পর্ব_৩
ব্রিটিশ শাসকের হাত ধরে যে ধর্মান্তকরন ও অনুপ্রবেশের মাধ্যমে ভারতের উত্তর পূর্বের রাজ্য গুলির জনসংখ্যা ভারসাম্য পরিবর্তনের অশুভ প্রয়াস শুরু হয়েছিল। ১৮২৬ সালে ২৪ ফেব্রুয়ারিতে ইয়ান্ডাবু চুক্তি কালক্রমে অখন্ড ও বহু ভাষাভাষী বৈচিত্র্যময় ভারতের বুকে রাহু হিসাবে প্রতিপন্ন হয়েছিল। উপরন্তু স্বাধীনতার পর সেকুলার রাজনৈতিক দল গুলি যদি নিজের গদির জন্য চিতার আগুনে রুটি বানাতে ব্যস্ত না হত তাহলে বোধয় আজকের দিনে NRC ও CAB এর কোনো প্রয়োজন ছিল। একটি অনেক বড় ইতিহাস আমি পূর্ব দুইটি পর্বে বলেছি।
১৯৬০ সালের এপ্রিলে, আসাম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটিতে অসমীয়া ভাষাকে প্রদেশের একমাত্র দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ঘোষণা করার একটি প্রস্তাবের সূচনা হয়। এতে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় উত্তেজনা বাড়তে থাকে। অসমীয়া উত্তেজিত জনতা বাঙালি অভিবাসীদের আক্রমণ করে। জুলাই ও সেপ্টেম্বরে সহিংসতা যখন উচ্চ রূপ নেয়, তখন প্রায় ৫০,০০০ বাঙ্গালী হিন্দু ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে পালিয়ে যায়। অন্য ৯০,০০০ বরাক উপত্যকা ও উত্তর-পূর্বের অন্যত্র পালিয়ে যায়। ন্যায়াধীশ গোপাল মেহরোত্রার নেতৃত্বে এক ব্যক্তির একটি তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, কামরূপ জেলার গোরেশ্বর অঞ্চলের ২৫টি গ্রামের ৪,০১৯টি কুঁড়েঘর এবং ৫৮টি বাড়ি ধ্বংস ও আক্রমণ করা হয়; এই জেলা ছিল সহিংসতার সবচেয়ে আক্রান্ত এলাকা। নয়জন বাঙ্গালী হিন্দুকে হত্যা করা হয় এবং শতাধিক লোক আহত হয়।
১০ অক্টোবর, ১৯৬০ সালের সেই সময়ের অসমের মুখ্যমন্ত্রী বিমলা প্রসাদ চলিহা অসমীয়াকে আসামের একমাত্র সরকারী ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়ার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। উত্তর করিমগঞ্জ-এর বিধায়ক রণেন্দ্রমোহন দাস এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু ২৪ অক্টোবর প্রস্তাবটি বিধানসভায় গৃহীত হয়।
বারাক উপত্যকার বাঙ্গালী হিন্দদুদেরউপর অসমীয়া ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে ১৯৬১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে কাছাড় গণ সংগ্রাম পরিষদ নামক সংগঠনটির জন্ম হয়। অসম সরকারের এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে ১৪ এপ্রিল তারিখে শিলচর, করিমগঞ্জ আর হাইলাকান্দির লোকেরা সংকল্প দিবস পালন করেন । বরাকের জনগণের মধ্যে সজাগতা সৃষ্টি করার জন্য এই পরিষদ ২৪ এপ্রিল একপক্ষ দীর্ঘ একটি পদযাত্রা শুরু করেছিল। ২ মে তে শেষ হওয়া এই পদযাত্রাটিতে অংশ নেওয়া সত্যাগ্রহীরা প্রায় ২০০ মাইল উপত্যকাটির গ্রামে গ্রামে ঘুরে প্রচার চালিয়েছিলেন। পদযাত্রার শেষে পরিষদের মুখ্যাধিকারী রথীন্দ্রনাথ সেন ঘোষণা করেছিলেন যে, যদি ১৩ এপ্রিল,১৯৬১ সালের ভিতর বাংলাকে সরকারী ভাষা হিসেবে ঘোষণা করা না হয়, ১৯ মে তে তারা ব্যাপক হরতাল করবেন।১২ মে তে অসম রাইফেল, মাদ্রাজ রেজিমেন্ট ও কেন্দ্রীয় সংরক্ষিত পুলিশ বাহিনী শিলচরে ফ্ল্যাগ মার্চ করেছিল।১৮ মে তে অসম পুলিশ আন্দোলনের তিনজন নেতা নলিনীকান্ত দাস, রথীন্দ্রনাথ সেন ও বিধুভূষণ চৌধুরী (সাপ্তাহিক যুগশক্তির সম্পাদক) কে গ্রেপ্তার করে।
