বিসৃষ্টৌ সৃষ্টিরূপা ত্বং স্থিতিরূপা চ পালনে।
তথা সংহৃতিরূপান্তে জগতো’স্য জগন্ময়ে ।
মহাবিদ্যা মহামায়া মহামেধা মহাস্মৃতিঃ।
মহামোহা চ ভবতি মহাদেবী মহেশ্বরী।।
প্রকৃতিস্ত্বং চ সর্বস্ব গুণাত্রয়বিভাবিনী।
কালরাত্রির্মহারাত্রির্মোহারাত্রিশ্চ দারূণা ।।
তুমি ধারণ করে আছ বিশ্বকে, তুমি-ই জগৎ সৃষ্টি করেছ।
তুমি পালন কর সকলকে, সকলের অন্তিমেও তুমি-ই আছ।।
সৃষ্টিরূপে তুমি ব্যপ্ত চরাচরে, এবং পালনে তুমি স্থিতিরূপা।
আবার হে জগন্ময়ী, অন্তিম কালে তুমি-ই দাও সব শেষ করে।।
মহাবিদ্যা তুমি, মহামায়া, মহামেধা, তুমি মহাস্মৃতি।
তুমি-ই সেই মহামোহ, তুমি-ই মহাদেবী, তুমি মহেশ্বরী।।
তুমি-ই প্রকৃতি (আদি শক্তি), তুমি-ই সর্বস্ব, তুমি-ই এনেছ (সেই) তিন গুণ (সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ)।
তুমি কালরাত্রি (সময়ের নিয়ম অনুসারে ধ্বংসের রাত), মহারাত্রি (সমস্ত শেষ হয়ে যাওয়ার রাত), মোহাচ্ছন্ন হয়ে যাওয়ার নিদারুণ রাত্রি ও তুমি।।
দক্ষিণবঙ্গের চন্দ্রকেতুগড়-তমলুকের খ্রিস্টপূর্ব যুগের বেশ কিছু দেবী মূর্তি পাওয়া যায় তাঁদের কেশসজ্জায় গাঁথা রয়েছে দুর্গার পাঁচটি সুপরিচিত প্রহরণ— বাণ, পরশু, অঙ্কুশ, বজ্র ও ত্রিশূল। অন্য দিকে রাজস্থানের নাগোর-এ পাওয়া আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকের এক ফলকে সম্ভবত রয়েছে মহিষমর্দিনী দেবীর প্রাচীনতম নিদর্শন। সেখানে কিন্তু সিংহ নেই, সিংহবাহিনী দেবীর উৎস ভারতের বাইরে বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তবে খ্রিস্টীয় চতুর্থ-পঞ্চম শতকে মধ্য ভারতে আলাদা আলাদা ভাবে সিংহবাহিনী ও মহিষমর্দিনী দেবীর পূজা প্রচলিত ছিল, এমন প্রমাণের অভাব নেই। এই দুইয়ের মিলিত রূপ দেখা যাবে সপ্তম শতকে, দক্ষিণ ভারতের মহাবলীপুরমে।
বাংলায় বহু প্রাচীন থেকেই মহিষমর্দিনী দুর্গার মূর্তি পাওয়া যাচ্ছে। উত্তরবঙ্গ থেকে পাওয়া এমন টেরাকোটা ও পাথরের ভাস্কর্য নিদর্শন রক্ষিত আছে বর্তমান বাংলাদেশের মহাস্থান সংগ্রহশালায়। বাংলায় দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত সিংহবাহিনী ও মহিষমর্দিনী দেবীর পৃথক ও মিলিত, দুই ধরনের মূর্তিরই পূজা প্রচলিত ছিল। তবে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের নিরিখে শুধু সিংহবাহিনীর সংখ্যা কম। সিংহবাহিনী ও মহিষমর্দিনী দেবীর মূর্তির সঙ্গে শিব, গণেশ ও কার্তিককেও দ্বাদশ শতকের মূর্তিতে পাওয়া যাচ্ছে। তবে এই পরিবারে লক্ষ্মী-সরস্বতীর প্রবেশ ঘটল কবে বা কোন পথে, তা বলা কঠিন। গৌতম সেনগুপ্তের মতে, ‘‘দেবীর ভক্তের কাছে লক্ষ্মী এবং সরস্বতী দুর্গার অমিতশক্তির প্রক্ষেপণ, সম্ভবত এই অভিন্নতা বোধ থেকেই প্রাচীন মহিষমর্দিনী সিংহবাহিনী প্রতিমাপার্শ্বস্থ সহচরীদ্বয় মধ্যযুগে রূপান্তরিত হয়েছেন লক্ষ্মী এবং সরস্বতী পরিচয়ে।’’
