#পর্ব_ পাচ : নুন ও আলুন
তরকারিতে দরকারি খুব নুন
গাইয়ে এলাম তাই আজিকে
নুনের গুনাগুন ।
পান্তা ভাতে নুন না হলে
রুচে না তা মুখে
মরিচ-লবন মিশিয়ে নিলে
বাদাম খাওয়া সুখে ।
আমড়া যদি নুন ছাড়া খাই
কিংবা করমচা
লাগবে জানি খেতে যেমন
চিনি ছাড়া চা ।
ভুলেই গেছি বলতে তোমায়
আসল কথাটাই
নুনে থাকা আয়োডিন যে
অসুখ সারায় ভাই।
নুনের তো সত্যি অনেক অনেক গুন। নুন ছাড়া তো এককথায় মানব জীবন অচল। তো এ হেন নুনের উৎপত্তি তো সমুদ্রের জল। তাছাড়া আছে পাহাড়ি গুহার মধ্যে প্রাপ্ত রক স্লট। নুনের জন্য কত কি….নুনের জন্য যুদ্ধ ,হত্যা , নুনের জন্য রূপকথা। নুনের জন্য শুরু একটি সমাজে বাণিজ্য।আদি জনগোষ্ঠীর মধ্যে একটি উপবিভাগ নাম বোরি। সেই যে বোরি দের কথা প্রথম পর্বে বলেছিলাম। সেই যাঁরা সিয়াঙ জেলার উত্তর-পশ্চিমের দুর্গম অঞ্চলে বারোটি গ্রামে বাস করেন । সেই যে, পশম ও কার্পাস তন্তু দিয়ে বস্ত্রবয়নে তাঁরা ছিলেন দক্ষ। শিকার ও মাছ ধরা আদি জীবিকা। এছাড়াও মিনইয়ঙ , গালঙ ও পশ্চিমের অন্যান্য গোষ্ঠীর মধ্যে বাণিজ্যিক আদান প্রদানের মধ্যস্থতা করতেন। সেই বোরি গোষ্ঠীর মধ্যে নুন নিয়ে আছে রূপকথার প্রচলন। সেই রকম দুইটি রূপকথা বা লোককথা আজ বলব, যা ভেরিয়ার এলউইন সংগ্রহ করে ছিলেন আদি সমাজ হতে….
প্রথম লোককথা :
সে অনেক অনেক দিন আগের কথা । দুই ভাই ছিল টানি আর টারো। দুজনের মধ্যে খুব খুব ঝগড়া হয়েছিল।ফলে, টারো তাঁর গ্রাম ছেড়ে মিমেটের দিকে পাড়ি দিল। মিমেট তিব্বতকে বলা হত। বড় বড় জলা , জঙ্গল দিয়ে যেতে যেতে, বড় বড় তুষার পর্বতের উপরে ঘুরতে ঘুরতে টারোর একদিন এক সাদা চামড়ার মেয়ের সঙ্গে দেখা হল। সেই মেয়ের মাথায় লম্বা চুল মাটি ছুঁয়েছে।নাকটা খুব টিকালো। দাঁত গুলোও বড় বড় ধারালো। কিন্তু তাও টারো তাকে বিবাহ করল। তাদের একটি সন্তানও হল। কিন্তু তারপর একটি টারোর স্ত্রী মারা গেল। টারো স্ত্রীর মৃতদেহ নিয়ে বরফ পাহাড়ের জঙ্গলের মধ্যে নিয়ে গিয়ে কবর দিয়ে দিল।
এই দিকে টারো চলে যাবার পর টানি তার ভাইয়ের বড় অভাব বোধ করল। সে ঠিক করল যে সে তার ভাইকে খুঁজতে বেরবে। একদিন সে বেরিয়েও পড়ল ও তিব্বতের পথ ধরল। পথে যেতে যেতে সেই স্থানে সে এসে পৌঁছাল যেখানে টারো তার স্ত্রীকে কবর দিয়েছিল। সে ক্লান্ত ছিল। সে তৃষ্ণার্ত ছিল। ধু ধু বরফ পাহাড়। কিন্তু খাবার মত যোগ্য জল নেই। কাছে পাত্রও নেই যাতে সে বরফ ভরে গরম করে নেবে। খুঁজতে খুঁজতে সে হঠাৎ সেই যে কবর সেখানে একটা ছোট ফোয়ারা দেখতে পেল।সেই ফোয়ারার জল সে আঁজলা ভরে খেল। অদ্ভুত স্বাদ সেই জলের।সে দেখল সেই ফোয়ারার জলের চারপাশে সাদা সাদা গুঁড়ো স্তুপ হয়ে পড়েছিল।সে সেখানে সেই গুঁড়োর স্বাদ নিল। নোনতা স্বাদ। বেশ ভালো লাগল তার। সে তখন তার ভাইয়ের কথা ভুলে গিয়ে বোঝা ভরে সেই সাদা গুঁড়ো নিয়ে ফিরে এলে নিজের গাঁয়ে। টারোর বংশধররা এখনো তিব্বতে থাকে। তাই তিব্বতের মানুষদের কাছে নুন পাওয়া যায়।