১৯ মে তে শিলচর, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দিতে হরতাল ও পিকেটিং আরম্ভ হয়। করিমগঞ্জে আন্দোলনকারীরা সরকারী কার্যালয়, রেলওয়ে স্টেশন, কোর্ট ইত্যাদিতে পিকেটিং করেন। শিলচরে তারা রেলওয়ে স্টেশনে সত্যাগ্রহ করেছিলেন। বিকেল ৪টার সময়সূচির ট্রেনটির সময় পার হওয়ার পর হরতাল শেষ করার কথা ছিল। ভোর ৫:৪০ এর ট্রেনটির একটিও টিকিট বিক্রি হয় নি। সকালে হরতাল শান্তিপূর্ণ ভাবে অতিবাহিত হয়েছিল। কিন্তু বিকালে স্টেশনে অসম রাইফেল এসে উপস্থিত হয়।
বিকেল প্রায় ২:৩০র সময় ন’জন সত্যাগ্রহীকে কাটিগোরা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের একটি ট্রাক তারাপুর স্টেশনের (বর্তমানের শিলচর রেলওয়ে স্টেশন) কাছ থেকে পার হয়ে যাচ্ছিল । পিকেটিংকারী সকলে তাদেরকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যেতে দেখে তীব্র প্রতিবাদ করেন। ভয় পেয়ে ট্রাকচালক সহ পুলিশরা বন্দীদের নিয়ে পালিয়ে যায়। এর পর কোনো অসনাক্ত লোক ট্রাকটি জ্বালিয়ে দেয়, যদিও দমকল বাহিনী এসে তৎপরতার সাথে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। তারপর প্রায় ২:৩৫ নাগাদ স্টেশনের সুরক্ষায় থাকা প্যারামিলিটারী বাহিনী আন্দোলনকারীদেরকে বন্দুক ও লাঠি দিয়ে মারতে শুরু করে। এরপর সাত মিনিটের ভিতর তারা ১৭ রাউণ্ড গুলি আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে চালায়। ১২ জন লোকের দেহে গুলি লেগেছিল। তাদের মধ্যে ন’জন সেদিনই নিহত হয়েছিলেন; দু’জন পরে মারা যান। ২০ মে তে শিলচরের জনগণ শহীদদের শবদেহ নিয়ে শোকমিছিল করে প্রতিবাদ সাব্যস্ত করেছিলেন।
এই ঘটনার পর অসম সরকার বরাক উপত্যকায় বাংলাকে সরকারী ভাষা হিসাবে ঘোষণা করতে বাধ্য হয়।প্রতি বছর বরাক উপত্যকাসহ ভারতের বিভিন্নপ্রান্তে ১৯ মে কে বাংলা ভাষা শহীদ দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
২০১১ সালে, ভাষা আন্দোলনের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে শহীদ কমলা ভট্টাচার্য মূর্তি স্থাপন কমিটির পক্ষ থেকে গোপা দত্ত আইচ ছোটেলাল শেঠ ইনস্টিটিউটের প্রাঙ্গণে কমলার একটি ব্রোঞ্জের আবক্ষ মূর্তি উন্মোচন করেন।
শহীদদের তালিকা:
কানাইলাল নিয়োগী,চন্ডীচরণ সূত্রধর,হিতেশ বিশ্বাস,সত্যেন্দ্রকুমার দেব,কুমুদরঞ্জন দাস,সুনীল সরকার,তরণী দেবনাথ,শচীন্দ্র চন্দ্র পাল,বীরেন্দ্র সূত্রধর,সুকোমল পুরকায়স্থ এবংকমলা ভট্টাচার্য।এছাড়াও আসামেই বাংলা ভাষার জন্য ১৯৭২ সালের ১৭ আগস্ট আরো একজন শহীদ হন:
