#পর্ব_৪ : ঝুমের কতকথা
এইবার হাজার স্নেহের চারা রোপণ
ঝুম বৃষ্টিতে মাটির সাথে ঘাসের সঙ্গম-আঁকড়ে থাকা
মায়া-মমতার শেকড় ঢোকে ভেতর-ভেতরে, গভীর-গভীরে
গহন-মাটির শরীর-চোষা আদর আর সূর্য-ঢালা রোদ সোহাগে-
কচি গাছ গুলো বড় হয় আনন্দ-উচ্ছ্বাসে
বুননে বুননে মেতে ওঠে ভালবাসার স্বপ্ন-কানন
ফুলে ফলে সবুজ পাতায় আকাশ ছোঁয়া তরু ছায়ায়
স্বপ্নচাষী গল্প শোনায় গানে,সুরে কবিতায়
বাতাস হাসে, রোদ হাসে, ছায়াও হাসে
সুখের চোটে আকাশ হাসে বৃষ্টি ঝরায় অঝোর ধারায়
আমি হাসি শিহরণে নরম কোমল ছোঁয়ায়
ঝুম চাষ” এক ধরনের স্থানান্তরিত কৃষিপদ্ধতি। এটি মূলত: জঙ্গল কেটে পুড়িয়ে চাষ করা হয়, আবার সেই স্থানে জমির উর্বরতা কমে গেলে পূর্বের স্থান হতে কৃষি জমি স্থানান্তরিত করে অন্যত্র আবার কৃষি জমি গড়ে ওঠে। পাহাড়ের গায়ে ঢালু এলাকায় এই চাষ করা হয়। এই পদ্ধতির চাষে বছরের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ফসল উৎপাদন করা সম্ভব হয়। জুম চাষ পার্বত্য অঞ্চলের ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীদের জীবন জীবিকার প্রধান অবলম্বন। বর্তমানে প্রতি বছর প্রায় ২০০০০ হেক্টর ভূমি এ পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা হয়।
“ঝুম চাষ” ভারতে পোড়ু, বীরা, পোনম, প্রভৃতি নামেও পরিচিত। সুতরাং অরুনাচল প্রদেশের পার্বত্য অঞ্চল ও উপত্যকা অঞ্চল তার ব্যতিক্রম হবে না এটাই স্বাভাবিক।
প্রতি বছর কোন কোন জমিতে ঝুম চাষ করা হবে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় কেবাঙ- এর মাধ্যমে। কেবাঙ-এর সিদ্ধান্ত হবার পরে গাঁয়ের ঘোষকরা রাতে ঘুরে ঘুরে সারা গ্রামে তা জানিয়ে দেন । পর দিবসে সেই নির্দিষ্ট জমিতে গোটা গ্রামের মানুষ সমবেত হয়ে চাষের প্রক্রিয়া শুরু করেন। ঝুম চাষের প্রক্রিয়া গ্রামের মানুষের যৌথশ্রমের প্রক্রিয়া , তা কোন ব্যক্তি, ব্যক্তিগোষ্ঠী বা পরিবারের পৃথক উদ্যোগে ওয়া সম্ভব নয় ।
আদি জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন ছোট ছোট উপগোষ্ঠীর মধ্যে ঝুম চাষ সংক্রান্ত রীতিনীতি, প্রক্রিয়া ও উৎপাদনশীলতার কিছু কিছু পার্থক্য আছে। তবু সে সম্পর্কে একটা ধারনা তৈরি করার জন্য আদিদের সবচেয়ে বড় উপগোষ্ঠী মিনইয়ঙদের অনুসৃত ব্যবস্থা কিরকম তা নিয়ে একটু আলোচনা করি ….
