#ছোট্ট_একটা_দেশলাই_বাক্সের_গল্প

#পঞ্চম_ভাগ

লোকের হাতে হাতে যা ঘোরে –  বড়লোক হোক বা দরিদ্র , শ্রমিক হোক বা মালিক , গৃহবধূ হোক বা গৃহকর্তা এরকম সহজলভ্য, সর্বগামী এবং সহজে বহনযোগ্য একটি জিনিসের বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্র হিসাবে ব্যবসায়ীদের কাছে আদর্শ মনে হল। দেশলাই বাক্সের পিছনে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন রকম সংস্থার বিজ্ঞাপন বেরোতে লাগলো । একসময় প্রথিতযশা দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলিও বিজ্ঞাপন দিতে লাগল।

যেমন – পিএম বাগচী – কালি, সুগন্ধী, ঔষধ, রাবার স্ট্যাম্প ;  সি কে সেন – জবাকুসুম তেল,  গিনি ম্যানসন, ফারপোর রুটি, এস এ বক্সী এন্ড কোং  – সুন্দরী সোহাগ কেশতৈল , কবিরাজ এন এন সেন – কেশরঞ্জন তৈল , আর জি এন্ড কোং কোন্নগর – ম্যালেরিন , আইভি সোপ এচ এ বি এম জে , বোম্বে স্পেশাল সিগারেট – বঙ্গীয় দিয়াশলাই কার্যালয়, নেসলে কোম্পানির গোয়ালিনী মার্কা টিনের দুধ – মিল্কমেইড কনডেসড মিল্ক , জি এফ কেলনার এন্ড কোং ইত্যাদি।


উক্ত বিভিন্ন দেশলাই বাক্সের পিছনে বিজ্ঞাপনের মধ্যে সব থেকে বেশি যেটি নজর কাড়ে সেটি হল : জে এফ ম্যাডানের বিজ্ঞাপন। যে এফ ম্যাডান হল নির্বাক যুগের সিনেমা তথা ভারতের সবচেয়ে বড় প্রযোজক, হল ও স্টুডিওর মালিক।


কলকাতার বাইরেও বহু দেশলাই কারখানা গড়ে উঠেছিল। যেমন – বেঙ্গল সেফটি ম্যাচ মেনুফ্যাকচারিং কোম্পানি লিমিটেড – হাওড়া, সালকিয়া; বীরভূম ম্যাচ ফ্যাক্টরি – সন্ধ্যা ব্র্যান্ড – সাঁইথিয়া , দাগা এন্ড কোম্পানি – জলপাইগুড়ি, জগন্নাথ ম্যাচ ফ্যাক্টরি – ব্র্যান্ড – স্টিম লঞ্চ – ঢাকা , কেটল সেফটি ম্যাচ ফ্যাক্টরি – কুচবিহার , খাদি প্রতিষ্ঠান – ব্র্যান্ড লাঙ্গল মার্কা – সোদপুর , ২৪ পরগনা ;  মজুমদার ম্যাচ ফ্যাক্টরি – স্বদেশী ম্যাচ – নোয়াখালী, প্রসন্ন ম্যাচ ফ্যাক্টরি- স্বরাজ পতাকা- ঢাকা, সুন্দর বন ম্যাচ ফ্যাক্টরি – ব্র্যান্ড আরতি – সুন্দরবন।


প্রসঙ্গত কলকাতা পুলিশও একসময় দেশলাই বাক্সের পিছনে বিজ্ঞাপন দিত । আই সি আই , কলকাতা পুলিশের বিজ্ঞাপিত বিষয় ছিল ট্রাফিক আইন মেনে চলুন উৎসবের আনন্দ বাড়িয়ে তুলুন। 


পূর্বেই বলেছিলাম যে বহু ব্যক্তিত্ব , স্মারক ও প্রতিষ্ঠান বিগত এক শতাব্দীর সময়কাল ধরে দেশলাই লেবেলের বিষয় হিসাবে দেখা গেছে। কেবলমাত্র কলকাতা বা বাংলায় বা বাইরের রাজ্যেই নয় , বিদেশে তৈরি করে আমদানি করা দেশলাই বাক্সেও। মুখ্যত দেশ নায়কএ স্বাধীনতা সংগ্রামীরা এই শ্রেণীর সিংহভাগ দখল করেছিলেন। যেমন – নেতাজী, দেশবন্ধু, সরোজিনী নাইডু, দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন প্রমুখ। পেটল্যান্ডের বেস্ট ইন্ডিয়ান ম্যাচ কো  যতীন্দ্রমোহনের ছবি দেওয়া দেশলাই বানাত।  এ ই ম্যাচিসওয়ালা – সরোজিনী নাইডুর ম্যাচ বক্স বানাত এবং সিস্টার নিবেদিতা ছিল সিস্টার নিবেদিতা ম্যাচ ওয়ার্কসের।