বিজন চক্রবর্তী
এবং১৯৮৬ সালের ২১ জুলাই শহীদ হন দুজন:
জগন্ময় দেব ওদিব্যেন্দু দাস।
১৯৭৮ সাল ২৮ শে মার্চ লোকসভার সদস্য হীরালাল পাটোয়ারীর মৃত্যুর পর মঙ্গলদৈ লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনের প্রয়োজন হয়। শূন্যপদ পূরণ করার জন্য ১৯৭৯ সালের শেষের দিকে সেই আসনের উপ-নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেয় ভারতের নির্বাচন কমিশন । এই একই সঙ্গে ওই বছরের এপ্রিল মাসে নতুন ভোটারদের ভোটার তালিকাতে নাম নথিভুক্ত করনের কাজ আরম্ভ করে। মে মাস পর্যন্ত ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজ চলার কথা ছিল ।কিন্তু মে মাসের প্রথম সপ্তাহে ভোটার তালিকায় প্রচুর অবৈধ বিদেশির নাম ঢুকে গেছে এরূপ অভিযোগ উত্থাপিত হয় । বলা হয় কংগ্রেস আই দল নিজের গদি শক্ত রাখতে কৌশলে সন্দেহজনক নাগরিকের নাম ভোটার তালিকায় ঢুকিয়েছে। এই অভিযোগ তুলে সমস্ত আসাম কাঁপিয়ে তোলে সারা আসাম ছাত্র সংস্থা বা আসু। অবশ্য এর আগে থেকেই বিদেশি অনুপ্রবেশ থেকে শুরু করে বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের দাবিতে সারা আসাম ছাত্র সংস্থা বা আসু বিভিন্ন প্রতিবাদী কর্মসূচি গ্রহণ করে আসছিল।
এক্ষেত্রে বলে রাখি ,১৯৬২ সালে বঙাল খেদা বা বাঙালি খেদা আন্দোলনের প্রতিবাদে বাঙ্গালী হিন্দু পল্লি কবি নিবারান পন্ডিত সেই দিনগুলির কথা নামে কাব্যের একটি সংগ্রহ রচনা করেন।১৯৭২ সালে আসামে বড় বড় জাতিগত দাঙ্গা সংঘটিত হয়, যেখানে লক্ষ্য ছিল বেশিরভাগই বাঙ্গালী হিন্দু। প্রায় ১৪,০০০ বাঙালি পশ্চিমবঙ্গ এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের অন্য রাজ্য গুলিতে পালিয়ে যায়।
১৯৮০ সালে কেন্দ্রীয় সরকার এই আন্দোলনের প্রতি কঠোর দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করতে শুরু করেন। এই সময়ে আসামের বিভিন্ন স্থানে নানান হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেছিল । আসাম আন্দোলনের উত্তাপ থেকে সংখ্যালঘুদের বাঁচাতে ১৯৮৩ সালে ইন্দিরা গান্ধী আইএমডিটি এক্ট কার্যকর করলেন। এই আইনে কেউ বিদেশি কিনা সেটা প্রমাণের দায়িত্ব নিতে হতো অভিযোগকারীকে অর্থাৎ পুলিশকে । অথচ ১৯৪৬ সালে ফরেনাস ট্রাইব্যুনাল এক্ট অনুসারে অভিযুক্তকেই প্রমান করতে সে বিদেশি কিনা। ১৯৮৩ সালের নতুন আইনা কাউকে বিদেশি বলে চিহ্নিত করেন ও সংশ্লিষ্ট দেশে ফেরত পাঠানো অত্যন্ত কঠিন ব্যপার ছিল । সর্বানন্দ সনোয়াল সুপ্রিম কোর্টে এই আইনকে চ্যালেঞ্জ করে মামলা করলেন । অবশেষে ২০০৫ সালে এই আইন রদ হয়।
