#নিতাইগঞ্জের_ডাকাত

দেবী ! প্রসীদ পরিপালয় নোহরিভীতে -নির্ত্যং যথাসুরবধাদধুনৈব সদ্যঃ।

পাপানি সর্ব্বজগতাঞ্চ শমং নয়াশুউৎপাতপাকজনিতাংশচ মহোপসর্গান।।

দেবী তুমি বিশ্বেশ্বরী রূপে বিশ্বকে করাল গ্রাস হতে উদ্ধার কর। বসন্ত দুর্গা মহালয়া সূচিত হয়ে গেছে। আগামীকাল ৩১ শে মার্চ অর্থাৎ ১৭ ই চৈত্র বাসন্তী সপ্তমী। দেবী দুর্গা বাসন্তী লক্ষ্মী রূপে ধরাধামে আসবেন । চলুন তাই আজ আপনাদের বধর্মানের কাটোয়ায় নিয়ে যাই। সেই খানে দেবী মহিষমর্দিনীর বাস। আমি গল্পের মতো বলি সেই সব কথা , সেই সঙ্গে চলুন আমার কথার সাথে সেথায়, ঘুরিয়ে আনি।

বর্ধমান জেলার কাটোয়া ।  কাটোয়া থেকে একটু দূরে ভাগীরথীর একটি খাল বের হয়ে গিয়েছে । বেশ চওড়া খাল । বনজঙ্গল, মাঠ এবং বিভিন্ন গ্রামের পাশ দিয়ে এটি চলে গিয়েছে অনেক দূর । এই খালটিকে লোকে বলে ডাকাতের খাল।
এই খালটির  পাশে বাস করেন ধনী দরিদ্র সবাই । এখানে যেমন আছে জমিদার বাড়ি, আবার দেখা যায় গরিব চাষির বাড়ি। এই গাঁ গঞ্জগুলিতে নানা জাতের নানা বর্ণের মানুষ বাস করেন। 
সে অনেক দিন আগের কথা। তখন ব্রিটিশ আমল। তখন আসল শাসনকর্তা কোম্পানির লোকেরা  ।
এই খালের পাশে মঙ্গলচন্ডীর ভাঙ্গা মন্দির । সেখানে নিবিড় ঘন অরণ্য । সেই অরণ্যের মধ্যে দিয়ে পায়ে চলা রাস্তা চলে গিয়েছে মন্দির পর্যন্ত । মন্দিরটি দক্ষিণমুখী ।মন্দিরে রেখেছে জায়গাটিকে দিনের বেলাতেও অন্ধকার মনে হয়। বৃদ্ধ বটের শীতল ছায়ায় ,অরণ্যের উত্তাল হাওয়ায় শরীর-মনের ক্লান্তি দূর হয়।
সেই ভাঙা মন্দিরের মধ্যে কাঠের ভাঙা সিংহাসন  । সেই সিংহাসনে অধিষ্ঠান করছেন দেবী মহিষমর্দিনী। তার ঠিক পাশের সিংহাসনে সামনে একটি পাথরের মূর্তি। সেই মূর্তিতে অধিষ্ঠান করছেন কপিলেশ্বর মাহাদেব।মন্দিরের সামনে পোঁতা একটি হাঁড়িকাঠ। তার পাশে পড়ে আছে এক ভীষন খড়্গ। খড়্গ ও তার পাশের মাটি সিক্ত।  
সে ভাঙা মন্দিরের আশেপাশে কোন লোক নেই। নেই কোনো পুরহিতও। মন্দিরের দরজা ভাঙা । একটি তেলের প্রদীপ জ্বলছে। আর সেই আলোতে দেখা যাচ্ছে বেবি মহিষমর্দিনীর মূর্তি। 
এখানে ডাকাত সর্দার হারান বাগদির আস্তানা। হারান নিজেই তার আরাধ্যা দেবী মহিষমর্দিনী পূজা করেন। পুজোর সময় “জয় মা কালী” ” জয় মা কালী ” রবে মন্দির প্রাঙ্গন মুখরিত হয়ে ওঠে । আর তার সঙ্গে গলায় তার দলের সাগরেদরা। 
হারান সর্দার একটা খুলির মধ্যে দেবীর উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত রক্ত নিয়ে নিজের কপালে ও সাগরেদের কপালে নিজে হাতে পরিয়ে দেয়।
 তারপর ?  
তারপর “হারে রে রে রে রে ” চিৎকার করে সমগ্র অর্নিকে কম্পমান করে ডাকাতি করতে বের হয়।

