পর্ব_২
হিমের রাতে ওই গগনের দীপগুলিরে
হেমন্তিকা করল গোপন আঁচল ঘিরে॥
ঘরে ঘরে ডাক পাঠালো– “দীপালিকায় জ্বালাও আলো,
জ্বালাও আলো, আপন আলো, সাজাও আলোয় ধরিত্রীরে।’
শূন্য এখন ফুলের বাগান, দোয়েল কোকিল গাহে না গান,
কাশ ঝরে যায় নদীর তীরে।
যাক অবসাদ বিষাদ কালো, দীপালিকায় জ্বালাও আলো–
জ্বালাও আলো, আপন আলো, শুনাও আলোর জয়বাণীরে॥
হাওয়ার রাত আসে। হিমের পরশ থাকে সেই হাওয়ায়। চারদিকে ধূসর আবহ , হিম হিম, স্বল্পায়ু দিন ক্রমে মিইয়ে যাচ্ছে, শেষ বিকালে কুয়াশার আবছা চাদর প্রকৃতিকে ঢেকে শিশিরের শব্দের মতো নামে সন্ধ্যা। সবুজ পাতার খামের ভেতরহলুদ গাঁদা চিঠি লেখেকোন্ পাথারের ওপার থেকেআনল ডেকে হেমন্তকে?
আনল ডেকে মটরশুঁটি,খেসারি আর কলাই ফুলেআনল ডেকে কুয়াশাকেসাঁঝ সকালে নদীর কূলে।
শরতের পর কার্তিক-অগ্রহায়ণ মিলে হেমন্ত। নতুন ঋতুর আগমনে রূপ বদলায় প্রকৃতি। প্রকৃতির ম্লান, ধূসর ও অস্পষ্টতার অনুভূতি হানা দেয় চেতনলোকে।হেমন্তকে বলা হয় শীতের বাহন। প্রকৃতিতে অনুভূত হচ্ছে শীতের আমেজ।
আকাশ থেকে খণ্ড খণ্ড মেঘ সরে গিয়ে উদোম হয়েছে বিশাল নীল আকাশ।কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়—
হায় হেমন্তলক্ষ্মী, তোমার নয়ন কেন ঢাকা–
হিমের ঘন ঘোমটাখানি ধুমল রঙে আঁকা ॥
সন্ধ্যাপ্রদীপ তোমার হাতে মলিন হেরি কুয়াশাতে,
কণ্ঠে তোমার বাণী যেন করুণ বাষ্পে মাখা ॥
ধরার আঁচল ভরে দিলে প্রচুর সোনার ধানে।
দিগঙ্গনার অঙ্গন আজ পূর্ণ তোমার দানে।
আপন দানের আড়ালেতে রইলে কেন আসন পেতে,
আপনাকে এই কেমন তোমার গোপন ক’রে রাখা ॥
টহলের গানের পাশাপাশি বঙ্গ হিন্দু জীবনের আরো একটি অঙ্গ হল কার্তিক মাসভর আকাশ প্রদীপ। কার্তিকের সাঁঝবেলায় প্রতিটি হিন্দু গৃহের তুলসিতলা আলোকিত হয়ে ওঠে প্রদীপ দানে। আর কি হয়?আর আকাশ প্রদীপ জ্বলে…. দূরের তারাকে সাক্ষী করে… সেই আকাশ প্রদীপ জ্বালানোর জন্য আগে গৃহের উঠানে বা বাড়ির ছাদে পোঁতা হত একটি বাঁশ। তার উচ্চতা হত প্রায় ১৫ থেকে ২০ ফুট লম্বা। বিশেষ পদ্ধতিতে তৈরি এই প্রদীপটির মধ্যে মোম বাতি বা প্রদীপ জ্বেলে বা লন্ঠন বা হ্যাজাক জ্বেলে পতাকা উত্তলনের ন্যায় বাঁশের ডগায় তোলা হত। তেল ফুরালে বা বাতি নিভে গেলে প্রদীপকে ধীরে নামিয়ে আবার প্রজ্জ্বলিত করা হত। এখন রেট্রো লাইফ। মানুষের সময় কম। তাই অনেকেই এখন প্রদীপের বদলে ইলেকট্রিক বাল্ব বাড়ির মাথায় লাগিয়ে নিয়ম রক্ষা করেন।
সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে ; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল ;
পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
তথন গল্পের তরে জেনাকীর রঙে ঝিলমিল ;
সব পাখী ঘরে আসে – সব নদী – ফুরায় এ-জীবনের সব লেন দেন ;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন…
প্রচলিত রীতি হল‚ গোটা কার্তিক মাস ধরে পূর্বপুরুষদের বাতি দেখানো | মহালয়া অমাবস্যায় আমাদের মৃত পূর্ব পুরুষদের আত্মার সেই অমোঘ লোক হতে এই নশ্বর লোকে নেমে আসেন। কার্তিকের হিমেল পরশের সময় তাঁরা পুনশ্চ ফিরে যান নিজ গন্তব্যে। তাঁদের পথ দেখানোর জন্য এই আকাশ প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত করা হয় সারা কার্তিক মাস জুড়ে। কার্তিক মাস মানে হেমন্ত ঋতু | আসলে এই মন কেমন করা ঋতুর মধ্যে কিছু একটা আছে |
আশ্বিনের শেষ দিনের থেকে জলবিষুব সংক্রান্তি পালনের উদ্যোগ চলে গ্রাম বাংলায়।
হিন্দু শাস্ত্রে প্রদীপ হল মানবদেহের প্রতীক | ক্ষিতি‚ অপ‚ মরুৎ‚ ব্যোম‚ তেজ-এই পঞ্চভূতে তৈরি নশ্বর দেহ | প্রদীপও তাই | ক্ষিতি বা পৃথিবী বা মাটি দিয়ে তাকে বানানো হয় | অপ বা জল ছাড়া সেই সৃষ্টি সম্ভব নয় | অগ্নিশিখা হল তার তেজ | মরুৎ বা বাতাস সেই তেজকে জ্বলতে সাহায্য করে | ব্যোম বা অবিনশ্বর শূন্যে বিলীন হয় সেই তেজ |
অনেকেই মনে করেন , আকাশ প্রদীপ দান বৈষ্ণব চতুর্মাস্য ব্রতের অন্যতম একটি অঙ্গ। অনন্ত শয্যায় শায়িত বিষ্ণু বা নারায়ণকে আলোক প্রদানের নিমিত্ত আকাশপ্রদীপ দেখানো হয়।
কার্তিক মাস ধরে এই প্রদীপ দেওয়া শুধুই বিষ্ণুর আশীর্বাদ যাচনা নয়। তাঁকে তো স্মরণ করতেই হবে। এই পৃথিবীকে পালন করেন তিনি, মৃত্যুর পরেও মানুষের উপরে রয়েছে তাঁরই অধিকার। তাই আকাশপ্রদীপ দেওয়ার সময় উচ্চারণ করা হয় মন্ত্র- ‘’আকাশে সলক্ষ্মীক বিষ্ণোস্তোষার্থং দীয়মানে প্রদীপঃ শাকব তৎ।‘’
আকাশে লক্ষ্মীর সঙ্গে অবস্থান করছেন যে বিষ্ণু, তাঁর উদ্দেশে দেওয়া হল এই প্রদীপ। এ বাদেও আকাশপ্রদীপ শীতঋতুতে মানুষের অগ্নিসঞ্চয়ের অভ্যাস।
এর জন্য যজ্ঞের উপযোগী এক বৃহৎ কাঠের এক পুরুষপ্রমাণ দণ্ড নির্মাণ করা হয়। তাতে যবাঙ্গুল পরিমাণ ছিদ্র করে লাগানো হয় দু’হাত পরিমাণ রক্তবর্ণের পট্টি।