আসাম বিপ্লবের প্রথম পর্যায়ে, ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা জুড়ে বাঙ্গালী হিন্দু সম্প্রদায়কে আক্রমণ করা হয়েছিল। দুলিয়াজানে অয়েল ইন্ডিয়ার সদর দফতরের একটি জন বাঙ্গালী টেকনিক্যাল অফিসার রবি মিত্রের উপর রক্তক্ষয়ী হামলায় বাঙালিদের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক দেখা দেয়। ১৯৮৩ সালে, বিদেশি বিতারণ আন্দোলনের নামে আবারও বাঙ্গালী হিন্দুদের উপর আক্রমণ করা হয়। ধমাইজি জেলায়, শালাপাথের অসমীয়া ছাত্রদের দ্বারা পূর্ব নোটিশ ছাড়াই বাঙালিদের ঘর ভাঙচুর করা হয়।বাঙ্গালী হিন্দুদের প্রতি অসমীয়া জনগণের ঘৃণার পথ অনুসরণ করে, আদিবাসীরা মেঘালয়তে বাঙ্গালী হিন্দুদের উপর হামলা চালাতে শুরু করে, এবং তাদের চাকরি ও ব্যবসার আধিপত্য রোধ করে। আক্রমণগুলি বেশিরভাগই শিলংতে সীমাবদ্ধ ছিল। ১৯৮০ সালে, এক জন বাঙ্গালী হিন্দু বিধায়ক নিহত হন এবং হিন্দু এলাকাগুলি বারংবার নিয়মিত আক্রমণের মধ্য পরে। বেশিরভাগ বাঙ্গালী হিন্দুর উৎসব দুর্গা পূজার আগে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হামলা হয়েছিল। ১৯৮০ সাল থেকে আনুমানিক ২৫,০০০ থেকে ৩৫,০০০ বাঙ্গালী হিন্দু মেঘালয় ত্যাগ করে এবং পশ্চিমবঙ্গ এবং ভারতের অন্যান্য অংশে বসতি স্থাপন করে।
বিদেশি ইস্যুতে উত্তাল পরিস্থিতিতে ১৯৮৩ সালে বিধান সভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ও নির্বাচনা হিতেশ্বর শইকিয়া মুখ্যমন্ত্রী হন।এদিকে সমস্ত ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা জুড়ে হিংসা বিস্তারিত হয়। ১৮ ই ফেব্রুয়ারি ১৯৮৩ সালে একদল সশস্ত্র জনতা ধারালো অস্ত্র নিয়ে নগাঁও জেলায় সরকারী হিসাবে ২১৯১ জনকে নিৰ্মম ভাবে হত্যা করে। যদিও বেসরকারি হিসাবে সংখ্যাটি আরো অধিক।এই হত্যাকাণ্ড নেলী হত্যাকান্ড নামে পরিচিত।
১৯৯৭ সালের ১৭ জুলাই ভারতের নির্বাচন কমিশন আসাম সরকারকে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে নাগরিকত্বহীন ব্যক্তিদের ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার নির্দেশ প্রদান করেন। এই নির্দেশ পাওয়ার পর আসাম সরকারের তরফ থেকে বাড়ি বাড়ি সার্ভার মাধ্যমে মাধ্যমে যাচাই করে ভোটার তালিকা নবিকরনের কাজ শুরু হয়। এ সময় যারা সঠিক পথ দেখাতে পারেননি অথবা যারা অনুপস্থিত ছিলেন তাদের নামের পাশে D বা Doubtful চিহ্নিত রাখা হয় ।এই প্রক্রিয়ার ফলে সে সময় ভোটার তালিকায় ৩৭০০০০ জনকে D ভোটার চিহ্নিত করা হয়। এরপর নির্বাচন কমিশন চিহ্নিত ব্যক্তিদের নিয়ে ফরেনার ট্রাইব্যুনাল অর্ডার অনুসারে ১৯৬৪ অনুসারে গঠিত ফরেনার ট্রাইব্যুনালে ট্রায়াল চালানোর নির্দেশ দেন। প্রাথমিক খোঁজখবর এরপর সেই ৩৭০০০০ লক্ষ জনের মধ্যে ১৯৯৬৩১ জনকে ট্রাইব্যুনালে ট্রায়ালে পাঠানো হয়েছিল ।
ট্রায়ালের পর ৩৬৮৬ জনকে বিদেশি বলে চিহ্নিত করা হয়। সমগ্র আসাম জুড়ে ৩৬ টি ট্রাইবুনালের মাধ্যমে অত্যন্ত ধীর গতিতে ট্রায়ালের কাজ চলতে থাকে। এর মধ্যে ট্রায়াল অনুপস্থিত D চিহ্নিত বেশকিছু বাংলাদেশী পলাতক বলে ঘোষিত হয় ।