মদনাবতী: বঙ্গের এক লুপ্ত গর্বিত নগরী – দ্বিতীয় পর্ব

দ্বিতীয় পর্ব

পূর্ব পর্বের পর অপর একটি জনশ্রুতি তথা ইতিহাস এই আলোচনায় আমরা আনব। বল্লাল সেনের শ্বশুরের নাম ছিল মদন হাঁড়ি, তাঁর বসবাস সূত্রে মদনবাটি থেকে মদনাবতী নামটি এসেছে। ঢাকুর গ্রন্থ সাক্ষ্যে জানা যায় যে বল্লাল সেন জনৈক ডোমকন্যার রূপে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে স্ত্রী রূপে গ্রহণ করেন । ফলে, লক্ষ্মণ সেনের সঙ্গে পিতার মনান্তর ঘটে। ঢাকুর গ্রন্থে আছে – বল্লাল সেন একদিন মৃগয়ায় গেলে ঝড় বৃষ্টি শুরু হয় । রাজা লোকালয়ে এসে এক ডোমের গৃহে আশ্রয় নেন। তারপর –

সেই রাত্রি তথায় রহিল উপবাসী।
মিলিলেক ডোম কন্যা প্রাতঃকালে আসি।।
বিবাহ করিব বলি লৈয়া আইল ঘরে।
যেবা শুনে যেবা জানে শতনিন্দা করে।।

রজনীকান্ত চক্রবর্তীর অনুমান বল্লালসেন তান্ত্রিক ছিলেন। তিনি তাঁর গৌড়ের ইতিহাস গ্রন্থে বলছেন -” আনন্দভট্টের লেখা হইতে জানা যায় বিল্লাল প্রথমে শৈব ছিলেন, পরে সিংহগিরি নামক ব্যক্তির প্রবর্তনায় ঘোর তান্ত্রিক হইয়া পড়েন। “

এক্ষেত্রেও বলা যায় যদি শ্বশুরের প্রতি সৌজন্য দেখাতে গিয়ে বল্লালসেন মদনাবতীতে রাজকীয় পৃষ্ঠপোষণা করে থাকেন তাহলেও মদনাবতীর স্থায়িত্ব স্বল্প কালই ছিল। কারণ বল্লালসেনের রাজ্যকাল সূচিত হয় তাঁর পিতা বিজয়সেনের মৃত্যুর পরে। বিজয়সেনের মৃত্যু হয় আনুমানিক ১১৬০ সালে। এরপর বল্লালসেন রাজা হন। তিনি প্রায় দুদশক রাজত্ব করেন। প্রসঙ্গত এই বিজয়সেনই গৌড়রাজ মদনপালকে পরাজিত করেন। তাই , যদি মদনাবতীর প্রতিষ্ঠাতা বল্লাল হন তবে , নগরীটি আয়ুষ্কাল আরো স্বল্প হবে। যদিও বল্লালসেনের নগরীটির প্রতিষ্ঠা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

তবে কেবলমাত্র নাম প্রমাণেই নয় , মদনাবতী সনাতনী রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা ধন্য নগরী ছিল , তা শ্রদ্ধেয় হরিদাস পালিতের লেখা থেকে জানা যায়। স্থানটি পরিদর্শন করে শতাধিক বর্ষকাল পূর্বে তিনি যে বিবরণ রেখে যান তা অনেকটা এরকম – ( আমি চলিত বাঙ্গালায় তর্জমা করলাম ) – এটি বামনগোলা হতে ছয়ক্রোশ পূর্বোত্তর ভাগে অবস্থিত। প্রায় তিন-চার হাজার বিঘা উন্নত ভূখণ্ড পরিখা ও উচ্চ প্রাচীর বেষ্টিত ভূখণ্ড। প্রাচীরের ইষ্টক স্তূপ মাল্যের ন্যায় মদনাবতী দুর্গ বেষ্টিত করে আছে। অভ্যন্তরে চার পাঁচ বিঘা পরিমিত উত্তর দক্ষিণে বিস্তৃত দীঘি বর্তমান। ইহার চারটি পাড়ই ইষ্টক পাষাণ মন্ডিত ছিল। তার উপর রাজপ্রাসাদ শোভিত ছিল। সমগ্র ভূখণ্ড ইষ্টক প্রস্তরে পরিব্যাপ্ত রয়েছে। কোথাও কোথাও সুন্দর , সুবৃহৎ প্রস্তর স্তম্ভ সমূহ দন্ডায়মান রয়েছে। কোন স্থানে গম্বুজের কিয়দংশ ,কোথাও ভগ্ন প্রাচীর ও গৃহাদির সামান্য অংশমাত্র বিদ্যমান থেকে অতীতের বিশাল নিদর্শন ব্যক্ত করছে। ইতস্তত বিক্ষিপ্ত কিছু দেবদেবীর পাষাণ মূর্তি একত্র করলে একটি স্তূপে পরিণত হতে পারে। নগরে প্রবেশের চারটি তোরণ দ্বার ছিল।”

এই বিবরণ মাত্র শতাধিক বর্ষকাল পূর্বের। একটি সুপরিকল্পিত বিলুপ্ত সনাতনী নগরী যা বর্তমান দিনে কেবল কিছু কষ্টিপাথরের দেবদেবীমূর্তি , ভগ্ন অলঙ্কৃত পাষাণ স্তম্ভ, পাল যুগের ইষ্টকাদি সমন্বিত সাধারণ একটি গ্রামে পরিণত হয়েছে। মাইল খানেক পশ্চিমে প্রবাহিত টাঙ্গনের পূর্ব পাড়ের নিম্নাংশ প্রচুর ইট দেখা যায়। সন্দেহ নেই যে স্বল্পকাল স্থায়ী জীবনে মদনাবতীর সৌন্দর্য ছিল নয়নাভিরাম।

