#পর্ব_৩
ভাদরের চারি আশ্বিনের চারি।
#কলাই রোব যত পারি ॥
সরিষা বনে #কলাই মুগ।
বুনে বেড়াও চাপড়ে বুক ॥
খনা বলে চাষার পো
শরতের শেষে সরিষা রো ।।
একটু কলাই এর ডাল , একটু ভাত ,একটা গন্ধরাজলেবু আর সাথে যদি জুটে যায় একটু আলুপোস্ত তাহলে জীবনে কিবা চাই…. নুন ভাত, ফ্যান ভাত , শাক ভাত , ডাল ভাত….খেটেখাওয়া মানুষ দুধ ভাতের আশা হয়ত কোনো দিনও রাখেননি বা রাখতেন না কিন্তু দিনের শেষে একটু মোটা চালের ভাত সঙ্গে একটু গরম ডালের আশা অবশ্যই করতেন এবং এখনো করেন। তো এই ডালশস্য কে বাংলায় প্রাচীন কালে কলাই বলা হত। অনেক জায়গায় লৌকিক নামের মধ্যে ডালশস্যকে কেঁড়িলি নামটিও পাওয়া যায়।বিভিন্ন লিপি যেগুলো বাংলায় প্রত্ন তাত্ত্বিক উৎখননে পাওয়া গেছে বা বিভিন্ন সাহিত্য সেখানে ডাল নামক কোনো শস্যের উল্লেখ নেই আবার একটা সময় কিন্তু ধান বলেও কিছুর উল্লেখ নেই….সেক্ষেত্রের শস্য শব্দটির উল্লেখ আছে। এই শস্যের মধ্যে তাহলে কলাই বা কেঁড়িলি ছিল না যে কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। তাছাড়া আমি সূচনাতেই খনার বচনের কথা উল্লেখ করেছি। সেখানে কিন্তু বাংলার একটি প্রাচীন ও অর্থকরী ফসল শিম্ব গোত্ৰীয় উদ্ভিদ সর্ষের সঙ্গে কলাই মুগের উল্লেখ আছে।
কলাই বা কেঁড়িলি অর্থাৎ ডাল শিম্ব গোত্রীয় উদ্ভিদ এবং জমিতে চাষ করলে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। এর শিকড়ে থাকা রাইজবিয়াম ব্যাকটেরিয়া জমিতে নট্রোজেনের পরিমান বৃদ্ধি করে। যতদূর জানি শস্য চক্রের মধ্যে ধান ,গম চাষের পরে ডাল জাতীয় বা শিম্ব জাতীয় শস্য উৎপাদন করলে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি পায়।মাটির রস সংরক্ষণ বড় কথা। গ্রীষ্মকালে জমিতে আচ্ছাদন ফসলের যেমন মুগের চাষ করা। এই সময় রাসায়নিক কৃষির মত গভীর চাষ করতে হবে না। এতে মাটির রস উঠে যাবে। যা হোক, এছাড়াও কলাই বা ডালশস্যের মধ্যে প্রোটিন ও আয়রন থাকায় সাধারণ মানুষের নিকট তা অত্যন্ত পুষ্টিকর খাদ্য বলে পরিগণিত হয়।
এবার আসি ডালশস্য বাংলায় ঠিক চাষ হত কি? বিষয়টিকে বিতর্কিত ।সেই প্রসঙ্গে এটা বলতে পারি যে মাস কলাই বা কালো মুগ বাংলা তথা সমগ্র ভারতের একটি অতীব প্রাচীন শস্য। পঞ্চশস্য পূজার নিমিত্ত একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দ্রব্য । কি কি শস্য থাকে এই পঞ্চশস্যে ? কেনই বা ব্যবহার করা হয়ে আসছে সেই প্রাচীন কাল হতে?
প্রাচীন বাংলায় অন্যান্য বহু ফসল জন্মানোর উল্লেখও পাওয়া যায় যেমন তুলা, যব, সরিষা, আখ এবং কলাই ও মুগের মতো ডাল। তুলা ছিল সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক ফসল। বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাচীন বাংলায় তুলার চাষাবাদের কথা জানা যায়। এসব শস্য ছাড়াও বহু শাকসবজি ও ফলমূল উৎপন্ন হতো। খনার বচনে নিম্নোক্ত শাকসবজির উল্লেখ রয়েছে বেগুন, লাউ, মূলা, কচু, মরিচ, হলুদ, পটল। বিভিন্ন ধরনের ফলগাছ যেমন আম, কাঁঠাল, ডালিম, কলা, মহুয়া, খেজুর, লেবু, ডুমুর, তেঁতুল, নারিকেল প্রভৃতি প্রচুর জন্মাতো। পাল ও সেন রাজত্বকালের বহু লিপিতে আম ও কাঁঠালের উল্লেখ পাওয়া যায়।
কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কৃষিজাত পণ্যে বৈচিত্রও দেখা যায় । ঋক্বৈদিক যুগে প্রধান ফসল ছিল যব । ঋক্বৈদিক যুগে ধান উৎপন্ন হলেও ধান অর্থে ‘ব্রীহি’ শব্দটি এই প্রথম শুরু হয় । এই সময় আর একটি প্রধান ফসল হল ‘গোধূম’ বা গম । গম ও যব থেকে তৈরি হয় ‘সক্তব’ বা ছাতু । এই যুগে তিল চাষের শুরু হয় । তা ছাড়া তুলোও উৎপন্ন হত । বৌদ্ধসাহিত্য থেকে তুলো ও আখ চাষের কথাও জানা যায় । খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে অন্যান্য খাদ্য দ্রব্যের মধ্যে বাজরা, ভুট্টা, #মুগ, সরষে, পান, বেগুন, মুলো, পেঁয়াজ, রসুন, লবঙ্গ, হলুদ, লঙ্কা, গোলমরিচ প্রভৃতির নাম পাওয়া যায় ।
যে কোন পূজার সময় ঘট স্থাপন করতে হয়। ঘট কোন দেবী বা দেবতার প্রতিমা নয়। ঘট ভগবানের নিরাকার অবস্থার প্রতীক। হিন্দুরা পূজার সময় যেমন ভগবানের সাকার স্বরূপ কে পূজা করে তেমনি নিরাকার স্বরূপকেও পূজা করেন। তাই ঘট স্থাপন প্রতি পূজাতে একান্ত আবশ্যক। ঘট স্থাপন ছাড়া পূজা অসম্পূর্ণ বলে মনে করা হয়। প্রায় সব পূজায় ঘট লাগে।
যারা পুজোর কাজের সাথে জড়িত আমরা জানি ঘটের মধ্যে অনেক উপাদান ব্যবহার হয়। যেমন- পঞ্চশস্য, পঞ্ছগুড়ি,পঞ্চপল্লব,পঞ্চরত্ন, জল,মাটি,নারিকেল,গামছা,কান্ডকাঠি ইত্যাদি।
আজকে আমরা এসব উপাদানগুলোর তাৎপর্য সম্পর্কে জানব।
ঘট আমাদের দেহের প্রতিরুপ……… পুজোর সময় পঞ্চগুড়ি দিয়ে পিঠ তৈরি করা হয় । এই পঞ্ছগুড়ি_পঞ্চমহাভুত (অর্থাৎ ক্ষিতি , অপ , তেজ , মরুৎ , ব্যোম ) এর প্রতিক। এই পঞ্চমহাভুত এর উপর মৃত্তিকা দিয়ে পিঠ তৈরি করা হয়। মৃত্তিকা বেদীর উপর পঞ্চশস্য দেয়া হয়। ধান, মুগ, মাষ, যব, তিল এই হল পঞ্চশস্য….. _____এই পঞ্চশস্য আমাদের পঞ্চবৃত্তি (কাম,ক্রোধ , লোভ, মোহ ও মাৎসর্য) এর প্রতীক । এর ওপর ঘট উপস্থাপন করা হয় ।ঘট আমাদের দেহের প্রতিক। আধ্যাত্মিক ভাষায় দেহকে দেহঘটও বলা হয়।
সুতরাং , মুগ বা কলাই বেশ প্রাচীন শস্য এবং যথেষ্ট পরিমানে উৎপাদন না হলে তাকে কখনো পূজার কাজে ব্যবহার করা হত না।
ভারতীয় খাদ্যের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিই, যেখানে আহারকে ছয়টি স্বাদের (অম্ল, তিক্ত, মধুর, লবণ, কটু ও কষায়) ভিত্তিতে ভাগ করা হয়েছে এবং এই ছটি স্বাদের ভিত্তিতে আবার চারটি ভাগে (চর্ব্য, চোষ্য, লেহ্য, পেয়) বিভক্ত করা হয়েছে।এই চতুর্বিধ খাদ্যের মধ্যে রয়েছে চার শ্রেণীর খাদ্য, যথা- জরায়ুজ, অণ্ডজ, স্বেদজ এবং উদ্ভিদ্দাজি।এই হল মোটামুটি বাঙালি রান্নার তত্ত্বগত বিচার।এবার এই কচকচানি থেকে বেরিয়ে যে কথা বলছিলাম সেখানে ফিরে যাই।অর্থাৎ ডালভাত।
বর্ষাকাল এলেই বাঙালি মাত্রই একটি নির্ভেজাল খিচুড়ি-প্রেমিক হয়ে ওঠেন — সেই খিচুড়ি আমিষ বা নিরামিষ যাই হোক না কেন। ‘মনসামঙ্গল’-এ আছে ডাবের জলে দিয়ে রান্না করা মুগের ডালের খিচুড়ি খেতে চেয়েছিলেন পার্বতীর কাছে স্বয়ং শিব। কৈলাসে তো নারকেল গাছ নেই যে ডাব পাওয়া যাবে। ‘মনসামঙ্গল’-এর লেখক বিজয় গুপ্ত জন্মেছেন বরিশালে, যেখানে সারা বছরই অঢেল নারকেল ও ডাব সুলভ ও সহজলভ্য। ফলে বিজয় গুপ্তের পক্ষে ডাবের জল দিয়ে খিচুড়ি রান্নার রেসিপি উল্লেখ খুব অন্যায্য নয়।