তবে, বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য উল্লেখ্য জাপান ও সুইডেনের তৈরি আনন্দমঠ হাতে বঙ্কিমচন্দ্র ,মাথার উপর লেখা #বন্দেমাতরম। সুইডেনের যে কোম্পানির দেশলাইতে এই ছবি থাকত তার নাম ক্যাপিটাল সিগারেট কোং। সুভাষচন্দ্র বসুর ম্যাচবক্সটি বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। এটির এক্সাইজ লেবেলটি ছিল অন্য কোনো দেশের এবং অবশ্যই ব্রিটিশ অধিকৃত ভারতের নয়।  এই ম্যাচবক্সের উপর লেখা ছিল  ” হামারে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস। হম হিন্দুস্থানী হর হালাত মে উনকা সাথ দেঙ্গে। ” গবেষকদের মতে এটি আজাদ হিন্দ সমর্থক কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের দ্বারা নির্মিত হয়েছিল এবং নির্মাণ স্থল ছিল দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার কোনো দেশ।


 এছাড়াও বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রাতস্মরনীয় ব্যক্তিগনের মধ্যে যেমন ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দ প্রমুখ। সংগীত চলচ্চিত্র ও ক্রীড়াজগৎ থেকে ছিলেন বহু ব্যক্তিত্ব। যেমন – গওহরজান, মালকাজান, সীতাদেবী , সত্যজিৎ রায়, উত্তমকুমার , মিঠুন থেকে সৌরভ গাঙ্গুলি আরও কতজন। গওহরজানের ছবি দেওয়া দেশলাই বেজিয়ামে তৈরি হত। সীতাদেবী বা রিনি স্মিথ ছিলেন সে যুগের কলকাতার নির্বাক চলচ্চিত্রের অভিনেত্রী । এম এম ডাবলু তাঁর লেবেলের দেশলাই বাক্স বের করত।

 না , থেকেও শেষ উত্তরের হিন্দি সংস্করণ  #জবাব – এর  বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে আছেন বাংলা তথা ভারতীয় চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগের কানন, প্রমথেশ ও যমুনারা।জবাব ১৯৪২ সালে বম্বের ইম্পেরিয়াল সিনেমাতে প্রদর্শিত হয়। কমল দাশগুপ্ত সুর দিয়েছিলেন।


আছে উইমকো কোম্পানি দ্বারা প্রস্তুত নিউ থিয়েটার্সের #হাতিমার্কা বাঙ্গালীর অতিপরিচিত লোগোটি । এই লোগোটি পরশুরামের গল্পের চিত্রী শ্ৰী যতীন সেনের সৃষ্টি। এর মধ্যে লেখা ছিল ” জীবতাং জ্যোতিরেতু ছায়াম ” । এটি শ্ৰী সুনীতিকুমার মহাশয়ের লেখা।এছাড়াও ছিল দক্ষিণেশ্বর মন্দির –  সুইডেন , কলকাতার ভিস্তিওয়ালা – জাপান , গাইড, মিলিটারি একাউন্টসের অফিস, কার্জন পার্ক , হাতে টানা রিকশা ইত্যাদি। আরো ছিল কলকাতার ট্রাম ও ১৮৮৩ – ৮৪ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত ভারতের প্রথম আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীর স্বর্ণপদক।
যেহেতু যে সময়ের কথা বলছি সেটা ছিল ব্রিটিশ পিরিয়ড। তাই দেশলাই বাক্সের উপর থাকত ভাইসরয় মিন্টো, হার্ডিঞ্জ এরাও তাদের লেডিদের নিয়ে। আশ্চর্য হবার কিছু নেই।কলকাতাস্থিত কমান্ডার ইন চিফ রবার্টস এবং কিচেনারাও দেশলাই বাক্সের বিষয় ছিল। 


যাহোক ,  একটা সময় এল এখানকার বাঙ্গালী দেশলাই ব্র‍্যান্ড গুলো এরকম অসম লড়াইয়ের জন্য আদৌ তৈরি ছিল না। তার উপরে সেটা ছিল ” চলছে না, চলবে না”-র অভিশপ্ত যুগ। কাঁচরাপাড়ার কয়েকশ বছরের পুরনো ছুরি-কাঁচি-অস্ত্রর বিখ্যাত ঐতিহাসিক শিল্পতালুক হোক বা কলকাতার নামী মিষ্টির দোকান অথবা জেলার বড় কারিগরী কারখানা, বাংলার যেখানে যা কিছু বাণিজ্যিক উৎকর্ষতার সম্ভাবনা ছিল, বিদেশী অবাস্তব আদর্শে উদ্বুদ্ধ একদল জঙ্গী উজবুকেরা নতুন দিন আনার বিপ্লবের নামে ধরে ধরে তার প্রত্যেকটারই গলা টিপে চিরতরে হত্যা করতে পরিকল্পিত ভাবে উদ্যত ছিল। যতটা পেরেছে করেও ছেড়েছে। 


