১৮৯৮ সালের আগষ্ট মাস, স্বামীজি কাশ্মীরের জাগ্রত দেবীস্থান ক্ষীরভবানী মন্দিরে পুজো দিতে গিয়ে দেখলেন মন্দিরের নিদারুণ ভগ্নদশা। মনে তীব্র ক্রোধ আর হতাশা জন্ম নিল, মনে মনে প্রবল বিদ্রোহী হয়ে উঠলেন মন্দির ধ্বংসকারী মুসলমানদের উপর। “যবনেরা এসে তাঁর মন্দির ধ্বংস করে গেল, তবু এখানকার লোকগুলি কিছুই করল না। আমি যদি তখন থাকতাম, তবে কখনো চুপ করে সে-দৃশ্য দেখতে পারতাম না।” পরধর্মীদের আগ্রাসনে অন্য ধর্মীয় নেতার মনে যেমন ক্রোধের উদয় হয়, তেমনই হল স্বামীজির। তারপরই শুনলেন সেই দৈববাণী, “আমার ইচ্ছা আমি ভাঙা মন্দিরে বাস করব। ইচ্ছা করলে আমি কি এখনই এখানে সাততলা সোনার মন্দির তুলতে পারি না? তুই কি করতে পারিস?”
তিনি মহাকালের উপরই সেদিন ছেড়ে দিয়েছিলেন সমস্ত দায়ভার, তুরীয় অবস্থায় তাঁর উপর মহাশক্তি ভর করল। কিন্তু সুদূরের সলতে পাকানোর দায়িত্ব নিয়ে নিলেন। লিখলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ কবিতা ‘Kali the Mother’, যার পরতে পরতে মহাকালীর তান্ডব, প্রগাঢ় মানসিক অভিভবে ধ্বংসলীলা। আপন বোধকে লক্ষ-কোটি মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিলেন তিনি। কবিতাটি ভারতের সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কাছে এক আবশ্যিক পাঠ হয়ে দাঁড়ালো। আর সেই স্বাধীনতা সংগ্রামও হয়ে দাঁড়ালো হিন্দু জাতীয়তাবাদ। অস্বীকার করার উপায় নেই, যে নবজাগরণের ফলে বাঙ্গালি তথা ভারতবাসী সুপ্তিদশা থেকে জেগে উঠেছিলেন, তা আদতে ছিল হিন্দু নবজাগরণ; তার মধ্যে বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, বিপিনচন্দ্র, অরবিন্দের মত মহান মনীষার কেউই বাদ ছিলেন না।
স্বামীজির ‘Kali the Mother’ কবিতার মধ্যে রয়েছে তাঁর ভাব-শিষ্যদের প্রতি শক্তি-সাধনার আহ্বান, যার ধারাপাত ক্ষীরভবানী মন্দিরকেও লাঞ্ছনা মুক্ত করতে পারে, পারে ভারতীয় উপমহাদেশে ছড়ানো ছিটানো অনেকানেক দেবালয়ের লাঞ্ছনা মুক্তি। সে কাজ স্বামীজির একলার পক্ষে সম্ভব নয়; অনেক স্বামীজির জন্ম নিতে হয়। স্বামীজি তখন ক্লান্ত, অসুস্থ; সনাতনী ধর্মের প্রচার ও প্রসারে জীবনী-শক্তি নিঃশেষ করে ফেলেছেন। তাই কাব্যের মোড়কে স্পষ্টই বার্তা দিলেন আগামী প্রজন্মের প্রতি। দীপ হাতে হাজির হলেন শ্রীঅরবিন্দ; লিখলেন ‘ভবানী-ভারতী’। ‘শ্যামা জননীর মহাপ্রসাদ’ শ্যামাপ্রসাদের বলিদান হল কাশ্মীরে। তারই ধারাবাহিকতায় স্বামীজির ১২০ বছর বাদে আর এক নরেন্দ্র-র হাতে দীপাধার পৌঁছলো। অমিতবিক্রমে জম্মু-কাশ্মীর থেকে বিতর্কিত অস্থায়ী ধারা বিলোপ করে সেই কর্তব্যেরই অখন্ড ধারাবাহিকতা সারলেন তিনি। সেই ধারার কাজ এখনও চলছে। কেবল কাশ্মীরের ইতিহাসই বদল হচ্ছে না, বদল হচ্ছে তার ভূগোলও। এ এক অমিত-অভ্যুত্থান, অমিত-বিক্রম। অতীতের ভুলের পাহাড়কে সরানোর কাজ।