#একটি_ইতিহাস_ও_জাতীয়_নাগরিকপঞ্জি

পর্ব_৪


 অন্তিম NRC এর চূড়ান্ত খসড়া প্রকাশিত হবার পরে আসামের সংবাদপত্র গুলির শিরোনাম ছিল লক্ষণীয়। সেখানে বিষয়টি নিয়ে সংবাদ পত্র গুলি নানা ভাবে সংবাদ প্রকাশিত করেছিল। প্রতি সংবাদ পত্রের প্রথম পৃষ্ঠা জুড়ে একটি উৎসবের চিত্র ফুটে উঠেছিল। তার সঙ্গে ছাপা হয় যাঁদের ঘাড়ের উপর নাগরিকত্ব হারানোর খাঁড়া ঝুলছিল তাঁদের প্রতিক্রিয়াও। প্রসঙ্গত নাগরিকত্ব হারানোর মত চরম পরিস্থিতিতে ওই মানুষ গুলি চলমান ব্যবস্থা ও আসাম সরকারের উপর আস্থা হারিয়ে অত্যন্ত ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। তবে তার জন্য আরো খারাপ কিছু হচ্ছে সেটা কিন্তু আসামের কোনো সংবাদ পত্র প্রকাশ করেনি। উপরন্তু সংবাদপত্র গুলিতে NRC র চূড়ান্ত খসড়া প্রকাশের পর আসামের মানুষের প্রতিক্রিয়াতে এক অদ্ভুত ধৈর্য ,বিশ্বাস ও ভারসাম্য প্রতিফলিত হয়েছিল।

২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে আসামের বাসিন্দাদের কাছ থেকে তাদের নাগরিকত্ব প্রমাণের নথি জমা নেওয়া হয় । ২০১৭ সালের ৩১ শে ডিসেম্বর এই প্রক্রিয়া শেষ হয়। ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে এনআরসির প্রথম খসড়া তালিকায় তিন কোটি উনত্রিশ লক্ষ আবেদনকারীর মধ্যে এক কোটি নব্বই লক্ষ ভারতীয় নাম প্রকাশ করা হয় । 

আসাম এনআরসি সম্পূর্ণভাবে একটি সাংবিধানিক ও আইনি বিষয় । কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় খসড়া নাগরিকপঞ্জিটি প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অত্যন্ত স্পর্শ কাতর এই বিষয়টি নিয়ে মেঠো রাজনীতির পথে নামেন নানা সেকুলার ভন্ড রাজনৈতিক দল। তাঁরা বলতে থাকেন এর ফলে নাকি গৃহ যুদ্ধ বেধে যাবে ,রক্তপাত হবে ।  

নোট বন্দীর সময়ও এসব রাজনৈতিক দলগুলি এইভাবে মাঠে নেমে উস্কানি দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন ।এই সব রাজনৈতিক দল এমন ভাবেই উস্কানি দেবার চেষ্টা করেন যাতে জনতা উত্তপ্ত হয়ে গিয়ে ব্যাংক এটিএম গুলিতে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং দেশজুড়ে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি তৈরি হয়। কিন্তু তাঁদের কাছে দুঃখের বিষয় এটা যে এত শত শত প্রোরচনা থাকা সত্বেও সেই সময় মানুষ শান্ত থেকেছেন। সৌভাগ্যের বিষয় যে আসামে প্রায় ১৬ লক্ষ মানুষের নাম বাদ পরা সত্বেও খসড়া প্রকাশকে ঘিরে আসামের মতো সংবেদনশীল রাজ্যে একটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।  এ দুটি বিষয় খুবই পরিষ্কার যে জনতা যথেষ্ট সমঝদার এবং তাঁরা কোন রকম ভাবে ফাঁদে পা দেয়নি । দুই,  রাজ্যে  ও দেশে ভারতীয় জনতা পার্টির সরকার সমস্ত জনগোষ্ঠীর মানুষের বিশ্বাস ও আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন।


 NRC  নিয়ে বিভিন্ন সেকুলার রাজনৈতিক দল গুলি অতিসংবেদন শীল হয়ে গৃহযুদ্ধ ও রক্তপাতের  হুমকি দিয়ে মানুষের কাছে যথেষ্ট ভাবে নিন্দিত হয়েছিলেন । প্রতিক্রিয়া স্বরূপ  অনেকেই আসামে সেই সকল বিরোধীদল গুলিকে পরিত্যাগ করেছেন।  রাজ্য থেকে সেই সব রাজনৈতিক দলগুলোর অস্তিত্ব শূন্য হয়ে পড়েছে।