এই বিষাক্ত পরিবেশটাই কিন্তু হাওড়ার রুগ্ন শিল্পাঞ্চলে বাইরে থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসা উইমকোর মালিকদের জন্য যেন শাপে বর হয়েছিল! অল্প সময়েই তারা গেড়ে ফেলেছিল একচেটিয়ার মৌরসিপাট্টা। অন্যদিকে ঝড়ের সামনে ঝরা পাতার মতো উড়ে গেছিল বাঙালিদের ওইসব বিভিন্ন ছোটোখাটো দেশলাই ব্র‍্যান্ড গুলো। তখন না ছিল অসম প্রতিযোগিতায় কম্পিটিশন কমিশনের সুরক্ষা, না ছিল মুনাফাবাজী প্রফিটিয়ারিং বিরোধী নব্য পুঁজিবাদী আইন। সাম্যবাদের কেতাবি সুমহান “আদর্শে” অনুপ্রাণিত ঐক্যবদ্ধ এক দেশ ভরা কয়েক কোটি ইগোসর্বস্ব মগজধোলাই খাওয়া মধ্যমেধার গাড়ল গোষ্ঠী মনেপ্রাণে তখন বিশ্বাস করতো যে দেশের কারখানাগুলো ভালো চললে, ঘরে ঘরে সবার রোজগার নিশ্চিত হলে, কেউ “সর্বহারা” না থাকলে, খাদ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত হলে তাদের তাতে ক্ষতিই হবে। কেরানীগিরিকে শ্রমের থেকে বেশি মর্যাদা দিতো তারা। 


কোনো বিশেষ বাধা না পেয়ে এরপরে ক্যান্সারের মতো হুহু করে বাড়তে শুরু করে ওই দূষিত রক্তবীজের ঝাড়বংশ। শুধু তো ছোট শিল্পের নাভিশ্বাস তুলেই তারা ক্ষান্ত হয়নি, পেট ও পকেটের টানে কুনজর ভালোমতোই পড়ে এবার বড় কারখানায়। অনেক তাবড় জাতীয় ব্র‍্যান্ড তাদের কারখানা বন্ধ করে পালায় বাংলা ছেড়ে। কালক্রমে উইমকোতেও আরম্ভ হয় জঙ্গি ইউনিয়নবাজি।
সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে। উলটে যায় স্তালিনবাবাদের রক্তরাঙা সিংহাসন। হতভম্ব, দীশাহারা হয়ে যায় রক্তবীজের অশুভ ক্লোনরা। তারপর সেই বিশেষ রাজপরিবারের দেশের অর্থনীতি ভেঙে দিলেন।  তখন বিনা বিলম্বে হুহু করে ঢুকতে থাকে বিদেশী পণ্য, উন্নততর প্রযুক্তি, আসে নানা নতুনতর পরিষেবা। কমে যায় দেশলাইয়ের তেজ। তদ্দিনে হাতে হাতে উঠেছিল স্মাগলিং করে আনা রংবেরঙের চাইনিজ প্লাস্টিকের লাইটার।


এরপরে হুগলী নদীতে অনেক নোংরা জল বয়েছে। আজকাল মাঝেমধ্যেই দেখি হাতে চলে আসছে বেশ কিছু নতুন দেশলাই বাক্স যাদের গায়ে আবার বাংলায় লেখা দেখা যায়। এগুলো যে সব বাংলার তৈরি তাও নয়, যেমন- উড়িষ্যার ব্র‍্যান্ড কিন্তু বাংলায় কারখানা গড়েছে সম্প্রতি এবং শুরু থেকেই বাক্সে বাংলায় লিখছে। এর বাইরে দেখছি গুটিকয়েক আঞ্চলিক স্টার্টআপ ও নিয়ে আসছে নানারকম ডিজাইনার দেশলাই, দাম অল্প বেশি….


পরিশেষে বলি কলকাতা ও বাংলার দেশলাই সংক্রান্ত আলোচ্য বিষয় অবহেলিত , যদিও বহুকাল ধরে এর সংগ্রাহকের সংখ্যা নিতান্ত কম নয়। যে বিষয়ে কোনো বই আমার চোখে পড়েনি একমাত্র গোপাল বিশ্বাসের প্রবন্ধ ছাড়া।আমি এই যে লেখা লিখলাম এর মধ্যে বহু প্রতিষ্ঠানের নাম যাচর । আবার অনেকেরই নেই। আর প্রতিষ্ঠান গুলি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্যও সহজ লভ্য নয়। আমার লেখা পড়ে যদি কোনো উৎসাহী ব্যক্তি আরো কিছু প্রতিষ্ঠানের নাম, তার ইতিহাস, লেবেলের ছবি বা তথ্য প্রদান করেন তাহলে চির কৃতজ্ঞ থাকব।

সমাপ্ত
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ কলকাতা ও বাংলার দেশলাই : গোপাল বিশ্বাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.