বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিয়েছে ব্রাজিল। কোয়ার্টার ফাইনালে শেষ হয়ে গিয়েছে নেমারদের স্বপ্ন। শুধু তাই নয়, লক্ষ লক্ষ দেশবাসীর স্বপ্নও, যাঁরা বেঁচে থাকেন ফুটবলের স্বপ্নে বিভোর হয়ে। ২০ বছর পরেও সেই মুখে হাসি ফুটবল না। তবে ব্রাজিলের বিদায়ের পর প্রশ্ন উঠছে, সত্যিই কি এই দল গোটা দেশবাসীর? ব্রাজিলের সব লোকই কি নিজের দেশের ফুটবলারদের সমর্থন করেন? প্রশ্নটা উঠছে এই কারণে, ব্রাজিলের জাতীয় দলের সঙ্গে বার বার অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়েছে সে দেশের রাজনীতি। এমনকী কিছু ফুটবলারও রাজনীতির থেকে নিজেদের দূরে রাখতে পারেননি। যে কারণে দেশের একটা অংশের কাছেই তাঁরা বিদ্রোহী হয়ে গিয়েছেন।
ব্রাজিল দলে এই মুহূর্তে সবচেয়ে জনপ্রিয় ফুটবলার কে? অন্তত ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে বলা হবে নেমারের নাম। পায়ের কাজ, প্রতিভা, সাজসজ্জা— সবেতেই নিয়মিত শিরোনাম তৈরি করেন তিনি। কিন্তু এই নেমারই ব্রাজিলের এক অংশের মানুষের কাছে অশ্রদ্ধার পাত্র। কারণ, বিশ্বকাপের আগেই খোলাখুলি ডানপন্থী প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জেয়ার বলসোনারোর হয়ে মুখ খুলেছিলেন তিনি। সমাজমাধ্যমে লিখেছিলেন, “প্রেসিডেন্টের যে ইচ্ছাশক্তি, তা আমার মূল্যবোধের সঙ্গে মিলে যায়।” ফলে রাতারাতি দেশের বামপন্থী সমর্থক মানুষের কাছে খলনায়ক হয়ে যান। বলসোনারা এবং দক্ষিণপন্থী সমর্থকরা রাজনৈতিক সভায় হলুদ জার্সি পরে বোঝাতে চেয়েছিলেন, জাতীয় দলটা তাঁদেরই সম্পত্তি।
উদারবাদীরা সেই সম্পত্তিতে ভাগ বসানোর একটা চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু লাভ হয়নি। সম্প্রতি একটি প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, রাজনৈতিক কারণে প্রতি পাঁচ ব্রাজিলীয়ের এক জন জাতীয় দলের হলুদ জার্সি পরেননি। তবে এই প্রথম নয়। অতীতে বহু বার জাতীয় দলকে নিয়ে দক্ষিণপন্থী এবং বামপন্থীদের মধ্যে কাড়াকাড়ি দেখা গিয়েছে। প্রথম বার বিশ্বকাপ হয়েছিল ১৯৩০ সালে। সে বার ব্রাজিলের স্বৈরাচারী শাসক গেতুইলো ভারগাস বিরাট বিরাট স্টেডিয়াম তৈরি করেছিলেন, যাতে সেখানে ফুটবল ম্যাচের পাশাপাশি বিরাট জনসভা আয়োজন করা যায়।
তার কয়েক দশক পরে ১৯৬৪ থেকে ১৯৮৫ পর্যন্ত ব্রাজিলে চলেছিল সামরিক স্বৈরশাসন। সামরিক অভ্যুত্থানের সময় ব্রাজিল বিশ্বের সেরা ফুটবল দল ছিল। পেলে, গ্যারিঞ্চা সেই দলে ছিলেন। অসাধারণ দৃষ্টিনন্দন ফুটবল খেলে দু’টি বিশ্বকাপ জিতেছিল তারা। সামরিক শাসকরা জাতীয় দলের সঙ্গে নিজেদের জুড়ে দেওয়ার জন্য চেষ্টার কোনও ত্রুটি রাখেননি। নতুন স্টেডিয়াম তৈরি করেন। সেখানে ফুটবলারদের পাশাপাশি দেখা যায় সামরিক নেতাদের।