সেই অষ্টকোণযুক্ত পট্টির ভিতরে রাখা হয় এই দেহের প্রতীক প্রদীপটি। স্থাপনের সময় বলা হয়- ‘’দামোদরায় নভসি তুলায়াং লোলয় সহ/প্রদীপং তে প্রযচ্ছামি নমোহনস্তায় বেধসে।‘’
কাৰ্ত্তিকমাসে লক্ষ্মীর সঙ্গে দামোদরকে আমি আকাশে এই প্রদীপ দিচ্ছি। বেদ অনন্তকে নমস্কার।
অনেক পরিবার আকাশপ্রদীপ স্থাপনের সময় উচ্চারণ করেন- ‘’নিবেদ্য ধৰ্ম্মার হরায় ভূম্যৈ দামোদরায়াপ্যথ ধৰ্ম্মরাজে/প্রজাপতিভ্যত্বথ সৎপিতৃভ্যঃ প্রেতেভ্য এবাথ তমঃ স্থিতেভ্যঃ।‘’
মানুষ যখন গুহামানব তখন তার কাছে আগুন অতি মূল্যবান | সেটা ছিল হিংস্র শ্বাপদদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ব্রহ্মাস্ত্র | শীত আসার আগে যতটা সম্ভব আগুন এবং জ্বালানি জমানো হতো | গুহায় থাকত জ্বলন্ত শিখা | তা কখনও নেভানো হতো না | এটিই রূপান্তরিত হয়েছে অগ্নিহোত্র রক্ষার আচারে। এছাড়াও ফসল পাকার সময় যাতে পোকামাকড় ইত্যাদির হাত থেকে রেহাই পাওয়া যেত। তাই টাঙ্গানো হত অগ্নির আলোক।
গ্রামাঞ্চলে আকাশ প্রদীপ কে অনেকে ফানুস বা ফনেস বলে।পন্ডিতগনের মতে, ফনেস একটি গ্রিক শব্দ। এর অর্থ মোমবাতি বা দীপ। মিশর দেশে ফানুস বাতি প্রজ্জ্বলিত করে অভিবাদনের প্রথা ছিল। তারও পূর্বে ফারাওগন সাইরিয়াস নামক নক্ষত্রের উদয়কালে যে উৎসব পালন করতেন সেই উৎসবে যে মশাল ব্যবহৃত হত সেখান থেকেই ফানুস বা ফনেসের উদ্ভব হয়।
দেবতারা আজ আছে চেয়ে– জাগো ধরার ছেলে মেয়ে,
আলোয় জাগাও যামিনীরে।
এল আঁধার দিন ফুরালো, দীপালিকায় জ্বালাও আলো,
জ্বালাও আলো, আপন আলো, জয় করো এই তামসীরে॥
প্রবারণা বৌদ্ধ মার্গীয় অনুশাসনের অন্যতম এক উৎসব। এই উৎসবে ফানুস জ্বালানো একটি বৃহৎ ও সুবিশাল উৎসব । আত্নন্বেষণ ও আত্ন সমপর্ণ এর তিথি। এটি গৌতম বুদ্ধ তাঁর ভিক্ষু সংঘের জন্য প্রবারণা অনুজ্ঞা প্রদান করেছিলেন- ভিক্ষু তিন মাস বর্ষাবাস ব্রত পালনোত্তর আসে প্রবারণা। বর্ষাবাসব্রত পালন কালে ভিক্ষুসংঘ সদ্ধর্মাচারের গভীর ভাবে অনুধ্যান ও অনুবেদনে ব্যাপৃত থাকেন, তাই প্রতিটি বিহারে ভিক্ষুসংঘ পরস্পরের সাথে বাস করেও বর্ষাবাস কালীন প্রায় একাচারী জীবন যাপন করেন। কারণ এ সময় বর্ষাব্রতের শৃংখলা রক্ষার্থে ভিক্ষুসংঘ পরস্পরের সাথে আলাপচারিতা বর্জন করতেন গৌতম বুদ্ধ এরূপ নিস্পাণ মৌনব্রত অবিধেয় বলেছেন।গৌতমবুদ্ধ শ্রাবস্তীতে অনাথপিন্ড শ্রেষ্ঠীর আরামে অবস্থানকালে কৌশল জনপদে বর্ষাবাস যাপনকৃত ভিক্ষুসংঘের জীবনাচার বিধি অবগত হয়ে বুদ্ধ বর্ষাবাস তিনমাস বর্ষাবাসব্রত পালনোত্তর প্রবারণা পালনের সূচনা হয়।