পাল-সেন যুগের প্রস্তর-ভাস্কর্যে অমিল হলেও মধ্যযুগের মন্দির টেরাকোটায় অনেক ক্ষেত্রেই সপরিবার দুর্গার দেখা মেলে। অন্যতম প্রাচীন নিদর্শন মুর্শিদাবাদ জেলার গোকর্ণ গ্রামের নরসিংহ মন্দিরের (১৫৮০) টেরাকোটা ফলকে মহিষাসুরমর্দিনী— সেটি কিন্তু পুত্রকন্যাবিহীন চতুর্ভুজা মূর্তি।
টেরাকোটায় একই ‘মেড়’ বা চালের মধ্যে সপরিবার দুর্গা রয়েছেন বর্ধমান শহরের সর্বমঙ্গলা মন্দিরে (১৯ শতকের প্রথম ভাগ)। এর সিংহ ঘোড়ার আকৃতি, দুর্গার দু’টি হাত বাকি আটটি হাতের তুলনায় বড়। আবার মন্দির টেরাকোটাতেই দেখা যায়, মেড় থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবী ও তাঁর পুত্রকন্যাদের সাজানো হয়েছে আলাদা ভাবে। এ থেকে প্রমাণিত হয়, এক চালের বাইরে এনে মূর্তি সাজানো আধুনিক শিল্পীদের অবদান নয়, এর প্রচলন ছিল অনেক আগেই। বিষ্ণুপুরের শ্যামরায় মন্দিরে (১৬৪৩) যেমন পাচ্ছি এর প্রাচীন নিদর্শন, তেমনই বর্ধমান জেলার বাহাদুরপুর গ্রামের ১৮ শতকের রঘুনাথ মন্দিরেও রয়েছে এর নমুনা। পুরাণের মতে, দেবী দুর্গার অকালবোধন করেছিলেন স্বয়ং ব্রহ্মা। কৃত্তিবাসী রামায়ণের কাহিনিতে কিন্তু বোধন ও আরাধনা করেন রামচন্দ্র স্বয়ং। বাংলার মন্দিরে কৃত্তিবাসী রামায়ণের প্রভাব সুস্পষ্ট। তাই লঙ্কার রণক্ষেত্রে এই অকালবোধনের দৃশ্য মন্দির টেরাকোটায় দুর্লভ নয়। বর্ধমান জেলার কালনার প্রতাপেশ্বর মন্দিরে (১৮৪৯) মহিষমর্দিনী দেবীকে যুদ্ধরত রাম-রাবণের মধ্যে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখা যায়। রামের দিকে সশস্ত্র বানরসেনা, অপর দিকে রাক্ষসবাহিনী। পুত্রকন্যারা এখানে অনুপস্থিত। কালনারই কৃষ্ণচন্দ্রের পঁচিশচূড়া মন্দিরে (১৭৫১) সপরিবার দুর্গা, সঙ্গে জয়া-বিজয়ার মূর্তি আছে।
পূর্বেই আলোচনা করেছি যে বীরভূমে পটদুর্গাপূজায় যে চিত্র আমরা দেখতে পাই সেগুলি কিন্তু অধিকাংশই কোনো তথা কথিত পটুয়া বা চিত্রকরের আঁকা নয়। মাতৃ আরাধনার একটি মাধ্যমের প্রয়োজন তাই এই চিত্র। চিত্র কোথাও মায়ের মুখচ্ছবি , কোথাও দুর্গা লক্ষ্মী , সরস্বতী ও অসুর, কোথাও সপরিবারে মা। এক্ষেত্রে বলে রাখি দুর্গা লক্ষ্মী , সরস্বতী ও অসুর পট বা মূর্তি কিন্তু সুপ্রাচীন দুর্গার প্রকাশ। তাইতো বলা হয়েছে –
