একটি ইতিহাস ও জাতীয় নাগরিকপঞ্জি : পর্ব ১

পর্ব_১

সাত বোনের রাজ্য, কুয়াশা মাখা, হিমেল পার্বত্য হাওয়া র সাত রাজ্য অসম,মণিপুর ,নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরা, মেঘালয়, অরুণাচল প্রদেশ ও মিজোরাম। একসময় এরাই ছিল সন্ত্রাসবাদের কলঙ্কে কলঙ্কিত। ১৯৭৯ সাল থেকে সন্ত্রাসবাদী ক্রিয়াকলাপের জন্য এখানে অজস্র মানুষের মৃত্যু হয়েছে। কংগ্রেস শাসনের সময় গজিয়ে উঠেছিল অগণিত বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন।নানা ভারত বিরোধী সংগঠন কাজের ক্ষেত্র হিসাবে বেছে নিয়েছিল এই উত্তরপূর্ব ভারতকে। এই সব সন্ত্রাসী সংগঠন গুলি র কারুর দাবি ছিল স্বায়ত্তশাসন কেউ চাইত স্বার্বভৌমত্ব। এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার সমান্তরাল আন্ডারগ্রাউন্ড সরকার গঠন করে সরকারি কর ব্যবস্থার মত কর আদায় করত। কেউ এই কর না দিতে চাইলে তার জন্য অপেক্ষা করত মৃত্যু।
কংগ্রেসের উক্ত রাজ্যগুলি থেকে পতনের সঙ্গে সঙ্গে ম্যাজিকের মত সন্ত্রাসবাদ উড়ে গেছে। গণতান্ত্রিক রীতি অনুসারে সরকার পরিবর্তন হবে স্বাভাবিক কিন্তু তার সঙ্গে সন্ত্রাসীদের উত্থান থেকে পতনের বিষয়টি জনমানসের মধ্যে নতুন চিন্তার সৃষ্টি করেছে। ২০১৪ সালে ভারতীয় জনতা পার্টি ক্ষমতায় এসে লুক ইস্ট নীতির মাধ্যমে সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন সৃষ্টি করেন। ফলত বহু মানুষ সন্ত্রাস ত্যাগ করে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে শুরু করেন।


ইতিহাস মন্থন করলে দেখা যায় যে ধর্মান্তকরণ ও অনুপ্রবেশের সূচনা ঘটেছিল ব্রিটিশ শাসনের মাধ্যমে। ১৮৩৭ সাল হতে ভাষা নিয়ে ইংরেজরাই বার বার রাজনীতি করেছিল। ১৮৭৪ সালে শ্রীহট্ট , কাছাড় ও গোয়ালপাড়াকে কেবল জনসংখ্যার ভারসাম্য পরিবর্তনের অশুভ প্রয়াস হিসাবে আসামে যুক্ত করা হয়। স্বাধীনতার পূর্ব সময় থেকেই বিদেশি ইস্যুতে বারে বারে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে এই সাত রাজ্য। এই নিয়ে বহু দাঙ্গা হয়েছে।  ১৯৮৫ সালে রাজীব গান্ধীর নেতৃত্বে অসম চুক্তি স্বাক্ষর হলেও ঐ চুক্তি কার্যকর করার মত ক্ষমতা ও রাজনৈতিক ইচ্ছা কোনোটাই কংগ্রেসের ছিল না।


