#পর্ব_১
ত্বং স্বাহা ত্বং স্বধা ত্বং হি বষট্কারঃ স্বরাত্মিকা।
সুধা ত্বমক্ষরে নিত্যে ত্রিধা মাত্রাত্মিকা স্থিতা।।
অর্ধমাত্রা স্থিতা নিত্যা যানুচ্চার্যা বিশেষতঃ।
ত্বমেব সা ত্বং সাবিত্রী ত্বং দেবজননী পরা।।
ত্বয়ৈব ধার্যতে সর্বং ত্বয়ৈতৎ সৃজ্যতে জগৎ।
ত্বয়ৈতৎ পাল্যতে দেবি ত্বমৎস্যন্তে চ সর্বদা।।
বিসৃষ্টৌ সৃষ্টিরূপা ত্বং স্থিতিরূপা চ পালনে।
তথা সংহৃতিরূপান্তে জগতোঽস্য জগন্ময়ে।।
তুমি হোম, শ্রাদ্ধ ও যজ্ঞে প্রযুজ্য স্বাহা, স্বধা ও বষট্কাররূপে মন্ত্রস্বরূপা এবং দেবভক্ষ্য সুধাও তুমি। হে নিত্যে! তুমি অক্ষর সমুদায়ে হ্রস্ব, দীর্ঘ ও প্লুত এই তিন প্রকার মাত্রাস্বরূপ হইয়া অবস্থান করিতেছ এবং যাহা বিশেষরূপে অনুচার্য ও অর্দ্ধমাত্রারূপে অবস্থিত, তাহাও তুমি। তুমিই সেই (বেদ সারভূতা) সাবিত্রী; হে দেবি! তুমিই আদি জননী। তোমা কর্তৃকই সমস্ত জগৎ ধৃত এবং তোমা কর্তৃকই জগৎ সৃষ্ট হইয়াছে। তোমা কর্তৃকই এই জগৎ পালিত হইতেছে এবং তুমিই অন্তে ইহা ভক্ষণ (ধ্বংস) করিয়া থাক। হে জগদ্রূপে! তুমিই এই জগতের নানাপ্রকার নির্মাণকার্যে সৃষ্টিরূপা ও পালনকার্যে স্থিতিরূপা এবং অন্তে ইহার সংহার কার্যে তদ্রূপ সংহাররূপা।
মা দুর্গা… সমগ্র হিন্দুজাতি তথা সমগ্র জগতের নিকট মাতৃস্বরূপা। আবার তিনি মায়ের নিকট কন্যা স্বরূপা।তিনি কখনো সিংহবাহিনী , কখনো তিনি ব্যাঘ্রবাহিনী জগদম্বা শেরাবালী, কখনো তিনি মহাবিদ্যা শারদা , কখনো তিনি শস্যশ্যামলা শাকম্ভরি মহালক্ষ্মী। আশ্বিনের চারিটি দিবস জুড়ে আনন্দময়ী তাই আসেন এই ধরাধামে। মানবকুল তাঁর প্রাণ প্রিয় কন্যা , স্নেহময়ী মা কে নিয়ে হৃদয়ের উচ্ছাসে ভেসে যায়। সব অশুভ , সব দুঃখ , সব ব্যাথা সেই দেবীপক্ষে থমকে দাঁড়ায়।
আর আজ আমরা আলোচনা করব সেই মা দুর্গার পটের কথা ও চিত্রকরদের কথা নিয়ে। আজকে আমাদের বিষয় থাকবে বীরভূমে মা দুর্গার পটচিত্র ।
বীরভূম , পশ্চিমবঙ্গের প্রাচীনতম জেলা গুলির মধ্যে অন্যতম।বহু বহু প্রাচীনকাল থেকে এই বঙ্গে , এই বীরভূমে অস্ট্রিক, দ্রাবিড়,এল্পীয়, নোরডিক গোষ্ঠীর মানুষ এসে ভিড় করেছেন।তারপর মৌর্য, গুপ্ত, পাল, সেন ইত্যাদি সময়কাল পর হয়ে বীরভূম তার রূপ লাভ করে ইংরেজ আমলে। দীর্ঘকালের এই বির্বতনের ফলে এই অঞ্চলে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন জনজাতির বিচিত্র জীবনাচরণের ছাপ। খুব সহজ ভাবে বলতে গেলে বীরভূম হল ধর্ম- সংস্কৃতি – জীবনাচরণের এক জীবন্ত যাদুঘর। বীরভূমবাসীর বর্তমান জীবন যাপনের মধ্যে এই সমস্ত ছাপ এখনো সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে খুঁজে পাওয়া সম্ভব। প্রাচীন সনাতন- বৌদ্ধ – জৈন …. ইতিহাসের দৃষ্টিতে এ এক অমূল্য পরিক্রমন।