মহাবিদ্যা মহামায়া মহামেধা মহাস্মৃতিঃ।
মহামোহা চ ভবতি মহাদেবী মহেশ্বরী।।
এই সমস্ত ছবির ক্ষেত্রে পূজকরা শিল্পকলার খুব একটা বিচার করেন না।চিত্র সুন্দর হল কিনা অথবা চিত্রটি বাংলার পটের যথার্থ অনুরণ হল কিনা ? এসব প্রশ্ন অবান্তর। পূজায় মায়ের মুখচ্ছবি দরকার তাই একটা দুর্গার মায়ের ছবি হলেই হল। পূজকগন তাই ভক্তিভরে মাথায় তুলে নেন। এই সব ক্ষেত্রে কেউই শিল্প নির্দেশিত শর্তাবলির কথা কোনোভাবেই মনে আনেন না।
আসলে আমার মূল উদ্দেশ্য বাংলার লোকশিল্প অঙ্গনে এবং পূজার ইতিহাসে পটচিত্রের উজ্জ্বল অতীতকে উপস্থাপিত করা। তাই কোনটি চিত্রশিল্পের নিয়ম বা ব্যাকরণ মেনে দারুন ,কোনটি একদম সাধারণ এসব নিয়ে গুরুত্ব বিচার করি না।আমাদের আলোচ্য বিষয় বীরভূমের পটের দুর্গা ও তাঁর পূজার সুলুক সন্ধান।
বীরভূমে বিভিন্ন দুর্গা পট আঁকার কাজ টি করেন বিভিন্ন শিল্পী । প্রথমেই যাদের নাম আসে সিউড়ির মালী পাড়া। সেই যে আগের পর্ব গুলিতে মালাকারদের কথা বলেছিলাম….সেই মালাকার গন।উক্ত এলাকায় শুভঙ্কর মৈত্র , রত্না মালাকার প্রমুখ শিল্পীরা বেশ পরিচিত নাম। আর সেই যে সিউড়ির বড়াবাগানের শিল্পী সমীরণ সরকারের নাম বলেছিলাম, তিনিও বেশ বিখ্যাত আঁকিয়ে।
পটদুর্গার শিল্পী বলতে বীরভূম তথা পশ্চিমবঙ্গে বিখ্যাত নাম হাটসারেন্দির সূত্রধর বংশের শিল্পীদের। দেখা যায় বংশ পরম্পরায় এনারা এই শিল্পের কাজে যুক্ত। দীপঙ্কর ঘোষ মহাশয়ের গ্রন্থের সূত্র অনুসারে এনাদের বংশতালিকা নিম্নলিখিত-
রাজামোহন সূত্রধর
৷
দ্বারকানাথ সূত্রধর
|
মাধব সূত্রধর
|
শিবরাম সূত্রধর
|
কালীপদ সূত্রধর
|
আদরগোপাল সূত্রধর
আদরগোপাল সূত্রধর চার ভাই। তবে অন্য তিনভাই পট আঁকার কাজে প্রবৃত্ত হন নি। বংশধারা শুধুমাত্র তাঁর মধ্যে দিয়েই প্রবাহিত হয়েছে। অন্য ভাইরা পট শিল্পের কাজে প্রবৃত্ত নাহলেও তাঁদের বংশের গুরুপদ সূত্রধর এবং তাঁর পুত্র মানিকচন্দ্র সূত্রধর অঙ্কন শিল্পের প্রখ্যাত ব্যক্তি। গুরুপদ সূত্রধর হলেন কালীপদ সূত্রধরের ভ্রাতা।
অগ্নিমিত্র ঘোষ তাঁর ” হাটসারেন্দির দুর্গাপট ও পটুয়া” গ্রন্থে বলেছেন ” গ্রামের মানুষের বিশ্বাস কালীবাবুর কাজের শক্তি ছিল বর্ণবিন্যাসে, আদর মহাশয়ের তা নেই।কিন্তু আমাদের এমনটি মনে হয় নি। বরং তাঁর বর্ণ বিন্যাসে অভিনবত্ব চোখ এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তিনি শিক্ষিত শিল্পীর ন্যায় ছবিতে রঙ লাগান। তথাকথিত পটুয়াদের মতো নয়।