  গত ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৮ রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাধারণ সভায় বক্তব্য রাখার সময় পাকিস্তানের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে যে আসামে নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়ে রাষ্ট্রহীন করে দেওয়ার চক্রান্ত হচ্ছে। যে নিজে খেতে পায়না সে দেশ পরের দেশের জনগণকে নিয়ে চিন্তা করছে …..এতে কি প্রমাণিত হয় ? প্রমানিত হয় যে  শুধু দেশের ভেতরেই নয় ,কিছু বিদেশী শক্তিও ভারতকে অশান্ত করার জন্য ষড়যন্ত্রে সামিল হয়েছে বছরের পর বছর ধরে। 

বছরের পর বছর ধরে অশান্ত আসামকে এনআরসি পরবর্তী পরিস্থিতিতে শান্ত থাকতে দেখে মরিয়া হয়ে উঠেছে উত্তর-পূর্বের বিভিন্ন অশান্তির কারিগররা। ফল স্বরূপ , ১ নভেম্বর ২০১৮  পাঁচজন বাঙ্গালী হিন্দুকে  গুলি করে হত্যা করা হয়। ক্রমশ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়া প্রাদেশিকতা বিষাক্ত ভাবনায় জারিত বিচ্ছিন্নতাকামী শক্তিগুলো আরেকবার মাথা তোলার সুযোগ পেয়ে যায়। বামফ্রন্ট, অতিবাম এবং সেক্যুলার রাজনৈতিক দলগুলো মাঠে নামার সুযোগ পেলেন এবং বাঙ্গালীর ত্রাতা হয়ে উঠলেন । 

ঘরপোরা গরুর ন্যায় উদ্বাস্তু হওয়ার আশঙ্কা সর্বক্ষণ বাঙ্গালী হিন্দু সেন্টিমেন্টকে তাড়না দিয়ে বেড়ায়। অন্য দিকে নিজের কৃষ্টি সংস্কৃতি হারিয়ে নিজ ভূমে পরবাসী হওয়ার আশঙ্কা তাড়িয়ে বেড়ায় অসমীয়া সেন্টিমেন্টকে। বর্তমানে নাগরিক সংশোধনী বিল ২০১৬ নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আসামে অসমীয়া সেন্টিমেন্টকে ও পশ্চিমবঙ্গে বাঙ্গালী সেন্টিমেন্টকে উস্কে সমস্ত প্রক্রিয়াটি নষ্ট করে দিয়ে দেশবিরোধী শক্তি সক্রিয় হবে না সেটা আশা না করাই ভালো। আবার  রাজনীতির শিয়ালরা ঘোলা জলে মাছ ধরতে নামবেন না ম এটাও ভাবা যায়না ।

 NRC এর খসড়া প্রকাশের পর নাগরিকত্ব হারানো  মানুষের পরিচয় নিয়ে নানা রকম ব্যাখা উত্থাপিত হয়।  বাঙ্গালী সেন্টিমেন্টকে উস্কে দেওয়ার জন্য বহু রাজনৈতিক দল প্রকাশ্যে বলছেন যে, এরা সবাই বাঙ্গালী । মুসলিম ভোট ব্যাংক অটুট রাখার জন্য  মুসলিম এলাকায় গিয়ে রাজনৈতিক দল গুলি  বলছে যে , নাগরিকত্ব হারানোর সিংহভাগ হলো মুসলিম। হিন্দু এলাকায় এসে বলা হচ্ছে যে , এদের সিংহভাগ হিন্দু।  ভারতীয়-মুসলমানদের সঙ্গে বাংলাদেশী মুসলমানদের জুড়ে দিয়ে মুসলিম বিতাড়ন আতঙ্ক ছড়ানো হচ্ছে।  বলা হচ্ছে মায়ানমারের যেভাবে রোহিঙ্গাদের তাড়ানো হয়েছে ঠিক একইভাবে  এনআরসি করে ভারত থেকে মুসলিমদের তাড়ানো হবে । শুধু  নানা সেকুলার রাজনীতি করা দলগুলি যে যেভাবে পারছে সে এনআরসি বিরোধী প্রচার করছে। অর্থাৎ ভারতের স্থিতিশীলতা, অখন্ডতার প্রশ্নে জড়িয়ে আছে এনআরসির মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । তা কেবল আজ রাজনৈতিক স্বার্থ পূরণের উপাদানে পরিণত হয়েছে ।