এই পরিস্থিতিতে ৪ এপ্রিল ২০০৪ সালে গৌহাটি হাইকোর্ট ট্রায়াল শেষ না হওয়া পর্যন্ত D ভোটারদের ডিটেনশন ক্যাম্পে রাখার নির্দেশ দেন। সেই অনুসারে D ভোটারদের গোয়ালপাড়া ও কোকরাঝাড় ডিটেনশন ক্যাম্পে রাখা হয়। ২০০৫ সালে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে আরও একটি সার্ভে বাড়ি বাড়ি সার্ভে হয়। এতে দেখা যায় ১৯৯৭ সালের D ভোটার বলে চিহ্নিতদের মধ্যে একটি ভালো অংশের খোঁজ নেই। এই সার্ভের মাধ্যমে সব মিলিয়ে ১৮১৬১৯ জনকে চিহ্নিত করে রাখা হয়। ২০১২ সালের জুন মাস পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে সরকারিভাবে ১৫৭৪৬৫ জনকে D চিহ্নিত ভোটার পাওয়া যায়।
D ভোটারদের ব্যাপক ভাবে পুলিশি হয়রানি হতে হচ্ছে এমন অভিযোগ প্রচুর ।
আসামে জন্মগ্রহণ করে বেশ কয়েকবার ভোট দিয়ে D ভোটার হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার পর জোর করে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর পর তাঁদের খোঁজ পাওয়া যায়নি এমন দৃষ্টান্ত আছে। বাংলাদেশ থেকে যে সমস্ত বাঙ্গালী হিন্দুরা অত্যাচারিত হয়ে কেবল প্রাণের তাগিদে শরণার্থী হয়ে আসামে বসবাস করছিলেন তাঁদের নিকট D ভোটার তকমা পাওয়া বা ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দী থাকা নরক জীবন যন্ত্রণা এবং বেইমানি ছাড়া আর কিছু নয় । আশার কথা এই যে আসামে কর্মরত বিভিন্ন ধরনের হিন্দু সংগঠনগুলো বাঙ্গালী হিন্দুদের এই নরক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেওয়ার আপ্রাণ প্রয়াস করে যাচ্ছেন।
২০১২ সালের মার্চ মাসের আসাম চুক্তি রূপায়ন মন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা বলেন আসাম সরকার বাঙ্গালী হিন্দু D ভোটার বিষয়টি দেখার জন্য একটি কমিটি গঠন করবেন। এবং তাঁদের যাতে পুলিশি হয়রানি না করে সেই বিষয়টি সরকার নিশ্চিত করবে । এত কিছু প্রতিশ্রুতির পরেও তাঁদের প্রতি পুলিশি হয়রানি বন্ধ হয়নি এমন দৃষ্টান্ত যথেষ্ট লক্ষ্য করা যায়। এরপর সুপ্রিমকোর্ট কিছু শর্তসাপেক্ষে ডিটেনশন ক্যাম্পে থাকা D ভোটারদের মুক্তির নির্দেশ দান করেছেন। এই শর্তগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মুক্তি দেওয়ার আগে প্রত্যেকের বিস্তারিত বায়োমেট্রিক তথ্য সংরক্ষন করে রাখতে হবে, এক লক্ষ টাকা বন্ড সহ দুইজন ভারতীয় জামিনদার দিতে হবে। মুক্তি পাওয়া ব্যক্তিকে সপ্তাহে একবার ট্রাইব্যুনাল সংশ্লিষ্ট থানায় হাজিরা দিতে হবে এবং জেলার পুলিশ সুপারকে ট্রাইব্যুনালের ত্রৈ মাসিক রিপোর্ট পাঠাতে হবে ।
১৯৮৫ সাল ১৫ আগস্ট…আসাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হল । স্বাক্ষর করলেন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী , আসু ও অল আসাম গণসংগ্রাম পরিষদ। এই চুক্তি অনুসারে অভিবাসীদের তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়েছিল। প্রথমত যারা ১.১.১৯৬৬ সালের আগে আসামে এসেছিল। দ্বিতীয় , যাঁরা ১.১.১৯৬৬ সাল থেকে ২৪.৩.১৯৭১ সালের মধ্যে আসামে।এসেছেন । তৃতীয়, যাঁরা ২৫.০৩.১৯৭১ সালের পরে এসেছেন….