ব্রিটিশ সরকার অসমের পতিত জমি দুর্ভিক্ষ পীড়িত কৃষকদের বিলি করতে শুরু করলে ভূমিহীন মুসলমানরা ব্যাপক হারে অসমমুখী হতে শুরু করে। ফলে যেখানে মুসলিম ছিল না সেখানে অদ্ভুত ভাবে ডেমোগ্রাফিক পরিবর্তন শুরু হল। ১৯০১ সালে এন্ড্রু ফ্রেজার বাংলার গভর্নর হয়ে আসেন। ১৯০৩ সালে তৈরি হল বঙ্গভঙ্গের খসড়া। এই খসড়ায় পূর্ব বঙ্গের চট্টগ্রাম বিভাগ, ঢাকা, ময়মনসিংহকে আসামের সঙ্গে যুক্ত করে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির আয়তন হ্রাস করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। এই বিষয় কার্জনের অনুমোদন পাওয়ার পর লন্ডনে কর্তৃপক্ষ নিকট অনুমোদনের জন্য পাঠিয়ে বলা হয় শাসনতান্ত্রিক সুবিধার জন্য বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব এবং নবগঠিত প্রদেশের নাম হবে পূর্ববঙ্গ অসম। এদিকে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন সূচিত হয় সমগ্র ভারত জুড়ে। কার্জন প্রমাদ গুনে কার কাছে গেলেন? গেলেন পূর্ব বঙ্গ , অতিথি হলেন ঢাকার নবাব সলিমুল্লার।সেখানে কি হল? সেখানে পরামর্শ হল পদ্মাপারে একটি ইসলামপ্রধান দেশ গঠন করা হবে । যার রাজধানী হবে ঢাকা। এই সময় ঢাকায় আয়োজিত বিশাল মুসলিম জনসভায় কার্জন তাঁর ভাষণে বলেছিলেন ” পূর্ববঙ্গের মুসলিম জনগন প্রাচীন সুলতান ও সুবেদারদের আমল থেকেই রাজনৈতিক ঐক্য বঞ্চিত, সে জন্য তাদের ঐক্য ফিরিয়ে দিতে হবে।”


গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া এক্ট ১৯৩৫ অনুসারে ১৯৩৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অসমে সাধারণ নির্বাচন হয় । এই নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে জয় লাভ করে কংগ্রেস কিন্তু সরকার গঠন করতে অস্বীকার করেন। এই পর অসমের গভর্নর মহম্মদ সইদুল্লা নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগকে মন্ত্রী সভা গঠনের জন্য ডাক দেন। ১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত সইদুল্লা অসমের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে কাজ করেন। ১৯৩৯ সালে এই সইদুল্লাই অসমের পতিত জমিতে বাংলাভাষী মুসলমানদের পুনর্বাসন দেওয়ার নীতি ঘোষণা করেন। যুক্তি কি এর পিছনে?


যুক্তি এই দেওয়া হয় যে সল্প জনসংখ্যা বিশিষ্ট আসামে পতিত জমিতে আরো অধিক খাদ্য উৎপাদনের জন্যই এই পুনর্বাসন নীতি। এক সময় ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেল এই গ্রো মোর ফুড স্লোগান করে গ্রো মোর মুসলিম হিসাবে আখ্যায়িত করেছিলেন। আরো মজার কথা বলি। এই সইদুল্লা ১৯৪০ সালে লীগের লাহোর অধিবেশনে পাকিস্তান প্রস্তাবের খসড়া তৈরিতে অংশ নিয়েছিলেন। এহেন বীভৎস সাম্প্রদায়িক মানসিকতা সম্পন্ন সইদুল্লা ১৯৪৭ সালে ভারতের সংবিধান পরিষদের সদস্য হিসাবেও নিযুক্ত হয়েছিলেন।


১৯৪০ সালের লাহোর চুক্তিতে পাকিস্তান প্রস্তাবে আসামকেও পাকিস্তানের অংশ করে নেওয়াতর প্রস্তাব গৃহীত হয়।  এই সব ঘটনা থেকে এটাই স্পষ্ট হয় যে মুসলিমদের শক্তিশালী ও খুশি করার জন্যই অসম কে মুসলিম বহুল রাজ্যে পরিণত করা ছিল শাসকদের ডিভাইড এন্ড রুলস পলিসির অঙ্গ। আসাম পাকিস্তানে গেলে সেখানের প্রাচীন ঐতিহ্য ,কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ধর্ম রক্ষা সম্ভব নয়। ফলে অসমিয়াদের মধ্যে বৃদ্ধি পেতে থাকল ইসলামিক আগ্রাসন নিয়ে আতঙ্ক ও ক্ষোভ। ইসলামিক ক্ষোভ ও আতঙ্ক থেকেই বাংলাভাষী মুসলিম বিদ্বেষ যা পরে বাঙালি বিদ্বেষ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। 