উগ্র অসমীয়া সেন্টিমেন্টকে বা উগ্র বাঙ্গালী সেন্টিমেন্টকে সরিয়ে রেখে এনআরসি নবায়নের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করা যায় তাহলে দেখা যাবে ধর্মের ভিত্তিতে আবার যেন দেশভাগের পরিস্থিতি তৈরি না হয় সেটাই এনআরসির মূল উদ্দেশ্য । কেউ বাংলায় কথা বললে সে বাঙ্গালী হয়ে যাবে বা কেউ অসমীয়াতে কথা বললে সে অহমিয়া হয়ে যাবে , এই বিভ্রান্তি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ভাষাই যদি ঐক্যের ভিত্তি হত হতো তাহলে দেশ ভাগ হত না ও বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের মতো দুইটি বিষাক্ত রাষ্ট্রের সৃষ্টি হতোনা । ভাষাগত পরিচয়ের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজে মিশে থেকে প্রভাব বিস্তার করা যে ইসলামিক জেহাদিদের পুরনো কৌশল এটা আজ প্রমানিত। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা,  ক্যালকাটা কিলিং, নোয়াখালি গণহত্যা, দেশ ভাগ,  লক্ষ লক্ষ বাঙ্গালী হিন্দুর উদ্বাস্তু হওয়ার ইতিহাস এ কথা বারবার স্মরণ করিয়ে দেয় যে দেশের অখন্ডতা ,ধর্মনিরপেক্ষতা, স্থিতিশীলতা রাখতে গেলে  হিন্দু-মুসলমান ভারসাম্য রক্ষা করা জরুরি ।

ধর্মনিরপেক্ষতা ও সংখ্যালঘু স্বার্থ রক্ষা করা সম্ভব নয় হিন্দু মুসলিম ভারসাম্য রক্ষা না করলে। মহান বুলি আওড়ে যোগনে মন্ডল ব্যতীত অন্য কিছু হওয়া যায় না। তা অনুভব করতে গেলে আসাম ও  পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলোতে যেতে হবে। ভাষা পরিচয়ের আড়ালে নিজেদের প্রকৃত পরিচয় আড়াল করে  হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতে অনুপ্রবেশ করে ,অনিয়ন্ত্রিত জন্মহার ইত্যাদির মাধ্যমে গজবায় হিন্দকে সফল করার কৌশল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় ইসলামিক জেহাদিদের অতি পরিচিত রণকৌশল । 

আসাম ও  পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলো থেকে যথাক্রমে অসমীয়া ও বাঙ্গালী হিন্দুদের নিরন্তর পলায়ন জিহাদিদের সাম্রাজ্য বিস্তারের সেই কৌশলকে স্মরণ করিয়ে দেয় । স্বাধীনোত্তর ভারতে জিহাদিদের সুকৌশলে সংখ্যা বৃদ্ধি   ও ভোটের রাজনীতির সঙ্গে তাকে যুক্ত করা আবার সেই দেশে ভাগের পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে ।  দেশ ভাগের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা সামনে থাকা সত্বেও স্বাধীনতা অর্জনের সাত দশক অতিবাহিত হয়ে গেলেও ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য কোন রাজনৈতিক দল কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করার সাহস দেখায়নি। সেই দিক থেকে এনআরসি জিহাদিদের অনুপ্রবেশের মাধ্যমে সংখ্যা বৃদ্ধির কৌশল মোকাবিলায় একটি কার্যকরী পদক্ষেপ।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে….. এনআরসি বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারীদের কতটা চিহ্নিত করতে পারল? ১৯৯২ সালের এপ্রিল মাসে এপ্রিল মাসে আসামে তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী হিতেশ্বর সাইকিয়া বলেছিলেন যে আসামে ৩৩ লক্ষ অবৈধ অনুপ্রবেশকারী রয়েছেন।  ২০০৪ সালের ১৪ জুলাই কংগ্রেস সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রকাশ জয়সওয়াল রাজ্যসভায় জানান ভারতে ১ কোটি ২০ লক্ষ  ৫৩ হাজার ৯৫০ জন অনুপ্রবেশকারী রয়েছে।  এর মধ্যে রয়েছে আসামে ৫০ লক্ষ ও  পশ্চিমবঙ্গে রয়েছেন ৫৭ লক্ষ। আসামে এনআরসি সংক্রান্ত তথ্য বলেছে যে নাগরিকত্ব থেকে বাদ পড়া মানুষদের মধ্যে একটা অংশ বাংলাদেশি মুসলিম যা হিতেশ্বর সাইকিয়া বা প্রকাশ জয়সওয়ালের পরিসংখ্যান থেকে অনেক কম। 