সংস্কৃতে খিচুড়ির আর এক নাম কৃশর; অর্থাৎ তিল, মুগ ডাল ও চালে ঘৃতপক্ক অন্ন।
চাল ও ডালের মিশ্রণে এক ধরনের খাবার তৈরির কথা ভারতের প্রাচীন লেখায় পাওয়া যায়। খিচুড়িকে ব্যাখ্যা করতে প্রধানত দু’টি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। কৃসারান্না ও খিচ্ছা। ১২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পাওয়া প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ অনুযায়ী ভারতে চাল ও ডাল এক সঙ্গে খাওয়ার প্রচলন ছিল। যদিও, চাল, ডাল আলাদাও খাওয়া হত সেই সময়। চাণক্যের লেখাতেও মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের আমলে চাল, ডালের মিশ্রণে খিচুড়ি খাওয়ার উল্লেখ পাওয়া যায়। সুষম আহারের কথা প্রসঙ্গে চাণক্য লিখেছেন, এক প্রস্থ চাল (৬০০ গ্রাম মতো) ও সিকি প্রস্থ ডাল, ১/৬২ প্রস্থ নুন ও ১/১৬ প্রস্থ ঘি তৈরি খাবারই হল সুষম আহার। গ্রিক পরিব্রাজক মেগাস্থিনিসের লেখাতেও চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যের রাজসভার হেঁশেলে চাল, ডাল এক সঙ্গে মিশিয়ে রান্নার উল্লেখ পাওয়া যায়।
পঞ্চদশ শতকে রুশ পরিব্রাজক নিকিতিনের লেখাতে দক্ষিণ ভারতে চাল-ডাল মিশিয়ে খাওয়ার প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। সপ্তদশ শতকে ফরাসি পরিব্রাজক তাভেরনিয়ের লিখেছেন, সে সময় ভারতের প্রায় সব বাড়িতেই ‘খিচুড়ি’ খাওয়ার রেওয়াজ ছিল।
নীহাররঞ্জন রায় তাঁর বাঙ্গালীর ইতিহাস গ্রন্থে লিখেছেন, ‘প্রাচীন বাঙালীর খাদ্য তালিকায় ডালের উল্লেখ কোথাও দেখিতেছি না।’ ডাল না থাকলে ডালেচালে মেশানো খিচুড়ি হবে কী করে? কোনো কিছু তালগোল পাকিয়ে গেলে বাংলায় তাকে ‘জগাখিচুড়ি’ দশা বলে। বাস্তবে জগাখিচুড়ি বলে এক রকমের খিচুড়ি আছে। পুরীর জগন্নাথ দেবের মন্দিরে প্রসাদ হিসেবে ভক্তদের নিত্যদিন খিচুড়ি বিতরণ করা হয়। ‘জগন্নাথ দেবের খিচুড়ি’ লোকমুখে সংক্ষেপে হয়েছে ‘জগাখিচুড়ি’। আর বাঙালীর কথ্যরীতিতে তা তালগোল পাকানোর প্রতিশব্দ হিসেবে পরিণত হয়েছে।
এবার আসি বিভিন্ন কাব্য, মঙ্গলকাব্য ও ব্রত কথা গুলিতে।
রেলফ ফিচারের বর্ণনায় পাওয়া যায় কিছু বাঙ্গালী ছিলেন যারা নিরামিষ আহার করতেন এবং ফল ও দুগ্ধজাত দ্রব্য খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করতেন। বৈষ্ণবীয় রীতিতে ভোগ অন্ন পরিবেশন বাংলা বৈষ্ণব সাহিত্যের এক অপূর্ব দৃশ্য ।অতি তুচ্ছ বস্তু এখানে বড় উপাদেয় হয়ে ওঠে । গ্রাম বাংলার রন্ধন পটিয়সী মা ,স্ত্রী বা ভগিনীর হাতে রাঁধা ব্যঞ্জন স্বর্গের অমৃত সমান। কৃষ্ণদাস কবিরাজ সার্বভৌম ভট্টাচার্য্যের বাড়িতে চৈতন্যদেবেরনিরামিষ আহারের বিবরণ যে দিয়েছেন—
বত্রিশ কলার এক আঙ্গেটিয়া পাত,
তিন মান তণ্ডুল তাতে ধরে ভাত।
পীত সুগন্ধি ঘৃতে অন্ন সিক্ত কৈল
চারিদিকে পাতে ঘৃত বাহিয়া চলিল
কেয়াপত্র কলার খোলা ডোঙ্গা সারি সারি,
চারিদিকে ধরিয়াছে নানা ব্যঞ্জন ভরি।…..
