নিউ জ়িল্যান্ড মানেই ভারতীয়দের মাথায় আসে কেন উইলিয়ামসন, স্টিফেন ফ্লেমিং, শেন বন্ড, ট্রেন্ট বোল্টের নাম। ক্রিকেট সে দেশে তেমন জনপ্রিয় না হলেও ভারতের ক্রীড়াপ্রেমীরা নিউ জ়িল্যান্ডকে তাই দিয়েই চেনেন। তবে সোমবার থেকে আরও একটি নাম পরিচিত হতে চলেছে। লুলু সান। তাঁর হাত ধরেই নিউ জ়িল্যান্ডে টেনিসের সূর্যোদয়।
উইম্বলডনের প্রি-কোয়ার্টার ফাইনালে এমা রাদুকানুকে হারিয়ে দেন লুলু। কিন্তু তাঁর জয়ে শুধু নিউ জ়িল্যান্ড খুশি হবে এমন নয়। আরও কয়েকটি দেশ খুশি হবে লুলুর সাফল্যে। কারণ নিউ জ়িল্যান্ডের হয়ে খেললেও লুলুর টেনিস খেলা শুরু হয় সুইৎজ়ারল্যান্ডে। সেই দেশের নাগরিকত্বও রয়েছে তাঁর। যদিও লুলুর বাবা ক্রোয়েশিয়ার এবং মা চিনের। লুলুর এক সৎবাবাও রয়েছেন। তিনি জার্মান। তাই লুলুর সাফল্য একসঙ্গে অনেক দেশের টেনিসপ্রেমীদের মুখে হাসি ফোটাতে পারে।
সোমবার গ্র্যান্ড স্ল্যামজয়ী রাদুকানুকে উইম্বলডনের প্রি-কোয়ার্টার ফাইনালে ৬-২, ৫-৭, ৬-২ গেমে হারিয়ে দেন লুলু। রাদুকানুর মারা শেষ শটটি লাইনের বাইরে যেতেই মুখ ঢেকে কোর্টের মধ্যে বসে পড়েন তিনি। তখনই চোখে জল এসে গিয়েছে তাঁর। কাঁদতে কাঁদতেই উঠে গেলেন রাদুকানুর সঙ্গে হাত মেলাতে। আম্পায়ারের সঙ্গে মিলিয়ে বসে পড়লেন নিজের চেয়ারে। মুখ ঢাকলেন তোয়ালেতে। গ্যালারিতে তাঁর মায়ের চোখেও তখন জল। টেনিসের ওপেন যুগে নিউ জ়িল্যান্ডের হয়ে প্রথম কোনও মহিলা খেলোয়াড় উইম্বলডনের কোয়ার্টার ফাইনালে উঠলেন। এর আগে ১৯৫৯ সালে রুইয়া মরিসন প্রি-কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছিলেন।
রাদুকানুকে হারানো তো দূর, লুলু ভাবেননি তিনি এত দূর পৌঁছতে পারবেন। উইম্বলডনের কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে লুলুর কান্না কিছুতেই থামছিল না। কোর্টের মধ্যে কথাই বলতে পারছিলেন না তিনি। বেশ কিছু ক্ষণের চেষ্টা পর কান্না থামে। লুলু বলেন, “আমি ভাবতেই পারিনি এত দূর আসতে পারব। তবে আমি প্রতি ম্যাচ ধরে এগিয়েছি। আর পৌঁছে গিয়েছি।”
লুলুর ইনস্টাগ্রামে পাঁচ হাজার ফলোয়ার। একেবারেই অপরিচিত এক টেনিস খেলোয়াড় উইম্বলডনের ঘাসের কোর্টে নজর কাড়ছেন। প্রথম রাউন্ডে বিশ্বের আট নম্বর কিনওয়েন ঝেংকে হারিয়ে দিলেও সে ভাবে উৎসাহ তৈরি হয়নি তাঁকে নিয়ে। কিন্তু সোমবার প্রি-কোয়ার্টার ফাইনালে রাদুকানুকে হারিয়ে দিতেই তৈরি হয়েছে আগ্রহ। নিজের সম্বন্ধে বলতে গিয়ে লুলু কিছু দিন আগে বলছিলেন, “খুব ছোট একটা শহর থেকে এসেছি। সেখানে মানুষের থেকে বেশি হরিণ আর ভেড়া পাওয়া যায়।”
লুলু ঘাসের কোর্টে খেলা শিখেছেন রজার ফেডেরারকে দেখে। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “আমি এই ঘাসের কোর্টে খেলে বড় হতে দেখেছি অনেককে। রজার ফেডেরার যে ভাবে কোর্টের কাছে এসে খেলতেন, স্টেফি গ্রাফ এবং মার্টিনা নাভ্রাতিলোভার ম্যাচ দেখেছি। ইউটিউবে এই খেলা দেখি। ওদের খেলা দেখতে ভাল লাগে। অবশ্যই ওদের খেলা চোখের সামনে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। কিন্তু ওদের খেলা দেখেই আমি শিখেছি।”
