পি সি সরকারের ম্যাজিক দেখেছেন? সিনিয়র পি সি সরকারের? একজন সুন্দরী মহিলাকে ঢেকে দিতেন কালাে কাপড়ে। তার পর অদ্ভুত কায়দায় বনবন করে ঘােরাতেন হাতের জাদুদণ্ড দ্য ম্যাজিক ওয়ার্ল্ড। আর মুখে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে জিভ নাড়তেন— আওয়াজ বেরােত গিলি গিলি গিলি…। ম্যাজিক্যাল ওয়ান্ডারটা প্রকাশ পেত এর পরই। কালাে কাপড়টা সরিয়ে নেওয়ার পর দেখা যেত সুন্দরী মহিলা নেই। ভ্যানিশ! ঝকমকে পােশাকে সজ্জিত পি সি সরকার ঝকঝকে দাঁত বের করে হাসতেন কোলগেট হাসি। আর গােটা হলঘর ফেটে পড়ত দমবন্ধ করা হাততালির শব্দে। সিনিয়র পি সি সরকার গত হয়েছেন অনেক কাল আগেই। কিন্তু এখন খােদ কলকাতার বুকেই কলকাতার বহু নাগরিকের চোখের সামনে বসেই ওই খেলা দেখাচ্ছেন এক পিসি। কালীঘাট পাড়ার অতি প্রাচীন এক নিম্নবিত্ত পাড়া হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটে পিসি-র জাদুদণ্ডের ছোঁয়ায় এক এক করে নির্বাসনে চলে যাচ্ছেন বাসিন্দারা যারা ওই অঞ্চলে বাস করছেন ২/৩ কিংবা ৪/৫ পুরুষ ধরে আদিগঙ্গার জোয়ারের জল ঠেলে, কাছেই রেডলাইট এরিয়ার যন্ত্রণা সয়ে। রাতারাতি হাপিস হয়ে যাচ্ছেন সেই সব ভাড়াটিয়ারা যাঁরা স্বল্প পয়সায় অন্ধকূপে জীবনযাপন করতেন দিনভর রিক্সা টেনে বা মুদির দোকানে বেগার খেটে। এই ছিল এই নেই। ভ্যানিশ হয়ে যাচ্ছে হাবু বাগের পানের দোকান, সুরজের মুদীর দোকান। উচ্ছেদ হয়ে যাচ্ছেন বরুণ দেবনাথ, রবি চক্রবর্তীরা। আর তারপর ওইসব জমিতে লটকে দেওয়া হচ্ছে ‘বিশ্ববাংলা’র লােগাে কিংবা, লিপস্ অ্যান্ড বা কাউন্ডস-এর সাইনবাের্ড, নয়তাে তেরঙা পতাকা লাগানাে তৃণমূল কংগ্রেসের পার্টি অফিস। এই আশ্চর্য দক্ষতায় অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বুজে যায় আদিগঙ্গার গভীরতা। আর দ্য ম্যাজিক ওয়ার্ল্ড সৃষ্টি করে আর এক ওয়ান্ডার– আদিগঙ্গার বুকে কংক্রিটের প্রাসাদ।
গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে এমনি করেই পিসি-র ম্যাজিকে বদলে যাচ্ছে কালীঘাটের কালীঘাট রােড আর হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিট। এক, ৩০বি হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিট ছাড়া। সেখানে আজও সেই টালির চাল যে চালে ঢালের রক্ষা পেয়েছিলেন বহু চিট ফান্ডের কর্তা, সােনা পাচারকারীরা, নীল-সাদা রঙের কারবারি থেকে শুরু করে ক্রিকেট, ফুটবল, বিবেক মেলার কারবারিরা, হয়তাে বা পুরীর কোনও কোনও হােটেল মালিকও।
ঘটনাটা অদ্ভুত। সবাই সব জানে, কিন্তু কেউ জানেনা। সবাই জানে কালীঘাট পাড়ায় যে দুনিয়াদারির সম্রাট—তাদের নাম কার্তিক ব্যানার্জি, স্বপন ব্যানার্জি, অজিত ব্যানার্জি, অভিষেক ব্যানার্জি এমনকী এক বিদেশি নাগরিক মহিলাও। সবাই জানে, রাজ্য রাজনীতির সাম্রাজ্ঞীর পরিবারেই সদস্য এরা সবাই। কিন্তু সবার মুখে কুলুপ। সব সংবাদমাধ্যমের কলম এবং ক্যামেরা বন্ধ। বিরােধী শিবিরও কোনও এক জাদুদণ্ডের ছোঁয়ায় অদ্ভুত নীরবতার শিকার। হাবু বাগের জমিতে উচ্ছেদের পর বসেছিল তৃমমূলের পার্টি অফিস। তিনমাস আগে সেই পার্টি অফিস চলে গেল মুক্তদল মােড়ে। কর্পোরেশনের ৭৩ নম্বর ওয়ার্ডের অফিসের ভিতরেই রমরমিয়ে চলছে পার্টি অফিস। আর জমিটা এখন কার্তিক ব্যানার্জির দখলে। ভাঙাভাঙি চলছে। এবার অপেক্ষা বহুতলের। সবাই জানে, ৪৫/ডি, হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের বাড়ির মালিক ছিলেন চিত্তরঞ্জনবাবু। সেই বাড়ির দখল নিল জনৈক স্বপন দে। তারপর তা হাতফেরত হয়ে চলে এল স্বপন ব্যানার্জির কাছে। ভাড়াটিয়াদের উচ্ছেদ করা হয় গায়ের জোরে। শেষ উচ্ছেদ বাহিনীর শিকার সত্যজিৎ দে— স্বপন দে-র ভাই। এখনও ভাড়াটিয়া আছে দু’ঘর। শুধু উচ্ছেদের অপেক্ষায়। ৩৩ নম্বর হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটে ছিল জ্ঞান সিংহের জিভে জল আনা রুটি-তরকার হােটেল। এখন? নেই। পাশেই ছিল প্রহ্লাদ কাকার হােটেল। এখন? হাওয়া। আজ্ঞে হ্যাঁ ওখানেই জন্ম নিয়েছে স্বপন ব্যানার্জি ওরফে বাবুনের ঝাঁ তকতকে ক্লাব স্পাের্টস লাভাের্স অ্যাসােসিয়েশন। পুলিশও জানে ৮০ বি,হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের বাসিন্দা দীপক হাজরা আর তার দিদি তাদের জমি ও গ্যারেজ গায়ের জোরে দখলের বিরুদ্ধে থানায় এফ আই আর করেছন। মারধরও খেয়েছেন। পুলিশ চুপ, প্রশাসনও চুপ।
আজ্ঞে হ্যাঁ, চুপিচুপিই, প্রায় নিঃশব্দেই হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিট আর কালীঘাট রােড-সহ গােটা কালীঘাট পাড়াটাই ব্যানার্জি পাড়া হয়ে উঠছে। ইতিমধ্যেই সেখানে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে তিনতলা একটি হােয়াইট হাউস। যার মালিক সাংসদ অভিষেক ব্যানার্জি। সেই বাড়ির ছাদে সুইমিং পুল। দোতলা, তিনতলায় ওঠার জন্য এসক্যলেটার। অজস্র পিতলের ও রুপার তৈরি থাইল্যান্ডিয় বুদ্ধমূর্তি ও অন্যান্য মূর্তি। আর এক কোটি টাকা মূল্যের এক অনবদ্য ঝাড়বাতি।
ব্যবসা? প্রতারণা?নাকি লুট? আর সব কিছুই কি ওই টালির চালের বাসিন্দার মহিমায় যিনি সততার প্রতিমূর্তি হয়ে ঝোলেন কাটআউটে রাস্তার ধারে ল্যাম্পপােস্টে, গাছের ডালে কিংবা মেট্রো রেলের পিলারে ? এ সবই কি তারই অনুপ্ররেণায় যিনি কথায় কথায় মা মাটি মানুষ, নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, অতুলপ্রসাদ, বিবেকানন্দ, যিশুখ্রিস্ট, মহম্মদ আউড়ান? আর ভােটের মুখে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামােদরদাস মােদীর নামে মিথ্যা আরােপ চড়িয়ে গলাবাজি করেন? মুসলমানদের তুষ্ট করতে হিজাব পরেন। হিন্দুদের তুষ্ট করতে গঙ্গাজল ছেটাতে বলেন কিন্তু নিজে ছেটান না।
অতি সম্প্রতি প্রকাশ্যে চলে এসেছে আরও এক ভয়ঙ্কর কাহিনি আর তা নিয়েই এখন রাজ্যরাজনীতি তােলপাড়। জানা গিয়েছে, হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটেই ‘সততার প্রতিমূর্তি’র ঘরে বাসা বেঁধেছেন তাইল্যান্ডের এক নারী। তিনি পিসি-র ভাইপাের স্ত্রী। তার জন্ম ব্যাঙ্ককে। নাম রুজিরা নারুলা। বিয়ের পর হয়েছেন রুজিরা নারুলা ব্যানার্জি। ২০১০ সালের ৮ জানুয়ারি তাইল্যান্ডে ভারতীয় দূতাবাস তাকে পার্সন অব ইন্ডিয়ান অরিজিন (পিআইও) কার্ড অনুমােদন করে। ওই কার্ডের জন্য রুজিরার করা আবেদনপত্রে তার বাবার নাম লেখা