তবে , শিবডাঙ্গির শিবমন্দির এহেন সুদৃশ্য নগরের উপান্তে অবস্থিত ছিল। তার সময়কাল মদনাবতীর পূর্বে। আনুমানিক একাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের মধ্যবর্তী সময়ে। মদনাবতীর প্রতিষ্ঠা তার পরবর্তী কালের ঘটনা।

মদনাবতীর গর্বের অন্যতম পালক ছিল মেঘডম্বর দীঘি। তা আজো বর্তমান রয়েছে। কিন্তু তার তীরবর্তী রাজপ্রাসাদ বা চতুর্দিকের পাড় বাঁধানো ইষ্টক বা পাষাণ অবশেষ আজ বিলুপ্ত। কাল মদনাবতীর সকল অলঙ্করণ খুলে নিয়ে তাকে নিঃস্ব – রিক্ত করে দিয়েছে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দশকে উইলিয়াম কেরী এখানে পদার্পণ করেন। দীঘির উত্তর পশ্চিম কোণে তাঁর নীলকুঠির ধ্বংসাবশেষ আজও বর্তমান। কেরীর আগমনে বছর পাঁচেক মদনবতীতে প্রাণচাঞ্চল্য আসে। কিন্তু তারপর আবার শতাব্দীর পর শতাব্দী মদনাবতী ঘুমে অচেতন হয়ে যায়।

মদনাবতী বিজিত হয়েছিল তুর্কী ম্লেচ্ছদের হাতে, হারিয়েছিল তার হৃত গৌরব। কিন্তু তার গুরুত্ব হারায়নি একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত। তার প্রমাণ স্পষ্টত রয়ে গেছে মৌজার নামকরণে। মদনাবতীর মৌজা নাম – উত্তর কসবা। হ্যাঁ ,কসবা বা কসবাহ কোনো বাঙ্গালা শব্দ নয়। এটি একটি আরবি শব্দ। এর অর্থ বঙ্গীয় শব্দকোষ ( হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়) অনুসারে ক . নগর , খ. বড় গ্রাম , গ. মহাল বা পরগণার প্রধান নগর।

আবার সংসদ বাংলা অভিধানে বলা হয়েছে গ্রামের অপেক্ষা বড় কিন্তু নগরের অপেক্ষা ছোট বসতি, সমৃদ্ধ গ্রামকে কসবা বলা হয়। আসলে মদনাবতীর সনাতনী আমল বিধ্বস্ত এবং অতীতের বিষয়ে পরিণত হলেও এখানকার উৎকৃষ্ট ভূমি, সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য দৃষ্টে একেবারে প্রথম পর্বেই সেই বখতিয়ারের আক্রমণ কি তার কিছু আছে সুফি জালালউদ্দিন তাব্রেজের আগমন থেকেই এখানে সেই বৈদেশিক সাম্রাজ্যবাদীদের বসতি গড়ে ওঠে। ঠিক সেই , হ্যাঁ সেই সময়েই এই মদনাবতীর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় কসবা।

প্রাপ্ত প্রত্নবস্তুর নিরিখে মদনাবতীর নাম ছিল যথার্থ। মদনাবতী অতীত গৌরব যা ইতিমধ্যেই স্মৃতিতে পরিণত হয়েছিল, আরবি কসবা নামকরণের সঙ্গে তার শেষ অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছিল এমন বলা যায় কি ? মানুষের মনে তো প্রবলভাবে মদনাবতী জাগ্রত ছিল। সেই কারণেই টোডরমলের জরিপ সূত্রে থাকা সরকার জন্নতাবাদ অর্থাৎ গৌড় – লক্ষ্মৌতির ৬৬ টি মহালের অন্যতম পরগনার হিসাবে মদনাবতী নামটি পাওয়া যায় আবুল ফজলের আইন- ই- আকবরী গ্রন্থে। যাবতীয় সনাতনী ভারতীয় স্মারক বিকৃত করে এমনকি নামটিও বিলুপ্ত করার প্রচেষ্টা যখন সফল হল না তখন এটুকু উপলব্ধি সকলকে করতেই হবে যে মদনাবতীর কালজয়ী প্রভাব কিরূপে জনমানসে ছিল। হয়তো, মদনাবতী রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা ধন্য হওয়ায় এমনটি হয়েছিল। মদনাবতী হয়তো একেবারে রাজধানী ছিল বা ছিল না , তবে পালযুগে রাজাদের সাময়িক বিশ্রামস্থল বা পল্লীনিবাস হিসাবে এবং কতিপয় প্রধান দপ্তর স্থাপিত হওয়ায় সম্ভবত এটি জনমানসে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল।

ক্রমশঃ

©দুর্গেশনন্দিনী

তথ্যঋণ স্বীকার : ১. বরিন্দের ইতিহাস : প্রসঙ্গ শিবডাঙ্গির মন্দির

২. গৌড়লেখমালা

৩. বখতিয়ারের ঘোড়া

৪. বাঙ্গালীর ইতিহাস : আদিপর্ব

৫. মালদা জেলার ইতিহাস ও প্রত্নচর্চা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.