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ শাক্ত কবিতা মৃত্যুরূপা মাতা, Kali the Mother কবিতা, “Who dares misery love,/And hug the form of Death,/Dance in Destruction’s dance,/To him the Mother comes.” (সাহসে যে দুঃখ দৈন্য চায়, মৃত্যুরে যে বাঁধে বাহুপাশে,/কাল-নৃত্য করে উপভোগ,/মাতৃরূপা তারি কাছে আসে)। এ যে ভয়ঙ্করের পুজো, মৃত্যুর পুজো, এ যে কাপুরুষের আত্মহত্যা নয়, এ যে শক্তিমানের মৃত্যু সম্ভাষণ! এক এক করে স্বামীজি লিখে চলেছেন মৃত্যুরূপা কালীকে নিয়ে; ‘নাচুক তাহাতে শ্যামা’, ‘My play is done’, ‘Who knows how Mother plays’. ঠিকই তো! জগজ্জননীর অনন্তলীলার কে কবে তল পেয়েছে? “কেবা সে পামর দুঃখে যার ভালবাসা?” হৃদয়কে শ্মশান করে তুলে, স্বার্থ-সাধ-মানকে চূর্ণ করে সেখানে নাচাতে চান শ্যামা-মাকে! মৃত্যু, অন্ধকার, সংগ্রাম ও দুঃখচেতনার এই অন্তর্নিহিতি জারিত করেছিল ভগিনী নিবেদিতাকে।
নিবেদিতা ১৮৯৯ সালের নভেম্বরে পাশ্চাত্যে যাত্রাকালে স্বামীজির কাছ থেকে গভীরভাবে জেনে নিলেন কালী-দর্শন। তিনিও লিখলেন গ্রন্থ, ‘Kali the Mother’; এ যেন মনোময়ী কালী, একেবারেই নিবেদিতার নিজস্বতার ছোঁয়া। তার আগে স্বামীজি তাঁকে দিয়ে বঙ্গদেশে কালীতত্ত্ব প্রচার করিয়ে নিয়েছেন। ১৮৯৮ সালের ১১ ই মার্চ কলকাতার স্টার থিয়েটারে নিবেদিতা বক্তা, ১৮৯৯ সালের ১৩ ই ফেব্রুয়ারি অ্যালবার্ট হলে এবং ১৮৯৯ সালের ২৮ শে মে কালীঘাট মন্দিরেও নিবেদিতার ভাষণ। নিবেদিতার নিজের উপর বিশ্বাস তখন পুরোদমে। এই কালী ভাবনার মধ্যে ফুটে উঠছে মানুষের মনের বিপুল শক্তির আলোড়নের প্রতিচ্ছবি, কালী-সদাশিবের তত্ত্ব। নিবেদিতা লিখতে পেরেছেন এই জন্যই, ততদিনে তাঁর খ্রিস্টিয় সংস্কারের ওপরে কালীর কৃষ্ণছায়াপাতের সূচনা হয়েছে। সৃষ্টিতত্ত্বের রহস্যের পরত সরে যাচ্ছে, কোনো লাস্যময়ীর লীলাচাতুরির হাল্কা ওড়নার ঢাকা সরে যাচ্ছে। যে শিবকালী সাধনাকে জাতি-গঠনের কাজে লাগানোর কথা বলছেন স্বামীজি, সেই শিব-কালীকেই ভারতের চৈতন্য হিসাবে রূপায়িত করলেন নিবেদিতা। ভয়ঙ্করী কালী যেন জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ নারীর ভয়ঙ্কর বাসনা!