বর্তমানে বীরভূম নামে পরিচিত অঞ্চলটি প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই জনবসতিপূর্ণ। আউসগ্রামের পাণ্ডুরাজার ঢিবি সম্পর্কিত কয়েকটি তাম্রপ্রস্তরযুগীয় প্রত্নস্থল এই জেলায় অবস্থিত। জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে প্রস্তরযুগের নানা নিদর্শনও পাওয়া গেছে।
#আচারাঙ্গ_সূত্র নামক একটি প্রাচীন জৈন ধর্মগ্রন্থের বিবরণী অনুযায়ী, সর্বশেষ (২৪তম) তীর্থঙ্কর মহাবীর ভ্রমণ করতে করতে এই অঞ্চলে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন। উক্ত গ্রন্থে খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকের এই অঞ্চল বজ্জভূমি ও সুহ্মভূমি অঞ্চলে স্থিত লাঢ়ার পথহীন দেশ নামে চিহ্নিত হয়েছে। কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে রাঢ় অঞ্চলে বৌদ্ধ ও জৈন কাল্ট প্রচার ছিল এই অঞ্চলের বহির্ভূত ধর্মকরণের একটি অঙ্গ। #দিব্যাবদান নামক একটি বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থের ভিত্তিতে ডক্টর অতুল সুর দেখিয়েছেন যে গৌতম বুদ্ধ এই অঞ্চলের উপর দিয়েই ভ্রমণ করে পুণ্ড্রবর্দ্ধন ও সমতট অঞ্চলে যান।
রাঢ় অঞ্চল কোনো এক সময় মৌর্য সাম্রাজ্যের অঙ্গীভূত হয়। পরবর্তীকালে এই অঞ্চল গুপ্ত সাম্রাজ্য, শশাঙ্ক ও হর্ষবর্ধনের সাম্রাজ্যভুক্তও হয়েছিল। হর্ষবর্ধনের সাম্রাজ্যের পতনের পর খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত পাল রাজারা এই অঞ্চল শাসন করেন। তারপর এই অঞ্চলের শাসনভার সেন রাজাদের হস্তগত হয়। পালযুগে বৌদ্ধমত, বিশেষত মহাযান বৌদ্ধকাল্ট, এই অঞ্চলে বিকশিত হয়ে উঠেছিল। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে চীনা পর্যটক হিউয়েন সাং তাঁর ভ্রমণ-বিবরণীতে এই অঞ্চলে তাঁর দেখা কয়েকটি মঠের বর্ণনা দিয়েছেন।
কিন্তু এই অঞ্চল আরণ্যক ও রুক্ষ।
বীরভূমের মহিষডাল থেকে প্রত্নক্ষেত্র উৎখননের ফলে প্রাপ্ত তথ্যে জানতে পারি আজি হত্ৰ প্রায় তিন হাজার বৎসর পূর্বে সভ্যতার আলোকে আলোকিত একদল নৃ গোষ্ঠীর মানব কুল হেথায় বাস করত।
উক্ত বিষয় শ্রদ্ধেয় দেবকুমার চক্রবর্তী মহাশয় বলেছেন –