জুম বা ঝুম চাষের জন্য ব্যবহৃত জমিকে পাটাট বা রিক্টাট বলা হয় । একেকটি পাটাট ব রিক্টাট র তিন বছর চাষ করার পর , বেশ কিছু বছরের জন্য অকর্ষিত অবস্থায় ফেলে রাখা হয়। সেই অনাবাদিত ঝুম চাষের জমির উপর বন জঙ্গল গজিয়ে যায় । তারপর গ্রামের শামান ও গ্রামপ্রধানদের হিসাব অনুযায়ী চাষ চক্রের সময় বা রিক্টাট পাসুপ পূর্ন হলে , পুনরায় সেই রিক্টাট পরিষ্কার করে আবার চাষ করা হয় । কোন রিক্টাটে প্রথম বছরের চাষকে বলে রিকপা এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় বছরের চাষকে রিগাঙ বলে।
কোনো রিক্টাটে তৃতীয় বছরের চাষ অর্থাৎ দ্বিতীয় রিগাঙ চলার বছরই অন্য একটি রিক্টাটে প্রথম বছরের চাষ বা রিকপা চালু করা হয় । এক একটি গ্রামে এমন ধারা একাধিক রিক্টাট থাকে। যেমন – বগিঙ গ্রামে ছয়টি রিক্টাট আছে। রিউ গ্রামে আছে দশটি রিক্টাট। এই এসব ঝুম রিক্টাটে কোন রাসায়নিক বা বাইরে থেকে সার ব্যবহার করা হয় না ।।প্রাকৃতিক উপায়ে জমির উর্বরতা আবার ফিরে আসতে দেওয়ার জন্যই এই চাষ পদ্ধতি।
সেই অনেক আগে , প্রাচীন কালে গাঁয়ের প্রতিটি মানুষের মুখস্থ থাকত গ্রামের কোন রিক্টাট কোন অবস্থায় রয়েছে । রিক্টাট পাসুপের সময় কাল মানুষের বয়সের হিসাবের একক হিসাবে ব্যবহৃত হত। একটি রিক্টাট পাসুপ পার করেছেন যে মানুষ সেই মানুষটাকে প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে ধরা হতো । তিনটে রিক্টাট পাসুপ পার করলে সে বৃদ্ধাবস্থা এবং খুব কম মানুষই পাঁচটা রিক্টাট পার করতে পারত । এখনো পাহাড় পর্বতের গ্রামের বয়স্করা এই ভাবে হিসাব রাখেন ।
রিক্টাট পাসুপের সময়কাল সব গ্রামে এক রকম নয়। জমির উর্বরতা, গ্রামের জনসংখ্যা, হাতে থাকা রিক্টাটের সংখ্যা এসবের উপর নির্ভর করে রিক্টাট পাসুপের দৈর্ঘ্য বদলে যায়। রিউ গ্রামে যেমন এখন রিক্টাট পাসুপের দৈর্ঘ্য ২১ বছর, কোমসিঙ গ্রামে ২৫ বছর, বেগিঙ গ্রামে ১৩ বছর।
প্রকৃতির চক্রের সঙ্গে বাঁধা আদিম জীবন। সেই তালে চলে মিনইয়ঙরাও ….
তাই তো গীতায় বলা হয়েছে :
- অপরেয়মিতস্ত্বন্যাং প্রকৃতিং বিদ্ধি মে পরাম্ ।
জীবভূতাং মহাবাহো যয়েদং ধার্যতে জগৎ ॥ - হে মহাবাহো ! এই নিকৃষ্টা প্রকৃতি ব্যতীত আমার আর একটি উৎকৃষ্টা প্রকৃতি রয়েছে। সেই প্রকৃতি চৈতন্য-স্বরূপা ও জীবভূতা; সেই শক্তি থেকে সমস্ত জীব নিঃসৃত হয়ে এই জড় জগৎকে ধারণ করে আছে।
সেই ছন্দের মিনইয়ংদের জীবন চিত্র নিম্ন ভাবেই ছন্দিত হয় । তাদের তৈরী আদিম পঞ্জিকা অনুসারে চলে কৃষিকাজ। অদ্ভুত সেসব মাসের নাম । সে এক এক ঋতুর কেমন সব নাম , ঋতু অনুযায়ী চলে ঝুমের চাষ।
ভাঁটা – পড়া বেলায়,
ঘাসের উপরে ছড়িয়ে – পড়া বিকেলের আলোতে
গাছেদের নিস্তব্ধ খুশি,
মজ্জার মধ্যে লুকোনো খুশি,
পাতায় পাতায় ছড়ানো খুশি।
আমার প্রাণ নিজেকে বাতাসে মেলে দিয়ে
নিচ্ছে বিশ্বপ্রাণের স্পর্শরস
চেতনার মধ্যে দিয়ে ছেঁকে।