হতে পারে ২০১০ সালের পাইলট প্রজেক্ট হওয়ার পর অনুপ্রবেশকারীরা সতর্ক হয়ে গিয়ে নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য প্রয়োজনীয় নথিপত্র সংগ্রহ করে রেখেছিল। বাকি নাগরিকত্ব হারানো মানুষের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে আগত বাঙ্গালী হিন্দু উদ্বাস্তু সহ , আদিবাসী জনগোষ্ঠী ও অন্যান্য ধরনের মানুষ আছেন । এই থেকে একথা স্পষ্ট যে এনআরসি করেও আসামে অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশী মুসলিমদের সম্পূর্ণভাবে সনাক্ত করা সম্ভব হয়নি ।অর্থাৎ এনআরসির আসামের জনসংখ্যা ভারসাম্য একেবারেই পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়।

 নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ২০১৬ আইনে পরিণত করে এনআরসি থেকে বাদপড়া হিন্দুদের নাগরিকত্ব দিতে পারলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসবে ….নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ২০১৬  এ বাংলাদেশ ,পাকিস্তান , আফগানিস্থান থেকে অত্যাচারিত নিপীড়িত হিন্দু, শিখ , জৈন, -বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ধর্মীয় সম্প্রদায়ের কোনো মানুষে ভারতে প্রবেশ করলে তাকে উদ্বাস্তু হিসাবে গণ্য করে নাগরিকত্ব প্রদানের কথা বলা হয়েছে।  বলার অপেক্ষা রাখেনা ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের পর এই তিনটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে অমুসলমানদের মানবাধিকার বলে আর কিছু বাকি নেই । 

অমুসলমানদের উদ্দেশ্যে এই দেশগুলোতে বিভিন্ন সময় নানা ধরনের অত্যাচার চালানো হয়েছে। সংগঠিত হয়েছে গণহত্যা।  পাকিস্তান-আফগানিস্তান প্রায় হিন্দু শূন্য। ১৯৫১ সালে বাংলাদেশে কমবেশি ২৪ শতাংশ হিন্দু ছিল বর্তমানে তা ৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। শুধুমাত্র ধর্মীয় কারণে যাঁরা নির্যাতিত তাঁদের ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতেই পুনর্বাসন ও নাগরিকত্ব প্রদানের ভাবনা অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত।

 বিভিন্ন সেকুলার ও দেশবিরোধী রাজনৈতিক দলের সংখ্যা লঘুদের  তোষনের ধর্মনিরপেক্ষতা , মানবাধিকার দোহাই দিয়ে এই বিলে অনুপ্রবেশকারী মুসলিমদের নাগরিকত্ব প্রদানের দাবি তুলেছে। আবার অনেকে এই বিল রূপায়ণ হলে  কাতারে কাতারে বাংলাদেশী হিন্দুরা আসামে আশ্রয় নেবে এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে বাঙ্গালী আধিপত্যের ইস্যু উত্থান করে অসমিয়াদের অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার কথা বলছেন। অতীত অভিজ্ঞতা ও বাস্তব পরিস্থিতি কোনোটাই সমস্ত দাবির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয তা বলাই বাহুল্য । সংখ্যালঘু ভোট ব্যাংকের মোড়কে লুকিয়ে রয়েছে বাংলাদেশে, আসাম , পশ্চিমবঙ্গকে নিয়ে বাংলাস্থান গঠনের জন্য ইসলামিক জিহাদের রননীতি। যে সমস্ত মুসলমান শুধুমাত্র ধর্মীয় কারণে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে পাকিস্তান বুঝে নিয়ে সেখানে বাস করছে তাদের বা তাদের বংশধরকে আবার এখানে নাগরিকত্ব প্রদানের দাবী তোলার অর্থ ইতিহাসকে অস্বীকার করা।

