ইংরেজি ১৮৮৬ সালের ২৪ শে মে ( বাংলা ১২৯৩ সালের ১১ ই জ্যৈষ্ঠ )
কালীস্থান নিয়ে বিতর্কের জেরে শহর কলকাতায় এক বিশাল নগর সংকীর্তন বের
হয়েছিল, আজ সেই হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের পাতায় আমাদের যাত্রা।
এর কারণ ছিল মূলত পাঁঠার মাংস বিক্রির প্রসঙ্গ। তার আগে “কালীস্থান” নিয়ে কিছু কথা।
কালীস্থান মানে কালীমূর্তির সামনে পাঁঠা বলি দিয়ে সেই মাংস বিক্রি হতো।
ওই মাংস শুদ্ধ প্রসাদী মাংস হিসেবে গণ্য ছিল। “কালীস্থান” নাম হলেও এগুলি
আসলে ছিল কসাইখানা।
অন্যদিকে, প্রতিষ্ঠিত কালীমন্দিরগুলি ছিল কালী উপাসনার কেন্দ্র। কাজেই দুটি বিষয় সম্পূর্ণ আলাদা।
ইংরেজি ১৮৭৭-৭৮ সালে কলকাতা পৌর কর্তৃপক্ষের কাছে বেশ কিছু অভিযোগপত্র
আসে, ওইসব কালীস্থানের পরিবেশ অস্বাস্থ্যকর এবং তাই এগুলি অবিলম্বে বন্ধ
করে দেওয়া দরকার।
এরপর পৌরসভা এগুলি বন্ধ করতে উদ্যোগী হয়। তৈরি হয় আইন। কিন্তু তা কার্যকর করা যায়নি।
এরপর ১৮৮০ সালে কালীমন্দিরগুলিকে এই আইনের আওতার বাইরে রাখা হয়।
১৮৮৪ সালে কলকাতা পৌরসভা কালীস্থানগুলিকে নিয়মিত তদারকি করার সিদ্ধান্ত নেয়।
১৮৮৫-৮৬
সালে কলকাতা শহরের কালীস্থানগুলিকে দুটি কেন্দ্রে ভাগ করে একটি পূর্বদিকে
এবং অন্যটি উত্তরদিকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এরজন্য ২০ হাজার
টাকা খরচ করে দুটি ঘর তৈরির কথা বলা হয়। কিন্তু একটি অঞ্চলের বাসিন্দাদের
আপত্তিতে ঘর তৈরির পরিকল্পনা বন্ধ হয়ে যায়।
এরপর কালীমন্দির ও কালীস্থানের মধ্যে কোনটি কী, তা নির্ণয় করতে হিমশিম খায় পৌরসভা।
কালীস্থান নিয়ে সারা কলকাতা জুড়ে তীব্র হৈ চৈ শুরু হয়ে যায়। এ বিষয়ে “দ্য হিন্দু পেট্রিয়ট” ( মে ১০, ১৮৮৬ ) সম্পাদকীয় কলমে লেখে,
কর্ণওয়ালিশ স্ট্রিটের কসাইখানার বিরোধিতা প্রসঙ্গে বলেছিলাম, রক্ষণশীল
হিন্দুরা বলিদান করা ছাগ মাংস খান এবং তাই তারা কালীস্থানের মাংস খেতে
আপত্তি করবেন।
এ বিষয়ে জনৈক কমিশনার অভিমত দেন, এই পরিকল্পিত
কসাইখানায় কালীমূর্তি প্রতিষ্ঠিত করা হবে এবং নিত্যপুজোর জন্য একজন পুজারী
ব্রাহ্মণ ও ছাগ বলির জন্য একজন হিন্দু কামারকে নিয়োগ করা হবে। যথাবিহিত
পুজোর পর মা কালীর সামনে ছাগ বলি দেওয়া হবে।
বিষয়টি নিয়ে আলোচনার
জন্য কলকাতা করপোরেশনের চেয়ারম্যান স্যার হেনরি হ্যারিসনের উদ্যোগে টাউন
হলে একটি সভা বসে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই হ্যারিসনের নামেই কলকাতার
“হ্যারিসন রোড” ( বর্তমানে “মহাত্মা গান্ধী রোড” )।
এই সভায়
রক্ষণশীল হিন্দুরা বলেন, কালীমন্দির ও কালীস্থান এক নয়। মাংস খাবার জন্য
কালীমন্দিরে বলি হয় না। কসাইখানাকে কালীমন্দির বললে তা কালীমন্দির হয় না।
বরং কসাইখানা সুষ্ঠুভাবে চলার জন্য স্বাস্থ্যসম্মত আইন তৈরি হোক।
ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার বললেন,
“That no slaughter-houses be eracted, or allowed to be erected, by the
Municipality within the present limits of Calcutta, and that the
so-called Kalisthans, where there is no regular worship, and where goats
are not duly consecreated and sacrified, be treated as
slaughter-house.”
—The Indian Daily News, Monday, May 17, 1886.
শেষ
পর্যন্ত সিমলা ভট্টাচার্যের বাগান নামক জায়গায় কসাইখানা তৈরি হবে বলে
সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু এর প্রতিবাদে কমিশনারদের বাড়ির সামনে সঙের দল
ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে। শেষ পর্যন্ত বাতিল হয়ে যায় কসাইখানা তৈরির
পরিকল্পনা।
এই আন্দোলনে জয়ের আনন্দে ১৮৮৬ সালের ২৪ শে মে সঙের দল এক
বিশাল নগর সংকীর্তন বের করে। তারা গাইছিল বাউল সুরে, এক তালা তালে এই গান,
“আয় রে ভাই সবাই মিলে, বাহু তুলে, হরি বলে নাচি চল্ ।
সহরে কসাই-কালী—জবাই বলি—ঢলাঢলি যত ছিল ;
শ্রীহরির কৃপা-বশে এক বাতাসে,
তুলার মতন উড়ে গেল !
যত সব ষণ্ডামার্ক, ঘোর বিপক্ষ,
কুতর্ক জাল পেতেছিল ;
তারা সেই কসাই-কালী—কলির চেলা
চূন কালি লাভ্ তাইতে হলো !
শুভ জন্মদিন আজ মহারাণীর নাম গেয়ে
জয়-নিশান তোলো !
ওরে ভাই , তাঁর রাজত্বে, ধর্মের পথে,
কার সাধ্য গোল্ বাঁধায় বল ?
ওহে, এই করো দয়াল হরি !
রাজ্যেশ্বরী-কুইন মাকে রেখো ভাল !
আর যারা হিঁদুর ছেলে, যায় কু-চেলে,
তাদের মন সপথে চালো। “