” আদি ঐতিহাসিক যুগে যে লিঙ্গ পূজা যে উৎপত্তি এখানে দেখা যায় পরবর্তী কালে সেই পূজা ব্যাপক বিস্তার লাভ করে।” আত্মধ্যানে স্ব-স্বরূপে লীন থাকেন। আর সব মানুষকেও আত্মনিমগ্ন তথা ধ্যানমগ্ন হতে উপদেশ দেন। “লয়ং যাতি ইতি লিঙ্গম্”- অর্থাৎ যাঁর মধ্যে সমস্ত কিছু লয় প্রাপ্ত হয়, তাই লিঙ্গ। লিঙ্গ শব্দটির উৎপত্তি সৎস্কৃত লিঙ্গম্ শব্দ থেকে যার অর্থ প্রতীক বা চিহ্ন।
বীরভূমের বিভিন্ন স্থানে প্রতিষ্ঠিত শিবমন্দির এই অঞ্চলের ধর্মাচরণের দিকে বিশেষ ভাবে ইঙ্গিত প্রদান করে। অর্থাৎ বৌদ্ধ , জৈন ইত্যাদি কাল্ট বা মতের আগমনের আগেই বীরভূম শৈব উপাসক হিসাবে প্রসিদ্ধ হয়েছিল। পরে বীরভূমে বৌদ্ধ মতের প্রভাব যতখানি দেখা যায় ততখানি জৈন প্রভাব দেখা যায় না। বীরভূম ও মালভুমির বিস্তৃত ক্ষেত্রে ধর্ম ঠাকুর, মৌলিক্ষা দেবী বা লাল তারা বা পান্ডারা দেবী, তারা মা বা নীলতারা বা নীল সরস্বতী র অবস্থান, নানা জনজাতির আচরণে বৌদ্ধমত প্রভাব অনায়াসে লক্ষিত হয়।
ডক্টর রেবতী মোহন সরকারের ” লোকদেবী মনসার মঙ্গলগাথা এবং লোকসমাজ ও সংস্কৃতি” উল্লেখ আছে যে, রাঢ়ের জঙ্গলাকীর্ণ এবং দুস্তর পথঘাট সমন্বিত পরিবেশে বহিরাগত ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রভাব পড়তে পারেনি, আদিম সংস্কৃতির মূলে তা কখনোই কুঠারাঘাত করতে পারেনি।তাই বীরভূম বাসী তান্ত্রিক সহজিয়া বৌদ্ধ কাল্টকে গ্রহণ করেছিলেন।
বীরভূম এই নাম করনের পিছনে কয়েকটি মত আছে বীরভূমের নামের কথা অনেকেই বলে থাকেন বীরপুত্রদের দেশ হিসাবে। এখানকার প্রাচীন আদিবাসীগণ ছিলেন যুদ্ধকুশল। নিজেদের বহিঃশত্রুর হাত থেকে রক্ষা করার জন্যই তাঁরা যুদ্ধে পারদর্শী হয়েছিলেন। এই সকল বীর যোদ্ধা এখানে বাস করতেন বলেই এই স্থানের নাম হয় “#বীর_ভূমি”।
“দিগ্বিজয় প্রকাশ” গ্রন্থে রাঢ় ভূমির যে সীমার বর্ণনা পাওয়া যায় তা নিম্নরূপ-“গৌড়সঃ পশ্চিমে ভাগে বীরদেশস্য পূর্বতঃ,দামদরোত্তর ভাগে রাঢ়দেশস্যঃ প্রকর্তিত।।”
এই শ্লোক থেকেই বীরভূম নামের উৎপত্তি বলে একটি মত প্রচলিত আছে।
অন্য একটি মতে #বীরাচারী তান্ত্রিকদের দেশ বলে এই স্থানের নাম হয় বীরভূম।
সুবর্ণগ্রাম ও লক্ষনাবতী গ্রামের দুই শাসকের মধ্যে ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দের আগে ও পরে যুদ্ধ ও কলহ বর্তমান ছিল। সেই দ্বন্দ্বের সুযোগ কাজে লাগিয়ে “#বীর” উপাধিধারী এক হিন্দু রাজা, তৎকালীন লখনুরে (বর্তমান রাজনগরে) নিজের আধিপত্য বিস্তার করেন। তাঁর নেওয়া বীর উপাধি থেকেই বীরভূম নাম এসেছে বলে অনুমান করা হয়।