প্রবারণার শাব্দিক অর্থ –প্রকৃষ্ট রূপে বারণ বা নিষেধকরণ।সেই নিষেধযোগ্য বিষয় সমূহ হলো-আচরণীয় ক্ষেত্রে ত্রুটি নৈতিক স্থলন এবং সর্বোপরি চিত্তের মল(লোভ,বিদ্বেষ ও মোহ)এগুলোর নিরোধমূলক অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকলে এগুলো সম্পর্কে সচেতন থাকা যায়। প্রকৃত অর্থে এগুলোই হলো(লোভ,বিদ্বেষ ও মোহ) মানুষের অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে মূল অন্তরায়। এই অন্তরায় হতে দুরে থাকার জন্য চঞ্চল চিত্তের জন্য দরকার পরিশুদ্ধ অবলম্বন। তাই ‘প্রবারণার’ আর একটি অর্থ হলো ‘বরণ’ অর্থাৎ শুভ, শুদ্ধ, সুন্দর ও সু-আচারকে বরণ। বৌদ্ধ পরিভাষায় বলা যায় অকুশলকে বারণ এবং কুশলকে বরণই হলো প্রবারণা। বলাবাহুল্য শুধু কৃতকর্মের জন্যই প্রবারণা নয়। গৌতম বুদ্ধের অনুজ্ঞা মতে চিত্তের অন্তলীন কমনা-বাসনা অথবা অনুমেয় ও আশন্কিত মনোবাসনার জন্যও প্রবারণা আবশ্যক। ত্রিপিটকের মহাবর্গ গন্থে দেখা যায় বুদ্ধ ভিক্ষুদের বলেছেন-“ভিক্ষুগণ দৃষ্টশ্রুত অথবা আশান্কিত ত্রুটি বিষয়ে প্রবারণা করিবে”।
প্রবারণার আর একটি বিশেষ গুণ হলো-এর মাধ্যমে সাংঘিক জীবনের পরস্পরের প্রতি নির্ভরশীলতা, অপরাধ প্রবণতা দূরীকরণ এবং বিনয়আনুবর্তিতা সুদৃর করণে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। সে দিক থেকে প্রবারণার সরলীকৃত স্বরূপ হলো “আত্নশুদ্ধি ও উৎসব”। ভিক্ষু সংঘ এই তিথিতে পরস্পরের কাছে স্ব-স্ব দৃষ্টশ্রুত অথবা আশন্কিত অপরাধ প্রসঙ্গে মাজর্না কামনা করেন এবং জ্ঞাতসারে যদি কোন অপরাধ ঘটে যায় তার জন্য বিনয় সন্মত প্রতিবিধান প্রদানের কাজটিও প্রবারণায় হয়। সুতরাং মহান ভিক্ষুসংঘের জীবনে প্রবারণার গুরুত্ব অপরিসীম।
জাতকে কার্তিকোৎসবের কথা দেখা যায় যা কার্তিক মাসের পূর্ণিমা তিথিতে অনুষ্ঠিত হতো। এ উৎসব দু’তিন দিন স্থায়ী হওয়ার তথ্যও পাওয়া যায়। এ প্রেক্ষিতে এটিই অনুমিত হয় যে, সে সময় যেহেতু কঠিন চীবর দানোৎব(যা প্রবারণার পর হতে শুরু হয়) এত জাঁকজমক করে আয়োজন হতো না। এছাড়া বর্ষাবাস বর্ধিত করায় এবং আষাঢ়ী পূর্ণিমায় বর্ষাবাস ব্রত শুরু করতে না পারলে শ্রাবণী পূর্ণিমায় শুরু করার বিধান রয়েছে । সে হিসাবে বর্ষাবাস সমাপনোত্তর এটি কার্তিক উৎসব বলে ধরা হয়।এখানে বহুমাএিক ধর্মীয় ও আনন্দ উৎসবের আয়োজন হতো। হয়ত তারই ধারাবাহিকতায় আজকের প্রবারণা পূ্ণিমায় বহুবিধ সামাজিক আনন্দ উৎসবের সংযোজন। যার ফানুস উত্তোলন একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় ।