কালীবাবুর পটের লাবণ্য বেশি ঠিকই ,কিন্তু ঔজ্জ্বল্য , দীপ্তি, জৌলুস ও বুদ্ধির ছাপ অনেক বেশি আদরবাবুর ক্ষেত্রে এমনটি হয় না। পটের রেখার রঙের আকারের যে সরল যোগাযোগ চোখকে তৃপ্তি প্রদান করে তাই পাওয়া যেত কালীবাবুর কাজে। আদর গোপাল বাবুর বিশ্বাস শুধু সরল যোগ নয় জরুরি বৌদ্ধিক ছাপও। দুর্গা পটকে বাঁচিয়ে রাখতে গেলে এখনই নিতে হবে রঙ রেখার সাম্প্রতিক চাপ।তিনি বলেন – বিষয় আমরা পরিবর্তন আনতে পারি না। কিন্তু শৈলীতে পরিবর্তন আনা সম্ভব।যদি ঠিক পথে তা করতে পারি , তাহলে আরও কিছু বছর বাঁচিয়ে রাখা যাবে কিছু বছর। ” শোনা যায় আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন আদরবাবু এবং পেয়েছিলেন সার্থকতা, উল্লেখযোগ্য তিনিতা জীবিত কালে দেখে যেতে পেরেছিলেন।
আদরবাবু, কালীবাবু ,গুরুপদবাবু , মানিকবাবু যেখানে শিল্পী সেখানে আধুনিক শিল্পীরা বাংলার পটের সাধারণ সহজ, সরলতা, রঙ, রেখার বুনন দেখাতে পারেন না। তাঁদের নিকট তা হয়ে ওঠে আর্ট ওয়ার্ক।
বিকাশ দলুই ( পানুরিয়া) , তাপস বন্দ্যোপাধ্যায় ( সিউড়ি) , তাপস মুখপাধ্যায় ( সিউড়ি) , শ্যামল দে ( চন্দ্রবাড়ি , সেনবাড়ি, কড়িধ্যা) , সমীরণ সরকার ( রায়বাড়ি, চোরমুড়) , নেপাল মালাকার ( দে পরিবার : রাজনগর, নন্দী বাড়ি, নাকাশ: রাজনগর) , বিপত্তারন দাস বৈষ্ণব ( ধরবাড়ি : লোকপুর) , নবকুমার চিত্রকর ( সরকার পরিবার : লম্বোদর পুর), গঙ্গাধর মালাকার ( রায়পরিবার : খটঙ্গা) , সুশীল রুজ ( ছোট বাড়ি নন্দীতলা , মহোদরী ঘোষ বাড়ি, তাঁতিনপাড়া) , গৌরাঙ্গ সূত্রধর ( পাল বাড়ি : জলন্দি) , শ্যামা পটুয়া ( চৌধুরী পরিবার : গণপুর) , নিহার রায় ( মন্ডলবাড়ি : গণপুর) , লালন কবিরাজ ( বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার : পাঁচরা) , বুদ্ধদেব মালাকার ( রায় পরিবার : খরুন) – এদের মধ্যে কয়েকজন মালাকার, একজন পটুয়া , বাকি সবাই পটুয়া বা মালাকার বা চিত্রকর নন। বাকিরা প্রোয়জনে পট আঁকেন। বীরভূমের পটচিত্র ধারার অনুপুঙ্খ অনুসরণ হয় । তবে এমন পট আঁকিয়েও পাওয়া যায় যাঁর মজুরি ১০০ কি ২০০ টাকা। অর্থাৎ ব্যাপারটি নিয়ম রক্ষার্থে সাম্মানিক। যেমন – কীর্ণাহার গ্রামের রায় চৌধুরী পরিবারের দুর্গা পট আঁকেন গ্রামের একটি ছেলে। তাঁর সম্মান দক্ষিণা ১০০ টাকা। মানিক সূত্রধরের দক্ষিণা ৩০০০ টাকা। বাজার থেকে কিনে আনা ( মালিপাড়া ,সিউড়ি) সপরিবারে দুর্গা পটের দাম ৯০০- ১০০০ টাকা। এগুলি পূজা সামগ্রীর ন্যায় একটি অত্যাবশ্যকীয় সামগ্রীর দাম মাত্র।
প্রথম আদি তব শক্তি–
আদি পরমোজ্জ্বল জ্যোতি তোমারি হে
গগনে গগনে ॥
তোমার আদি বাণী বহিছে তব আনন্দ,
জাগিছে নব নব রসে হৃদয়ে মনে ॥