ভারতমাতার এক স্বরূপ হচ্ছেন মহাকালী। যিনি ব্রহ্মময়ী, তিনিই দেশমাতৃকা, তিনিই ভারতমাতা। তাই দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দির ছিল বিপ্লবীদের এক মহাশক্তির আধার। রামকৃষ্ণ-সারদা-বিবেকানন্দ এই ত্রয়ী ছিলেন মহাবিপ্লবের প্রতীক। শ্রীরামকৃষ্ণের পদধূলিরঞ্জিত মৃত্তিকা বিপ্লবীদের কাছে ছিল এক tremendous explosive material. শ্রীরামকৃষ্ণ একবার নরেন্দ্রনাথকে বলেছিলেন, “মনে রাখিস ইংরেজরাই এদেশের সর্বনাশ করছে।” স্বামীজি বলেছিলেন আগামী পঞ্চাশ বছর ভারতমাতাই ভারতবাসীর একমাত্র উপাস্য দেবতা। নিবেদিতার আদর্শে ভারতমাতার ছবি আঁকলেন অবনীন্দ্রনাথ। অখণ্ড ভারতবর্ষের সাধনায় ব্রতী হলেন অরবিন্দ। ডি. এল. রায় লিখলেন, “চল সমরে দিব জীবন ঢালি–/জয় মা ভারত, জয় মা কালী!”
পুলিশের নজরও ছিল মঠ মিশন ও তার শাখাকেন্দ্রগুলিতে; ছিল জয়রামবাটিতে মায়ের ভিটেতে। মা সারদার ধারণা ছিল, নরেন বেঁচে থাকলে ‘কোম্পানি’ তাকে জেলে ভরে রাখত। ১৯০৮ সালের ২রা মে মানিকতলা বোমা মামলার অন্যতম আসামিকে ৪৮ নং গ্রে স্ট্রিটের বাড়ি থেকে গ্রেফতারের সময় পুলিশ সুপার ক্রেগান সাহেব অরবিন্দের শিয়রের কাছ থেকে আবিষ্কার করেছিলেন দক্ষিণেশ্বরের পবিত্র মাটিপূর্ণ একটি পাত্র। অগ্নিযুগের বিপ্লবী হেমচন্দ্র ঘোষ বলেছিলেন, তার রক্তে যে চির বিপ্লবের নেশা, তা স্বামীজির স্পর্শে সঞ্জীবিত। স্বামীজি এই শক্তি আবার পেয়েছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণের কাছ থেকে৷ তাই বোমা-বিপ্লবীর আদানপ্রদান ও মত বিনিময়ের গুপ্ত ঠিকানা ছিল দক্ষিণেশ্বরের পঞ্চবটীতলার নির্জন স্থল। তারই পাশে আড়িয়াদহের বাচস্পতি পাড়ায় এক পুরোনো নির্জন বাড়িতে তৈরি হত বোমাবারুদ; তা বিপ্লবীরা ছড়িয়ে দিতেন ভারতের নানাস্থানে। ‘দক্ষিণেশ্বর বোমা মামলা’ ছিল তারই অনুষঙ্গজাত এক গুরুত্বপূর্ণ আইনি পদক্ষেপ।
স্বাধীনতাকামী গুপ্ত বিপ্লবী সমিতিগুলির মূল শক্তি ছিল বাংলার শক্তিভূমি। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়েরের অনুশীলন তত্ত্বের আদর্শে ব্যায়ামের আখড়ার আড়ালে বঙ্গদেশে স্থাপিত হয় সশস্ত্র ব্রিট্রিশ বিরোধী সংগঠন ‘অনুশীলন সমিতি’।এই সংগঠনে যুক্ত ছিলেন অরবিন্দ ঘোষ স্বয়ং। শাক্তদর্শনে বিশ্বাসী ছিল এই সংগঠন। সিস্টার নিবেদিতা, স্বামী সারদানন্দ, জাপানি কাকুজ ওকাকুরার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল সংগঠনের। শরীরচর্চা, লাঠিখেলা, তরোয়াল খেলা, ড্রিল, মুষ্টিযুদ্ধ, কুস্তি শিখতেন সদস্যরা। পাঠ নিতেন নৈতিকতার এবং জাতীয় আধ্যাত্মিকতার। স্বামীজির দর্শন ও দেশপ্রেম তাদের নবচেতনার উন্মেষ ঘটিয়েছিল। নিবেদিতার বাসাও ছিল গুপ্ত সমিতির এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র।
আগামী দিনের জন্য সমস্ত দিক থেকে ভারতবর্ষ প্রস্তুত থাকুক — এটাই শ্রীঅরবিন্দের বাণী, এটাই স্বামীজির কথা। স্বামীজি বলতেন, “স্বাধীন হওয়ার পর আরো পঞ্চাশ বছর লাগবে উঠতে। আর তখন উন্নতির শ্রেষ্ঠ শিখরে আরোহণ করবে ভারত।” স্বাধীন হবার পঞ্চাশ পেরোবার পরই অটলবিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বে এসেছে ভারত; নরেন্দ্র মোদী বলেছেন, তিনি তাঁরই পথ অনুসরণ করে চলেছেন। এ অখণ্ড ভারতবর্ষের মানচিত্রকে সামনে রেখে এ যেন শক্তিমন্ত্রের ধ্যান। এই ধ্যানমন্ত্র তাঁরা কোথায় পেলেন?