জনশ্রুতি আছে , শাক্য সিংহ গৌতম সিদ্ধার্থ আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথিতে সংসার পরিত্যাগ করেছিলেন । তাঁর সঙ্গী ছিলেন ছন্দক। সেই রাত্রে অনোমো নদীর তীরে সিদ্ধার্থ তাঁর সকল রাজ আভরণ ত্যাগ করেছিলেন। তিনি তাঁর রাজ ঐশ্বর্য পূর্ন কেশকে তরবারী দিয়ে কর্তন করে আকাশে দিকে নিক্ষেপ করেছিলেন।শোনা যায় দেবরাজ ইন্দ্র নাকি সেই কেশরাজি সোনার ঝুড়ি দিয়ে ঢেকে রাখলেন । অনেকে মনেকরেন ,এই সংরক্ষিত চুলের স্মরণে বৌদ্ধ রা ফানুস বা আকাশ প্রদীপ দেখান।
গোধূলিতে নামল আঁধার,
ফুরিয়ে গেল বেলা,
ঘরের মাঝে সাঙ্গ হল
চেনা মুখের মেলা।
দূরে তাকায় লক্ষ্যহারা
নয়ন ছলোছলো,
এবার তবে ঘরের প্রদীপ
বাইরে নিয়ে চলো।
মিলনরাতে সাক্ষী ছিল যারা
আজো জ্বলে আকাশে সেই তারা।
পাণ্ডু-আঁধার বিদায়রাতের শেষে
যে তাকাত শিশিরসজল শূন্যতা-উদ্দেশে
সেই তারকাই তেমনি চেয়েই আছে
অস্তলোকের প্রান্তদ্বারের কাছে।
অকারণে তাই এ প্রদীপ জ্বালাই আকাশ-পানে–
যেখান হতে স্বপ্ন নামে প্রাণে।
আকাশ প্রদীপ বানাতে চাই বাঁশের কাবারি, সরু তার বা সুতো । পাতলা ফানুসের রঙিন কাগজ , আঠা , সুতলী দড়ি , একটা লোহার এস , আর খাড়াই বাঁশ । প্রথমে বাঁশ ফাটিয়ে , দেড় ফুট মাপের চারটে সরু গোলাকার দন্ড কেটে বার করতে হবে। বাকি ছয় ও আট ইঞ্চি মাপের সরু কাঠি বার করতে হবে বত্রিশ টি।এরপর সেগুলি নির্দিষ্ট প্রণালী অনুসারে বেঁধে রঙিন কাগজ দিয়ে মুড়ে দিতে হবে আঠা দিয়ে। আকাশ প্রদীপ ঝোলানোর জন্য মাথায় দড়ির সঙ্গে একটি এসের সাহায্য চাই। ভিতরে বাতি, প্রদীপ ইত্যাদি দেবার স্ট্যান্ড থাকে। ফনেস তোলার সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যেন কত না হয় বা জোরে বাতাস না বলে, তাহলে আগুন লেগে যাবার সম্ভাবনা । আগে স্থানীয় মালাকাররা ফনেস বানাতেন । এখন তো আকাশ প্রদীপ বা ফনেস টাঙানো প্রায় অবলুপ্তির পথে।