এই রকমই অন্য দিনের মত একটি দিন। ঘোর অমাবস্যা ।  সেদিন হারান সরদার বসেছে পূজাতে । বলিও হয়ে গিয়েছে । মাকে প্রণাম করে রক্ত তিলক মেখে এবার তারা বের হবে ডাকাতি করতে । পুরো দল তৈরি ।
ঠিক ওই একই সময় নিতাই বণিক ব্যবসা করে বাড়ি ফিরছে জঙ্গল লাগোয়া বিশাল খাল দিয়ে । অমানিশা , তাই তার বড় ইচ্ছা এখানে নৌকা দাঁড় করিয়ে মাকে  একটি বার পুজো দিয়ে বাড়ি ফিরবে। কিন্তু গাঁ থেকে ভিন্ন গাঁ , ভিন গাঁ ছাড়িয়ে বহু দূর , সব্বাই জানে ওই থান প্রবল প্রতাপশালী হারান ডাকাতের। হারান যাকে একবার ধরে তার দেহ তারপর ওই খালের জলে গিয়ে মেশে। তার উপর আজ অমাবস্যা। লোকে বলে করাল অমাবস্যায় হারান বাগদি নাকি কাঁচা খেকো হয়ে ওঠে। তাই  নৌকার মাঝিরা এর মধ্যে নৌকা দাঁড় করাতে চাচ্ছিল না। 
নিতাই বলে ,  ” এই খাল দিয়ে তো বহুবার যাতায়াত করেছি কোনদিন তো কোন বিপদে পড়িনি । তাই কোন ভয় নেই । নৌকা বাঁধ। আমি মাকে পূজা দিয়ে আসি ।”
নিতাই নৌকা থেকে নেমেই হাঁটতে আরম্ভ করল জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে মঙ্গলচন্ডীর ভাঙা মন্দিরের দিকে। নৌকার মধ্যে রয়েছে ব্যবসায় লাভের জিনিস ও গরীব মানুষকে দান করবার জন্য বহু জামাকাপড়ের বস্তা। গরীব গুরব মানুষদের দান করত বলে এলাকার মানুষ তাকে নিতাইবাবু বলে ডাকত । সে ছিল পরোপকারী মানুষ ।

এমন সময় ডাকাতদলের নজরে পড়ল এক ব্যক্তি তার কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে এই মন্দিরে পূজা দিতে আসছে।
হারান বাগদিকে দেখেই নিতাই চিনতে পারল। তারপর হঠাৎ জঙ্গলের মধ্যে থেকে ডাকাতদল যখন তাদের ঘিরে ধরে তখন নিতাই ভয় পেয়ে গেল। সে বুঝতে পারে হারান বাগদি ডাকাত সর্দার তার দলবল নিয়ে ডাকাতি করবে এবার।
নিতাই ভয়ে হারানের পা ধরে বলে ,  ” হারান আমাকে মেরে ফেলো না। ” হারানের রক্ত চোখ,  মাথা ভর্তি বাবরি চুল, মুখভর্তি দাড়ি,  তার এই ভয়ঙ্কর রূপ দেখে নিতাই তাই কাঁপতে আরম্ভ করে। 


 হারান তখন নিতাইকে বলে , ” তোমার নৌকার সব মাল আমার লোকেরা নামিয়ে নিয়েছে। তোমাকে আমি জীবনে মারব না, এই কারণে যে তুমি মায়ের মন্দিরে পুজো দিতে এসেচো। না হলে এখনই তোমাকে মায়ের সামনে বলি দিয়ে এইখালে ভাসিয়ে দিতে পারতাম। কিন্তু তা করব না। 
” আজ আমি তোমার জন্য ডাকাত হয়েছি”  হারানো বাগদী  বলল , ” মনে পড়ে সেদিন আমাকে চোর অপবাদ দিয়ে তুমি আমায় চাবুক মেরে ছিলে? ” 


