#বাংলার_লুপ্ত_ও_লুপ্তপ্রায়_কৃষিজ_দ্রব্য

#পর্ব_৬


গরিফা বহিয়া সাধু বায় ভাগীরথী

করোতোয়া এড়াইয়া পাইল সরস্বতী।

 ব্রহ্মপুত্র পদ্মাবতী যেই ঘাটে মেলা

 বুড়া মন্তেশ্বর বায় বানিঞার বালা ।

উপনীত হইলো গিয়া নিমাঞি তীর্থের ঘাটে

নিমের গাছেতে গুড় ফুল ফোটে।।


মধ্যযুগে সমকালীন বাংলা সাহিত্যের বহির্বাণিজ্যের কথা। কাব্যের চিত্র লোকজীবন এবং মঙ্গলকাব্য গুলো প্রাচীন ঐতিহ্যের অনুসারী সামাজিক চিত্র ও বানিজ্য চিত্র আমাদের সামনে তুলে ধরে।


বেতড় ছাড়িয়া সাধু পাইল নবাসন

 হিমাঞি বামেদের ওহে হিজুলির পথ 

রাজহংস কিনিঞা লইল পায়রাবত ।

বিষ্ণহরির দেউল ডাহিনে এড়াইয়া

শাঁকারাড়া বাহে সাধু মন্তেশ্বর দিয়া।

 তায় রয়্যা স্নান দান ভোজন করেন রঙ্গে

 লঘুগতি সদাগর জায় কালিপাড়া

দুকূলে যাত্রী র ঠাট ঘন পড়ে সাড়া।

সেই দিন সদাগর হ্যাথাগড়ে রয়-

রজনি প্রভাতে মেলিয়া সাত নয়।


বাংলার মধ্যযুগের এই সমস্ত কাহিনী বাংলায় বাণিজ্যের ও অর্থনৈতিক ইতিহাস গঠনে বহু সাহায্য করেছে ।বাংলার অর্থনৈতিক বৃত্ত জানার জন্য কবিদের এই কাব্য চিত্র আমাদের কাছে বিদেশি পর্যটকদের লেখনির ন্যায় সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ ।


মধ্যযুগের বাংলার গুরুত্বপূর্ণ অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য সাহায্যে বাংলার নানা প্রান্তের চাহিদা পরিপূরিত হত। অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য ঘাঁটিও গড়ে উঠেছিল অনেক। ঢাকা ,রাজনগর, ভগবানগোলা ,হুগলি এবং কলকাতা এর কেন্দ্রস্থল ছিল ।খুচরো বিক্রিয়ের নিমিত্ত ছিল হাট বাজার ,ছিল গঞ্জ, নদীকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য কেন্দ্র।মধ্যশ্রেণীর বণিক ও সাধারণ দোকানদারই এই শ্রেণীর বাণিজ্য টিকিয়ে রেখেছিল । দেশিয় বাজার বা গঞ্জে কি কি দ্রব্য বিক্রি হতো তা বাংলা সাহিত্যের বিশেষভাবে উল্লেখ হয়েছে।


 অষ্টাদশ শতকে বা  মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে আমরা  দেখি যে সমস্ত বাঙ্গালী বণিকদের নদীবন্দরে বাণিজ্য পসার নিয়ে ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে এবং বাংলা থেকে উত্তর ভারতের সবথেকে বেশি জিনিস আদান-প্রদান হচ্ছে রপ্তানি তালিকায় আমরা পাই – বাঙ্গালার বিখ্যাত সুতিবস্ত্র, রেশম বস্ত্র, মসলিন, চিনি, লবণ আদা, হলুদ আর আমদানি হত বিভিন্ন ফল, ঔষধ, টিন ইত্যাদি। কাঁচা সুতো ও কাঁচা রেশমের লেনদেন হত বাংলা আর গুজরাটের মধ্যে ।বছরে প্রায় ৭০ লক্ষ টাকার রেশম বাইরে যেত। ভারতের সর্বত্র বাংলার পাট ও পাটজাত দ্রব্য পৌঁছেছিল বলে আমরা বিদেশিদের লেখা থেকে জানতে পারি।