তবে শুধু এনআরসি ও নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ২০১৬ রুপায়ন করেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসা সম্ভব নয় ।যদি না ধর্মমত নির্বিশেষে জন্মনিয়ন্ত্রণের বিধিও কঠোরভাবে বলবৎ হয়।  ২০১৮  ডিসেম্বর পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফলাফল বা ২০১৯ এর দেশব্যাপী কেন্দ্রীয় সরকার নির্বাচনের ফলাফল বলছে আসামের মানুষ নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ইস্যুতে বিজেপির পাশেই আছেন। বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি সাময়িকভাবে পিছু হটতে ও নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাস হওয়ার পর অপপ্রচারের ঝড় তুলে আবার সংগঠিত হওয়ার কোন সুযোগ হাতছাড়া করছে না । গণতান্ত্রিক উপায়ে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমে  এই বিষয় প্রমাণ হয়ে গেছে যে মানুষ নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল বিরোধীদের পক্ষে নেই। 

 সুতরাং উত্তর-পূর্ব ভারতে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা সংগঠনগুলির সামনে একটি পথ, তা হল ব্যাপক সন্ত্রাস, বনধ, অবরোধ, হুমকি-ধমকির মত নেতিবাচক ক্রিয়া-কলাপের মাধ্যমে নিজেদের ঋণাত্মক শক্তি প্রদর্শন করা।আসাম ও পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে সঙ্গে ভারত  বাংলাদেশের সীমান্ত দৈর্ঘ্য যথাক্রমে ২৫৬ ও ২২১৭  কিলোমিটার। আসামে যদি এক বিরাট সংখ্যায় অনুপ্রবেশকারী ঢুকতে পারে তাহলে আসামের তুলনায় নয় গুন বেশি দৈর্ঘ্য   সীমান্ত দিয়ে কত বাংলাদেশের মুসলিম পশ্চিমবঙ্গে ঢুকতে পারে তা কল্পনা করাও কঠিন । গদি বাঁচানোর তাগিদে যে সমস্ত রাজনৈতিক দল বিষয়টির সমর্থন করছেন তাঁরা  বৃহত্তর ইসলামিক বাংলাদেশ গঠনে সহায়ক হয়ে উঠছেন এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই । সব মিলিয়ে বলা যায় আজ পশ্চিমবঙ্গ বারুদের স্তুপে দাঁড়িয়ে আছে। ইসলামিক জেহাদিদের এই নক্সাকে সর্বসমক্ষে আনতে পশ্চিমবঙ্গতেও NRC এর আসু প্রোয়জন।

 সীমান্ত বরাবর ক্রমাগত অনুপ্রবেশের ফলে ১৯৫১ সালের গণনা অনুসারে আসামে মুসলমানের সংখ্যা ২৪ শতাংশ ছিল সেখান থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০১১ সালের গণনায় তা ৩৪ শতাংশে পৌঁছেছে । আসামে তেইশটি জেলার মধ্যে নয়টি জেলা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ সে কথা আগেই বলেছি এবং ১২৬ সদস্যবিশিষ্ট অসম বিধানসভার মুসলিম সদস্য সংখ্যা ৩০ জন। রিপোর্ট বলছে অসমে বর্তমানে ১৫ টি মুসলিম মৌলবাদী সংগঠন ক্রিয়াশীল আছে। 

এর ফলে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দিকে অনেক সমস্যা উঠে এসেছে। রাজনীতির দিক থেকে দেখতে গেলে আতর ব্যবসায়ী বদরুদ্দিন আজমলের  আশ্চর্য জনক ভাবে রাজনৈতিক উত্থান চোখে পড়ার মতো। বরুদ্দিনের দল AIUDF আসামে বর্তমানে একটি প্রথম সারির রাজনৈতিক দল হিসেবে বিবেচিত হয়। এখন বহু ক্ষেত্রে আসামে বহু দেবোত্তর সম্পত্তি বেদখল হয়ে গিয়েছে এবং এই অনুপ্রবেশকারীদের হাত থেকে ছাড় পায়নি কাজিরাঙ্গা জাতীয় উদ্যান এর জমিও। কয়েক বছর আগে যাদের কোনো অস্তিত্ব ছিল না তারা এখন ভারতীয়দের অস্তিত্ব বিপন্ন করতে প্রস্তুত।  এ প্রসঙ্গে আরও মনে রাখা দরকার যে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা থেকে নির্বাচিত হিন্দুর বাঙ্গালীর সংখ্যা কিন্তু রয়ে গেছে দুই – ই থেকে গিয়েছে। বরাক উপত্যকায় নির্বাচিত বাঙ্গালী হিন্দুর সংখ্যা ক্রমশ হ্রাসমান। 

