#পর্ব_৩ : রূপকথা ও সমাজের কৌম
পাহাড়কে ডেকে মেঘ বলল,
তুই কি আজ বৃষ্টি নিবি ?
অালতো স্পর্শে গা ভিজাবি ?
ভালবেসে বৃষ্টি দেবো, তোর গহীনে জল ছিঁটাবো,
শান্ত কোলে ঘুম পাড়াবো।
বৃষ্টি নিবি?
না মেঘ,
বৃষ্টি আমার চাই না আজ,
দেখ না আমার বহুরূপী সাঁজ
কত রঙ্গের নিয়ম মেনে,
বড্ড ক্ষরায় পড়ছি ঋণে।
তুই বরং আজ অশ্রুঝরা, আমি একটু কাঁদি।
সেই পাহাড় ঘিরে সরু রুপালি চেনের মত বয়ে চলে নদী। সেই পাহাড় ঘিরে আছে সবুজ ভেলভেটের মত অরণ্য। সেই অরণ্যের মধ্যে আছে কত নাম না জানা প্রাণী। আর সেই সূর্য উদয়ের পাহাড়ে আছে মেঘ পিয়ন তার ব্যাগের ভিতরে করে কত পাহাড়ি উপজাতির ইতিহাস , উপকথা, লোককথা নিয়ে ঘোরে। যদি কেউ শুনতে চায় তাহলে তাহলে সে ব্যাগ উপুড় করে দেয়। সেখান থেকে সে সব কথা কুয়াশা হয়ে পাহাড়, জঙ্গল, নদী,উপত্যকা ছড়িয়ে যায়। সে সব লোক গাঁথা কেমন যেন মন কেমন করা…. ওই যাকে বলে Melancholic ।
সেই যে আগের পর্বে আদি জনগোষ্ঠীর যে সব উপবিভাগের কথা বলেছিলাম সে সব বিভাগ কেমন করে হল ? বসবাস এলাকার সঙ্গে আদি জনগোষ্ঠীর কি সম্পর্ক? এসব নিয়ে কুয়াশার মধ্যে ঠান্ডা হাওয়া ফিস ফিস করে বলে যায় এক লোককথা….
প্রসঙ্গত লোককথাটি গামেঙ গ্রামের বোরিদের নিকট হতে ভেরিয়ার এলউইন সংগ্রহ করেছিলেন ১৯৫৪ থেকে ১৯৫৭ সালের মধ্যে Myths of the North East Frontier of India গ্রন্থে সংকলিত করেছিলেন….
সে অনেক অনেক দিন আগের কথা, সেই বরফচূড়া পর্বতে গেলিঙ এর ওপারে থাকত পাঁচ ভাই- ইয়াইয়িং, নিজো, ইয়েবু, নিতান, নিগাঙ। এই পাঁচ ভাই গেলিঙ-এর ওপার থেকে একদা টুটিঙ চলে আসে এবং তারা সেখানে থিতু হয়ে বসবাস শুরু করবে বলে ঠিক করে । কিন্তু হায়, বসবাস করবে বললেই তো হল না ….পাহাড়ি এলাকায় সব উপজাতির জায়গা বাঁধা। সেখানে অন্য কারুর ঢোকার অধিকার নেই। ফলে মেম্বা উপজাতির মানুষ ওই পাঁচ ভাইয়ের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে ও তাদের সেখান থেকে তাড়িয়ে দেয় । তখন পাঁচ ভাই ঘুরতে ঘুরতে জানবো বলে এক জায়গায় এসে পৌঁছয়। যে ভাইয়ের নাম নিজো তার এই জায়গাটি খুব ভালো লাগে এবং সে বলে, ” আমি এখানেই থাকবো “…তাকে ওখানে রেখে বাকি চার ভাই আবার ঘুরতে শুরু করে এবং তারা এসে পৌঁছয় কারকো তে। তাদের এই চারজনেরই কারকো কে খুব ভালো লাগে এবং তারা এখানে ঘরবাড়ি বেঁধে থিতু হয়। কারকোয় থাকাকালীন তারা তাদের দেবতা ডোগিনের উদ্দেশ্যে বলিদান দেবে বলে ঠিক করে। এই বলিদানের রীতি হল দুটি পুরুষ মিঠুন কে একে অপরের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দিয়ে জাতিকে একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তারপর তাদের বলি দেওয়া । মিঠুন অর্থাৎ বাইসন প্রজাতির প্রাণী।
