#পর্ব_২
কৌশল্যার সনে রাজা করি অনুমান।
তোমার পুত্রের নাম থুইল শ্রীরাম।।
কৈকয়ীর পুত্র দেখিয়া রাজা হরিষ অন্তর।
ভরত নাম থুইল তার দেখি মনোহর।।
সুমিত্রার তনয় জমজ দুইজন।
দুজনার নাম থুইল লক্ষণ শত্রুঘ্ন।।
একই দিবসে কৈল চারিজনের নামকরণ।
রাম লক্ষণ আর ভরত শত্রুঘ্ন।।”
নারদ রামের পরিচয় তথা জীবন বৃত্তান্ত শোনালেন।
কথোপকথন শেষে নারদ বিদায় নিলে বাল্মীকি শিষ্য ভরদ্বাজকে সঙ্গে নিয়ে অবগাহনের উদ্দেশ্যে জাহ্নবীর অদূরে তমসায় উপনীত হয়ে ভরদ্বাজকে কলস রেখে বল্কল দিতে বললেন। বল্কল নিয়ে তমসার বনে বিচরণকালে বাল্মীকি সুরতাসক্ত ক্ৰৌঞ্চমিথুন দেখলেন। হেনকালে অদৃশ্য ব্যাধ কর্তৃক ক্ৰৌঞ্চ নিহত হলে শোকাভিভূত বাল্মীকির কণ্ঠ হতে উদ্গীত হল,
মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ।
যৎ ক্ৰৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম্॥
রামায়ণের কালে সূর্য কর্কটরাশিতে এলে শ্রাবণ মাস বর্ষা ঋতুর প্রথম মাস। ক্ৰৌঞ্চমিথুন শব্দটি সূর্যর মিথুনরাশির পুনর্বসু নক্ষত্রে অবস্থান ইংগিত করছে। যুগ্ম-তারকা পুনর্বসু নক্ষত্র মিথুনের দোতক। পুনর্বসু নক্ষত্রর তারাগুলির সমন্বয়ে ক্ৰৌঞ্চমিথুন কম্পন করা যায়।
সূর্যর এই অবস্থানকাল গ্রীষ্মঋতুর শেষ মাস আষাঢ়। ধরে নেওয়া যেতে পারে তিথি অমাবস্যা, এক্ষেত্রেও মিথুন শব্দটি প্রয়োগ করা যায়। যেহেতু অমাবস্যায় সূর্য ও চন্দ্র সমসূত্রে থাকে।
জাহ্নবী অর্থে ছায়াপথ। জাহ্নবীর অদূরে অর্থে ছায়াপথের পূর্বদিকস্থ পুনর্বসু নক্ষত্র।
তমসা শব্দে বৃষ্টিহীন প্রচণ্ড গ্রীষ্মে ধ্বংসোন্মুখ পরিবেশকে বুঝানো হয়েছে। গ্রীষ্মঋতুর শেষে জলাশয় শুকিয়ে যায়, নদীর বুকে বালির চর জেগে ওঠে, বায়ুপ্রবাহ ও ভূ-পৃষ্ঠ রুক্ষ ও তপ্ত, জলাভাবে উদ্ভিদাদি শ্ৰীভ্রষ্ট ও মৃতপ্রায়, জীবজগৎ তৃষ্ণাত ও ক্লান্ত, আকাশের রং তাম্রবর্ণ।
এই ধ্বংসোম্মখে পরিস্থিতিতে বাল্মীকি বিচরণ করার কালে পুরুষ ক্ৰৌঞ্চ নিহত হয়।
নিহারিকাপ্রবহ হতে সূর্যর সৃষ্টি, একারণে দ্বিজ। সূর্যরশ্মি বিশাল বিশ্বে প্রসারিত, সুতরাং বিস্তৃতপক্ষ। গ্রীষ্মের আকাশের রং তাম্রবর্ণ, অতএব তাম্রশীর্ষ।
ক্ৰৌঞ্চ অর্থাৎ কোঁচবকের মিথুনকাল গ্রীষ্মঋতুর শেষে ও বর্ষার প্রথমে। সুতরাং ক্ৰৌঞ্চবধ অর্থে গ্রীষ্মের শেষে প্রথম আবিভূত মেঘ দ্বারা সূর্যর আচ্ছাদন।
সূর্য আড়াল হলেও ভূপৃষ্ঠ হতে তখনও তাপ বিকিরণ হয়। একারণে ক্ৰৌঞ্চের শোকে ক্রোঞ্চীর অস্থিরতা প্রকাশ করা।
