#পর্ব_৮
“তম আসীত্তমসা গূড়হমগ্রহপ্রকেতং সলিলং সর্বমা ইদম্। তুচ্ছ্যনাভ্বপিতিহং যদাসীত্তপসস্তম্মহিনাজায়তৈকম্।।ঋগ্বেদ- মন্ডল-১০/১২৯/৩
“এই সমস্ত বিশ্বের সৃষ্টির পূর্বে সবই ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন,শুধুই অন্ধকার,অন্ধকারের চেয়েও যেন অন্ধকার। সেখানে তাপের সৃষ্টির মাধ্যমে সমস্ত উদ্ভূত হল…..”
যচ্চ কিঞ্চিৎ ক্বচিৎ বস্তু সদঅসদ্বাখিলাত্মিকে।তস্য সর্বস্য ইয়া শক্তিঃ সা ত্বং কিং স্তুয়সে ময়া।।
ইয়া ত্বয়া জগতস্রষ্টা জগৎ পাত্যত্তি ইয়ো জগৎ।সোহ্পি নিদ্রাবশং নীতঃ কস্ত্বাং স্তোতুং ইহা ঈশ্বরঃ।।
যেখানে, যখন, যা কিছু বস্তু আছে – প্রকৃত বা মায়া, সবার-ই অন্তরে তুমি।সমস্ত কিছুতে তোমার-ই শক্তি; আর কিভাবে আমি তোমার গুণকীর্তন করব! ।।
এমন কি, জগৎ সৃষ্টি, পালন আর ধ্বংস করেন যিনি সেই তাঁকেও তুমিনিদ্রায় অভিভূত করে রাখ ,ঈশ্বর তুমি, তোমার মহিমা বর্ণনার সাধ্য কার।।
পরমা প্রকৃতির মহাশক্তির উৎস….সেই পরমা শক্তি অযোনী সম্ভবা।তিনি আকাশ বাতাস, জ্ঞান কর্ম, আলো অন্ধকার সবেতেই ব্যাপ্ত।
বিশ্বেশ্বরি তং পরিপাসি বিশ্বং বিশ্বাত্মিক ধারয়সীতি বিশ্বম্ । বিশ্বেশবন্দ্যা ভবতী ভবত্তি বিশ্বাশ্রয় যে ত্বয়ি ভক্তিনম্রাঃ ॥
তিনিই জগতধাত্রী ,তিনিই বিশ্বকে পালন করেন। তিনিই প্রকৃতি, তিনিই শাকম্ভরি অন্নদাত্রী। তিনিই দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গা। সেই সুপ্রাচীন পৃথিবী, সেই মহেঞ্জোদারো হরপ্পা সভ্যতা, সেই বৈদিক ঋষি কুল সকলেই সেই আদি শক্তিকে পূজা করতেন।নারীই সব কিছু উৎপত্তির কারন। ইহাই সত্য। তাই তিনিই পৃথিবী রূপে মাতা ও আকাশ মহাশূন্য হলেন শিব। শিবের যে অষ্ট রূপ বা মূর্তি আছে । ক্ষিতি ,জল প্রভৃতি আটটি মূর্তিতে প্রকাশিত শিবের মূর্তিগুলি হল –
পুৰ্ব্বদিকে সৰ্ব্বায় ক্ষিতিমূৰ্ত্তিয়ে নমঃ । ঈশান কোণে ভবায় জল মূৰ্ত্তয়ে নমঃ । উত্তরে রুদ্রায় অগ্নি মূৰ্ত্তয়ে নমঃ । বায়ুকোণে উগ্ৰায় বায়ু মূৰ্ত্তয়ে নমঃ । পশ্চিমে ভীমায় আকাশ মূৰ্ত্তয়ে নমঃ । নৈঋত কোণে পশুপতিয়ে যজমান মূৰ্ত্তয়ে নমঃ । দক্ষিণে মহাদেবায় সোম মূৰ্ত্তয়ে নমঃ । অগ্নি কোণে ঈশানায় সূৰ্য্য মূৰ্ত্তয়ে নমঃ ।