তিনটি ভাষায় স্বচ্ছন্দ লুলু। ইংরেজি ছাড়াও জানেন ফরাসি এবং চিনা ভাষা। ক্রমতালিকায় ১২৩ নম্বরে থাকা লুলু ইতিমধ্যেই এ বারের উইম্বলডনে নিশ্চিত করে ফেলেছেন ২০ লক্ষ ৪৫ হাজার টাকা। এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার আগে তাঁর মোট পুরস্কার ছিল ২২ লক্ষ ১৭ হাজার টাকা।
লুলুর জন্ম হয় নিউ জ়িল্যান্ডে। কিন্তু সেখানে খুব বেশি থাকা হয়নি। পাঁচ বছর বয়সে চলে গিয়েছিলেন সুইৎজ়ারল্যান্ডে। তার আগে কিছু সময় কাটিয়ে ছিলেন চিনের শাংহাই শহরে। লুলু বলেন, “সুইৎজ়ারল্যান্ডে বড় হলেও সে দেশে খুব বেশি দিন থাকা হত না। খেলার জন্য বিভিন্ন দেশে ঘুরতে হত।”
লুলুর পড়াশোনা টেক্সাসে। তাঁর মা চাইতেন পড়াশোনাটাই মন দিয়ে করুক মেয়ে। টেনিস খেলে সকলের পক্ষে বিরাট আয় করা কঠিন। তাই মেয়ে টেনিসে সাফল্য পেলেও পড়াশোনায় জোর দিতেন মা। কোভিডের সময় যখন সব জায়গায় খেলা বন্ধ, তখন পড়াশোনা নিয়েই ছিলেন লুলু। তিনি বলেন, “কোভিড আমার জন্য সৌভাগ্য নিয়ে এসেছিল। আমার চোট লেগেছিল ওই বছর। মা খুব চিন্তিত ছিল। কবে পরীক্ষা দিতে পারব জানতাম না, কিন্তু ওই সময় পড়াশোনা করে গিয়েছি। মা বলেছিল, পুরোপুরি টেনিস খেলোয়াড় হয়ে ওঠার আগে পড়াশোনা শেষ করতে হবে। আমার ভাগ্য ভাল আমি ওই সময় পড়াশোনা শেষ করে ফেলতে পেরেছিলাম। ফলে এখন আমার জীবনে টেনিস ছাড়া কিছু নেই।”
২৩ বছর বয়স লুলুর। কোচ ভ্লাদিমির প্ল্যাটেনিকের হাতে দ্রুত উন্নতি করছেন তিনি। কোচ বলেন, “লুলু দুর্দান্ত। ওর সঙ্গে কাজ করা খুব সহজ। তবে ওর আরও আত্মবিশ্বাস প্রয়োজন। সেটার একটু অভাব রয়েছে ওর মধ্যে। আমি চেষ্টা করি লুলুর আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করার। সেই সঙ্গে এটাও দেখা যাতে ও অহঙ্কারি না হয়ে যায়। শুধু ভাল টেনিস খেলোয়াড় নয়, ভাল মানুষ হওয়াটাও জরুরি।”
জুনিয়ার লেভেলে খেলার সময় সুইৎজ়ারল্যান্ডের হয়ে খেলেছেন লুলু। পরে এক সময় খেলেন নিউ জ়িল্যান্ডের হয়ে। তাঁর প্রতিভা চিনতে ভুল করেনি কিউইরা। নিউ জ়িল্যান্ডের হয়ে খেলতে অনুরোধ করা হয় তাঁকে। যে দেশে জন্মেছেন, সেই দেশের অনুরোধ ফেলতে পারেননি লুলু। উইম্বলডনে সেই দেশেরই প্রতিনিধিত্ব করছেন তিনি। লুলু এখন দু’টি জায়গায় অনুশীলন করেন। কখনও থাকেন ফ্লোরিডায়, কখনও আবার তাঁর কোচের দেশ স্লোভাকিয়ায়।
উইম্বলডনের কোয়ার্টার ফাইনালে লুলু খেলবেন ডোনা ভেকিচের বিরুদ্ধে। মঙ্গলবার সেই ম্যাচ জিতলে তাঁর তৈরি করা ইতিহাস আরও উজ্জ্বল হবে। লুলু সানের প্রতিভার আলো ছড়িয়ে পড়বে আরও দূরে।
উইম্বলডনে খেলতে নামার আগে লুলু ঘাসের কোর্টে কোনও ম্যাচ জেতেননি। কিন্তু তাঁকেও নিয়েও এখন ভেকিচ বলেন, “যোগ্যতা অর্জন পর্ব থেকে দুর্দান্ত খেলে আসছে লুলু। খুব ভাল খেলছে। আমি ওর সম্পর্কে খুব বেশি জানি না। কিন্তু কেউ উইম্বলডনের কোয়ার্টার ফাইনালে হঠাৎ করে ওঠে না।”