ার ভাষায় হালকা হিন্দুত্বের দিকে বেঁকে। এই সূত্রে গত বছরের মধ্যপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস ইস্তাহারে ‘রাম বনগমন পথ’ সন্ধানের উল্লেখ তাৎপর্যপূর্ণ। তবে ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে এইসব ‘কসমেটিক চেঞ্জ’ কোনো কাজে আসেনি। ফলে ভারতের অতি প্রাচীন কংগ্রেস দল সম্পূর্ণ হতাশাগ্রস্ত হয়ে চিরঅভ্যস্ত ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতিকেই আবার আঁকড়ে ধরেছে।
মোটামুটি বিজেপি ছাড়া সমস্ত দলই মুসলমানদের নেহাতই মামুলি ভোটব্যাঙ্ক হিসেবেই গণ্য করতে অভ্যস্ত। কিন্তু এখন পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে। আজকে এটা আবাক হওয়ার ব্যাপার নয় যে নবীন প্রজন্মের সংখ্যালঘু ছেলে-মেয়েরা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশা অন্য সম্প্রদায়ের মতোই পোষণ করে। জম্মু-কাশ্মীরে এখন নতুন শিল্পোদ্যোগ শুরু হয়েছে। মুসলমান মেয়েরা এখন ন্যায়সঙ্গতভাবেই সমান সম্মান এবং অন্যায়ের হাত থেকে নিরাপত্তা দাবি করতে পারে। কিন্তু ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতি এই নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনকে কেন্দ্র করে একটা সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছে। প্রাসঙ্গিক থাকতে ব্যাপক ভুয়ো প্রচারের ঢেউ তুলে দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু সংখ্যালঘুদের এই মিথ্যার জালে। আবদ্ধ রাখার কৌশল তিনটে নির্দিষ্ট কারণে মুখ থুবড়ে পড়বে। (১) লোকে যত এই আইনের গভীরে ঢুকবে ততই স্বাভাবিক অবস্থা দ্রুত ফিরে আসবে। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নির্দিষ্ট তিনটি দেশের ধর্মীয় কারণে নির্যাতিত মানুষদের ভারতে বসবাসের অধিকার ত্বরান্বিত করার আইন। এটিই সারবস্তু। দেশের প্রচলিত আইনে বিশ্বের যে কোনো দেশ থেকে আসা মানুষকে (মুসলমান-সহ) ভারতে ১১ বছর বসবাসের পর নাগরিকত্ব দেওয়া হতে পারে। নির্যাতিত শরণার্থীদের ক্ষেত্রে এই বসবাসের সময়সীমা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে, কেননা তারা দীর্ঘদিন ধরেই এখানে বসবাস করছে। সহজ কথায় বৈষম্য হলেও এটি ইতিবাচক বৈষম্য। সমাজে মেয়েদের, শারীরিকভাবে অপটুদের বা নিতান্ত প্রান্তিক মানুষদের যেমন বিশেষ সুবিধে প্রদান করা হয় এটা প্রায় তারই সমতুল। যে কারণেই দেশের প্রধানমন্ত্রী ও গৃহমন্ত্রী শাহ বলেছেন নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের অন্তর্গত ধারাগুলি নিয়ে দেশের মানুষের বিন্দুমাত্র চিন্তার কারণ নেই। (২) সংখ্যালঘু বিশেষ করে মুসলমানদের বোকা বানানো এখন কঠিন। প্রথম এনডিএ সরকারের আমলেই মাদ্রাসাগুলিতে প্রথম কম্পিউটার প্রচলিত হয়, একথা তারা জানে। একইভাবে মোদী সরকারের একনিষ্ঠ দৃঢ়তায় আদালতে তিন তালাক প্রথা রদ হয়ে যায়। মুসলমানদের মধ্যে সরকারি সাহায্যে উদ্যোগপতি হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে বর্তমান সরকার বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে। সংখ্যালঘুদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির এই পরিবর্তনই প্রথম করে তাদের সরকার নিছক বাঁধা ভোটব্যাঙ্ক হিসেবে গণ্য করে না।
(৩) ধীরে হলেও মুসলমানরা নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারছে আজকে জাতিগত পরিচয়কে ছাপিয়ে আশাআকাঙ্ক্ষা পূরণের পথ খোঁজাই গুরত্বপূর্ণ। এর প্রমাণ এতদিন চিরাচরিত বিশ্বাস অনুযায়ী তিন তালাক রদ, ৩৭০ ধারা বিলোপ বা অযোধ্যায় সর্বোচ্চ আদালতের রামমন্দির নির্মাণের রায়ের বিরোধিতায় মুসলমানরা ঝাপিয়ে পড়বে—সে ধারণা ধুলিসাৎ হয়ে গেছে। এ কথার মধ্যে এখন আর কোনো সত্য নেই যে মুসলমান তরুণরা তাদের প্রজন্মের তরুণীদের জন্য সম সম্মান, নিরাপত্তা ও সম সুযোগ প্রত্যাশা করে না। শেষকালে যারা এই আইনটির বিরুদ্ধে কোমর বেঁধে সরকারের সমালোচনা করছেন তাদের কিছু শিক্ষণীয় আছে।
তাদের বক্তব্য সরকার জনতার মতামতকে বিলকুল অগ্রাহ্য করছে। প্রবাদ প্রতিম ইংরেজ বাগ্মী এডমন্ড বার্ক বলেছিলেন— “Your representative owes you not his industry (37) only but his judgement, and he betrays instead of serving you if he sacrifices it to your opinion.” মহা মূল্যবান কথা। মোদী একজন প্রাজ্ঞ নেতার মতোই তার বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করে দেশবাসীর বৃহত্তর কল্যাণে কাজ করে চলেছেন।
বিনয় সহস্রবুদ্ধে
(অনুবাদক : সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়)
2020-01-17