সমস্ত বিষয়কে সহজবোধ্য করতে আমাদের অবশ্যই আশ্রয় নিতে হয় তন্ত্রের । আসলে লৌকিক ভাব কল্পনা যেমন গড়ে তুলেছে মূর্তি , তেমনি তাকে স্থায়িত্ব দিয়েছে দর্শন।ভাবকল্পনা ও দর্শনকে জীবন যাত্রার মাধুর্যে বেঁধেছে পূজা। এই পূজা প্রসঙ্গেই সরাসরি এসে হাজির হয় তন্ত্র। তন্ত্রই পুরাকাল থেকে অদ্যবধি প্রায় অবিকৃতভাবে উপাসনা পদ্ধতিকে বহন করে চলেছে । পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় বলেছিলেন যে , যে কোনো উপাসক সম্প্রদায় সাধনায় তৎপর হয়েছেন তাঁকেই তন্ত্র পদ্ধতি অবলম্বন করতে হয়েছে। মাতৃ বা দেবী পূজা ভাবের পূজা । আর এই ভাবকে শরীর ,হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে গেলে তন্ত্রের প্রোয়জন।
নিত্যই সা জগন্মুৰ্ত্তি স্তয়া সৰ্ব্বমিদং ততম ॥
তিনিই দুর্গা, উমা, চন্ডী , সিংহবাহিনী ,মহাকালী, অন্নপূর্ণা, জগতধাত্রী, শাকম্ভরি। তিনিই সনাতন, আদি, অন্তত, তিনিই এই জগতের সবকিছুর মূলীভূত কারন। সকল দেব চেতনা দুর্গায় এসে বিলীন হয়। তিনিই কন্যা রূপে লক্ষী, সরস্বতী, মাতা রূপে তিনি জগৎ জননী, তিনি দুষ্টের নাশকারী ভয়ঙ্করী। তিনি কখনো দশভুজা,কখনো অষ্ট ভুজা, কখনো চতুর্ভুজা,কখনো বারোভুজা….তিনি আদিম, তাই তাঁর প্রকৃত রূপকে অনুধাবন করা আমাদের নিকট দুঃসাধ্য। আমাদের নিকট যা দৃশ্যময় জগৎ সকলই তিনি।
খটঙ্গা রায় পারিবারের মেজরানীর বংশধর নডিহি বা নওয়াডিহির রায় পরিবার।কৃষিকে তাঁরা জীবিকা হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন।তবে শোনা যায় এই পরিবারের জমিদারী মহাল কিছুটা ছিল বিলকান্দি, বাঁশকুলী ইত্যাদি জায়গায় এবং আরো কিছু স্থান যেগুলি রাজনগরের রাজাদের দেওয়া। বিলকান্দি অঞ্চলের জঙ্গলে একটা বিরাট হাতি মারা গিয়েছিল, যে হাতিটি ব্রিটিশ সরকার খবর পেয়ে সেটা নিয়ে গিয়ে কলকাতার জাদুঘরে সংরক্ষণ করে। সে সময় রীতি অনুসারে জমিদার হিসাবে নওয়াডিহি তে খবর দেওয়া হয়। বাঁশকুশলী বিহার এলাকায় ছিল। এই পরিবারের কেউ রাজনগরে রাজার অধীনে কর্মচারী ছিলেন। কথিত আছে ওই কর্মচারী রাজাকে চালভাজা খাইয়ে সন্তুষ্ট করেছিলেন।তাতে খুশি হয়ে ১৬ বিঘা নিষ্কর সম্পত্তি দান করেন। দলিল টি নিম্ন রূপ-
” চালভাজা খাইয়া খোস হইয়া ওই নিষ্কর সম্পত্তি হুকুম হই।”
রায় বংশধর অসীম কুমার রায়ের পূর্ববর্তী চতুর্থ পুরুষ মহানন্দ রায়ের নামে একটি পুকুর রয়েছে এই গ্রামে মোহনাগড়ে।
পটের পূজাটি বংশপরম্পরায় প্রচলিত এবং পূর্বেই বলেছিলাম যে বংশের আরাধ্যা মগধেশ্বরী কালী থাকার জন্যই প্রতি বংশধর আলাদা বাস করলেও দুর্গা পটে পূজিতা হন। একসময় বাজার থেকে পট ক্রয় করে আনা হত। তারপর পট আঁকতেন তারাপদ সূত্রধর , কাজল সূত্রধর। ২০০৬ সাল থেকে পট আঁকেন গ্রামেরই শিল্পী জনার্দন মিস্ত্রী।