 বাংলা সাহিত্যের মধ্যে এবার এসব তথ্য নিমিত্ত সমর্থন খোঁজা যাক । মূলত মঙ্গলকাব্য গুলিতে বাণিজ্যের প্রসঙ্গ বেশি পেয়েছি। চাঁদ সদাগর , ধনপতি , শ্রীমন্ত প্রভৃতি চরিত্রের মাধ্যমে আমরা প্রতি তৎকালীন ব্যবসার কথা জানতে পারি। কবির কাব্যে সে সব কিছু ছুঁয়ে যায় বাস্তবের মাটি। প্রথমেই উল্লেখ করি ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে দ্বিজমাধব রচিত #মঙ্গলচন্ডীর_গীত এ শ্রীমন্তের বাণিজ্য যাত্রার কথা জানতে পারি। কবি রপ্তানি দ্রব্যের নাম উল্লেখ করেছেন ।সেখানে কাপড় বা বস্ত্র আর পাট কত গুরুত্বপূর্ণ ছিল?


সোনা রূপা লোহা সীসা রাঙ্গা কাপড়

তামা পিতল তোলে চামড় গঙ্গার জল।


দ্বিজ মাধব বাণিজ্যের কথা বলতে গিয়ে আরো বললেন :


লোহা সীসা লঅ সাধু যথ বাস মন।

এহার বদলে পাইবা নির্মল কাঞ্চন।।


গুয়াফল লঅরে সাধু কি কহিমু আর।

এহার বদলে পাইবা গজমতির হার।।

ঘৃণা তেজি লঅ সাধু পাটের পাছরা।

এহার বদলে পাইবা মুকুতার ছরা।।


অর্থাৎ আমরা দেখতে পাচ্ছি শ্রীমন্ত সওদাগর সোনা,রূপো, তামা, পিতল প্রভৃতি ধাতুর সঙ্গে সমান গুরুত্বপূর্ণ ভাবে রাঙা কাপড় কেও বাণিজ্যের দ্রব্য হিসেবে রাখছেন ।অপরদিকে আবার আমরা দেখতে পাচ্ছি যে পাটের পাছড়ার বদলে বণিক লাভ করছে মুক্তার ছড়া।


কবিকঙ্কন মুকুন্দ রচিত চন্ডীমঙ্গল কাব্যে ধনপতির উপাখ্যানে আমরা পাই এক দারুণ বাণিজ্যের চিত্র। সেখানে আমরা সুতো , পাট ইত্যাদির গুরুত্ব যে কত সে কথা জানতে পারি।


কুরঙ্গ বদলে মাতঙ্গ পাব নারিকেল বদলে সঙ্গ।

বিড়ঙ্গ বদলে লবঙ্গ পাব সুঁঠের বদলে টঙ্ক।।

আবার দেখতে পাচ্ছি , ধনপতি বলছেন যে,


 চিনির বদলে কর্পূর পাইব আলতার বদলে নাটী। 

সকলাত কম্বল পামরি পাব বদল করিয়া পাটি।


এস্থলে সুঁঠ বলতে সুতো বা  সুতির বস্ত্র এবং পাটি বলতে পাট কে বোঝানো হয়েছে এবং  সেই সুতি বিক্রি করে তিনি অনেক টাকা পাবেন এই কথা বলছেন । আবার পাট বিক্রি করে তিনি দামি কম্বল পাবেন সেই কথা কবি উল্লেখ করেছেন।