তো যখন মিঠুন দুইটি লড়ছিল একে অপরের বিরুদ্ধে তখন একটি মিঠুনের পা মাটিতে গিয়ে সেখান থেকে জলের ফোয়ারা বেরিয়ে আসে। ফলে সবার মনে হয় যে সেখানে নিশ্চয়ই কোন শুভ বা অশুভ উইয়ু বা আত্মা আছে। সেই ভয়ে তারা সেই জায়গা পরিত্যাগ করে চলে গেল । সেখানে কেবল রয়ে গেল ইয়েবু এবং তার থেকে মিনইয়ঙ জনজাতির সৃষ্টি হল।
তিন ভাই আবার ঘুরতে ঘুরতে এক জায়গায় এসে পৌঁছলো ।সেই স্থানের নাম হচ্ছে ইউয়িঙ-কেবে-রন্নে। ইয়াইয়িং বলল ,”আমার এই জায়গা ভালো লাগছেনা আমি চললাম । ” কিন্তু নিতান ও নিগাঙ দুই ভাইয়ের মনে হল যে জায়গাটা কৃষিকাজে পক্ষে উপযোগী ।তাই তারা সেখানে রয়ে গেল।
ইয়াইয়িং ও তার পরিবার আবার ঘুরতে ঘুরতে এক জায়গায় এসে পৌঁছল। সেই জায়গার নাম টুলুঙ। তারা সেখানে ঘর বাঁধলো । কিন্তু কামকিঙ এর গালঙরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাদের সেখান থেকে হটিয়ে দিল। বিতাড়িত হয়ে তারা নদী উপত্যকা ধরে আরো ওপর দিকে যেতে যেতে গালঙ এসে পৌঁছল এবং সেখানেই বাস শুরু করল ।
গামেঙ এলাকায় জনবসতি গড়ে তোলার পর তারা পায়ুমের মানুষজনের সঙ্গে যুক্তভাবে তাগিনদের বিরুদ্ধে লড়াই করে তাদের এই অঞ্চলের বাইরে বার করে দেয়…
এই লোককথা তার মধ্যে লৌকিক ইতিহাসের এক বুনোট খেয়াল করা যায়। অনুমান করা যায় যে আদি জনজাতির পূর্বপুরুষরা খুব সম্ভবত বহু বহুদিন আগে তিব্বত থেকে এসেছিলেন ।। আরো উল্লেখযোগ্য যে আদি জনগোষ্ঠীর প্রতিটি ছোট ছোট উপবিভাগকে তাঁরা উক্ত পাঁচ ভাইয়ের বংশ হিসাবেই ভাবেন, যাঁরা খুব সম্ভবত তিব্বতের কোন জায়গা থেকে এই অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন।
প্রত্যেকটি উপ জনজাতি পৃথক বসবাস অঞ্চল দেখে সেই স্থান হিসেবে সেখানে তাদের বংশধররা আদিপুরুষের প্রথম মনুষ্য বসতি স্থাপন করে । এর ফলে তাদের কাছে বসবাস অঞ্চল কেবলমাত্র জল, জঙ্গল, জমি, শস্যক্ষেত্রের প্রাকৃতিক ভাণ্ডারই ছিল না। তাঁদের নিকট তা ছিল পূর্বপুরুষের স্মৃতি কীর্তি ও মৃত্যুপরবর্তী উপস্থিতির স্থান।