১৯৭০ বিশ্বকাপের ঠিক আগে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট সে দেশের কোচকে সরিয়ে দেন। কারণ, সেই বামপন্থী কোচ শাসকদের অত্যাচার, খুন এবং জেলে ভরার বিরোধিতা করেছিলেন। তবু সে বার বিশ্বকাপ জেতে ব্রাজিল। সঙ্গে সঙ্গে শাসক দল ব্যস্ত হয়ে পড়ে সেই জয়কে নিজেদের জয় বলে দাবি করতে। দেশে ফেরার পর শাসকনেতার সঙ্গে ফুটবলারদের ছবি ফলাও করে ছাপা হয়। বামপন্থীরা তার বিরোধিতা করলেও ফুটবলারদের সাফল্যের থেকে নিজেদের দূরে রাখতে পারেননি।
চিত্রটা বদল হয় আশির দশক থেকে। ব্রাজিলে তখন সামরিক শাসনের শেষ পর্যায়ে। সক্রেটিস, জিকোর মতো অনেক ফুটবলারই তখন বামপন্থার পক্ষে মুখ খুলতে শুরু করেছেন। ১৯৮৮-তে ব্রাজিলে প্রথম নির্বাচন হয় এবং দক্ষিণপন্থীরা জয়ী হন। ১৯৯৪ এবং ২০০২ বিশ্বকাপ জয় ছিল কার্যত রাজনীতিমুক্ত। কোনও ফুটবলারকে কোনও রাজনৈতিক দলের হয়ে মুখ খুলতে দেখা যায়নি। আবার কোনও রাজনৈতিক দলও ফুটবল দলকে নিজেদের সম্পত্তি বলে দাবি করেনি।
বদল শুরু হয় ২০১৩ থেকে। ফুটবল দলের জার্সি পরে এবং জাতীয় পতাকা গায়ে জড়িয়ে বামপন্থীদের থেকে নিজেদের আলাদা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন ডানপন্থীরা। তখন ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট বামপন্থী দিলমা রুসেফ। ২০১৪-য় ব্রাজিলে বিশ্বকাপ হওয়ার সময় সেই রুসেফের বিরোধিতা করেছিলেন ডানপন্থীরা। ২০১৬-য় দিলমার ইমপিচমেন্টের আগে প্রতিবাদীরা হলুদ জার্সি পরে সামরিক শাসনের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন। ২০১৮-য় বলসোনারো নিজেকে প্রেসিডেন্ট হিসাবে তুলে ধরার সময় থেকেই জাতীয় দলও ডানপন্থী হয়ে গিয়েছিল।
বলসোনারো থাকাকালীন জাতীয় দলকে ডানপন্থার থেকে আলাদা করা যায়নি। সুপ্রিম কোর্টের অবসান, কোভিড অতিমারির বিধিনিষেধ নিয়ে বিরোধিতা, ইভিএমের অবসান— যেখানেই ডানপন্থীরা বিক্ষোভ দেখিয়েছেন, গায়ে দেখা গিয়েছে হলুদ জার্সি। তবে ফুটবলাররা যে সবাই রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে এটা বলা অনুচিত। রিচার্লিসনের মতো কেউ কেউ দলের রাজনীতিকরণ নিয়ে মুখ খুলেছেন। পাউলিনহো সরাসরি বামপন্থী রাজনীতি নিয়ে কথা বলেছেন। তবে বেশির ভাগই কোনও কথা বলেননি।
কিছু দিন আগেই ব্রাজিলে ক্ষমতায় এসেছে বামপন্থী শাসকগোষ্ঠী। ব্রাজিলের হারের সঙ্গে সরাসরি দক্ষিণপন্থী রাজনীতিরও পতন হল কিনা, সেটা তর্কসাপেক্ষ বিষয়। দলে অনেকেই মনে করেন, বিশ্বকাপের আগেই বলসোনারোর পক্ষে নেমারের মুখ খোলা উচিত হয়নি। তাতেই তিনি দেশের অনেক সমর্থকের চোখে শত্রু হয়ে যান।