কাব্য গত এই সমস্ত বাণিজ্যিক দ্রব্যের উল্লেখ থেকে যে বাস্তব চিত্রটি  ফুটে ওঠে তা হল কারিগরি ,ফল , ধাতুদ্রব্য, রোগের ঔষধ, সোরা ইত্যাদির দিক থেকে বাংলা কিছুটা হলেও অন্য প্রদেশের উপর নির্ভর করলেও, ভালো সুতিবস্ত্র, মসলিন,খাদ্যশস্য ইত্যাদির জন্য বাংলা ছিল পুরোপুরি স্বনির্ভর। ধান, ইক্ষু, ইক্ষু জাত চিনি, গুড় , লবণ , ভেড়া, পায়রা , রবি শস্য,পাট ও পাটজাত দ্রব্য , সর্বোপরি বস্ত্র রপ্তানিতে বঙ্গ ভারতে সেই সময় ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ উচ্ছ্বসিত প্রশংসিত ছিল। 


  চীনা পরিব্রাজক ও দূতগন বঙ্গ  উৎপাদিত বিভিন্ন ধরনের সুতি বস্ত্রের সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন। তাঁরা ৬ প্রকার সুতি বস্ত্রের উল্লেখ করেছেন – 
১) পি পো নামে এক প্রকার সূক্ষ ও মিহি বস্ত্র, যা প্রায় প্রস্থে দুই থেকে তিন ফুট এবং দৈর্ঘে ৫৬ ইঞ্চি।
২) মান – চে – টি ছিল হলদে বস্ত্র ….যা ঠাসা বুনোন ও মজবুত ছিল।
৩) শাহ- না- কিয়ে যা প্রস্থে ৫ ফুট এবং দৈর্ঘ্য কুড়ি ফুট লম্বা ছিল। এটি চীনা কাপড় লু পু অনুরূপ ছিল।
৪) হীন -পেই – টাঙ্গ টা- লি যা ছিল ৩ ফুট প্রস্থ ও ছয় ফুট লম্বা এক ধরনের মোটা কাপড়।
৫) শা -তা – ইউর এর মাপ ছিল প্রস্থে  ৫ ইঞ্চি এবং দৈর্ঘ্য ৪০ ফুট আর এক ধরনের বস্ত্র ছিল যা প্রস্থে আড়াই ফুট এবং দৈর্ঘ্য ৪ ফুট লম্বা ।
৬ ) মা – হেই – মালি এর দৈর্ঘ্য ছিল কুড়ি ফুট বা ততোধিক এবং প্রস্থে ছিল চার ফুট। এটি দেখতে অনেকটা চীনা বস্ত্র #তুলোফিয়া বস্ত্রের মত ছিল।

মনসামঙ্গলের বণিক চাঁদ সওদাগরকে দেখা যায় সিংহলের রাজার সঙ্গে বাণিজ্য করতে। বিনিময় চাঁদসদাগর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সোনার ঘটিবাটি, সিংহাসন প্রভৃতি দাবি করছেন । এই ইঙ্গিত থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে বঙ্গে স্বর্ণের কি পরিমাণ গুরুত্ব ছিল?  স্বর্ণের পরিমাণের ওপর তখন ব্যক্তির আভিজাত্য নির্ভর করত। আর কবি জগজ্জীবন ঘোষাল তার কাব্য মারফত আমাদের জানান দেন যে খুব বেশি মাত্রায় সেসময় মশলা রপ্তানি হতো বঙ্গ থেকে । বস্ত্র রপ্তানির কথা তিনি বর্ণনা করেছেন বেশ গর্বিত ভাবে – 