দ্বিতীয় লোককথা :
বহু বহু দিন আগের কথা। বোরিরা নুন পেত না। বর্ষাকালে যখন সিকে নদীতে বান ডাকত, তখন সেই বানের জলে উপর থেকে কাঠের কাটা টুকরো ভেসে আসত। তাহলে নিশ্চয় কোনো মানুষ সেই কাঠ কেটেছে। তাই তাদের দৃঢ় বিশ্বাস হল যে উপরের দিকে উত্তরে নিশ্চয় মানুষের বাস আছে। কারা তারা? সেই অজানা মানুষের খোঁজে বোরিরা কয়েকজন নদীর উজান বেয়ে পাহাড় পেরিয়ে উত্তরে যেতে লাগল। যেতে যেতে তারা একদিন মিমেট বা তিব্বত পৌঁছল। এখন যেমন মিঠুনদের অল্প অল্প নুন খাওয়ানো হয়, তিব্বতের মানুষরা তেমন বোরিদের অল্প নুন দিল স্বাদ নেবার জন্য। তারপর তারা দেখাল পশমের তন্তু, তাদের ব্যবহৃত নৌকা আর জামা। বোরিরা কিছু নুন নিয়ে গাঁয়ে ফিরে এলে। কেবাঙ বা যৌথ সভা ডাকা হল। গাঁয়ের আবালবৃদ্ধবনিতা সেই নুন খেয়ে দেখল। সবার ভালো লাগল। তখন তো নুন খাওয়া শুরু করল। কিন্তু গাঁয়ের এত লোক। তারা সবাই নুন পেতে যদি চায় তাহলে তো নুনের যোগান রাখতে হবে। সুতরাং তারা বাঁশের কঞ্চি , ঔষধি লতাপাতা সংগ্রহ করে মিমেট নিয়ে গেল ও তার বদলে নুন আমদানি করল। পরের বার তারা মিমেট যাবার সময় সঙ্গে নিয়ে গেল পশুর চামড়া। তার বিনিময় পেল পশমের লম্বা জামা। তারপর থেকে তারা পশুর চামড়া ও ধান নিয়ে যেত মিমেটে। তখন তিন বোঝা ধানের বদলে এক বোঝা নুন পাওয়া যেত। এভাবেই বাণিজ্যিক সম্পর্ক সূচিত হল।
মিমেট থেকে পাওয়া বস্তু নিয়ে বোরিরা রিগা এবং কেরাঙ গ্রামের মিনইয়ঙদের নিকটেও যেত। মিনইয়ঙরা নুন পেতে এতই আগ্রহী ছিল যে তারা নুনের দাম হিসাবে তারা মিঠুনও দিয়ে দিত।
একবার গাসেঙ ও পায়ুঙ এর লোকেরা যখন বিপুল পরিমাণ বস্তু নিয়ে গেল মিমেটে বাণিজ্যের জন্য তখন মিমেটের লোক তাদের হত্যা করে সব চুরি করে নিল।বোরিরাও যোদ্ধা গোষ্ঠী। তাঁরা প্রতিশোধ নেবার জন্য সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে গেল মিমেট। মিমেটের লোকেরা তখন তাদের কাজের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করল ও দুপক্ষের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ক্রমবর্ধমান রাখা জন্য অনুরোধ করল। তারা তাদের বিনিময় হার স্বীকার করল। সেই বিনিময় হারে তারা দুই বোঝা ধানের ব্দলেনেক বোঝা নুন দিতে রাজি হল। এই বিনিময় হারই এখনো প্রচলিত আছে।
পরে বোরিরা জানতে পারল যে পাসিঘাটে ও নুন পাওয়া যায়। তারা নুন আনতে গেল পাসিঘাটে। কিন্তু সমতলে পাওয়া নুনের স্বাদ তাদের ভালো লাগল না। মিমেটের নুনের স্বাদই তারা সব থেকে ভালো বলে মনে করে।তবে ধীরে ধীরে পাসিঘাটের নুনের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেল। তবে আজ বোরিরা তাদের নুনের অধিকাংশ আলঙ থেকে , কখনো মিনইয়ঙ মধ্যবর্তীদের নিকট থেকে।