সিলেট বা শ্রীহট্ট  ছিল বাংলাভাষী কিন্তু আসামের অন্তর্গত। এই জেলার মানুষের কিছু সমাজতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য ছিল এখানকার হিন্দু ও  মুসলিমদের মধ্যে একটি বিশাল অংশ ব্রিটেনে চলে গিয়েছিল । লন্ডনের কেনেরি হার্ফ এবং ব্রিক লেন অঞ্চল এদেরই অধ্যুষিত।

 সিলেটে এদেরকে লন্ডনী বলা হত। বিদেশের সঙ্গে সংযোগ থাকার ফলে বা অন্য যে কোন কারণেই হোক সিলেটের মুসলিমরা কিছুটা আলাদা ছিল । সিলেটের হিন্দুরা শিক্ষায়-দীক্ষায় আরও অত্যন্ত অগ্রসর ছিল।  সে সময় আসাম প্রদেশ কে তিন ভাগে ভাগ করা হতো ।
১. ব্রহ্মপুত্র বা আসাম উপত্যকা ২. পার্বত্য অঞ্চল ৩.সুরমা উপত্যকা । 
সুরমা অঞ্চল বলতে প্রধানত কাছাড় ও সিলেট জেলা কে বোঝানো হতো । ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার তীরে প্রচুর খালি জমি পড়েছিল, প্রচুর অরণ্য সম্পদ ছিল ,খনিজ তেলও ছিল । ফলে এই উপত্যকায় অধিবাসীরা যাদের মধ্যে প্রধান বর্ণহিন্দু , অসমীয়া অহম, এবং গরিয়া মুসলিম সকলেই অসমীয়া ভাষী এবং এরা কেউ অঞ্চলের বাইরে যেতে উদ্যোগী হন নি । অপরপক্ষে জনসংখ্যার চাপে সিলেটি বাংলা ভাষী হিন্দুরা সুরমা উপত্যকার ছেড়ে চলে আসে এই উত্তরে।

 সরকারি চাকরির বেশ খানিকটা অংশ এটা অধিকার করেছিল ।শিলং শহর জুড়ে এক সময় এই বাঙ্গালীদের আধিপত্য ছিল এবং এখনও শিলং এ প্রচুর সিলেটি হিন্দু বাস করে থাকেন ।অন্যান্য পার্বত্য অঞ্চল যেমন , গারো পাহাড় যা বর্তমানে মেঘালয় নামে পরিচিত , লুসাই পাহাড় যা বর্তমানে মিজোরাম নামে পরিচিত ও নাগা পাহাড় বা তুয়েনসাং যা বর্তমানে নাগাল্যান্ড নামে পরিচিত । সেই সমস্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বহু সিলেটি হিন্দু বাস করতেন।

 সুরমা উপত্যকার মানুষ এভাবে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় আসার ফলে এই দুই শ্রেণীর মধ্যে মতান্তরে সৃষ্টি হয়েছিল ।এদের সঙ্গে সব থেকে বড় বিষয় ছিল ভাষায় প্রভেদ। অসমীয়া ও বাংলা ভাষা মোটামুটি একই লিপিতে লিখিত হলেও উচ্চারণ ও শব্দ সম্ভারের অনেকটাই আলাদা । এই মন অন্তর অনেক পরে সাময়িকভাবে উগ্র রূপ ধারণ করেছিল । 

আসামের রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে অসমীয়া ভাষিদেরি প্রধান প্রাধান্য ছিল এবং এদের অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন লোকপ্রিয় গোপীনাথ বরদৈল। বাংলাভাষী সিলেট থেকে এক সময় বিপিনচন্দ্র পালের মতো নেতারা উঠে এসেছিলেন।
 পরবর্তীকালে বরদলৈ এর মাপের কোনো নেতা তৈরি হননি ।বাংলাভাষী নেতাদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন বসন্ত দাস, বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ । 