.দশবিধ শাক নিম্ব তিক্ত শুক্তার ঝোল,
মরিচের ঝালে ছেড়াবড়ি বড়া ঘোল।
দুগ্ধতুম্বী, দুগ্ধ কুষ্মাণ্ড, বেশারী লাফরা,
মোচা ঘণ্ট, মোচা ভাজা, বিবিধ শাকরা।
ভৃষ্ঠ মাষ মুদ্গ সূপ অমৃতে নিন্দয়।
মধুরাম্ল বড়াম্লাদি অম্ল পাঁচ ছয়।।
মুদ্গ বড়া মাষবড়া কলা বড়া মিষ্ট।
ক্ষীর পুলি নারিকেল তুলি আর যথ শিষ্ঠ।।
হ্যাঁ , শ্রী চৈতন্য চরিতামৃত….সেথায় খাদ্যের কথা বলতে গিয়ে বার বার #বড়ি শব্দটি এসেছে। এবার কলাই , কেঁড়িলি মানে ওই ডাল শস্য ব্যতীত বড়ি অন্য কোনো উপায় বানানো সম্ভব নয়। তাহলে? তাছাড়া মাষ , মুদ্গ সূপ শব্দ ব্যবহার হয়েছে। প্রাচীন বাঙালি ডাল খেত কিনা তা নিয়ে নীহার রঞ্জন রায় তাঁর ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস’ গ্রন্থে একটি প্রশ্নচিহ্ন তুলেছেন।যদিও ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থে ডালের উল্লেখ না থাকলেও বড়ির উল্লেখ রয়েছে, আর কে না জানে যে বড়ি তৈরির একটি প্রধান উপাদান ডাল।তবে সে যুগে ডাল ছাড়াও বড়ি তৈরির অন্য কোনো উপকরণ ছিল কিনা তা জানা যায়না। মাষ বলতে মাস কলাই ও মুদ্গ সূপ বলতে মুগ ডালকে বলা হয়েছে।তাছাড়া গয়না বড়ি প্রাচীন বাংলার একটি ঐতিহ্য মন্ডিত লোক বা কুটির শিল্প। রাঢ় অঞ্চলের রমণীর হেঁসেলে ঢুকেই সেই নিখুঁত শিল্প কর্মটি পাওয়া যেত । যা আজ লুপ্ত প্রায়।
মেয়ে যাচ্ছে শ্বশুরবাড়ি
সঙ্গি হলো গয়না বড়ি
খুকুর কেন মন ভারী।
পাতে নেই যে গয়না বড়ি।।
রসিক মঙ্গলেও বৈষ্ণবীয় মহোৎসবে বিভিন্ন প্রকার নিরামিষ ব্যঞ্জনের কথা উল্লেখ হয়েছে । সেখানে অনেক প্রকার সবজি, ফলমূল, মশলার ব্যবহারের কথা জানতে পারা যায় ।সেখানে হিঙ্গু ,মেথি , গোলমরিচ , জায়ফল ইত্যাদির সঙ্গে গোধূম ছোলা এবং খেসারির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। রসিক মঙ্গলে শ্রীকৃষ্ণ মহোৎসবের জন্য যে সমস্ত রান্না হয়েছিল সেগুলো একটু আমি উল্লেখ করছি ।এর মধ্যে তদানীন্তন বাঙালির নিরামিষ ও শিমব গোত্ৰীয় শস্য আহারের বিশেষ পরিচয় পাওয়া যায় –
মহোৎসব দ্রব্য সব করিয়া প্রথমে।
তন্দুলাদি যুগ বিরি আনিল যতনে।।
মরাই করিয়া রাখি পর্বতসমান।
মহোৎসব মহানন্দে এসব প্রধান।।
গোধূম ময়দা #ছোলা #খেসারি অপার।
ঘৃত তৈল গুড় গুয়া শত শত ভার।।
চাঁদ সদাগরের কাহিনি তো শৈশব থেকে শুনে আসছি মা ঠাকুরমার মুখ থেকে।এইবারে পড়তে গিয়ে দেখি রত্নখনি।একজায়গায় এত হরেক রকমের রান্নাবান্নার কথা পড়লাম যে সব ছেড়ে সেইটা নিয়েই একেবারে আটকে গেলাম।
সনকার( লক্ষ্মীন্দর হবার সময়ে) পঞ্চামৃত(সাধ) ভক্ষণের সময়ের রান্নাবান্নার বৈচিত্র আর অদ্ভুতধরণের পাকপ্রণালী অবাক করার মত। স্লো কুকিং এর ধারণাও আছে !
“তেঁতুল চলার অগ্নি জ্বলে ধপ ধপ ।
নারিকেল কোরা দিয়া রান্ধে #মুগের সূপ।।
ধীরে ধীরে জ্বলে অগ্নি একমত জ্বাল ।
কড়ির বেগেতে রান্ধে #কলাইর ডাল।।
ঝিঙ্গা পোলাকারী রান্ধে কাঁঠালের আঁঠি।
নারিকেল কোরা দিয়া রান্ধে বটবটি।।
আনিয়া বাথুয়া শাক করিল লেচাফেচা।
লাড়িয়া চাড়িয়া রান্ধে দিয়া আদা ছেঁচা।।”
নারকেল কোরা দিয়ে মুগডাল, কলাইয়ের ডালের স্লো কুকিং, ঝিঙা আর কাঁঠালবিচির তরকারি, বটবটি নারকেল কোরা দিয়ে, আদাছেঁচা দিয়ে বাথুয়া শাক।কড়ির বেগেতে (শম্বুক গতিতে?) কলাইয়ের ডাল একদিন রেঁধে খেলে হয়!
এছাড়াও পাই বেহুলার লোহার কলাই রন্ধনের কথা ….চাঁদ বেনে ভাবী পুত্রবধূর গুণাবলী পরখ করবেন বলে লোহার কলাই সিদ্ধ করতে দিয়েছেন…মোর ঘরে আজি তুমি করিবা ভোজন।সাহের কথা শুনিয়া বলিল সদাগর।।
দক্ষিণ পাটনে গেলাম করিতে ব্যাপার।
ব্যাধির কারনে খাই লোহার #কলাই ভাত।।
এতেক বলিয়া কলাই দিলেক সাক্ষাৎ।
আঞ্চলে বান্ধিয়া কলাই লইল সত্বর।।
সত্বরে মিলিল গিয়া সুমিত্রার গোচর।
আমার ঘরে আজি অন্ন খাইবে বেহাই।।
ভোজন করিবে বেহাই চান্দ মহাজন।
লৌহ #কলাইর ভাত রান্ধিবে কোন জন।।
ধরা যেতে পারে কলাই ব্যাপারের প্রচলন না থাকলে লোহার কলাই বানানো বা কলাই রান্না পদ্ধতি কেউ জানবে কি করে?
