আশির দশকের গোড়া থেকে খলিস্তানি জঙ্গিদের নিয়মিত ভাবে অস্ত্রশস্ত্র জোগাতে শুরু করেছিল পাকিস্তানের গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই। শিখ দেহরক্ষীদের হাতে ইন্দিরা গান্ধীর হত্যার পরে প্রধানমন্ত্রী হলেন রাজীব গান্ধী। তিনি ভারতের গুপ্তচর সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং ওরফে র’-এর কর্তাদের ‘পাল্টা মার’ দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। র’ দুটো গোপন দল তৈরি করল— ‘টিম এক্স’ ও ‘টিম জে’। প্রথমটির কাজ ছিল, খলিস্তানিদের মদতের জবাবে পাকিস্তানকে পাল্টা মার দেওয়া। দ্বিতীয় দলটির কাজ ছিল খলিস্তানি জঙ্গি নেতাদের নিশানা করা। ভারতের মাটিতে খলিস্তানি সন্ত্রাসবাদীদের প্রতিটি হামলার জবাব লাহোর বা করাচির মাটিতে দেওয়া হত।
গত জুন মাসে নিষিদ্ধ সংগঠন খলিস্তান টাইগার ফোর্সের নেতা হরদীপ সিংহ নিজ্জরকে কানাডার পশ্চিম প্রান্তের প্রদেশ ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার গুরুদ্বারের সামনে গুলি করে খুন করা হয়েছিল। তিন মাস পরে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো অভিযোগ তুলেছেন, নিজ্জরের খুনে ভারতের ‘এজেন্ট’-দের হাত রয়েছে। কানাডার বিদেশ মন্ত্রক সে দেশে ভারতীয় কূটনীতিক হিসেবে নিযুক্ত পবন কুমার রাইকে কানাডায় র’-এর ‘স্টেশন চিফ’ হিসেবে চিহ্নিত করে দেশে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। পবন পঞ্জাব পুলিশের ‘দাবাং অফিসার’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ভারত অবশ্য কানাডার অভিযোগ স্বীকার করেনি। উল্টে প্রশ্ন তুলেছে, নিজ্জরের নামে ‘রেড কর্নার নোটিস’ থাকা সত্ত্বেও কানাডা কেন তাকে নাগরিকত্ব দিয়েছিল!
নিজ্জরের নাম নিহতের তালিকায় প্রথম নয়। গত এক বছরে একের পর খলিস্তানি জঙ্গি সংগঠনের নেতারা কেউ পাকিস্তানে, কেউ ব্রিটেনে রহস্যজনক ভাবে খুন হয়ে গিয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই দিল্লির রাজনৈতিক শিবিরে প্রশ্ন উঠেছে, রাজীব গান্ধীর আমলে ‘টিম-জে’-র জমানা কি আবার ফিরে এল?
কেন্দ্রীয় সরকারের কেউই এ নিয়ে মুখ খুলতে রাজি নন। রাজনৈতিক নেতারা অবশ্য বলছেন, সাম্প্রতিক ঘটনাবলি ‘টিম-জে’-র প্রত্যাবর্তনের দিকেই ইঙ্গিত করছে।
কী সেই ঘটনাবলি?
গত মার্চ মাসে খলিস্তান-পন্থীরা লন্ডনে ভারতীয় হাই কমিশনের দফতর থেকে ভারতের জাতীয় পতাকা নামিয়ে ফেলার চেষ্টা করেছিল। নিরাপত্তারক্ষীরা তাতে বাধা দেন। সিসি টিভি ফুটেজ দেখে চিহ্নিত করা হয়, ভিড়ের নেতৃত্বে ছিল নিষিদ্ধ সংগঠন খলিস্তানি লিবারেশন ফোর্সের প্রধান অবতার সিংহ খান্ডা। এক মাসের মধ্যে বার্মিংহামের হাসপাতালে বিষক্রিয়ায় খান্ডার মৃত্যু হয়। প্রায় একই ভাবে ২০২১-এ মোহালিতে পঞ্জাব পুলিশের দফতরে হামলায় অভিযুক্ত হরবিন্দর সিংহ সান্ধু পাকিস্তানের হাসপাতালে ওষুধের বিষক্রিয়ায় মারা গিয়েছে। ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের আইসি-৮১৪ বিমান অপহরণে জড়িত জ়াহুর মিস্ত্রিকে গত বছর মার্চে কে বা কারা রাওয়ালপিন্ডিতে গুলি করে মারে। তার এক মাসের মধ্যে হিজবুল মুজাহিদিন কমান্ডার বশির অহমেদ পীরকে রাওয়ালপিন্ডিতে গুলি করে মারা হয়। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে আবার অল বদরের কমান্ডার সৈয়দ খালিদ রাজা করাচিতে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির গুলিতে মারা যায়।
রাজীব গান্ধীর আমলে যে ‘গোপন প্রত্যাঘাত’ শুরু হয়েছিল, ইন্দ্রকুমার গুজরাল প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে তা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ‘গুজরাল ডকট্রিন’-এর বিদেশনীতি পাল্টা মারের অনুমোদন দেয়নি। অটলবিহারী বাজপেয়ীর জমানাতেও সেই নীতি বজায় ছিল। মনমোহন সিংহের জমানাতেও পাল্টা মারের অনুমতি মেলেনি।
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বাহিনীর এক উচ্চপদস্থ কর্তার বক্তব্য, বিদেশের মাটিতে সব সময়েই গুপ্তচর বাহিনীর গোপন ‘অ্যাসেট’ থাকে। তাঁরা শুধু গোয়েন্দা তথ্যই জোগাড় করেন না, পাল্টা মারও দেন। প্রয়োজন শুধু সরকারি অনুমোদনের। অবসরপ্রাপ্ত গোয়েন্দাদের বক্তব্য, মনমোহন সরকারের আমলে র-এর সঙ্গে আফগানিস্তানের গুপ্তচর সংস্থা রিয়াসত-এ-আমনিয়াত-এ-মিলি বা এনডিএস (ন্যাশনাল ডিরেক্টরেট অব সিকিউরিটি)-র ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ তৈরি হয়েছিল। ২৬/১১-র জঙ্গি হামলার পরে পাকিস্তানে এনডিএস-এর ‘অ্যাসেট’-দের কাজে লাগিয়ে লস্কর-ই-তইবা প্রধান হাফিজ সইদের উপরে হামলার ছকও কষা হয়েছিল। কিন্তু রাজনৈতিক অনুমোদন মেলেনি।
এখন কি সেই অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে? এ দেশের ‘র’ কি আমেরিকার সিআইএ, ব্রিটেনের এমআই সিক্স বা ইজরায়েলের মোসাদ হয়ে উঠছে?
কেন্দ্রীয় সরকারের এক শীর্ষকর্তা বলেন, ‘‘কানাডা অভিযোগ তুলেছে, নিজ্জরের খুনে আমাদের হাত রয়েছে। আমরা বলেছি, নিজ্জরকে আমরা মারিনি। গল্প এখানেই শেষ।’’