হয়েছিল নিফন নারুলা। ২০১৩ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্ট অনুযায়ী তার বিয়ে হয় অভিষেক ব্যানার্জির সঙ্গে। ২০১৭ সালে রুজিরা কলকাতার এফ আর আর ও অফিসে পি আই ও কার্ড পরিবর্তন করে ওভারসিজ সিটিজেন অব ইন্ডিয়া (ওসিআই) স্ট্যাটাসের জন্য আবেদন করেন। সেই আবেদনের সঙ্গে তিনি ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ সালে সংগঠিত তার বিয়ের সার্টিফিকেটের নথি জমা দেন। কিন্তু রহস্যটা দানা বাঁধে যখন দেখা যায়, ওই নােটিশে রুজিরাতার বাবার নাম লেখেন গুরু গুরুশরণ সিংহ আহুজা। ঠিকানা দিল্লির রাজৌড়ি গার্ডেন। এখানেই শেষ নয়। নিজের তাইল্যান্ডের নাগরিকত্ব গােপন করে ২০০৯ সালের ১৪ নভেম্বর রুজিরা প্যান কার্ডের জন্য আবেদন করেন। সেখানেও তাঁর বাবার নাম লেখা হয় গুরু গুরুশরণ সিংহ আহুজা। তাহলে তার পাসপাের্টে বাবা হিসেবে উল্লেখ করা নিফিন নারুলা কে? কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের উ পসচিব মনােজকুমার ঝা’র অভিযােগ, তাইল্যান্ডের নাগরিক হিসেবে প্যান কার্ডের জন্য রুজিরা ৪৯এএ ফর্মে আবেদন করার কথা। কিন্তু স্থানীয় পুলিশ জোর করে তাঁকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। এই অভিযােগের পরিপ্রেক্ষিতেই রাজ্যের সিপিএম বিধায়ক সুজন চক্রবর্তী খােলা প্রেস কনফারেন্সে প্রশ্ন তুলেছেন— (১) ওই ভদ্রমহিলা নাকি চিকিৎসার জন্য মাঝেমাঝেই ব্যাঙ্কক যান। কিন্তু ব্যাঙ্কক তাে চিকিৎসার জন্য বিখ্যাত নয়। তাছাড়া কী এমন অসুস্থতা যে এক মাসের মধ্যে তাকে ২১ বার ব্যাঙ্কক যেতে হয়েছে?
(২) তিনি কেন নিজের পরিচয় গােপন করছেন? উদ্দেশ্যটা কী?
(৩) মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে একজন বিদেশি নাগরিক বাস করছেন কেন?
এই ঘটনার পরপরই সংবাদপত্রে দেখা গেল, যাদবপুর লােকসভা কেন্দ্রের তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী মিমি চক্রবর্তী প্রকাশ্যে জনসভায় ঘােষণা করেছেন, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আমার মা।” নিঃসন্দেহে এটা কথার কথা। যেমনটি মুখ্যমন্ত্রীকে ‘জঙ্গলমহলের মা’ বলেছিলেন প্রাক্তন আইপিএস অফিসার ভারতী ঘােষ। তবে নিন্দুকদের নজর তাে কিছুই এড়ায় না। তারা তাই প্রশ্ন তুলেছেন—তৃণমূল কংগ্রেসে সবার বাবা মা নিয়ে নিত্যনতুন তথ্য কেন? কদিন আগেই মুখ্যমন্ত্রী তার বাবাকে ‘স্বাধীনতা সংগ্রামী’ বলে ফেললেন। এখন আবার মিমি চক্রবর্তী…। কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরােবে না এসব প্রশ্ন আগে ওঠেনি। এখন উঠছে, কারণ স্বাধীনতা পূর্ববর্তী এবং পরবর্তীকালে জাতীয় স্তরে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতির অভিযােগ উঠেছে একটি পরিবারের বিরুদ্ধেই নেহরু বা গান্ধী পরিবার। এখন স্বাধীনতা প্রাপ্তির ৭২ বছরে রাজ্যস্তরে পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে বেশি দুর্নীতির অভিযােগ একটি পরিবারের বিরুদ্ধে ব্যানার্জি পরিবার। টালির চাল দেখে ঘাবড়ে গেলে চলবে না। কেঁচোই বলুন আর সাপই বলুন— সবই আছে ওই টালির চালের আশীর্বাদে।
সনাতন রায়
2019-04-29