সূপ = এই শব্দটা ইউরোপীয়দের কাছ থেকে প্রাপ্ত নয়।ধর্ম্মশাস্ত্র অনুযায়ী সূপ হচ্ছে আজকের খিচুরী ধরনের খাবার।আয়ুর্ব্বেদ অনুযায়ী যে কোন ডালের খোসা ছাড়িয়ে নুন-জলে ফুটিয়ে বানানো ঝোল হচ্ছে সূপ।আদি পালি ভাষায় সূপ হচ্ছে ঝোল (broth/curry/soup)।প্রাসঙ্গিক বিবেচনায়, পালি শব্দ সূপ্পা’র মানে হচ্ছে চালুনী। আগেকার রাজবাড়ির হেঁসেলে সুপাকার থাকতেন।
মঙ্গলকাব্য গুলিতে তৎকালীন বঙ্গসমাজ জীবনের এক সামগ্রিক চিত্র ফুটে উঠতে দেখা যায়। বাঙালি জীবনচর্চার খুঁটিনাটি সমাজচিত্র এখানে ঘরোয়া চিত্রে প্রতিবিম্বিত হয়েছে । এখানে স্বর্গের দেবদেবীরা নিতান্তই বাঙালির ঘরের আপনজন। বাঙালির বৈচিত্র এবং রন্ধনের উপাচার বহুমাত্রিকতা এখানে বিস্তারিত ভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে ।এইসব রন্ধন উপকরণের মধ্যে কলাই, মুগ ও বড়ির একটি বিশেষ স্থান ছিল তার বারবার প্রমাণ মেলে।
কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গলে “ধনপতি সওদাগরের উপাখ্যানে” খুল্লনার রন্ধন অংশে খুল্লনা দেবী সর্বমঙ্গলা কে স্মরণ করে যে রান্না করেছিলেন সেখানে বড়ির ও মুসুরের বিশেষ উল্লেখ আছে।
প্রভুর আদেশ ধরি রান্দেয়ে খুল্লনা নারী
সোঙরিয়া সর্বমঙ্গলা
তেল ঘৃত লবণ ঝাল, আদি নানা বস্তুজাল
সহচরী যোগায় দুর্ব্বলা।
বাইগুন কুমড়াকড়া কাঁচকলা দিয়া
শাড়া বেসার পিঠালি ঘন কাটি।
ঘৃতে সন্দ্রোলিল তথি
হিঙ্গজীরা দিয়া মেথি,শুক্তা রন্ধন পরিপাটি।
ঘৃতে ভাজে পলাকড়ি নৈঠা শাকে ফুলবড়ি,
চরঙ্গি কাঁঠাল বিচি দিয়া।
ঘৃতে নলিতার শাক তৈলে বস্তু করি পাক
খণ্ডে খণ্ডে #বড়ি ফেলিল ভাজিয়া।
মুসুরি মিশ্রিত মাস সুপ রানদে রসবাসহিঙ্গুজীরা বাসে সুবাসিত
,ভাজে চিখলের কোল,
রোহিত মৎসের ঝোল
মান #বড়ি মরিচে ভূষিত।।
এরপর ভোজ পর্বে সাধু ব্যঞ্জনের প্রশংসা করেছিলেন। সেখানে আমিষ মাংসের সঙ্গে বড়ির উল্লেখ রয়েছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে তৎকালীন বঙ্গসমাজে মাছ মাংসের সঙ্গে ঘি দিয়ে ভাজা বড়ির বিশেষ স্থান ছিল এবং তা ভোজনরশিক সাধুর কাছে ছিল অত্যন্ত উপাদেয় ব্যঞ্জন।কবিকঙ্কন রচিত চন্ডীমঙ্গলের “নিদয়ার মনের কথা ” অংশে নিদয়া তার স্বামীকে সোহাগ করে বলছেন- শোনো প্রাণনাথ কহিয়ে তোমারে এবে মোর প্রাণ কেমন করে।। কইতে নিজ সাধ বড়লাজ বাসি। পান্ত ওদনে ব্যঞ্জনবাসীবথুয়া ঠনঠনি তৈলের পাক ।ডগডগি লাউ #ছোলার শাক ।।মীন চড়চড়ি কুসুম বড়ি।সরল সফরি ভাজা চাঙড়ি।।অথবা যদি বলি কালকেতুর উপাখ্যানের কালকেতুর ভোজনের বর্ণনা।মোচড়িয়া গোঁফ দুটা বান্ধিলেন ঘাড়ে |
এক শ্বাসে সাত হাড়ি আমানি উজাড়ে ||
চারি হাড়ি মহাবীর খায় খুদ জাউ,
ছয় হান্ডি #মুসুরি সুপ মিশ্যা তথি লাউ |
ঝুড়ি দুই তিন খায় আলু ওল পোড়া |
কচুর সহিত খায় করঞ্জা আমড়া ||
অম্বল খাইয়া বীর বনিতারে পুছে,
রন্ধন করাছ ভালো আর কিছু আছে |
এন্যাছি হরিণী দিয়া দধি এক হাড়ি ,
তাহা দিয়া অন্ন বীর খায় তিন হাড়ি |
খুলনার গর্ভ অংশে ব্রাহ্মণের দান সামগ্রিক কথা উল্লেখ করা হয়েছে। চলুন দেখে নিই সেইসব সামগ্রীতে কি কি দ্রব্য স্থান পেয়েছিল…