এই যে দুইটি লোককথা বললাম, এর থেকে কি ধারণা হয়? বোরি সম্প্রদায়ের পরম্পরাগত বাসস্থান ছিল সিয়াঙ জেলার উত্তর প্রান্ত বরাবর। এই উত্তর প্রান্ত তিব্বত বা মিমেট সংলগ্ন। ফলত, আদি জনজাতিদের মধ্যে বোরিদের সঙ্গেই সম্ভবত তিব্বতিদের আদানপ্রদান প্রথম নিয়মিত চেহারা নেয়। তিব্বতীয়দের নিকট হতে নুন পায় ও নুনের ব্যবহার শেখে। আশা করা যায় সেটা কোনো সামুদ্রিক নুন নয়। পাহাড়ের পাথরেরখাঁজে জমে থাকা নুন।
প্রথম লোককথা টিতে দেখা যায় বোরিদের নুন প্রাপ্তির সঙ্গে তাদের সুদূর পূর্ব পুরুষ টারোর বহির জাতিভুক্ত স্ত্রীর দেহাশ্মের সম্পর্ক তৈরি করেছেন। কেবল তাই নয় নুনের তাদের বংশগত অধিকার সে কথা উল্লেখ করেছেন। এখন প্রশ্ন হল এই সম্পর্ক তৈরির কারন কি? নেহাতি তিব্বতীয় অঞ্চলের একটি বস্তু না হয়ে নুনকে নিজেদের পূর্বপুরুষের সঙ্গে কোনো এক ভাবে সম্বন্ধীয় হতে হবে কেন ? যেকোন প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার কি তাহলে পূর্ব পুরুষ দ্বারা স্থাপিত ও নির্ধারিত? টারোর স্ত্রী এমন কেন দেখতে? নিজ গোষ্ঠীর বাহিরে বিবাহ, তাই তাকে অস্বাভাবিক বলে দেখানো হয়েছে?
দ্বিতীয় যে লোককথা বলেছি সেখানে কিন্তু রূপকথার থেকে ইতিহাসের ছোঁয়া অধিক পাওয়া যায়। কীভাবে বোরি ও তিব্বতীয়দের মধ্যে প্রথম বিনিময় হল? কি কি বিনিময় হল? বিনিময় হার কি ছিল? কিভাবে তিব্বতীয়দের নিকট হতে আমদানিকৃত নুন অন্যান্য আদি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বিনিময় মাধ্যম হয়ে উঠল? ইত্যাদি ইতিহাসের একটি আদল পাওয়া যায়। আরো উল্লেখ্য পাসিঘাটের প্রসঙ্গটি।পাসিঘাট হল সিয়াঙ বা সিয়াং দক্ষিণ পূর্ব আসাম সংলগ্ন একটি স্থান , এখানে তাই বিনিময় অসমের জনজাতির সঙ্গে হত।ফলত, নুনকে কেন্দ্র করেই তিব্বতীয়দের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক সূচিত হবার বহু বহু বছর বাদে আসামের পাসিঘাট অঞ্চলের জনজাতির সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক সূচিত হয়।
দক্ষিণে আসামের বাসিন্দাদের সঙ্গে এই বিনিময়ে বোরিরা মূল অংশ নিতেন না, নিতেন মিনইয়ঙরা। মিনইয়ঙদের নিকট হতে উত্তর আসামের মানুষ আবার নুন ও অন্য বস্তু পেতেন। ক্রমশ উত্তর সীমান্তে বিনিময়ের তুলনায় দক্ষিণ সীমান্তে বিনিময়ের গুরুত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে। এইভাবেই নুন বাণিজ্যিক , পারস্পরিক বিনিময় ও নির্ভরতার মূল কারণ হয়ে উঠেছিল।
নুনের জন্য জাতি বদলে ছিল…..
নুনের মতো ভালবাসাও
খুব যে আমার প্রিয়
সব কিছুর উপরে তাই
নুনকে স্থান দিও।
#ক্রমশঃ
#দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ তামাঙ , ডয়া, আদি, আপাতনি জনজাতি কথা