সে ঋতুর নাম ডঙগুপ। আদিদের আদিম পঞ্জিকায় তিনটি মাসের মিলনে হয় ডঙগুপ ঋতু। কেমন যেন শীত ও বসন্তের মিশ্রনে সেই ঋতু। এই ঋতুতে জিনমুর বা জানুয়ারি মাসে তাঁরা জোয়ার ফসলের শস্যসংগ্রহের কাজ শেষ করা , পুঁতি হিসাবে ব্যবহৃত ঘাসের বিচি সংগ্রহ করা, ঘর তৈরি বা সারাইয়ের রসদ সংগ্রহের কাজ শেষ করা এসব করেন। কোমবোঙ বা ফেব্রুয়ারি মাসে করেন ধান চাষের প্রস্তুতি। আর গালিঙ বা মার্চ মাসে পরবর্তী পাটাট তৈরির কাজ , ঘর তৈরির কাজ বা সারাইয়ের কাজ শেষ করা ইত্যাদি করেন। এই সময় এই মিনইয়ঙ গোষ্ঠী মেতে ওঠেন উনয়িঙ ও মোনপু উৎসব পালন করেন।
এর পর আসে লোবো ঋতু। বলতে পারেন গ্রীষ্ম কাল। এই ঋতুতে লুকিঙ বা এপ্রিল মাসে আদি সমাজের মানুষরা করেন রিকপার কাজ। লোবো বা মে মাসে দ্বিতীয় রিগাঙ হয়ে যাওয়া জমিকে অকর্ষিত অবস্থায় ফেলে রেখে পুনরায় জমি প্রস্তুত করা। ধান বোনা , বেড়া দেওয়া…এসব কাজ করেন। য়িলো বা জুন মাসে পুঁতি দেয় যে ঘাস সেই ঘাসের চাষ করেন আদি গোষ্ঠীর মানুষ। এছাড়াও জোয়ার বোনেন।পালন করেন ইটর উৎসব।
এরপর আসে গাদি ঋতু। বর্ষার ঋতু এটি। বর্ষায় জমির আগাছা বাড়ে।।টান্নো বা জুলাই মাসে জমির আগাছা সাফ, ফসল পরিচর্যা , সোলুঙ উৎসব পালন ও ভুট্টা ফসল সংগ্রহের কাজ হয়। য়িও বা আগস্ট মাসে দ্বিতীয়বার জমির আগাছা সাফ করা হয়। য়িতে বা সেপ্টেম্বর মাসে হয় নরম মাটিতে সবজি উৎপাদনের জন্য জুম চাষ। জোয়ার ফসল সংগ্রহ করা হয়।
তারপর আসে শরৎ হেমন্ত ও শীত….আদি সমাজে একত্রে তাঁরা ঋতু হয়ে নাম নেন ডিগিন। এই ঋতুর শুরু হয় আও বা অক্টোবর মাসে দিয়ে। ধান কাটা শুরু হয়। আর জন্য আগামী শৈত্য প্রবাহের জন্য সংগ্রহ হয় জ্বালানি কাঠ। আনে বা নভেম্বর মাসে ধান কাটার পালা সাঙ্গ হয়। আসে শীতল মাস বেসটিঙ বা ডিসেম্বর। জোয়ার ফসলের শস্য সংগ্রহের কাজ হয়। পুঁতি হিসাবে ব্যবহৃত ঘাসের বীজ সংগ্রহের কাজ শুরু হয়।
নাই রস নাই, দারুণ দাহনবেলা।
খেলো খেলো তব নীরব ভৈরব খেলা॥
যদি ঝ’রে পড়ে পড়ুক পাতা, ম্লান হয়ে যাক মালা গাঁথা,
থাক্ জনহীন পথে পথে মরীচিকাজাল ফেলা॥
শুষ্ক ধুলায় খসে-পড়া ফুলদলে ঘূর্ণী-আঁচল উড়াও আকাশতলে।
প্রাণ যদি কর মরুসম তবে তাই হোক– হে নির্মম,
তুমি একা আর আমি একা, কঠোর মিলনমেলা॥
ঝুম বা জুম চাষের ফসলের পাশাপাশি জঙ্গল থেকে সংগ্রহ করা খাদ্য, শিকার, গৃহপালিত মিঠুনের মাংস – এই সমস্ত দিয়ে আদিরা খাদ্যে প্রায় স্বনির্ভর ।কেবলমাত্র তাঁদের নুনের জন্য পরের উপর নির্ভর করতে হয় প্রথম থেকেই। তার মধ্যে বাণিজ্যিক আদান প্রদান শুরু হয় । এই নুন ও বাণিজ্য নিয়ে আদি সমাজের খাদ্যের দানায় দানায় ঘোরে কত শত রূপকথা আর লোককথার গল্প। কেমন যেন সব মন কেমন করা গল্প সেসব….নুনের জন্য তৃষ্ণা…
#ক্রমশঃ
#দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ তামাঙ , ডয়া, আদি, আপাতনি জনজাতি কথা