সিলেট আসামের অংশ,  আসাম হিন্দু প্রধান হবার দরুন তার পাকিস্তান যাবার কোন প্রশ্ন ওঠেনা । তাহলে হঠাৎ করে সিলেট অঞ্চলে গণভোট বা রেফারেন্ডাম হলো কেন?
 এর কু কৃতিত্ব টির হোতা হলেন মাউন্টব্যাটেন সাহেব। যদিও  মুসলিম লীগের চাপেই তিনি তা করতে বাধ্য হয়েছিলেন।বিলাতের পার্লামেন্টে আটলি যে ঘোষণাটি ৩ রা জুন ১৯৪৭ তারিখে করেছিলেন তার মধ্যে সিলেট এবং উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ভোট হবার ঘোষণা করা হয়েছিল । এই গণভোটের স্বপক্ষে মাউন্ট ব্যাটেনের যুক্তি ছিল আসাম  অমুসলিম প্রধান হলেও, সিলেট জেলা নাকি মুসলিম প্রধান এবং মুসলিম প্রধান পূর্ববঙ্গের সঙ্গে সংলগ্ন অতএব এখানে গণভোট হওয়া উচিত।

 সিলেটের জনবিন্যাসের মধ্যে শ্রীমঙ্গল ও অন্যান্য অঞ্চলে চা বাগিচায় প্রচুর কর্মরত শ্রমিক ছিল। সাধারন হিন্দুর সংখ্যা ছিল ৭৮ ৫০০৪ , অনুসূচিত জাতি ছিল ২৬৭৫১০ ,মুসলিম ছিল ১৮৯২১১৭, এবং চা শ্রমিক যারা বিভিন্ন ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এখানে এসেছিল তাদের সংখ্যা ছিল ১৪৪৪৭৬ অর্থাৎ মোট  অমুসলিমের সংখ্যা ছিল ১১৯৭৩৯০ মুসলিম জনসংখ্যার থেকে প্রায় ৭ লক্ষ কম । কিন্তু কোন ভোট প্রক্রিয়ায় চা শ্রমিকদের তখন সম্পুর্ন বাদ রাখা হয়েছিল । 

আজ পর্যন্ত সিলেটের হিন্দুদের অনেকের ধারণা এই কাণ্ড আসামের মুখ্যমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলৈএর । তাঁর চক্রান্ত  ছিল সিলেট যাতে পাকিস্তানে চলে যায়।  বাকি আসাম  অসমীয়া ভাষি প্রধান হয়ে থেকে যায়। কিন্তু চক্রান্তের কোন অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি। সিলেট গণভোট সম্পর্কে প্রামাণ্য রচনা খুব বেশি নেই ।তবে তার মধ্যে বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর বই একটি পাওয়া যায় , যাতে তিনি কিন্তু এই ধরনের কোন চক্রান্তের কথা লিখেন নি।


 শুধু মৌলানা আবুল কালাম আজাদ তার আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন , আসাম কংগ্রেসের কিছু নেতা ক্যাবিনেট মিশনের গ্রুপিং প্লান এর বিরোধিতা করার সময় এক অদ্ভুত বাঙালি আতঙ্কের পরিচয় দিয়েছিল ।

 এই লেখক এর পরিচিত আসামের গোয়ালপাড়া জেলার রামহরির চর নিবাসি ,অধুনা মার্কিন নাগরিক ,   দেবদাস ঘোষালের বয়ান অনুসারে ওই অঞ্চলে মুসলিমরা একটা ডান্ডার মাথায় রক্ত মাখা গরুর কর্তিত মুণ্ড নিয়ে মিছিল করত পাকিস্তান দাবির সমর্থনে । তাছাড়া যদি চক্রান্ত হয়েই থাকে তবে সে সময়কার আসাম সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাঙালি নেতা বসন্ত দাস কি করছিলেন ?তারা কেন এ নিয়ে হৈচৈ করেননি ?তাদের নিচেস্টতার প্রতিও অবশ্যই অঙ্গুলিনির্দেশ করতে হবে ।