রায় বাড়ির লাগোয়া দুর্গা মন্দির। টিনের ছাউনি প্রাচীন ধাঁচের বাড়ি।সারাবছর মন্দিরে পট রাখা থাকে।পরের বছর দুর্গা পাঞ্চমীতে বিসর্জন হয়।
চোরমুড়োর রায় পরিবারের পূজার উৎস খটঙ্গা।এনাদের পদবী ছিল সিংহ। কারন এই সব রায়েরা সকলেই বীর রাজার বংশধর।খটঙ্গা ভাণ্ডারীবন ছিল মূল উৎসস্থল। বহু বছর পূর্বে নগরী – মাধাইপুর হয়ে চোরমুড়ো আসেন তাঁরা পত্তনীদার হিসাবে।এখনো ভাণ্ডারীবনে গোপাল হলেন এই পরিবারের ইষ্টদেবতা।
২৫০ পূর্বে কালীচরণ রায় মহাশয়ের সময় থেকে এখানে পটের পূজা হয়। পূর্বে মূর্তিপূজা হত। সেই প্রথা আজও প্রচলিত। পট আঁকেন সিউড়ির সমীরণ সরকার মহাশয়। ৭-৮ বছর আগে সিউড়ির মালিপাড়া থেকে পট আসত। পূজার পর পট থাকে মন্দিরে। পরের বছর দুর্গা পূজার পাঞ্চমীতে পুরানো পট বিসর্জন হয়। এই পরিবারের পূজা হয় বৈষ্ণব মতে হলেও এখানে চালকুমড় ও অষ্টমীতে সাদা পাঁঠা বলি হয়। বিভিন্ন সমালোচকদের তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায় সাদা পাঁঠা ছিল ইংরেজ বিরোধিতার প্রতীক। তাছাড়া অষ্টমীর পাঁঠা সব সময় এক রঙের হতে হয়।
একসময় এখানে পূজার খরচ ২৪ টাকা ছিল। কিছু দেবোত্তর সম্পত্তি থাকলেও পরে তা বসতি স্থাপনের নিমিত্ত বিলি করা হয়।এখন কেবল শরিকি ব্যবস্থাতেই পূজা চলে।
১৫০ বছর পুরানো মাধাইপুরের রায় পরিবারের পূজা। পরিবার ও পূজার উৎস খটঙ্গা। এনারাও বীর রাজার বংশধর।পূজার বর্তমান শরিক তিনটি। পূর্বে এখানে মাটির মন্দির ছিল । ১৯৯৪ সালে এটি পাকা হয়।পটটিও পাকা, এলুমনিয়ামের পাতের উপরে ছিলা কেটে সপরিবারে দুর্গা পট আঁকা হয়েছে। পূর্বে হাতে আঁকা পট ছিল ,যা করমকাল গ্রামের শিল্পীরা আঁকতেন। পরে তাঁতিপাড়া গ্রামের শিল্পীরা আঁকতেন। হয়ত নিপুণ হাতে আঁকা হলে পটের পরিবর্তন হত না। কিন্তু কি আর করা যাবে…..? বর্তমান পটটি নির্মাণ করে দিয়েছেন দুর্গাপুর সেন্টার মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের এক টেকনিশিয়ান ।
আগে ছাগ বা পাঁঠা বলি থাকলেও এক বছর খুঁত হয়। তাই এখন অষ্টমীতে চালকুমড়া , নবমীতে আখ বলি হয়। শোনা যায় এক সময় একটি চালকুমড়ার দাম ছিল এক পাঁঠা সমান। পরিবারের নিকট রেকর্ড আছে ১ টাকা ২৫ পয়সা দিয়ে একটি পাঁঠা কিনতে পাওয়া যেত। এসব দিকে চালকুমড়ার চাষ হত না। বাংলার নদী মাতৃক এলাকা থেকে এগুলি সংগ্রহ হত বলে দাম পড়ত এক পাঁঠা সমান। পূর্বে ৫ বিঘা জমি সম্পত্তি ছিল।এখন ডাঙা জমি ,ফসল হয় না।পূজার খরচ তিনশরিক মিলে মিশে করেন।