বল্লাল সেনের #সীতাহাটি তাম্রশাসন থেকে জানা যায়- #বীরসেন নামে কোনও এক চন্দ্রবংশীয় রাজা ছিলেন। তারই বংশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সামন্তসেন, বিজয়সেন, বল্লালসেন ইত্যাদি নৃপতিগণ। অনেকের মতে এই সকল রাজারাই তাদের পূর্বপুরুষ বীরসেনের নামে এই অঞ্চলের নাম রাখেন বীরভূম।
আরেকটি মত অনুসারে, প্রায় সাতশ বা আটশ বছর আগে পশ্চিমত্তর প্রদেশ থেকে বীর সিংহ ও চৈতন্য সিংহ নামে দুই ভাই এই স্থানে এসে এখানকার অসভ্য আদিবাসীদের পরাস্ত করে, #বীরসিংহপুর নামে নিজেদের রাজধানী স্থাপন করেন। এই বীর সিংহ রাজাই বীরভূমের আদি হিন্দু ক্ষত্রিয় রাজা ছিলেন। প্রবাদ আছে যে রাজা বীর সিংহ, জরাসন্ধ রাজ বা তাঁর পুরোহিতের বংশধর ছিলেন এবং তিনিই ছিলেন বীরভূমের শেষ হিন্দু রাজা। ইনি মুসলিম শাসকদের সাথে যুদ্ধে নিহত হন ও তাঁর স্ত্রী কালীদীঘির জলে ডুবে আত্মহত্যা করেন। প্রবাদ আছে যে, তিনি নাকি এতই বলশালী ছিলেন যে হাতের মুঠোয় সর্ষে পিষে তেল বার করতেন। তাঁর নামেই এই স্থানের নাম হয় বীরভূম।
সাঁওতালি ভাষায় ‘#বির’ শব্দের অর্থ হল জঙ্গল। অনেকে মনে করেন যে অতীতে এই স্থান ছিল জঙ্গলময়, তাই জঙ্গলময় স্থান থেকেই বীরভূম নামের উৎপত্তি।
সুতরাং বীরভূম প্রাচীন, তা জঙ্গলময় , তা আদিম অধ্যুষিত। এই বীরভূম ও ছোটনাগপুর মালভূমি জঙ্গল সংকুল এই অঞ্চলের বিভিন্ন লোকদেবতাগুলিকে প্রত্যক্ষ করলে উপলব্ধি হয় এ অঞ্চলে প্রাচীন ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রবলতা। বলাবাহুল্য এই প্রভাব ই বীরভূমের মানুষকে , বীরভূমের সংস্কৃতিকে প্রকৃতি ও প্রতীকের প্রভাবকে দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর করেছে। নানা লৌকিক #বুড়ি দেবী, ধর্ম পূজা, চন্ডী, মনসা, গ্রামদেবী এবং লৌকিক জীবনে এই সমস্ত দেবদেবীর অংশগ্রহণ বীরভূমের মানুষকে প্রকৃতি ও প্রকৃতিকে প্রতীকের মধ্যে আসীন করে পূজায় বেশি উৎসাহিত করে। আর এখান থেকেই শুরু হয় বীরভূমের #দুর্গাপটের কথা….
নমস্তে জগচ্চিন্ত্যমানস্বরূপে নমস্তে মহাযোগিবিজ্ঞানরূপে .
নমস্তে নমস্তে সদানন্দ রূপে নমস্তে জগত্তারিণি ত্রাহি দুর্গে ..
অনাথস্য দীনস্য তৃষ্ণাতুরস্য ভযার্তস্য ভীতস্য বদ্ধস্য জন্তোঃ .
ত্বমেকা গতির্দেবি নিস্তারকর্ত্রী নমস্তে জগত্তারিণি ত্রাহি দুর্গে ….
#ক্রমশঃ
#দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ ১. পটের দুর্গা : বীরভূম
২.পট : বিমলেন্দু চক্রবর্তী