বরঞ্চ ভি পি মেনন লেখার উপর নির্ভর করে বিদ্যুৎ চক্রবর্তী দেখিয়েছেন যে কংগ্রেস রেফারেন্ডাম কমিশনার স্টর্ক এর উপর চাপ সৃষ্টি করেছিল যাতে ভোটাধিকার দেওয়া হয়। কিন্তু স্টর্ক তাতে সম্মত হননি ।  বলেছিলেন,  এরা ফ্লোটিং পপুলেশন । 
গণভোটের আরেক সমস্যা ছিল বর্ষা । ভোট হয় জুলাইয়ের  ৬ – ৭ তারিখ। বর্ষায় সিলেট জেলা জলে ভাসে। এটা নিয়ে আসাম গভর্নর পর্যন্ত চিহ্নিত ছিলেন। কিন্তু যেহেতু ব্যাটন ১৫ আগস্ট স্বাধীনতার দিন ঘোষণা করে ফেলেছেন তাই কোনো উপায় ছিল না ।

বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর লেখা থেকে জানতে পারা যায় , এই গণভোটের মুসলিম লীগ যে পরিমাণ তৎপরতা দেখিয়েছিল,  যেভাবে মুসলিমরা নিজেদের দিকে জেতার জন্য প্রাণপন চেষ্টা চালিয়েছিল কংগ্রেসের তরফ থেকে সে ধরনের কোনো রকম কোনো উদ্যোগ দেখতে পাওয়া যায়নি। এর দায়িত্ব আসাম কংগ্রেসের অসমীয়া নেতাদের উপর যতটা বর্তায় , বসন্ত দাস বৈদ্যনাথ মুখার্জি প্রমুখ বাঙালি তাদের উপর ঠিক ততটাই বর্তায়।


 এমনকি প্রথম যাকে রেফারেন্ডাম কমিশনার হিসেবে ভাবা হয়েছিল সেই এইচ .সি. স্টক এ নিযুক্তি মুসলিম লীগের চাপে খারিজ করা হয় । এর কারন স্টক সাহেব প্রথম মহাযুদ্ধে তুরস্কের যুদ্ধ বন্দী হয়েছিলেন এবং প্রচন্ড অত্যাচারিত হয়েছিলেন । ফলে তিনি মুসলিমদের অপছন্দ করতেন । জিন্না  এর জন্য এম এ ইস্পাহানির নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করেন যারা গ্রামে গ্রামে ঘুরে সভা ও প্রচার করেছিল। সে তুলনায় কংগ্রেস বিশেষ কিছু করেনি।


  গনভোট শান্তিপূর্ণভাবে সম্পূর্ণ হয়নি। মুসলিম লীগের গুন্ডা শাখা মুসলিম ন্যাশনাল গার্ডের লোকেরা উত্তর ভারত থেকে সিলেট পৌঁছে গিয়েছিল এবং এত গুন্ডামি করেছিল যে স্থানীয় সব জাতির লোক  উক্তত বোধ করেছিল।  এরা প্রত্যেকে উর্দুভাষী ছিল।  স্থানীয় ভাষা বলতে পারতোনা। এদের আনার কারণ সম্ভবত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা সত্বেও লিগ জয় সম্পর্কে সন্দিহান ছিল ।
কারণ, ১. তখনো অনেক ভারতপন্থী মুসলমান ছিল।
২.  আব্দুল মতলিব মজুমদারের নেতৃত্বে একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ  মুসলিম সিলেটের ভারত ভুক্তিরপক্ষে ছিল।
৩.  শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় নিজে এসেছিলেন সিলেটে । জেলা চষে বেরিয়েছিলেন। তার প্রেরণায় সিলেটি হিন্দুরা দিল্লি বা বার্মা থেকে বিমানযোগে সিলেটে এসে গিয়েছিলেন ভোট দিতে।
কিন্তু  শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর মত মহান মানুষ যেমন ছিলেন হিন্দুদের মধ্যেও বেইমানি করার লোকের অভাব ছিল না ।