প্রথম ক্যাটাগরিতে থাকা ব্যক্তিরক নাগরিকত্ব পাবেন । পরের ক্যাটাগরিতে থাকা ব্যক্তিরা ১০ বছর নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত হবেন এবং তৃতীয় ক্যাটাগরীতে থাকা ব্যক্তিদের নিজেদের দেশে ফেরত পাঠানো হবে।
১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর অটল বিহারী বাজপেয়ী নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্য সরকার ও অল আসাম স্টুডেন্ট ইউনিয়নের মধ্যে ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে জাতীয় নাগরিক পঞ্জি নবিকরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় । বৈঠক শেষ হতে এই কাজের জন্য কেন্দ্রের তরফে ২০ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল। এবং এর সাথে সাথে রাজ্য সরকারকে ৫ লক্ষ টাকা দিয়েও দেওয়া হয়…. এরপরেও এব্যাপারে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকারের তরফ থেকে কোনো সক্রিয়তা দেখতে পাওয়া যায়নি। ২০০৪ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সফরের সময় জাতীয় নাগরিক পঞ্জি নবিকরণের দাবিতে আসু বয়কট ঘোষণা করেন । ২০০৫ সালে ৫ মে মনমোহন সিংয়ের উপস্থিতিতে পুনরায় ত্রিপাক্ষিক বৈঠক হয় এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে এনআরসি আপডেটের কাজ শেষ করা হবে ।কিন্তু গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবে রূপায়িত হয়না। ২০০৯ সালের ১২ জুলাই আসামে আসাম পাবলিক ওয়ার্কস নামে একটি এনজিও সুপ্রিম কোর্টে একটি মামলা দায়ের করে যে আসামে ভোটার তালিকায় ৪১ লক্ষ নাম বিদেশি র নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
২০১০ সালে ২২ এপ্রিল কেন্দ্রীয় গৃহসচিবের নেতৃত্বে ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় বরাপেটা ও কামরূপ জেলার দুটি রেভিনিউ সার্কেলে NRCর পাইলট প্রজেক্ট সূচিত হবে। কামরূপে বিষয়টি সুন্দ ভাবে সম্মপন্ন হলেও অশান্তির সূত্রপাত হল বরাপেটায় । এখানে অল আসাম মুসলিম স্টুডেন্ট ইউনিয়ন বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করে। সেই বিক্ষোভ সামলাতে গিয়ে শুরু পুলিশের গুলিতে ৪ জনের মৃত্যু হয়ে যায়। ফলত NRC সংক্রান্ত প্রজেক্ট টি কোমায় চলে যায়।
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের ভাবাদর্শে গড়ে ওঠা বিভিন্ন সংগঠন ও আরো নানা হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের নিরলস প্রয়াস এর ফলে আশির দশক থেকে পরিস্থিতি পরিবর্তন হতে শুরু করে ।।এইজন্য সংঘের বেশ কয়েকজন প্রচারককে প্রাণ পর্যন্ত দিতে হয়েছিল । আসামকে নিয়ে ষড়যন্ত্রর স্বরূপ সম্পর্কে মানুষ সচেতন হতে শুরু করে । বাঙ্গালী হিন্দুরা বিপন্ন হলে অনেক জায়গাতেই আসাম হিন্দুরা সংখ্যালঘুতে পরিণত হবে পরিণত হবে অর্থাৎ অসমীয়া দের অস্তিত্ব বিপণ্ন হবে তা উপলব্ধি করানোর পিছনে এই সকল হিন্দু সঙ্ঘ গুলির ভূমিকা অনস্বীকার্য। ফলে ভাষা সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে ভেদ সৃষ্টি না করে যেকোনো মূল্যে হিন্দুসমাজের নিকট ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে ।উগ্র ও ভয়ঙ্কর অসমীয়া সেন্টিমেন্টে জায়গায় স্থান নিতে হবে এই ভাবনা ।