কাজেই এটা স্পষ্ট যে সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মূল আগ্রাসন কাদের মাধ্যমে হচ্ছে । কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আসামের বিভিন্ন নেতা ,বুদ্ধিজীবী এবং সংবাদমাধ্যম তাদের ক্ষুদ্র স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করছেন । তাদের মূল লক্ষ্য হিন্দু বাঙ্গালীরা। যার ফলে কিছুদিন আগে তিনসুকিয়া হিন্দু বাঙ্গালী গণহত্যা পর্যন্ত ঘটে গেল ।

আলফা জঙ্গী সংগঠনের সঙ্গে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের যোগাযোগ সুবিদিত।  অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এইটি যে আলফার বিভিন্ন নেতাদের সন্তানেরা বাংলাদেশে বাংলাভাষী মুসলমান হিসেবে বড় হচ্ছে। উল্টোদিকে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার হিন্দু বাঙ্গালীরা সকলেই অসমীয়া ভাষায় স্বচ্ছন্দ । অসমীয়া মাধ্যম স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। তাঁরাও বিহু উদযাপন করেন। তন্ত্র ও শক্তির উপাসনা বাঙ্গালীর ঐতিহ্য। দেবী কামাখ্যা বাঙ্গালী হিন্দু সমাজে সম্পূর্ণ ভাবে শ্রদ্ধার সাথে পূজা পান।একই ভাবে বৈষ্ণবভাবধারার  শ্রীমন্ত শংকরদেবও বাঙ্গালী সমাজের নিকট ঈশ্বর স্থানীয়। বাঙ্গালী এবং অসমিয়া সমাজের মধ্যে সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান ঘটে চলেছে বহু যুগ ধরে। 

 রাজা শিবসিংহের গুরুদেব মহন্ত কৃষ্ণরাম ভট্টাচার্য ছিলেন নদীয়ার মানুষ । তাঁর বংশধরেরা এখন অসমিয়া সমাজের অংশ এবং পার্বত্য গোঁসাই হিসেবে সুপরিচিত ।সেজন্য বাঙ্গালী সমাজের  থেকে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের আশঙ্কা নিতান্তই অমূলক ।

 NRC নিয়ে অপপ্রচারের ঝড় তোলা হচ্ছে । যখন আসামে বাঙ্গালী হত্যা সূচিত হয় তখন কিন্তু না ছিল হিন্দুত্ববাদের সুবিশাল ব্যাপকতা , না ছিল বিজেপি বা সঙ্ঘ পরিবার। NRC নিয়ে কংগ্রেস আসামে বিরোধিতা করার সাহস না পেলেও ত্রিপুরায় NRC এর বিরুদ্ধে মিছিল বিরুদ্ধে । তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন ধরনের বামপন্থী সংগঠনগুলো ও  নানা সেকুলার রাজনৈতিক দলগুলো । উক্ত দলগুলি ইতিমধ্যেই আসামের বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাদের আশ্বাস দিয়ে রেখেছেন যে কোনো মূল্যে নাগরিকত্ব বিল রুখে দেওয়া হবে। বিল বিরোধী মিছিলে ভারত বিরোধী স্লোগান দেওয়ার অভিযোগে ত্রিপুরার তিন আদিবাসী নেতার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা পর্যন্ত করতে হয়েছে ত্রিপুরা পুলিশকে। পশ্চিম ত্রিপুরায় রাধানগর থানায় দায়ের করা সেই অভিযোগে বলা হয় ৩০ শে জানুয়ারি সভা করার সময় দেশ বিরোধী স্লোগান দেওয়া হয়  ও তাতে বলা হয় ” বাই বাই ইন্ডিয়া ,হ্যালো চায়না”…এদিকে ৮ ফেব্রুয়ারি শিলচরে মনিপুরী ইউথ ফ্রন্ট অব আসাম বা মাইকা একটি বাইক মিছিল করে। সেখানে সুশান্ত রাজবংশী নামে এক যুবক স্লোগান দেয় ” ওয়েল কাম চায়না , গোব্যাক ইন্ডিয়া ” স্লোগান দেয়। তার বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করা হয় এবং তাকে পুলিশ  এরেস্ট করে। 