একথা শুনে হারানের দলের লোকেরা নিতাইকে মারবার জন্য অস্ত্র তুলে ধরল।  হারান নিষেধ করল। হারান নিতাইকে বলল, ” ভদ্রলোকেরা বেইমান হয়। গরীবের খাবার কেড়ে নিয়ে তারা বড়োলোক হয় । তারাই প্রকৃত চোর ডাকাত হয় । কিন্তু গরীব মানুষেরা তা হয় না । বাবু তোমাদের মত লোকেরা কাউকে বিশ্বাস করে না। “


 নিতাই বণিকের  নৌকা থেকে নামিয়ে সব জিনিস একটা জায়গায় রাখা হল। মন্দির থেকে বেরিয়ে এসে মন্দিরের দাওয়ায় বসল। নিতাই বণিক বসল ডাকাতদলের মাঝখানে।


রাত্রি শেষ হয়ে ভোর হলো।  জঙ্গলের পাখিরা ডাকতে আরম্ভ করল । নিতাই বণিক দেখল দলবেঁধে বিভিন্ন গ্রামের মানুষ এগিয়ে আসছ জঙ্গলের মধ্যে মন্দিরের দিকে। তাদের শরীর হাড় জিরজিরে । শরীরে মলিন বস্ত্র। 
লুন্ঠিত এইসব জিনিস হারান বাগদি বিলি করে দিতে লাগল গরীব মানুষ গুলির মধ্যে।  আর তাই দেখে নিতাই বণিকের চোখে জল এসে গেল। সে ভাবতে লাগলো – ” আমার দেশের লোক এত গরীব, এরা এত অসহায়।”


 আর এই মুহূর্তে নিতাইয়ের মনে হল , ” হতে পারে হারান বাগদি ডাকাত, হতে পারে সে অশিক্ষিত , ছোট লোক হতে পারে, কিন্তু সে অনেক বড় মনের মানুষ । “
 এরপর হারান তার দলের লোকদের নির্দেশ দিল ” নিতাইয়ের চোখ বেঁধে গায়ের মধ্যে  যেখানে নৌকা রাখা সেখানে পৌঁছে দিয়ে আয়। “
 নিতাই এর সঙ্গে তার মাঝি মাল্লাদেরও চোখ বেঁধে নিয়ে গেল ডাকাতদল । পৌঁছে দিল নৌকায়।


 যাবার আগে হারান বাগদি শুধু বলেছিল , ” থানা পুলিশে খবর দেবেন না। জীবনে অনেক রোজগার করেছেন । ধনী মানুষ আপনি । আমাদের মত গরীবদের কথা ভুলবেন না । আমরা বেঈমান নয়। “
হারানের  মুখে এই কথা শোনার পর নিতাই বণিক কেঁদে ফেলে সব ভুলে জড়িয়ে ধরল হারানকে । বলল , ” হারান প্রতিবছর তোমার হাত দিয়ে এমন করেই এসব গরীব মানুষের জন্য অন্ন আর জামাকাপড় বিলি করবো মায়ের নাম করে ।”

 এরপর থেকে প্রতিবছর ডাকাত সর্দার হারান বাগদিকে পাশে নিয়ে নিতাই বণিক আমৃত্যু  জনসেবা করে গিয়েছে। যে জঙ্গলে বসে নিতাই ও হারান এগুলি করত পরবর্তীতে সেই জায়গার নাম হয়েছিল #নিতাইগঞ্জ। এখন নিতাইগঞ্জে বড় হাট বসে। আজকের দিনে মানুষ হারান বা নিতাইয়ের নাম ভুলে গিয়েছে । কিন্তু তাদের নামে নিতাইগঞ্জ ও হাট,  ডাকাতের খাল আর দেবী মহিষমর্দিনী রয়ে গিয়েছে ইতিহাসের পাতায়।
চলুন বিশ্বের এই বিপদের দিনে আমরা সেই বিশ্বমাতার নিকট প্রার্থনা করি –
“অন্ধং কুষ্ঠঞ্চ দারিদ্রং রোগং শোকঞ্চ দারুনং। বন্ধু স্বজন বৈরাগ্যং দুর্গে ত্বং হর দুর্গতি।।” 

©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ বাংলার ডাকাত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.