পাটের ধকরা মেঘলা আর যত শাড়ি ।

যতন করিয়া লেহ কাপড়েতে জরি।। 

নানা বঙ্গ শাড়ি লেহ করিয়া যতন।

 ইহার বদলে নিব পাটের বসন ।।

জামির বদলে নিব জায়ফল জাম।

বাংলার বস্ত্র বয়ন শিল্প সম্পর্কে ফেড্রিক বারবসা বলেছেন –  এদেশে প্রচুর সুতা আছে । তারা সূক্ষ ও মিহি  অনেক প্রকারের বস্ত্র তৈরি করে। নিজেদের ব্যবহারের জন্য রঙিন বস্ত্র এবং ব্যবসার জন্য সাদা বস্ত্র রাখে । মূল্যবান কিছু বস্ত্র কে তারা ইনত্রাভানতিস বলে । এটি এক ধরনের সূক্ষ্ম কাপড়। অভিজাতরা পাগড়ির জন্য খুবই পছন্দ করেন । এই সমস্ত কাপড় ভর্তি বহু জাহাজ প্রতি বছর বিদেশে যায়। অন্যান্য যেসব কাপড় তারা তৈরি করে সেগুলির মামুনা,  দুন্ডরাজা, চৌতারি, সিনাবাফা নামে পরিচিত ছিল। সিনাবাফাকে শ্রেষ্ঠ কাপড় বলে মনে করা হয় দূর দেশের মানুষেরা এই সমস্ত কাপড় দিয়ে তৈরি জামা পরতে খুবই পছন্দ করতো।বঙ্গের এই কাপড় গুলো খুব সস্তা দামে বিক্রি হয়। এগুলো সুতো চরকায় কাটা হয় এবং পুরুষেরা বয়ন করে।বঙ্গের মত এত বেশি সুতি বস্ত্রের প্রাচুর্য পৃথিবীর অন্য কোথাও দেখেননি বলে তিনি মন্তব্য করেন। 

আমির খসরু বঙ্গের এইসব বস্ত্রে বয়নের উচ্চতর প্রশংসা করেছিলেন । তিনি লিখেছিলেন, “এই বস্ত্র এত বেশি সূক্ষ ছিল যে ১০০ গজ কাপড় মাথায় জড়ানোর পরেও তার ভেতর দিয়ে মাথার চুল দেখা যেত ।”আবুল ফজল তার বর্ণনায় উক্তিটিকে সমর্থন  করেছেন ।আবুল ফজল লিখেছেন সোনারগাঁও সরকারেেএক প্রকার মিহিন মসলিন প্রচুর পরিমাণে প্রস্তুত হয় । এগারসিন্ধু শহরে একটি বড় পুকুর আছে। এই পুকুরে ধোয়া কাপড় খুব চমৎকার ও সাদা হয়। তিনি আরো বলেন যে,বঙ্গে গঙ্গাজল নামে এক রকমের খুব মিহি কাপড় তৈরি হয়।” উল্লেখ্য একসময় এই গঙ্গাজল কাপড় খুব বিখ্যাত ছিল । কাপড়ের জমির রং গঙ্গার জলের মত ছিল, লাল পাড়। আমাদের মা ঠাকুমা দের কিন্তু একটি দুটি সেই লাল পেড়ে গঙ্গাজল রঙের শাড়ি থাকত এবং পুজোর সময় বা যেকোনো শুভ অনুষ্ঠানে সেই শাড়ি কিন্তু তারা পড়তেন। 

 সবচেয়ে সবথেকে উন্নত মানের মসলিন খুবই দামি ছিল। মির্জানাথন বলেন তিনি মালদহে চার হাজার টাকা মূল্যের একখন্ড মসলিন ক্রয় করেছিলেন।
 বঙ্গে সে সময় প্রচুর পরিমাণে কাঁচা সুতা উৎপন্ন হতো । এ থেকেই হত বিখ্যাত মসলিন। সাধারণের বিভিন্ন বস্ত্র  উৎপাদনের জন্য বোম্বাই ও সুরাট থেকে কাঁচা তুলো আমদানি করা কিন্তু বাংলার তুলোয় হত মসলিন । শাসক, অভিজাত, ধনী ব্যক্তিদের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রসার লাভ মসলিন ও রেশম শিল্প। রেশম বস্ত্র সাধারণত উত্তর পশ্চিম বাংলার কিছু অংশে তৈরি হতো ।উচ্চশ্রেণীর নারী পুরুষেরা রেশম বস্ত্র ব্যবহার করতেন। 