তাম্রশীর্ষ বিস্তৃতপক্ষ দ্বিজ পুরুষ ক্ৰৌঞ্চ গ্রীষ্মকালীন সূর্যর প্রতীক। জ্যোতিবিজ্ঞান দৃষ্টিতে বাল্মীকিকে ব্ৰহ্মহৃদয় নক্ষত্র ধরা যায়।
অদৃশ্য ব্যাধ শব্দ সেক্ষেত্রে লুব্ধক তারাকে ইংগিত করে।
এই দৃষ্টিভঙ্গিতে আদিশ্লোকের আবির্ভাবের পটভূমিকাটি চিন্তা করলে গ্রীষ্মকালীন পরিবেশে বৃষ্টির কামনায় মেঘবন্দনার স্বরূপ সুস্পষ্ট হয়।
যেহেতু রামায়ণে মেঘদৈবত রাম ও কৃষিশ্রী সীতার সকল চরিত্র আলোচিত হবে, সেকারণে বৰ্ষাঋতুর প্রাক্কালে মেঘবন্দনা করে মঙ্গলাচরণ করা হয়েছে।
আধ্যাত্ম দর্শন নিয়ে সাধক বলেছেন মায়াময় স্থূল জগতের বাইরে আছে এক সুক্ষ জগৎ। সেই সূক্ষ্ম জগৎ সম্পর্কে অনেক বিজ্ঞানীও হদিশ দিয়েছেন। আধ্যাত্ম দর্শন সেই বিজ্ঞানকেও জুড়ে নিয়েছে। বিশ্বসৃষ্টির রহস্য ও আধ্যাত্মবাদ শরীরী একতায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। তাই এখানে নানা প্রামানিক সংকেতকে ধরা হচ্ছে বিশ্বসৃষ্টির সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রবল যুক্তিকতায়। তাই ঈশ্বর উপাখ্যান, ইতিহাস ,পুরাণ নতুন দৃষ্টিকোনে শরীর কেন্দ্রীকতা স্থান স্থান নিচ্ছে সাধকদের অতীন্দ্রিয় দর্শনে। যে দর্শনেই রামায়ন পায় দেহ।
রাম ছিলেন, রামায়ণ ও ছিল। প্রত্নতাত্বিক সাক্ষ্য পাওয়া যায়। অযোধ্যার অস্তিত্বও আছে। উড়িষ্যায় সোনেপুর বলে একটি দ্বীপ আছে। তেলে নদীও মহানদীর সঙ্গমস্থলে ইহার অবস্থান। সেখানের এক উপজাতি সম্প্রদায় রাম ও রামায়ণের উপাখ্যানে অসম্ভব বিশ্বাস করেন। সেই বিশ্বাস নিয়েই সোনা খোঁজেন মাটির নিচে। আর এই খোঁজেই মিলেছে এক ভগ্ন দেওয়ালের সন্ধান। হয়ত এটিই স্বর্ণ লঙ্কার যাবার কোনো পুরাতন পথ। রামায়ণের সুবিশাল শক্তিশালী বানর সেনা ,সেই বানর উপজাতিও কিন্তু আছেন। পুষ্কর হ্রদের নিকট বানর নামে সেই উপজাতির খোঁজ পাওয়া যায়। রামায়ণে রাক্ষস, বানর, গোলাঙ্গুল প্রভৃতির সম্পর্কে বলা যায়, দাক্ষিণাত্যের পার্বত্যাঞ্চলে তৎকালীন জনগোষ্ঠীগুলির আকৃতি প্রকৃতির একটি পার্থক্য অপরাপর অঞ্চলের অধিবাসীদের থেকেই ছিল।রাবণ ও তার দশ মস্তক রাক্ষস ইত্যাদির দশ উপজাতির প্রধান । অর্থাৎ রাম ও রামায়ন আমাদের নিজেদের, তাঁর অস্তিত্ব আমাদের অস্তিত্ব। রামায়ণের যে আলোচ্য শরীর প্রামানিক ও তা যোগযৌক্তিকতায়।