দিন পরিবর্তনের সঙ্গে তেল বা ঘিয়ের প্রদীপকে সরিয়ে এল টুনি | বাঁশের মাথায় এল লাল বৈদ্যুতিন আলো | আশ্বিন সংক্রান্তি থেকে কার্তিক সংক্রান্তি অবধি তার থাকার কথা প্রজ্বলিত হয়ে | কিন্তু এখন আর এই আকাশপ্রদীপ প্রায় দেখাই যায় না | বিরল থেকে বিরলতর থেকে বিরলতম | শুধু তো আর পূর্বপুরুষ নয় |
আকাশপ্রদীপ পথ দেখায় হেমন্তের পরে আসন্ন শীতঋতুকেও | কিন্তু এত ধোয়াঁশা | এত অন্ধকার | দৃষ্টি আচ্ছন্ন হয়ে গেছে আকাশপ্রদীপেরও | সে নিজেই আর তারাদের দেখে তাদের সঙ্গে গল্প করতে পারে না।কতদিন সন্ধ্যার অন্ধকারে মিলিয়াছি আমরা দুজনে;
আকাশ প্রদীপ জ্বেলে তখন কাহারা যেন
কার্তিকের মাস সাজায়েছে, —
মাঠ থেকে গাজন গানের স্নান ধোঁয়াটে উচ্ছ্বাস ভেসে আসে;
ডানা তুলে সাপমাসী উড়ে যায় আপনার মনেআকন্দ বনের দিকে;
একদল দাঁড়কাক ম্লান গুঞ্জরণে নাটার মতন
রাঙা মেঘ নিঙড়ায়ে নিয়ে সন্ধ্যার আকাশদু’মুহূর্ত ভরে রাখে—
তারপর মৌরির গন্ধমাখা ঘাসপড়ে থাক:
লক্ষ্মীপেঁচা ডাল থেকে ডালে শুধু উড়ে চলে বনেআধো ফোটা জ্যোৎস্নায়;
তখন ঘাসের পাশে কতদিন তুমি হলুদ শাড়িটি বুকে অন্ধকারে
ফিঙ্গার পাখনার মতোবসেছ আমার কাছে এইখানে —
আসিয়াছে শটিবন চুমিগভীর আঁধার আরো —
বাদুড়ের মৃদু অবিরত আসা —যাওয়া
আমরা দুজনে বসে বলিয়াছি ছেঁড়াফাঁড়া কত
মাঠ ও চাঁদের কথা: ম্লান চোখে একদিন সব শুনেছ তো।
আশ্বিন সংক্রান্তি থেকেই তার আকাশ আলো করার কথা। কিন্তু, তিল তেল বা ঘিয়ের প্রদীপ কে সময় খরচ করে দেবে? তাই কর্তব্য সারা হবে বিদ্যুতের আলোতেই। বাঁশের ডগায় লাল টুনি জ্বলবে। সেই আলোতেই পথ চিনে, শীতের হাত ধরে একে একে গৃহে উপস্থিত হবেন পূর্বপুরুষরা। সেই আলোর নিশানা ধরে রাতের আঁধার পাড়ি দেবে পরিযায়ীরাও। বিষ্ণুর সৃষ্টি করা পৃথিবীর জীবনের চাকাটি ঘুরতে থাকবে নিজের নিয়মে।
সেই আলোও অবশ্য কমে এসেছে ক্ষীণ হতে হতে। হেমন্ত জুড়ে থাকা কার্তিকে আকাশপ্রদীপের বৈদ্যুতিন আলোও এখন আর বড় একটা চোখে পড়ে না। গত বছরে নজরে পড়েনি তেমন করে। এ বছরে কি পড়বে? সেই আলো পথ না দেখালে শীত এসে শহরে বসতে পারবে তো? তবুও আমরা প্রার্থনা করি….
অসতো মা সদ্গময়
তমসো মা জ্যোতির্গময়
মৃত্যোর্মামৃতং গময়।
আবিরাবীর্ম এধি।
রুদ্র যত্তে দক্ষিণং মুখং
তেন মাং পাহি নিত্যম্।
#সমাপ্ত
#দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ ১. বাংলার মুখ
২. বাংলার ব্রতকথা
৩. শুশুনিয়া লিপি ও চন্দ্রবর্মা
৪. জয়ঢাক