শুধুমাত্র আন্তদেশীয় বাণিজ্য নয় বহির্বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাংলার ভূমিকা ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ এবং তা প্রতিফলিত হয়েছে বিদেশী লেখকদের বিভিন্ন রচনাতে। ১৫৮৬ খ্রিস্টাব্দে রেলফ ফিচ বঙ্গের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র গুলিকে পরিদর্শন করেছিলেন। তাঁর রচনায় উল্লেখ বঙ্গের অন্যতম বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল : তাণ্ডা, হুগলি, সপ্তগ্রাম চট্টগ্রাম, বাকলা, শ্রীপুর, সোনারগাঁও । সাবেষ্টিয়ান মানরিখ পর্তুগিজ বণিকদের তুলাবস্ত্র ,রেশম বস্ত্র, চিনি ,মাখন, চাল ,নীল, লাক্ষা, মোম ইত্যাদি রপ্তানি দেখেছিলেন । খুলনা , মানুচি, সন্দ্বীপ, বাখরগঞ্জ, হুগলির লবণের ব্যবসার কারখানা ছিল বলে বিশেষভাবে উল্লেখ করেছিলেন। সপ্তদশ শতকে পর্যটক বার্নিয়ার মতে ,বাংলা প্রচুর পরিমাণে চিনি উৎপাদন করত ও তা গোলকুণ্ডা , কর্নাটকে রপ্তানি করত। এছাড়া মোকা ও বাসরা শহরের মাধ্যমে আরব ও  মেসোপটেমিয়া প্রভৃতি স্থানে এমনকি বন্দর বাসরার মধ্য দিয়ের পারস্যে  চিনি রপ্তানি হয়ে থাকত । 


বঙ্গের বহির্বাণিজ্যের ঐতিহ্য সুপ্রাচীন কালের। সুমাত্রা, সিংহল, মালাক্কা, পেগু, টেনাসিরিম ,  জাভা তে চাল ,চিনি ,মসলা,  মসলিন  নিয়ে দীর্ঘদিনের ছিল তার যাতায়াত। মুঘল প্রশাসনের কিছু পূর্ব থেকেই জলদস্যুদের আক্রমণের ফলে বহির্বাণিজ্যের বাঙ্গালীরা  পিছু হটতে শুরু করেছিল।  তাছাড়াও সেই সময় বাংলায় পৌছে গেছিল পশ্চিম এশিয়ার বণিক গোষ্ঠী ।তাদের সহায়তায় লোহিত সাগর ও পারস্য উপসাগরের উপকুলের দেশগুলিতে, আফ্রিকায় পূর্ব উপকূলে কেনিয়া ও মোজাম্বিতে বাংলার পণ্য পাঠানো সম্ভব হয়েছিল ।সুতিবস্ত্র ,কাঁচা হলুদ , কাঁচা সুতো ও রেশম , চাল, চিনি ইত্যাদি র বদলে বাংলা ওসব জায়গা থেকে লাভ করত ফল , ঔষধ, শাখা, টিন, তামা, ঘোড়া গোলাপজল ইত্যাদি ।


বাংলার ইতিহাসের আদি মধ্যযুগ থেকে নগর শ্রেষ্ঠী কুলের বাণিজ্যিক পরিচয় পাওয়া যায় যা মূলত কুলবৃত্তিগত বাণিজ্য। তবে এক্ষেত্রে উল্লেখ করে রাখি যে বাংলায় তাঁতি সম্প্রদায়ের কিন্তু যথেষ্ট পরিমাণে স্বতন্ত্র সামাজিক মর্যাদা ছিল। ব্রহ্মবৈর্ত পুরান অনুসারে জানা যায় বিশ্বকর্মা ও ঘৃতাচীর নয় জন পুত্র ছিলেন । তাঁরা হলেন মালাকার ,কর্মকার, শঙ্খকার, তন্তুবায় বা কুন্দিবক,  কুম্ভকার ,কাংস্যকার ,চিত্রকর অর্থাৎ পটুয়া এবং স্বর্ণকার ।এদিক থেকে বিবেচনা করলে সমাজের অন্যান্য সম্প্রদায়ের মতো  তন্তুবায় অত্যন্ত সম্মানিত এক সম্প্রদায়। প্রতিটি মঙ্গলকাব্যে কিন্তু উক্ত সম্প্রদায়ের কথা সমাজ স্তর আলোচনার সময় দেখা যায়।
   বৃন্দাবন দাসের চৈতন্য ভাগবতে মহাপ্রভুর নগর ভ্রমণের সময় যে কারিগরদের বর্ণনা দিয়েছেন তাঁতী অন্যতম। মধ্যযুগে ডোম থেকে তাঁতী , এরা প্রত্যেকে কিন্তু স্বাধীনভাবে নিজেদের পেশা মাধ্যমে তাঁর অস্তিত্বকে রক্ষা করেছেন  এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সেন আমলে কিন্তু পুরাণ অনুসারে যতজন বিশ্বকর্মার পুত্রের কথা জানতে পারি তারা কিন্তু নবশাখ গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। পরবর্তীকালে হয়তো কোনো না কোনোভাবে বিভিন্ন সামাজিক অবনতির মধ্য দিয়ে তাদেরকে সমাজে পতিত করা হয়েছিল। কিন্তু প্রথম পর্যায়ে তা ছিল না। 