উত্তর পূর্ব  ভারতের নাগরিকদের নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক দল এবং আঞ্চলিক দলগুলো তাদের বক্তব্যে এই সমস্ত ভারতবিরোধী ক্রিয়া-কলাপ নিন্দা না করে উল্টে বিজেপিকে দায়ী করছে । ফলে এটি ক্রমশই স্পষ্ট হয়ে উঠছে এই সমস্ত দলগুলো দেশবিরোধী শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়ে ক্ষমতা ফিরে পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে । উত্তর-পূর্ব ভারত জুড়ে ভারত বিরোধী শক্তি আবার সংগঠিত হয়েছে। এই প্রসঙ্গে  হিমন্ত বিশ্বশর্মা একটি জনসভায় দলের কর্মীদের উদ্দেশে  বলেছেন “আমরা আসামকে কিছুতেই দ্বিতীয় কাশ্মীর  হতে দিতে পারি না। সেটা যাতে না হয় তার জন্য আসাম চুক্তি ৬ নম্বর ধারা প্রয়োগ প্রয়োজন …”

বাংলাদেশ হতে  অনুপ্রবেশকারীদের জন্য আসামে হিন্দুদের জনসংখ্যা ১০ শতাংশ কমে গিয়েছে । ১৯৭১ সালে আসামে হিন্দু সংখ্যা ৭১ শতাংশ ছিল ।বর্তমানে কমে হয়েছে ৬১ শতাংশ। বাংলাদেশ থেকে আগত ৮ লক্ষ হিন্দুকে যদি বাদ দিয়ে দেওয়া যায় তাহলে সংখ্যা কমবে আরো, হিন্দু জনসংখ্যা হবে মাত্র ৫২ শতাংশ ।  তখনই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হবে বরুদ্দিন আজমল বা সিরাজুদ্দীন আজমল ।  হিন্দু প্রাদেশিকতা, ভাষা ,জাতপাতের উর্দ্ধে উঠে কবে জাগবে?

 NRC  থেকে যাঁরা বাদ পড়েছেন তাঁদেরর দুই ভাগে ভাগ করা যায় । এক, শরণার্থী অর্থাৎ বাংলাদেশ, পাকিস্তান,  আফগানিস্তান থেকে ভারতে আশ্রয় নেওয়া অমুসলিম সম্প্রদায়। দুই ,অনুপ্রবেশকারী অর্থাৎ উক্ত তিন দেশ হতে অবৈধ ভাবে প্রবেশকারী মুসলিম ।  শরণার্থীদের নাগরিকত্ব প্রদানের জন্য নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ২০১৬ কে পাস করতেই হবে । বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকারের লোকসভায় পাস করালেও উপযুক্ত সংখ্যাগরিষ্ঠতার অভাবে  এবং বিরোধী দলগুলির বাধার ফলে রাজ্যসভায় পাশ করাতে পারেননি। 

তবে এ ব্যাপারে জনমত শক্তিশালী হচ্ছে । ফলে ভবিষ্যতে সমস্ত বাধা দূরীভূত হবে এমন আশা করা যায় । অবশ্য এ ব্যাপারে বিজেপি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার ইতিমধ্যে সদর্থক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন । যেমন কেন্দ্রীয় সরকারের জারি করেছে যাতে বলা হয়েছে ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে যেসব শরণার্থী ভারতে প্রবেশ করবেন  তাঁদেরর হাতে কোনো বৈধ নথি না থাকলে  কিংবা তাঁদের কাছে যদি নথির মেয়াদ শেষ হয়ে যায় তবে সংশ্লিষ্ট দেশে ফেরত পাঠানো যাবে না । অনুপ্রবেশকারীদের ফেরত পাঠানোর প্রশ্নে  ভবিষ্যতে বাংলাদেশের সাথে কূটনৈতিক স্তরে কথা বলার সুযোগ রয়েছে । তাছাড়া এদের বসবাসের জন্য আলাদা পারমিট ব্যবস্থা চালু হতে পারে । অনুপ্রবেশকারী সমস্যা সমাধানের জন্য ভবিষ্যতে কোনো বিকল্প আমাদের সামনে আসতে পারে , যেমন – জমি। তবে অনুপ্রবেশকারীদের ভোটাধিকার না থাকার জন্য এ ব্যাপারে রাজনৈতিক তর্জাও কমে আসবে।


#সমাপ্ত

তথ্যঃ জাতীয় নাগরিক পঞ্জি : সাধন কুমার পাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.