তোমার চিদাকাশে ভাতে সূরয চন্দ্র তারা,
প্রাণতরঙ্গ উঠে পবনে।
ত্বং শ্রীস্তমীশ্বরী ত্বং হ্রীস্ত্বং বুদ্ধির্বোধলক্ষণা।
লজ্জা পুষ্টিস্তথা তুষ্টিস্ত্বং শান্তিঃ ক্ষান্তিরেব চ ।।
তুমি শ্রী, তুমি ঈশ্বরী, তুমি নম্রতা, তুমি বোধসম্পন্ন বুদ্ধি ।
তুমি লজ্জা, তুমি পুষ্টি, তুমি তুষ্টি, তুমি শান্তি, তুমি-ই ক্ষান্তি-ও।।
বীরভূম বীর রাজার সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত। আর পটের দুর্গা আলোচনায় যদি সেই রাজার বংশধরদের পূজার কথা না বলি তাহলে এ আলোচনাই ব্যর্থ। আর যদি না বলি রাজনগরের দে পরিবারের কথা। জামিরার সিংহ পরিবার , বড়গাঁ র সিংহ পরিবার , ইন্দ্রাগাছার চট্টোপাধ্যায় পরিবার, জলন্দির পাল পরিবার , গনপুরের চৌধুরী ও মন্ডল পরিবার, মহোদরী গ্রামের পূজার কথা না বললে লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যায়….
খটঙ্গা বড়বাড়ি রায় পরিবার বীর রাজার বংশধর। এই পরিবারের পটের দুর্গা পূজার বয়স আনুমানিক ৯০০ বছর। বীররাজার রাজধানী ,রাজ্যপাট ছিল বীরসিংহপুর ( বর্তমান সিউড়ির অনতি দূরে) । বীরসিংহপুরে রয়েছে বীর রাজা স্থাপিত মগধ রাজ জরাসন্ধ পূজিতা মা কালীর পাষান মূর্তি ও মন্দির। তাই পরিবারে মা দুর্গার পট পূজা হয়। সেই ঘটে পটে পূজা। লাঙ্গুলিয়ার মালাকারগন পট সরবরাহ করেন। এটাই নিয়ম এই পরিবারের। পূর্বে নবপত্রিকা তৈরি হতে ৪ টি মান পাতা দিয়ে। বর্তমানে একটি পাতা গোলবাড়ির পূজা প্রতিষ্ঠার জন্য দেওয়া হয়। বড়বাড়ির তিনটি শরিক আছেন। পূজা হয় শাক্ত মতে। কিন্তু একদিকে মন্দির অন্যদিকে রঘুনাথ মন্দির। নিত্য সেবা হয় তাঁদের। রঘুনাথ দামোদর মন্দিরের সকল কিছু বৈষ্ণব মতে। শাক্ত , শৈব, বৈষ্ণব মতের সম্বনয় বীরভূমের বহু দুর্গা পূজার চত্বরে দেখা যায়। নানা সাহিত্যে এর মিলনের কথা জানা যায়। সেই যে একবার ভুষন্ডি রামায়ন নিয়ে বলেছিলাম। পাকুড় রাজ পৃথ্বীচন্দ্র রচিত সেই বিখ্যাত গৌরীমঙ্গল ও ভুষন্ডি রামায়ন – দুইটি গ্রন্থের অন্তর্গত সুট বলা যায় শাক্ত ও বৈষ্ণব মিলন। খটঙ্গা বড়বাড়ি রায় পরিবারের বেশ কিছু দেবত্তর সম্পত্তি আছে। মহলে রয়েছে ৮ – ১০ বিঘা ও কালিদহে মৌজায় ,ময়ূরাক্ষীর অপর পারে ১ হাল। এছাড়া ৫ টি দেবত্তর পুকুর আছে।জমি ও পুকুর হতে বাৎসরিক আয় সবই পূজায় লাগানো হয়। পূজায় প্রতিদিন বলি হয়। বোধনে ১ , সপ্তমীতে ১ , অষ্টমীতে ২ , নবমী ও দশমীতে ১ করে ছাগ বলি হয়। দশমীর বিসর্জনের পর কালীবাড়িতে পূজা ও বলিদান হয়। এই পরিবারেই আছে বিজয় যাত্রা প্রথা। এখন এর নাম যাত্রাসাৎ। বিজয়ার দিন অস্ত্র ও যন্ত্র পূজার প্রথাও রয়েছে।