সেকালে সাধারণ পুরুষের পরিধেয় বস্ত্র বিদেশি পর্যটকদের চোখ এড়ায়নি । এই সম্পর্কে বিবরণ দিতে গিয়ে স্ট্যাভরিনাস লিখেছেন –
The common people go almost naked. They wear nothing but a piece of cloth…. Wrapped round the waist and passed between the legs…


তবে যাই হোক  মধ্য যুগে আর্থসামাজিক ব্যবস্থায় মানুষের ক্রয় ক্ষমতার উপরই নির্ভর করত বস্ত্রের ব্যবহার। আটপৌরে জীবনে সাধারণ ধুতি শাড়ি ব্যবহৃত হলেও বিশেষ বিশেষ পার্বণ ,পুজো উৎসবের সাজ পোশাকের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যেত । পুজোর সময় নারীরা লালপেড়ে ও শ্বেত বস্ত্র পরিধান করতেন। যদুনাথ রচিত ধর্মমঙ্গল কাব্যে পুজায় উপবিষ্ট রানীমদনা কে সাদা বসন পড়তে দেখতে পাওয়া যায় – 
করিয়া যুগল পানি   বন্দ্যেমাতা বাগবানী 

      শুক্লবসন পরিধান।।


আবার ধর্মপূজার আয়োজন পূর্বে  রাজা হরিশচন্দ্র রানী মদনা নির্দেশ দিচ্ছেন-


শুক্লবসন লহ  বল্লুকার জলে যাহ

স্নান করি আসিয়া এখন….।


 অপরদিকে বিধবা রমণীর পরিধেয় সাদা শাড়ি। কোন রঙিন শাড়ি পরিধান করতেন না।পরিধেয় বস্ত্রের ক্ষেত্রে সামাজিক মানুষের নিকট বিষয়টি বাঁধাধরা হলেও সমাজ-সংসারের বাইরের মানুষেরও একটি সাজপোশাক ছিল ।তাঁরা হলেন সন্ন্যাসী মানুষ । যেমন যোগীদের সাজ পোশাক সম্পর্কে ধর্মমঙ্গল কাব্যে জানা যায়-


চাঁচর কুন্তলে দোহে জটা বানাইল।

সকল শরীর কৈল ভস্মে বিভূষিত।

রাজা পরিধান করিলেন পীত লোহিত।

পরিলেন মদনা লোহিত লোহিত খুত্রে ভুনি।

লোহিত খিলিকায় অঙ্গ ঢাকিলেন রানী।

মদনা যোগিনী হইল যোগী নৃপবর।


মানুষের উচ্চবিত্তের মধ্যে পট্ট শাড়ি বা ধুতি ছিল পরিধেয় পোশাক। বিশেষত সম্মানিত উচ্চবিত্ত গৃহের মহিলারা পট্ট বস্ত্র পরিধান করতেন । তা  যদুনাথের কাব্যে যেমন মেলে তেমনি কবি নরসিংহ বসু ও মানিকরামের   কাব্যেও পাওয়া যায়। যদুনাথের কাব্যে উল্লেখ হয়েছে –