যোগশাস্ত্র ও তন্ত্রশাস্ত্র উভয় শাস্ত্র উভয়ই বলে থাকে আমাদের দেহভান্ডে আছে ৭২০০০ নাড়ি।যার মধ্য দিয়ে প্রাণ স্রোত প্রবাহিত হয়। এই স্রোতেই আছে অহঙ্কার, কাম, ক্রোধ , হিংসা, দ্বেষ ইত্যাদি। সেই পূর্ব পর্বে বলা রাবণ । সহজিয়া সাধকগন বলেন নয়টি ছিদ্র দিয়ে প্রাণ স্রোত প্রবাহিত হয়। ৭২০০০ নাড়িকে এভাবেও তো ভাবা যেতে পারে যে ৭+ ২=৯। একেই সহজিয়া বাউল সম্বোধন করেছেন নয় দরজা বলে। নয় হল আমাদের দেহের বিশেষ অঙ্গ প্রত্যঙ্গ। যাকে সাধক বলেছেন স্থূল ইন্দ্রিয় বলেই। দুই চক্ষু, দুটি নাসারন্ধ্র , দুটি কর্ণ কুহর, মুখ, গুহ্যদ্বার , মূত্রনালী। প্রাণস্রোত এই নাড়িগুলির মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়। এই ৭২০০০ নাড়ির মধ্যে যোগশাস্ত্র বলছে যে তিনটি নাড়িরই শারীরিক ক্রিয়াকল্পই প্রধান ও প্রোয়জনীয়। ইরা , পিঙ্গলা ও সুষুমনা ।
সাধক ৭২০০০ নাড়ির মধ্যে ১৪ টি নাড়িকে শারীরিক কর্মযজ্ঞে প্রয়জনীয় বলে মানছেন। তার মধ্যে আবার তিনটি প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ পূর্ন বলে বিচার করেছেন। তাঁরা সে সব নাড়ি গুলিকে চিহ্নিত করেছেন নদীর নামে। প্রধান তিন নাড়িকে তাঁরা বলেছেন গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতী। এগুলিকে আবার সূর্যনাড়ি , চন্দ্রনাড়ি, অগ্নিনাড়ি বলছেন। দক্ষিণ নাসারন্ধ্র বা ডান নাক সূর্য নাড়ির সঙ্গে যুক্ত। বাম নাসারন্ধ্র বা বাঁ নাক যুক্ত চন্দ্রনাড়ির সঙ্গে। অগ্নি নাড়ি যুক্ত মেরুদণ্ডের সঙ্গে। দক্ষিণ নাসা রন্ধ্রের সঙ্গে যুক্ত ইড়া নাড়িই হল সাধক মতে গঙ্গা বা সূর্য নাড়ি। বাম নাসারন্ধ্রের সঙ্গে যুক্ত পিঙ্গলা নাড়ি হল সাধক মতে যমুনা বা চন্দ্র নাড়ি।
যখন দক্ষিণ নাসারন্ধ্র দিয়ে শ্বাস প্রশ্বাস গৃহীত হয় তখন খিদে পকয় সাধকের। অর্থাৎ জঠরাগ্নি প্রজ্জ্বলিত হয়। যখন বাম নাসারন্ধ্র দিয়ে শ্বাস প্রশ্বাস গৃহিত হয় তখন আবার খিদে কমে আসে। দেহ শীতল হয়। এক এক নাসারন্ধ্রে বায়ু দেড় ঘন্টা খানেক ধরে রাখেন সাধক।
আরো ব্যাখ্যায় আসি। বাম নাসাতে যখন বায়ু প্রবাহিত হয় তখন সাধক শরীরে বিনয়ের ভাব জাগ্রত হয়। দক্ষিণ নাসাতে বায়ু প্রবেশ করে প্রবাহিত হতে থাকলে প্রভুত্বের ইচ্ছা জাগে শরীরের। এখানেই সেই পূর্ব পর্বে বলেছিলাম, রামচন্দ্রের উদয় হয় সাধক দেহভান্ডে। রাজা রাম প্রভুত্ব করতে থাকেন সাধক দেহভান্ডে। কিন্তু কেনই বা এই প্রভুত্ব?