আসিবে ব্রাম্ভন ভাট কড়ি চাহি পাটে পাট
জোড়গড়া কাচা চাহি ধুতি।
আলোচালু #ডাউল বড়ি শতেক তস্কারকটি
চিঁড়ে কলা দধি গুয়া পান।
‘আজ্ঞা পেয়ে কামার করাতে কাটে গিয়া।
তিন জাতি পরিসর উভে পাঁচ পোয়া।।
যাঁতাটাতে মণ্ডল ভাগিনা সহচরি।
অঙ্গারে আগুন জলে দপ দপ করি।।’
‘চন্ডীমঙ্গলে’ এভাবেই এসেছে জাঁতার প্রসঙ্গ। বাংলার লোকপ্রযুক্তির একটি অন্যতম উদাহরণ হল জাঁতা। সিন্ধুসভ্যতা থেকে জাঁতার ব্যবহার চলে আসছে। জাঁতাকে বলা যায় লোকশিল্প ও প্রযুক্তির সমাহার। অভিধান বলছে- ‘চাকার মতো গোলাকৃতি পাথরের পেষণযন্ত্র’। বাংলার প্রাচীনতম প্রযুক্তির নির্দশন হয়তো এটিই। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, বাংলায় পাথর দিয়ে তৈরি যন্ত্রপাতি, শিল্পের ইতিহাস নেই। চন্ডীমঙ্গলের এই পঙ্ক্তি কিন্তু অন্য কথা বলে- ‘ইন্দ্রনীল পাষাণে রচিত কৈল পোতা’।কবিকঙ্কণ মুকুন্দরামের ‘চন্ডীমঙ্গল’ কাব্যে ‘ইন্দ্রনীল’ বলে একরকম পাথরের উল্লেখ রয়েছে। বাংলায় উৎপাদিত নানা ডালজাতীয় খাদ্যশস্যাদি, যেমন- মুসরডাল ,মুগ, গম, কলাই, ছোলা, তিল ইত্যাদির খোলা ছাড়ানো বা ভাঙার জন্য ব্যবহৃত হয় এই জাঁতা। বাংলার দশবিধ সংস্কারেও জাঁতার উল্লেখ রয়েছে। বিশেষ করে বিবাহ অনুষ্ঠানে। জাঁতার দুটি পাটি থাকে। দুটি পাটির মাঝে গোলাকার দুটি গর্ত। গর্তের মধ্যে একটা কাঠি দেওয়া হয় জুড়ে থাকার জন্য। দুটি পাটির মাঝে একটি লোহার খাড়ু রাখা থাকে। ডাল জাতীয় শস্যাদি যাতে বেশি গুড়িয়ে না যায় এবং দ্রুত লয়ে ঘুরতে পারে, তার জন্যই এই ব্যবস্থা। উপরের একটি পাটির উপর ইংরাজি D অক্ষরের মতো গর্ত থাকে। তার মধ্যে দিয়ে শস্য ঢেলে দেওয়া হয়। উপরের পাটির একদম প্রান্তভাগে একটি ছোট্ট গর্ত করা হয় লাঠি দিয়ে ঘোরানোর প্রয়োজনে। চালানোর সময় ঘর্ ঘর্ ঘর্ ঘর্ আওয়াজ হয়।
ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল আমরা বিভিন্ন প্রকার ব্যঞ্জনের মধ্যে ডাল এবং বিভিন্ন বড়ির উল্লেখ পায় সেখানে বাঙালি রন্ধনে আমিষ নিরামিষ ব্যঞ্জনের মধ্যে ডালের যে বৈচিত্র পাই তার কিছু আমি উল্লেখ করলাম :
ভোগের রন্দন ভার লয়ে পদ্মমুখী।
রন্দন করিতে গেলা মনে মহা সুখী।।
স্নান করি করি রামা অন্নদার ধ্যান।
অন্নপূর্ণা রন্দনে করিলা অধিষ্ঠান ।।
ডালির রান্ধে ঘনতর ছোলা অরহরে।
যুগ মান বরবটি বাটুলা মটরে।।
কলাই ও বড়ি তখনকার দিনে যে বাণিজ্যিক পণ্য ছিল তার পরিচয় কিন্তু আমরা পাই এই মনসামঙ্গলে । সে সময় হয়তো মুদ্রার প্রচলন ব্যাপক ছিল না। তখনকার বাণিজ্যিক প্রথা পণ্য বদলের মাধ্যমে সম্পন্ন হত। কলাই ও বড়ি মূল্যবান বস্তুর সাথে বদল হতো তার বিস্তারিত উল্লেখ কিন্তু মনসামঙ্গলে করা হয়েছে।
চাঁদ বলে লেঙ্গাপাত্র শুনো মোর বাণী।
ডিঙ্গায় চাপাত ভাই যত দ্রব্য আনি।।
ঘরের বাহিরে আর কিনিতে যত পাঅ।
পাত ফলমূল সব ডিঙ্গায় চাপা।।
কাঁচা হরিদ্রা তোলে পুরান সুকুতা।
ইহার বদলে নিব পাটনে গজ মুকুতা।।
মাস কলাই আদার সুট আর তোলে জিরা।
মরিচ লবঙ্গ দিয়া বদল নিব হীরা।।
যতন করিয়া নেহ কিছু ফুলবড়ি।
একভারে বদল নিব দুই ভার কড়ি।।