অবশেষে ২০১৫ সালের সুপ্রিম কোর্টের মধ্যস্থতায় কেন্দ্র নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকারের উদ্যোগে রাজ্যজুড়ে এনআরসি নবীকরণ এর কাজ শুরু হয় গত ।
নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ২০১৬ সালে প্রথম উত্থাপিত হয়। এই বিষয়টি ভারতের নানা প্রান্তে এক মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। নাগরিক পরিচয় এই ব্যাপারটি গুরুত্বপূর্ণ তা মানুষ উপলব্ধি করেছেন। ২০১৬ সালে যখন উক্ত বিলটি পাস ,তারপর একটি যৌথ সংসদীয় কমিটি গঠন করা হয় পর্যালোচনার নিমিত্তে। সেই কমিটিতেও বহুদিন যাবৎ আলোচনা চলার পর কোন সংশোধনী ছাড়াই বিলটি সংসদে পুনরায় পেশ করা হয়, এবং তা পাশ হয় এই বছরের শুরুতেই।
ভারতীয় নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী অবৈধ অনুপ্রবেশকারীর একটি নির্দিষ্ট সংজ্ঞা আছে। যে সমস্ত ভিনদেশের নাগরিক ভারতে কোন বৈধ কাগজপত্র ব্যতীত অনুপ্রবেশ করেছে, অথবা নির্ধারিত সময়সীমার পরেও ভারতে অবস্থান করছে তাদের এই অবৈধ অনুপ্রবেশকারীর আওতায় ফেলা হয়। এই বিল অনুসারে আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ থেকে আগত হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্শি এবং খ্রিস্টানদের এবার থেকে আর অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসাবে গণ্য করা হবে না। ভারতের নাগরিকত্ব গ্রহণের জন্য বিদেশী নাগরিকদের কমপক্ষে ১১ বছর ভারতে থাকতে হয় অথবা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে চাকরি করতে হয়। এই বিল অনুসারে আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ থেকে আগত হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্শি এবং খ্রিস্টানদের জন্য এই সময়কাল কমিয়ে ৬ বছর করা হবে। নাগরিকত্বের আবেদনের বাকি সকল শর্ত অবশ্যই বজায় থাকবে।
উক্ত বিল আইন হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেলে তা হবে পূর্বপ্রান্তের হিন্দুদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে একটি সুদৃঢ় পদক্ষেপ। নিঃসন্দেহে সমগ্র ভারতের কর্তব্য দেশভাগের বলি হওয়া এই হিন্দুজাতির পুনর্বাসনের ভার গ্রহণ করা, যাদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে আমাদের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। কিন্তু এর সাথে সাথে আরেকটি বিষয়েও আমাদের নজর দেওয়া উচিত, যা আমাদের দেশের একটি জ্বলন্ত সমস্যা বহুদিন যাবৎ। তা হল বাংলাদেশ থেকে ঘটে চলা অবৈধ অনুপ্রবেশ। এই অনুপ্রবেশের সমস্যা সমগ্র ভারত জুড়েই পরিলক্ষিত, তবে তার মূল প্রকোপ পশ্চিমবঙ্গ এবং আসামে দেখা যায়।
#ক্রমশ
তথ্যঃ জাতীয় নাগরিক পঞ্জি : সাধন কুমার পাল