পতির সংহতি  ভুঞ্জিও সুরতিপরিলা পট্টর শাড়ী।।
কিংবা , কৌতুকে পরিলা রামা দিব্য পট্ট ধুতি।


মেয়েরা ধুতি পড়তেন কখনো কখনো, উল্লেখ করেছেন কবি নরসিংহ বসু –


সাজিলা রঞ্জাবতী  হরিদ্রাবর্ণ ধুতিপরিয়া বসিলা আসনে।


শাড়ির পাশাপাশি ছিল ঘুন্ডিকা পড়ার ছিল –
ঘুন্ডিকা পরিল কটি তটে।

তবে উচ্চ-মধ্য নিম্নশ্রেণির নারীদের মধ্যে শাড়ি পরা চলছিল তা ধর্মমঙ্গলের কবির কাব্যে মেলে। নরসিংহ বসুর কাব্যে উল্লেখ করেছেন –
কাছা মারয়া পরিধান ষোল গজ শাড়ি।

কষাকষ করিয়া আঁচলে বান্ধের ফাঁড়া।।

 আরেকটি উল্লেখযোগ্য সেকালে নারীরা কাঁচুলি ব্যবহার করতেন – 
কাঁচলি পরিল বুকে লেখা রাসবঙ্গ।

গোপীনির কাছে কান্ত নাচেন ত্রিভঙ্গ।।

বা  , কাঁচুলি পরিলে অঙ্গে নানা চিত্র তায়।


 মধ্যযুগের সময়কালে মঙ্গল কাব্যের রচনা হওয়ার ফলে দেখা যাচ্ছে সেখানে পোশাকের ক্ষেত্রেও আধুনিকতার ছোঁয়ায় এসেছে । 
 অলংকার এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বস্ত্র পরিধান করতেন নারীরা। –
নীল নীলাচলে শাড়ি শোভা গৌরগায়।

গোটা চারি চাপামালা পরিল গলায়।

 পুরুষেরা ধুতি ,জামা, চাদর পরতেন । এছাড়া উৎসব-অনুষ্ঠান বিবাহ  ইত্যাদিতে মাথায় পাগরি করার প্রথা ছিল। কলিঙ্গার বিবাহে, কালুডোম ও তাঁর পুত্ররা মাথায় পাগড়ি বেঁধে উপস্থিত হন।
মাথায় পাগড়ি দিল গায়ের কাবাই।

পিতাকে সম্ভাসে শাকা শুকা দুই ভাই।।


নিম্নবিত্ত, দরিদ্রদের মধ্যে পাট ও শনের মোটা ধরনের কাপড় পড়ার নিয়ম ছিল তা আমি পূর্বেই বলেছি । 
 ছেঁড়া কানি পরিধান জুড়ে নাঞি বাস।

আপুনি পরিচয় দিবে এই অভিলাষ।।


সেই এত ঐতিহ্যশালী কার্পাস , যার নাম অনুসারে নাম হয়েছিল সেই ভূখণ্ডের বাঙ্গাল, যে রেশম শিল্পের জন্য এককালে বঙ্গ ভারতে সুবিখ্যাত হয়েছিল, সেই তুলা উৎপাদন হারিয়ে গেছে বাঙ্গলার বুক হতে। রেশম চাষ ধিকিধিকি করে অসুস্থ রুগীর মতো টিকে আছে। রেশম চাষ কমার সঙ্গে সঙ্গে তুঁত গাছও হয়ে যাচ্ছে লুপ্ত। আর পাট ? এতক্ষণ তো তার কথাও বললাম। নাহয়  পরবর্তী পর্বে আরও কিছু বলব….

#ক্রমশঃ
#দুর্গেশনন্দিনী

তথ্যঃ বাঙ্গালীর ইতিহাস : আদি পর্ব
বাংলার সংস্কৃতি : লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.