বঙ্গসংস্কৃতির আঙিনা থেকেই একদিন বঙ্গীয় যুবকদের শক্তির উৎসকে খুঁজে দিয়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র, শ্রীঅরবিন্দ প্রমুখ। ব্রিটিশ ভারত তখন তোলপাড়। উপস্থাপিত হল বাংলার শক্তি-সাধনার এক অনন্য ধারা। যে বাংলা তন্ত্রের পীঠস্থান, যেখানে আদ্যাশক্তি লীলাময়ী, যেখানে ভগবান মাতৃরূপে সর্বোত্তম বৈশিষ্ট্যে প্রকাশিত, তারই আদলে দেশমাতৃকাকে দেখার চৈতন্য উদিত হল। যুবকেরা তাঁরই মধ্যে খুঁজে নিলেন অফুরন্ত প্রাণশক্তির উপাদান। রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, “কোন অমানুষ/তোমার বেদনা হতে না পাইবে বল!” শক্তি ও সুন্দরের যাবতীয় ভান্ডার যে মাতৃদেবীর মধ্যেই নিহিত, তা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিলেন শ্রীঅরবিন্দ তাঁর ‘দুর্গাস্তোত্র‘-এ। দুর্গাস্তোত্র ভারতবর্ষের জাতীয়তাবাদী মানুষের কাছে একটি অন্যতম সৃষ্টি, পরাধীন ভারতের স্বাধীনতা-সংগ্রামী যুবকবৃন্দের জপমন্ত্র। দেবী দুর্গা এখানে দেশজননীরূপে প্রতিভাত। সকল কাজেই দুর্গাপূজার প্রয়োজনীয়তা, তিমিরবিনাশী আভায় লড়াইয়ে পথ, “বীরমার্গপ্রদর্শিনি, এস! আর বিসর্জ্জন করিব না। আমাদের অখিল জীবন অনবিচ্ছিন্ন দুর্গাপূজা, আমাদের সর্ব্ব কার্য্য অবিরত পবিত্র প্রেমময় শক্তিময় মাতৃসেবাব্রত হউক, এই প্রার্থনা মাতঃ, ঊর বঙ্গদেশে, প্রকাশ হও।।” প্রেক্ষাপট বঙ্গদেশ হলেও, বাংলার তরুণদলের একাত্ম প্রার্থনা হলেও, তা আসলে ভারত-বাণী; তা আসলে বিশ্বজননীর বোধ। মা দুর্গা এখানে কখন যেন বঙ্গভূমি অতিক্রম করে ভারতমাতা হয়েছেন, হয়ে উঠেছেন জগদম্বে। আজও যখন বাঙালি ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ছে জাতীয় বিকাশের ধারাপাতে, নানান চোরাস্রোতে তলিয়ে যাচ্ছে তার যাবতীয় ক্ষাত্রবল, ভীরু-পলায়নপর জাতি হিসাবে প্রতিভাত হচ্ছে অনুক্ষণ, তখন বাঙালি যেন পুনর্পাঠ করে দুর্গাস্তোত্রের টেক্সট। আর নিমেষে শক্তিমান হয়ে অশুভশক্তির টুঁটি চেপে ধরতে পারে। দুর্গাস্তোত্রে পাচ্ছি, মাতঃ দুর্গে! কালীরূপিণি, নৃমুণ্ডমালিনি দিগম্বরি, কৃপাণপাণি দেবি অসুরবিনাশিনি! ক্রূর নিনাদে অন্তঃস্থ রিপু বিনাশ কর। একটিও যেন আমাদের ভিতরে জীবিত না থাকে, বিমল নির্মল যেন হই, এই প্রার্থনা, মাতঃ, প্রকাশ হও।।
ছবি এঁকেছেন শীর্ষ আচার্য।
(#সংগৃহীত)
[জয় মা কালী, জয় বাঙালি।]
কল্যাণ গৌতম