রাজনগরের দে পরিবার পটের দুর্গা পূজার নিমিত্ত একটি উল্লেখযোগ্য পরিবার। এনাদের আদি বাস ছিল মধ্যপ্রদেশ। এই বংশের ঊর্ধ্বতন অষ্টম পুরুষ রুদ্রচরন দে মহাশয় ৩০০ বছর পূর্বে রাজনগরে এসে বসতি স্থাপন করেন। তিনিই পূজার সূচনা করেন। এই সময় রাজনগরে চলছিল নবাবী আমল। তাই মূর্তি বিরোধীতার একটা সূক্ষ্ম ঘটনা ছিলই। উপরন্তু প্রতিমা গড়ার লোকও ছিল না। তাই নবপত্রিকাই পূজা হত।তাছাড়া পূর্বেই বলেছিলাম এই পরিবারে অষ্টধাতুর মা সিংহবাহিনী আছেন। তাঁর প্রতিবিম্ব আয়নায় পড়ে না। তাই পটের সাহায্য নিতে হয়। সেই পটের ছবি আয়নায় পড়লে মায়ের স্নান , আবাহন সম্ভব হয়।
নবপত্রিকা নদী বা পুকুর থেকে আনা হয় না। নবপত্রিকা স্নান বা অন্যান্য পূজার কাজ বাড়ির উঠানেই সম্পন্ন হয়। পূর্বে মন্দিরের পাশে একটি একটি কূপ ছিল। সেই জলেই বারি বা ঘট স্থাপন হত। এখন কুপটি নেই।পাশের বাড়ি থেকে জল এনে উঠোনে সমস্ত রীতি পালিত হয়। রাজনগরের নেপাল মালাকার পট আঁকেন। প্রত্যেকে পূজার নিজস্ব দায়িত্ব পালন করেন।কাউকেই বলতে হয় না হয় না। পারিশ্রমিক তিন বছর অন্তর বাড়ানো হয়। পাকা মন্দিরে মা সিংহ বাহিনী এবং সপ্তদেবী ( সর্বমঙ্গলা) থাকেন। মন্দিরে শালগ্রাম শিলাও আছেন।শাক্ত মতে মায়ের পূজা হয়। তাই সন্ধি পূজা শুরু হবার পূর্বে শালগ্রাম রূপী বিষ্ণু কে অন্য বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। বলি প্রচলিত আছে। সন্ধি পূজা ও দশমীর বিসর্জনের পর বলি প্রচলিত আছে। রাত্রে বিসর্জন হয়। এর জন্য এক বিষেশ কারন আছে- একবার বিসর্জনের দিন সংখ্যায় লঘুদের কোনো উৎসব ছিল। বিসর্জন দিতে দেবে না ও বাজনা বাজাতে দেবে না এই মর্মে রাস্তাকে অপবিত্র করা হয়। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে প্রচন্ড বৃষ্টিতে রাস্তা পরিষ্কার হয়ে যায়। সব মলিনতা মুছে পবিত্র হয়ে যায় পথ। দশমীর রাতে হল ঘট বিসর্জন হল। সেই থেকেই রীতি চলে আসে দশমীর পর বলি ও সেই রক্ত দিয়ে তিলক পরে বাড়ি ঢোকেন। যে অপমান ধুয়ে বিসর্জন হয়েছিল তাকে রক্ত তিলক করে বাড়ির মানুষজন গৃহে প্রবেশ করেন। বারি বা ঘট নিয়ে মন্দির থেকে বেরিয়ে এলে বাড়ির অন্যান্য সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে যান।বলি হলে বাড়ি ফেরেন।