এই কারনেই তাঁর প্রভুত্বতা – দুই নাসারন্ধ্রের মধ্যে বায়ু প্রবাহকে সাম্যের বা সমতায় আনা যায় তাহলে আনা যায় তাহলেই প্রাণ বায়ু প্রবেশ করে যাবে সুষুম্না নাড়িতে।যাকে অগ্নি নাড়ি বলা হয়। সাধক যাঁকে সরস্বতী নাড়িও বলে। আর প্রাণ বায়ু যদি সুষুম্নাতে ঢুকে যায় তাহলে কুন্ডলিনী শরীরের নিম্ন প্রান্ত থেকে মুলাধার পদ্মচক্র থেকে ঊর্ধ্ব দিকে চলতে থাকে। অর্থাৎ সেই পূর্ব পর্বে বলেছিলাম সাধকের ব্যাখ্যা ,সীতার জাগরণ ক্রিয়াতে শক্তি শরীরের একেকটি চক্র ভেদ করে উপরে উঠতে থাকে।সাধক প্রাণবায়ুকেই হনুমান বলেছেন। পূর্ব পর্বেই বলেছি।
হনুমান হলেন শ্রেষ্ঠ ভক্ত, তিনিই তাই রামের সহায়ক। এই প্রাণবায়ু বা হনুমানই কুন্ডলিনীশক্তি বা সীতাকে জাগরিত করছেন বা উদ্ধার করতে তৎপর হচ্ছেন রাবণের নিকট হতে। কুন্ডলিনী জাগরিত হলেই পরমাত্মার দেখা পাওয়া যাবে।যা হল সাধকের রাম স্বরূপ সূক্ষ্ম শরীর। স্থূল শরীরের যে মনঃসংযোগ তিনি সাধকের লক্ষ্মণ।অর্থাৎ লক্ষ্মণই স্থূল শরীরকে সূক্ষ্ম করে পরমাত্মার নিকট পাঠিয়ে দেন। রাম লক্ষ্মণ , দুই ভাই। সীতা উদ্ধারের বা কুন্ডলিনী শক্তির জাগরণের ক্ষেত্রেও তাই।
বাম নাসাতে যখন সাধক শরীরের শ্বাস ক্রিয়াতে বিনয় ভাব জাগার কথা বলা হয় তাকেই ধরে নিতে হবে সেই সাধকের লক্ষ্মণ ভাব।সীতা উদ্ধারে হনুমানের ভূমিকা অনস্বীকার্য। প্রাণবায়ু সদর্থক ভাবেই হনুমানের চরিত্রের নির্ণায়ক। তিনি সীতাকে বা কুন্ডলিনীশক্তিকে জাগরিত করে পরমাত্মা স্বরূপ ভগবান শ্রী রামের নিকট নিয়ে যেতে প্রধান ভূমিকা পালন করেছেন।
আচ্ছা এই হনুমানের লঙ্কাদগ্ধ মানে সাধক বলেছেন লং বীজ দগ্ধ ও তার উত্তাপ। এর ব্যাখ্যা কি হবে? না হয় লিখব পরের পর্বে….
পার কর রামচন্দ্র পার কর মোরে।
দীন দেখি নৌকা রাম লৈয়া গেলে দূরে।।
যার সনে কড়ি ছিল গেল পার হয়ে।
কড়ি বিনা পার করে তারে বলি নেয়ে।।
ধ্যান পূজা তন্ত্র মন্ত্র যার নাহি জ্ঞান।
তারে যদি কর পার তবে জানি রাম।।
যোগ যাগ তন্ত্র মন্ত্র যেই জন জানে।
তুমি কি তরাবে তারে তরে নিজ গুণে।।
মোর সঙ্গে কড়ি নাই পার হব কিসে।
কর বা না কর পার কূলে আছি বসে।।
#ক্রমশঃ
#দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ কাপালিক ,তান্ত্রিক, যোগী কথা