শেখ মুজিবের অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে দেখতে পাই , যে তারা সিলেটের গণভোট জেতবার জন্য কি কি পদক্ষেপ নিয়েছিল??? তার একটি তথ্য উল্লেখযোগ্য- যেখানে শেখ মুজিব নিজে লিখেছেন , “শহীদ সাহেবের অনুরোধে দানবীর রায়বাহাদুর রণদাপ্রসাদ সাহা বেশ  হিন্দু হয়েও কয়েকখানা লঞ্চ সিলেটে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ।এই লঞ্চগুলো ব্যবহার করা হয়েছিল মুসলিম লীগের কর্মী এবং পাকিস্তানের পক্ষে। শহীদ সাহেবের বন্ধু ছিলেন এই রায় বাহাদুর। তার কথা তিনি ফেলতে পারেননি শেষ।”
শেষ পর্যন্ত ভোটের ফল বের হলে দেখা গেল সিলেট পাকিস্থানে যাচ্ছে। পাকিস্তানের পক্ষে ভোট পড়েছিল ২৩৯৬১৯  টি, ভারতের পক্ষে ভোট পড়েছিল ১৮৪০৪১। স্পষ্টতই বেশ কিছু মুসলিম ভোট ভারতের পক্ষে পড়েছিল এবং আব্দুল মজুমদারের যে সমস্ত সাপোর্টার ছিল তারাই এই ভোটগুলো দিয়েছিল । এর সঙ্গে যদি চা শ্রমিকদের ভোট যোগ হত তাহলে ফল ঘুরে যেত । 


জেলার চারটি থানা – রাতাবাড়ি ,পাথর কান্ডি , বদরপুর , করিমগঞ্জ থানার এক অংশ ভারতে রইল ।শ্রীমঙ্গল এবং বড়লেখা হিন্দু প্রধান ও ভারত সংলগ্ন হওয়া সত্বেও পাকিস্তানকে দেওয়া হলো ।
দেশের ভাগ এর ফলে দেশের উত্তর পূর্ব অঞ্চল , সাবেক আসাম , নেফা এবং ত্রিপুরা কার্যত বাকি ভারত থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল । এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য আসাম বলতে তখন আসাম, মেঘালয় , নাগাল্যান্ড, মিজোরামকে একত্রে বলা হত।  নেফার বর্তমান নাম অরুণাচল প্রদেশ। এই যুক্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম যাতে মাত্র ৩ শতাংশ মুসলিম ছিল তা পাকিস্তানকে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল কারণ বলা হয়েছিল পার্বত্য চট্টগ্রামে মুসলিমের সংখ্যা নগণ্য হলেও চট্টগ্রাম এর মধ্য দিয়ে ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম যাবার উপায় নেই।
সিলেট পাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত হওয়ার পরও সমস্যা কমল না। ১৯৪৮ , ১৯৫৪ এবং ১৯৫৫ সালে বিশাল দাঙ্গা হল। ফলে স্বাধীনতার পর থেকেই জনবিন্যাসের ভারসাম্য নষ্ট হওয়া ও অভিবাসী বিতাড়ন ইস্যু আসামের রাজনীতির মূলভিত্তি হয়ে উঠল।সেই যে ইংরেজ আমল থেকে যে মুসলিমদের আসামমুখী হওয়ার ঘটনা তা কিন্তু কোনদিনই আর বন্ধহল না। দেশভাগের পর অবৈধ অনুপ্রবেশ হয়ে দাঁড়ালো। ১৯৫০ সাল থেকেই এই অনুপ্রবেশের ঘটনা ও অভিযোগ ওঠে আসছে।