উক্ত ঘটনার পর নবাব রা ডেমেজ কন্ট্রোলে নামে ও মায়ের নামে দুইটি পুকুর দান করেন।বর্তমানে পুকুর থেকে যা আয় হয় তাতে পূজার খরচ উঠে আসে। দেবোত্তর সম্পত্তি কিছু ছিল, পরে বর্গা হয়ে বেদখল যায়। সপ্তমীতে চালকুমড়া , অষ্টমী ,নবমী ও দশমীতে ছাগ বলি হয়। পট বিসর্জন হয় না। মন্দিরেই থাকেন।
নাকাশ রাজনগরের নন্দী বাড়ির পূজা ৪০০ বছরের পুরাতন। এনাদেরও নেপাল মালাকার পট এঁকে দেন। আগে পট কেনা হত। পটটি বিসর্জন হয় না।চালকুমড়া, আখ এব্বগ অষ্টমীতে ১ টি ও নবমীতে অন্তত দুইটি ছাগ বলি হয়।মায়ের নামে একটি পুকুর আছে । মাছের আয় থেকে পূজার খরচ হয়। বাকি নিজেরাই দিয়ে দেন।
চন্দ্রপুরের জামিরা গ্রামে একটি মাত্র পূজা ও তাহল সিংহ পরিবারের পটের দুর্গা পূজা। সমস্ত গ্রাম এই পূজাকে কেন্দ্র করে মাতোয়ারা থাকেন। পূর্বে পুরো গ্রামেই ক্ষত্রিয়দের বাস ছিল। বীরভূমের বীররাজা হীরাখুনি ঘাট পাহাড়া দেবার জন্য জামড় বা জামিরার ক্ষত্রিয়দের এখানে নিয়ে আসেন। এই পরিবারে সেই বীররাজার সময় থেকেই পূজা হয়ে আসছে। রাজা ১৬ টি হালের নিস্কর জমি দান করেছিলেন। বর্তমানে এনাদের পাঁচ শরিক। গ্রামের মন্দিরটি গ্রামের মানুষ ও পুরোহিত মৃত্যুন্জয় মুখার্জির প্রচেষ্টায় নতুন করে সজ্জিত হয়ে উঠেছে। মায়ের প্রতি এই এলাকার মানুষের অগাধ বিশ্বাস। সিউড়ির রত্নাকর মালাকার পট আঁকেন। মায়ের সঙ্গে মহাবিদ্যা রূপে সরস্বতী ও শস্য স্বরূপা রূপে দেবী লক্ষীর মুখও থাকে। পট্টি লাল পাড় সাদা শাড়ি দিয়ে ঘোমটা পরিয়ে সাজানো থাকে। পট সারাবছর দুর্গা মন্দিরে থাকেন। সকল শাস্ত্রীয় আচার অনুসারে পূজা হয়। মহাপ্রদীপ জ্বলে চারদিন ধরে।সপ্তমীতে চালকুমড়া , অষ্টমীতে সাদা পাঁঠা , নবমীতে যে কোনো রঙের পাঁঠা বলি হয়। কোনো দেবোত্তর সম্পত্তি নেই। পুজোর মোট খরচ ৪০০০০ টাকা চাঁদা করে তোলা হয়। পট বিসর্জন হয় পরের বছর দুর্গা পূজার বারি আনার সময়।
নগরী গ্রামের পাশেই বড় গাঁ বা বড়গ্রাম, সেখানেও এক সিংহ পরিবার বাস করেন। গ্রামের অন্যতম একটি সম্পত্তি একটি শিলালেখ। তাতে বরাহ, গাধা এবং মহিষের খোদাই চিত্রের নীচে প্রাচীন বাংলা হরফে কিছু লেখা । কিন্তু তা কালের নিয়মে এমন ভাবেই ক্ষয়িত হয়েছে যে পাঠোদ্ধার সম্ভব হয় নি। এক সময় এই গ্রাম লাট হুকমাপুরের অধীনে ছিল । এই সিংহরা ছিলেন রাজপুত। রাজার সঙ্গে তাদের এখানে আগমন ।তবে কোন রাজা, কোথা থেকে কবে এসেছে ?….সে সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায়না ।