রামেশ্বর শ’র রচনাবলী “দক্ষিণ রাঢ়ের তিন কবি ” নামক অংশে শিবায়ন পালার পার্বতীর বিবাহের যে বর্ণনা করেছেন তাতে বড়ি র উল্লেখ আমরা পাই। বিশেষজ্ঞদের মতে এখানে কুমারসম্ভবের প্রভাব রয়েছে। শিশুকন্যাদের পুতুল খেলার একটি মনোরম দৃশ্য এখানে আমরা পাই পার্বতীর খেলার ছলে ধুলাবালি মাটি কাদা ইত্যাদি দিয়ে যে ব্যঞ্জন প্রস্তুত করেছিলেন তা অতুলনীয়….হৈমবতী পুতুলের বিবাহ দিতেছেন-
বরযাত্রা কন্যা যাত্রা বসাইয়া ঘরে।
আপনি অভয়া অন্ন বিতরণ করে ।।
সবাকার সম্মুখে পাতিয়া কচু পাত।
ধরণী ধূলার তাতে ধরা দিল ভাত।।
শাক দিল শাকম্ভরী সজিনার পাতা ।
সুপ দিল তপ্ত বালি ত্রিভুবন মাতা।।
বড়ি ভাজা বিতরণ বদমবি বদরির বীজ।
কলামূলা ভাজা দিল কাট্যা নাটা সিজ।।
রামেশ্বর রচনাবলী শিবায়ন পালায় চতুর্থ দিবাসীয় দিবাপালা বলা আরম্ভ শিবের ভিক্ষা অংশে আমরা বড়ি এবং ডালের উল্লেখ পাই……
শুনিয়া শিবের শব্দ সীমন্তিনীগন।
দেখে গিয়া দিব দিগম্বরে দিয়া নানা ধন।।
কেহ দেয় কড়ি বড়ি কেহ দেয় চালু ডালি ।
কেহ আমন্ত্রণ করিয়া আইস্যা কালি।।
চন্দ্রচূড় চলে অঙ্গীকার করায় তাকে ।
হরহর বল্যা কেহ কিরা দিয়া রাখে।।
‘ধর্মমঙ্গল’ কাব্যের ধর্মঠাকুর নিজেই কৃষি দেবতা। বৃষ্টির দেবতাও। তাঁর কৃপায় কৃষক ভাল ফসল পায়। সপ্তদশতকের কবি রূপরাম চক্রবর্তী তার ‘ধর্মমঙ্গলে’ ধান, কাপাস, #কলাই ইত্যাদির কথা উল্লেখ করেছেন।
এতশুনি কালুবীর নিদারুণ কয়।
উচিত বলিতে গালি দিবে অতিশয়।।
কহিলে পাইবে পারিতাপ।
গরুর রাখাল ব্যাটা ছিল তোর বাপ।।
কাননে রাখিত গরু মুখে নাই রা।
ঘরে ঘরে রাখালি সাধিত তোর মা।।
কেহ দিত চালু খুদ পুরান কলাই।
অন্ন বিনে অকালে মরিল তোর ভাই।।
‘শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তন’ কাব্যে কৃষি কথার প্রসঙ্গ আছে। ‘বৃন্দাবন খন্ডে’ কৃষ্ণ প্রচুর ফুল ও ফলের গাছ রোপণ করেছে। ‘বংশীখন্ডে’ রাধা তার রান্নার তালিকায় চাল ছাড়াও পরল, ছোলঙ্গ, লেবু, শাক প্রভৃতির কথা বলেছে।
গঙ্গারামের মহারাষ্ট্রপুরাণ ও ভারতভন্দ্রের অন্নদামঙ্গলে এ সময়ের খাদ্য শস্য আর রবি শস্যের বিশদ বিবরণ পাওয়া যায়। অন্নদামঙ্গলে ‘দিল্লীতে উৎপাত’ তিনি বলছেন, ‘ধান চাল মাষ মুগ অরহর।/ মসুরাদি বরবটী বাটুলা মটর।।/ দে ধান মাড়ায়া কোদা চিনা ভুরা খর। জনার প্রভৃতি গম আদি আর সব।।’ গঙ্গারামও ‘চাউল কলাই মটর মষুরি খেসারির’ কথা জানিয়েছেন।
বড় এলো আসিকা পিষুষী পুরীপুলি।
চুষী রুটি রামরোট মুগের সামুলি।।
বাঙালী মুগ–ডাল দিয়ে তৈরী মুগ–শাউলি খেত৷ মুগ–শাউলির সঠিক পাক প্রণালী আধুনিক সৈরিন্ধ্রীদের জানা নেই৷ তবে অনুমিত হয় খোসা–ছাড়ানো গোটা মুগ দুধে সেদ্ধ করে তাতে চীনী, লব৷, তেজপাতা আর ভাজবার জন্যে কিঞ্চিৎ ঘৃত সহযোগে প্রস্তুত করা হত৷ সেকালে কতকটা অনুরূপ ভাবেই প্রস্তুত হ’ত মুগখণ্ড৷ মিষ্টান্ন হিসাবে মুগের বরফির ব্যবহার তখনও সম্ভবতঃ প্রচলিত হয় নি৷ শিউরীর (শিবপুরী>শিবৌরী> ভুল করে ‘স’, ‘ড়’ ব্যবহার করা হয়৷ ইংরেজী নাম স্যুরী–(Suri) কারিগরেরা সেখানকার সুপ্রসিদ্ধ মোরব্বা তৈরী করতে শুরু করেছিল আজ থেকে অনুমিত চারশ’ বছর আগে৷ সেখানকার মুগের বরফিও সম্ভবতঃ সেই সময় থেকে তৈরী হতে থাকে৷ সেখানকার শিউরী ছিল বীরভূমের একটি ক্ষৃহৎ শিক্ষিত ক্ষ্রাহ্মণদের গ্রাম মাত্র৷ সে যুগে বীরভূমের প্রাণকেন্দ্র ছিল অধুনা ধ্বংসপ্রায় রাজনগর৷