ফলত কেন্দ্র সরকারের সম্মতিক্রমে তখন থেকেই এই অনুপ্রবেশ রোধের উদ্দেশ্যে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হতে থাকে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল  ১৯৫০ সালের অভিবাসী আইন। ১৯৫০ সালের ১ মার্চ কার্যকরী হওয়া এই আইনে অসম থেকে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশকারীদের বহিষ্কারের কথা বলা হয়। অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করনের নিমিত্ত ১৯৫১ সালে জনগণনার তত্ত্বের ভিত্তিতে স্বরাষ্ট্র দপ্তরের তত্ত্বাবধানে এনআরসি বা ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেন কাজ শুরু করা হয়।কিন্তু বিদেশি চিহ্নিত করযে গিয়ে কিছু তৈরি হওয়া যায়নি জটিলতার নিমিত্ত এই কাজ এগোয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হল না। ১৯৬১ সালের জনগণনায় একটি রেজিস্টার জেনারেল একটি রিপোর্ট বানান। তাতে উল্লিখিত হয় যে আসামে ২২০৬৯১ জন অনুপ্রবেশকারী আছে।১৯৬৫ সালে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার মিলে আসামে দ্রুত এনআরসি সম্পুর্ন করে প্রত্যেক নাগরিককে একটি করে ন্যাশনাল আইডি কার্ড ইস্যু করার সিদ্ধান্ত নেন। ব্যবহারিক দিক থেকে এই বিষয়টি উপযুক্ততা নেই দেখে প্রস্তাব পরিত্যক্ত হয়। 

দেশভাগের সময় আসামের মুসলিমদের একটি বৃহৎ অংশ পাকিস্তানে ছিল গিয়েছিল। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হল এই যে ১৯৫০ সালের নেহেরু লিয়াকত চুক্তির পর তাদের অনেকেই ভারতেই ফিরে আসে। কংগ্রেস নেতা গোপীনাথ বরদৈল চিতার আগুনে রুটি সেঁকতে শুরু করেন। এনার রাজনৈতিক প্রয়োজনা বাঙ্গালী হিন্দুদের তুলনায় বাংলাভাষী মুসলিমরা অনেক বেশি উপযোগী ছিল। কারন বাঙ্গালী হিন্দুরা নিজ সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত পরিচিত অটুট রেখে অসমিয়াদের সঙ্গে সাবস্থানে বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু ….কিন্তু বাংলাভাষী মুসলিমরা নিজেদের ভূমিপুত্র হিসাবে তুলে ধরতে অসমিয়া হিসাবে পরিচয় দিতে এক পা এগিয়ে থাকতেন। একটা সময় নেহেরু নিজেও গোপীনাথের এইধরনের ভাবনাকে সংকীর্ণ মানসিকতা বলে সমালোচনা করেন।  এই সময় অম্বিকা গিরি রায়চৌধুরী ও অসম জাতীয় মহাসভার উদ্যোগে বাংলাভাষী মুসলিমরা নিজেদের অসমিয়া বলে পরিচয়  লিপিবদ্ধ করাতে থাকেন। 


ফলে ১৯৫১ সালের জনগণনায় অসমিয়াদের সংখ্যা বেড়ে যায়।স্বভাবিক ভাবেই ক্ষমতা দখলের রাজনীতিতে অসমিয়া সেন্টিমেন্টের সাথে সামঞ্জস্য রেখে মুসলিম ভোট ব্যাংক, কংগ্রেস সহ বিভিন্ন আঞ্চলিক দল গুলির নিকট একটি বৃহৎ সম্পদ হয়ে ওঠে। কোনো ভাবে সীমান্ত টপকে অপেক্ষাকৃত উন্নত ভারতে আসলেই রেশন কার্ড,  ভোটার কার্ড পেয়ে গিয়ে এই অমূল্য সম্পদ হয়ে ওঠার লোভনীয় সুযোগ পূর্ব পাকিস্তান বা বর্তমান বাংলাদেশের দরিদ্র বাংলাভাষী মুসলিমদের নিকট সোনার ডিম পাড়া হাঁসের মত লোভনীয় হয়ে ওঠে।
২০১২ সালের ২০ অক্টোবর আসাম সরকার একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করেন ….
“Following partition and communal riots in the subcontinent , Assam initially saw an influx of refugees and other migrants from East Pakistan. The Number of such migrants other than refugees was initially reported by the state government to be between 150000 and 200000 but later estimated to be around 500000.”

#একটিইতিহাসজাতীয়নাগরিকপঞ্জি #ক্রমশ

তথ্যঃ জাতীয় নাগরিক পঞ্জি : সাধন কুমার পাল


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.