হুকমাপুরছিল নিস্কর ।কোন রাজা, নবাব ,ব্রিটিশ সরকার তাদের কাছ থেকে খাজনা নিতে পারবেন না এরকমই নাকি লেখা ছিল শিলালিপিতে। এই সম্পর্কিত একটি দলিল ছিল। কিন্তু সেটি এখন হারিয়ে গেছে। এখানে পূজা শুরু হয়েছিল ৩০০ থেকে ৩৫০ বছর আগে পৃথ্বীরাজ সিংয়ের সময় থেকে । এটি এখন ৪ শরিকের প্রায় ১১ টি পরিবারের সম্মিলিত পূজা পূজা হলেও গ্রামের প্রতিটি লোক পূজায় যোগদান করেন। গ্রামে ঢুকতেই সামনে দুর্গা মন্দির। মন্দিরের পাশে রয়েছে শিলালেখটি।পট কিনে আনা হয় সিউড়ির মালিপাড়া থেকে ।পূজার পরে পট বিসর্জন হয়না। সারাবছর মন্দিরে পট রক্ষিত থাকে । বিসর্জন হয় পরের বছর দশমীর দিন । উল্লেখ্য এখানে বলি প্রথা আছে।
গণপুর গ্রাম বীরভূমে বিখ্যাত তার টেরাকোটার মন্দিরের জন্য। এছাড়াও গনপুর অঞ্চল একসময় বিখ্যাত ছিল বীরভূমে দেশীয় পদ্ধতিতে লৌহ উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে। ইংরেজ আমলের বিস্তীর্ণ একটি অঞ্চল পরিচিত হয়েছিল লোহামহল হিসাবে । এই লোহামহলের অন্যতম একটি গ্রাম হচ্ছে গণপুর। উহীনচাঁদ চৌধুরী হলেন গণপুর চৌধুরী পরিবারের আদিতম নাম। তিনি কোথা থেকে এসেছিলেন কি করেছিলেন তার সম্পূর্ণ সম্ভব হয় না। তবে সম্ভবত কর্মকার ও শালুইদের মধ্যে তিনি হয়ে উঠেছিলেন অন্যতম একজন বনিক এবং এইভাবে বেশকিছু অর্থ তিনি রোজগার করেন। তারপর চৌধুরী বংশের উল্লেখযোগ্য নাম অকিঞ্চন চৌধুরী। তাঁর মৃত্যু হয় ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে। তাঁর মৃত্যুর আগে একটি ঘটনা ঘটে-
রাজা জয়চন্দ্র রায় ছিলেন দামড়ার রাজা। রাজনগরের নবাবের পক্ষে আলীনকি খাঁর অতর্কিত আক্রমন করে জয়চন্দ্রকে হত্যা করে। তত্ত্বগতভাবে এখানে গৌরীহরি মিত্রের বীরভূমের ইতিহাস থেকে জানা যায় – প্রথমবার উক্ত আলীনকি খাঁ দামড়া আক্রমণ করে জয়চন্দ্র জ্যেষ্ঠ পুত্র রাজচন্দ্রকে পরাজিত করতে পারেনি । পরে রাজচন্দ্রের একাকীত্ব বুঝতে পেরে আলীনকি খাঁ পুনরায় দামড়া আক্রমণ করে এবং রাজচন্দ্রকে হত্যা করে। রানী রাজ সেনাপতি নারায়ন দলুই এর অনুরোধে তিনটি শিশু নিয়ে মলুটিতে চলে যান। আলীনকি দামড়ার বিপুল পরিমাণ সম্পদ লুন্ঠন করে ঘোড়ায় করে নিয়ে যাওয়ার