এছাড়া বাঙালির লক্ষীর ব্রতকথা : লক্ষ্মীর কাপড়ে সবুজ রঙ, গায়ে হলুদবর্ণ, কালীর পরিরেখ, এবং অধর ও পায়ের এবং করতলের জন্য লাল; নীলবর্ণ পটভূমিকার কারুকার্যে দেওয়া হয়। লক্ষ্মীসরার উর্ধে আধখানা নারিকেলের মালই—মেয়েরা এই মালইকে কুবেরের মাথা বা মাথার খুলি বলে। যশোর অঞ্চলে সবার পশ্চাতে একটি শীষ সমেত আস্ত ডাব—সেটিকে ঘোমটা দিয়ে, গহন ইত্যাদি দিয়ে অনেকটা একটি ছোটো মেয়ের মতো করে সাজানো হয়। এবং কলার খালুই নিয়ে ধানের গোলার অনুরূপ কতকগুলি ডোলা, তাতে নানাবিধ শস্য পূর্ণ করে আর একটি কাঠের খেলার নৌকোর প্রত্যেক গলুয়ে নানাবিধ শস্য—ধান, তিল, মুগ, মুসুরি, মটর ইত্যাদি দিয়ে লক্ষ্মীর চৌকির সম্মুখে রাখার প্রথাও আছে। পূজা শেষ হওয়া পর্যন্ত ব্রতীর উপবাস। দেশভেদের কোনো গ্রামে লক্ষ্মী, নারায়ণ ও কুবের—এই তিনটিকে তিন রঙের পিটুলির আকারে গড়ে দেওয়া হয়। এমনি নানা গ্রামে অনুষ্ঠানের একীউ অদলবদল আছে।অথবা নখ ছুটের ব্রত থেকে শুরু করে ইতু পূজা সবেই মুগ ও কলাই এর ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ দিকে আলোক পায় করে।
ফারমিঙ্গারের ‘ফিফথ রিপোর্ট’ থেকে বর্ধমানের বিশদ চাষের বর্ণনা পাওয়া যায় – মুগ, কলাই, ছোলা, মটর, তুলো, রেশম আর আখের মত রবিশস্য চাষের।রাঢ়ের মন–মাতানো বিরি কলাইয়ের কথা, ন নদীয়ার প্রাণ–তাতানো সোণা মুগের কথা, লঙ্কা–বাটা দেওয়া মুসুর ডালের কথা বঙ্গ জীবন হয়ত অনেক ক্ষেত্রে আজ ভুলতে বসেছে৷ তবে ব্যাপারখানা কী? প্রাচীন বাঙলার মানুষ হয়তো ডাল খেত, হয়তো বা ডাল খেত না৷ কিন্তু কলাই ,মুগ বা কেঁড়িলি র চাষ হত …..সে যাই হোক, সেকালে চল না থাকলেও পরবর্তীকালে বাঙালির রান্নায় ডাল ক্রমে একটি অতি অবশ্যকীয় পদ হয়ে ওঠে সম্ভবত দক্ষিণ থেকে সেন রাজবংশ ও উত্তর-পশ্চিম থেকে ইসলামের আগমনের সঙ্গে সঙ্গেই। তার প্রমান পাই ‘ব্যাঞ্জন রত্নাকর’ নামক আধুনিক বাঙলা ভাষায় রচিত প্রথম রান্নার বইতে। এই বইতে ডাল রান্নার একটি স্বতন্ত্র অধ্যায় রয়েছে যেখানে মুদগ, অরহর, মসুর ও কলাই ইত্যাদি ডাল রান্নার বিভিন্ন পদ্ধতির বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। বর্তমানে ডালশস্যের মধ্যে খেসারি বা সাদা মুগ পাটনী ডালের চাষ প্রায় বন্ধের পথে। হ কারণ হিসেবে দেখানো হয় এই ডাল বেশি খেলে প্যারালাইসিস হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে ।আরেকটি কারণ হল তুলনামূলকভাবে ডালটির মূল্য কম হওয়ায় কৃষকগণ উপযুক্ত দাম পান না । আরো এক ধরনের ডাল শস্য থেকে প্রায় লুপ্ত হয়ে গিয়েছে। তা হল টঙ্গুর। কালোমুগ বাংলা তথা ভারতের প্রাচীন ডাল। সেও বন্ধ।এ সকল ডাল আগে শরৎকালে চাষ হত । কিন্তু আস্তে আস্তে সব হারিয়ে গেছে…..
#ক্রমশঃ
#দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ বাঙ্গালীর ইতিহাস : আদি পর্ব
বাংলার সংস্কৃতি : লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায়