লেখাপড়া শিখে শুধু চাকরিই কেন করতে হবে? সেই বিদ্যে চাষের কাজেও তো লাগানো যায়! প্রমাণ করে দিয়েছেন সন্তোষ দেবী।
মরু রাজ্যে তাঁর বাড়ি। যেখানে জলাভাব তীব্র। চরম আবহাওয়া। শীতে প্রবল শীত, গরমে দহন। সেখানেই মাত্র এক একর জমিতে চাষ করে সোনা তুলেছেন ঘরে! ও টুকু জমি থেকেই বছরে এখন আয় হয় নয় নয় করে প্রায় ২৬ লক্ষ টাকা।
রাজস্থানের সীকর জেলার বৈরীতে থাকেন সন্তোষ। এক ছেলে ও এক মেয়ে। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডী পেরনোর পর তাঁদের চাকরিমুখো হতে দেননি। নামিয়ে দিয়েছেন ক্ষেতে! বাকিটা রূপকথার মতোই।
পারিবারিক সূত্রে বরাবরই ওটুকুই জমি সন্তোষ দেবীদের। এক একর। তাতে সামান্য যা চাষ হয় তা থেকে টেনেটুনে সংসার চলে। কিন্তু গতানুগতিক কোনও কালেই পছন্দ ছিল না সন্তোষ দেবীর। কী ভাবে আয় বাড়ানো যায় তা নিয়ে অহোরাত্র ভাবতেন।
কলকাতায় বিজ্ঞান উৎসবে যোগ দিতে এসেছিলেন সন্তোষ।তিনি জানালেন, ২০০৮ সালে রাজস্থানে উদ্যানপালন বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন তিনি। তার পর তাদের পরামর্শেই শুরু করেন ডালিম ফলাতে। কোনও রকম রাসায়নিক সার ব্যবহার করা বন্ধ করে দেন। আজকাল রাসায়নিক সার–ব্যতীত ফল-ফসলের কদর বাড়ছে। যাকে অর্গানিক ফুডও বলেন অনেকে। সেই ফর্মুলাই কাজে লাগান সন্তোষী। আয় বাড়তে থাকে। বছর খানেকের মধ্যেই আয় বেড়ে দ্বিগুণও হয়ে যায়।
শুধু ডালিম চাষে থেমে না থেকে সন্তোষ এ বার জমিকে তিন ভাগ করে নেন, এমন ভাবে ভাগ করেন, যাতে ওই জমি থেকে সারা বছর আয় হতে পারে। শুরু করেন পেঁপে ও মুসুম্বি লেবুর চারা লাগানো। তারপর বেল, আমলকি, নাগপুরি কমলালেবু, হাইব্রিড কমলালেবু (কিন্নু), পাতিলেবু, আপেল (এইচআরএমএন ৯৯) প্রভৃতি ফলের গাছ লাগান।
শুধুমাত্র একার চেষ্টা নয়, এই জমিতে কাজে লাগান প্রথমে তাঁর মেয়েকে। তিনি কৃষিবিদ্যায় বিএ পাস করার পর বাড়ির ওই এক একর ‘ক্ষেতি’তে নিজের বিদ্যাবুদ্ধি কাজে লাগিয়ে ফসল বাড়ানো শুরু করেন। তারপরে তাঁর ছেলেও এমএ পাস করে তাঁর শিক্ষাদীক্ষা উজাড় করে দেন ওই এক একর জমিতেই।
জমিতে সোনা ফলতে শুরু করে। তাঁদের পক্ষে আর এই বাগান তদ্বির করা সম্ভব হচ্ছিল না, তাই ধীরে ধীরে শ্রমিক নিয়োগ করতে থাকেন। বাড়তে থাকে তাঁর বাগান থেকে আয়।
উষর রাজস্থানে মাত্র এক একর জমিতে কয়েক হাজার টাকা থেকে বছরে ২৬ লক্ষ টাকা আয়! জমির পরিমাণ আরও বাড়াচ্ছেন না কেন? সন্তোষ দেবী বলেন, “আশপাশের কেউ জমি বিক্রি না করলে কী ভাবে জমি বাড়াব!” অন্য কোথাও তো জমি কেনা যেতে পারে। উত্তরে তিনি বলেন, “তা হলে এই জমিতে পুরো সময় দিতে পারব না আমরা। তাই অন্য কোথাও জমি কেনার কথা আপাতত ভাবছি না।” এখন তাঁর জমির উপরে নির্ভর করে দশটি পরিবার। শ্রমিকের মজুরি ও অন্য খরচ বাদ দিয়ে বছরে ২০ লাখ টাকা মতো তাঁর হাতে থাকে।
সন্তোষ দেবী বললেন, “আমার বড় মেয়ের বিয়েতে প্রত্যেক বরযাত্রীকে দুটো করে গাছের চারা দিয়েছি, মানে রাজস্থানে আরও ৫৫১টি নতুন গাছ লাগানো হল। বেশি গাছ লাগালে পরিবেশও ঠান্ডা হবে।”
কৃষিকাজ ছিল অশিক্ষিতদের জন্য, তাই লেখাপড়া শিখে কেউ চাষ করবে, এমন কথা ভাবাই যেত না। কিন্তু সময়ের সঙ্গে ভাবনা বদলাচ্ছে। সন্তোষ দেবী মনে করেন, বাইরে গিয়ে চাকরি না করে, লেখাপড়া করে শেখা বিদ্যা তো চাষের কাজেও লাগানো যায়, তাতেও তো আর কম রোজগার হয় না।
সন্তোষ দেবী পুরষ্কৃত হয়েছেন। দেশের বিভিন্ন জায়গায় এখন তাঁর ডাক পড়ে বিশেষজ্ঞ হিসেবে। সন্তোষ দেবীর মডেল এখন রাজস্থানের বিভিন্ন গ্রামে ছড়িয়ে দিয়ে সেই এলাকার মানুষের আয় বাড়ানোর চেষ্টা করছে রাজস্থান সরকার। কেন্দ্রীয় সরকারও চাইছে এই মডেলে চাষাবাদ বাড়ুক রাজস্থানে।