সময় একটি ঘোড়া হারিয়ে গিয়েছিল । সেই ঘোড়া ও তার পিঠে থাকা বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি অকিঞ্চন চৌধুরী ভাগ্যক্রমে লাভ করেছিলেন বলে জানা যায় । সেই সম্পত্তি গনপুরের চৌধুরী পরিবারের সমৃদ্ধির অন্যতম কারণ ছিল। এরপর গঙ্গারাম চৌধুরী চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জমিদারি কেনেন। এছাড়াও বেশ কিছু সম্পত্তির বন্দোবস্ত পেয়েছিলেন। তাছাড়াও চৌধুরী পরিবারের কুলদেবতার পুরোহিত ঘোষালচন্দ্র চক্রবর্তী মহাশয় ১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দের সময় কালে কোন ১০০ থেকে ১৫০ বিঘা সম্পত্তি বন্দোবস্ত পান।
তথ্য থেকে জানা যায় আনুমানিক ৩১৫ থেকে ৩১৬ বছর আগে দুর্গাপূজা শুরু…. গ্রামে মোট তিনটি পূজা হয় । দুইটি পট ও একটি মৃন্ময়ী। তবে চৌধুরীদের পটের পূজার জমক সবথেকে বেশি। মুদিয়ান গ্রামের শ্যাম পটুয়া পট আঁকেন। দুর্গা ,লক্ষ্মী, সরস্বতী , কার্তিক , গণেশের আলাদা আলাদা চিত্র সম্মিলিতভাবে বিশাল আকৃতি ধারণ করেছে।
একই চত্বরের মধ্যে লক্ষ্মীনারায়ণ, অকিঞ্চনেশ্বর শিব, দুর্গা মন্দির অবস্থান করছে। তার মাঝখানে এক বিশাল নাট মন্দির। পূজার খরচ এক লক্ষ কুড়ি হাজার টাকা। উক্ত মন্দিরগুলির নামে ১৫০ বিঘা জমি পুকুর সহ সম্পত্তি রয়েছে। এখান থেকে বার্ষিক আয় হয় তা থেকেই সকল পূজা-অর্চনার কাজ হয়। বলিদান হয়। সপ্তমীতে ১ সাদা ছাগ,অষ্টমীতে ৩ সাদা ছাগ, নবমীতে ৩ সাদা বা কালো ছাগ বলি হয়। পূজায় ঢাক ,ঢোল বাজানো বাধ্যতামূলক। পট বিসর্জন হয় না। মন্দিরেই অবস্থান করেন সারা বছর।
এভাবেই সমগ্র বীরভূম জুড়ে ছড়িয়ে আছে অজস্র পটের দুর্গা পূজা ও সেই সব পূজার দারুন সব ইতিহাস। এর পরের পর্বে আমি আরো কয়েকটি পূজার কথা বলে আমি লেখাটি শেষ করব।
দুই হাতে–
কালের মন্দিরা যে সদাই বাজে ডাইনে বাঁয়ে দুই হাতে,
সুপ্তি ছুটে নৃত্য উঠে নিত্য নূতন সংঘাতে॥
বাজে ফুলে, বাজে কাঁটায়, আলোছায়ার জোয়ার-ভাঁটায়,
প্রাণের মাঝে ওই-যে বাজে দুঃখে সুখে শঙ্কাতে॥
তালে তালে সাঁঝ-সকালে রূপ-সাগরে ঢেউ লাগে।
সাদা-কালোর দ্বন্দ্বে যে ওই ছন্দে নানান রঙ জাগে।
এই তালে তোর গান বেঁধে নে– কান্নাহাসির তান সেধে নে,
ডাক দিল শোন্ মরণ বাঁচন নাচন-সভার ডঙ্কাতে॥
#ক্রমশঃ
#দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ ১. পটের দুর্গা : বীরভূম
২.পট : বিমলেন্দু চক্রবর্তী