খটঙ্গা গোলাবাড়ির রায়পরিবারের পূজা প্রায় ৩০০ বছরের পুরাতন। মানে ৩০০ বছরের হিসাব পাওয়া যায়। মূল বীর রাজবাড়িতে কোনো একটি ঝামেলার নিমিত্ত এখানে পূজার সূচনা হয়। পূজার এখন ৫ শরিক। মূল রাজবাড়ি অর্থাৎ খটঙ্গা বড়বাড়ি রায় পরিবারের নবপত্রিকা হতে একটি মানপাতা এনে এখানে পূজার প্রতিষ্ঠা হয়। কিন্তু বংশের দেবী যেহেতু মগধেশ্বরী কালী তাই পটে দুর্গা পূজা হয়। একবারই নাকি মূর্তি পূজা হয়েছিল কিন্তু তা পরিবারের সহ্য হয় নি, নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়।ফলে আর কোনোদিন নিয়ম ভঙ্গ হয় নি। শোনা যায় কিতুরি নান্না বলে একটি স্থানে এনাদের জমিদারী ছিল।সেখান হতে ৬০ টাকা খাজনা আসত। সেই টাকায় পূজা হত। বর্তমানে ৪ টি পুকুর ও ৫ বিঘা দেবত্তর সম্পত্তি থেকে পূজার খরচ আসে। ৬০ টাকার পূজা খরচ এখন বৃদ্ধি পেয়ে ৪০-৫০ হাজার টাকা হয়েছে। পূজার জন্য প্রায় ৮ থেকে ১০ জন বেতন ভোগী কর্মচারী আছেন। এনারা ৫ দিনের নির্দিষ্ট বেতন পান। সে পুরোহিত থেকে ঢাকি , ফল কাটা থেকে ঝাঁট দেওয়া , নিত্য ভোগ সবের জন্য নির্দিষ্ট অর্থ ধার্য থাকে। বংশ পরম্পরায় পট আঁকেন ভাণ্ডারীবনের মালাকাররা। এখন পট আঁকেন গোপালপুর গাঁয়ের গঙ্গাধর মালাকার। পরিবারে বলি প্রথা আছে। শোনা যায় কোনো এক সমাজসেবী পারিবারিক আত্মীয় ( সম্পর্কে কাকা) বলি প্রথা তুলে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কেউই প্রথা ভাঙতে রাজি হননি। পূজা ছাড়াও এই পরিবারের সমাজ সেবার জন্য খ্যাতি আছে। দেবোত্তর সম্পত্তি থেকে গ্রামের রাস্তা , বস্ত্র দান , সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদি হয়ে থাকে।
উক্ত খটঙ্গা রায় পরিবারের থেকেই মাধাইপুর , সুরুল, নগরী ও নডিহার রায় পরিবারের উৎপত্তি।
পরবর্তী পর্বে এগুলি নিয়ে ও আরো কিছু পারিবারিক পূজা নিয়ে আলোচনা করব ।
খড়্গিনী শূলিনী ঘোড়া গদিনী চক্রিনী তথা।
শঙ্খিনী চাপিনী বাণ ভূশূন্ডী পরিঘআয়ূধা।।
সৌম্যা সৌম্যতরাহ্শেষ, সৌম্যেভ্যস ত্বতিসুন্দরী।
পরাপরাণাং পরমা ত্বমেব পরমেশ্বরী ।।
(তুমি)খড়্গ, শূল, ঘোড়া,গদা, চক্রধারিণী।
শঙ্খ, ধনুক, তীরধারিণী, অগ্নি-অস্ত্রসমন্বিতা, লৌহদণ্ড-অস্ত্রসজ্জিতা (দৃঢ় বাধাদায়িনী) ।।
তুমি অপরূপা,
বড়-ছোট (মহাজাগতিক বা পার্থিব) সমস্ত কিছু্র মধ্যে তুমি শ্রেষ্ঠা, তুমি-ই পরম ঈশ্বরী।
ক্রমশঃ
দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ
১. পটের দুর্গা : বীরভূম
২.পট : বিমলেন্দু চক্রবর্তী