সুতরাং সেই সব অঞ্চলে তাঁদের বিতাড়িত করলে বা হলে , সেই অঞ্চলের উপর দখল হারালে তাঁদের কেবল বস্তুগত ক্ষতিই হয় না, অর্থাৎ প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ ও ব্যবহার করার অধিকার হারানোর ক্ষতি হয়না ….আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক শিকড় উপরে যাবার অপূরণীয় ক্ষতি হয় পূর্বপুরুষদের স্মৃতি ও মৃত্যু পরবর্তী উপস্থিতির সঙ্গে সংযোগ ছিন্ন হয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে। এর ফলে প্রতিটি জনগোষ্ঠীর মনে করে যে তাদের টিকে থাকা নির্ভর করছে তাদের বসবাস অঞ্চলের উপর তাদের সঙ্গে বসবাস অঞ্চলের উপর তাদের দখল বজায় থাকার সঙ্গে । তাই বসবাস অঞ্চলের উপর দখল রাখার জন্য তাই সর্বশক্তি জড়ো করে তারা লড়তে প্রস্তুত ।
প্রাচীন ভূ সন্তানদের বসবাস অঞ্চলের সীমা , সীমান্ত ,পরিসীমা সবই নদী,জল, জঙ্গল, পাহাড় ইত্যাদির প্রাকৃতিক চিহ্ন দিয়ে চিহ্নিত হয়।
খামে ভরে সে রেখে গেছে আকাশ, বৃষ্টি, জল
বলেছে, পান করো
প্রলম্বিত খরায় বর্ষা আসতে দেরি হলে ভয় নেই কোনো
খামে ভরে সে রেখে গেছে তার মন
বলেছে, এই দ্যাখো আমি নিকট কিংবা হৃদয়ে
ভাবছ যতটা দূর, তা মাপবে কী দিয়ে
খামে ভরে সে রেখে গেছে তার চোখ
বলেছে, দৃষ্টিসীমায় দিগন্ত নেই কোনো, তুমি অরণ্য
আমার সবখানি পরিসীমা সবুজ হয়ে আছে
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জনসংখ্যা যদি একটা সীমা ছাড়িয়ে যায় তখন নতুন করে বাস্তু ভিটের খোঁজ পড়ে। ঝুম করেন তখন। ঝুম করে নতুন বসত বানান, নতুন চাষের জমি বানান। বন কেটে , পুড়িয়ে সাময়িক ভাবে পরিষ্কার করা জমিতে চাষকেই ঝুম বলে। নতুন জমির খোঁজ , নতুন জমির জন্য ঝুম, নতুন করে পাহাড়ের গাছ জঙ্গল কাটা, প্রাকৃতিক সীমানায় টান ফেলে। ফলে , দুই গোষ্ঠী বা একাধিক গোষ্ঠীর মধ্যে বিবাদ হয়। বিবাদ অসমাধিত থেকে গেলে সংঘাতের জন্ম হয় । এছাড়াও অন্য কোন জায়গা থেকে আসা কোন জনগোষ্ঠী নতুন করে বসত তৈরি করার জন্য আগে থেকে বসত করা অন্য জনগোষ্ঠীর এলাকায় ঢুকলেও সংঘাত সৃষ্টি হয় এবং এই সংঘাতের কাহিনীও উক্ত লোককথাটির মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে ।
পাহাড়ের দেশে
পাহাড়িয়াদের বেশে।
আমার মনটা হেসে।
বেড়ায় কেবল ভেসে ভেসে॥
সোনা রোদ্দুরে
পাহাড়ে পাহাড়ে;
রঙীন ফুলের বাহারে
ছুটে চলে মন রে
বাধাহীন খুশির সাহসে।
…ও পাহাড়…ও পাহাড়…
দেখা হবে কবে আবার…
বুঝি জীবনের নিশি রাতে
…ও পাহাড় তোমার সাথে?
আদি জনজাতির মধ্যে প্রচলিত লৌকিক ইতিহাস অনুযায়ী সিয়াঙ-এর প্রায় প্রতিটি গ্রাম তাঁদের কোনো না কোনো গোষ্ঠী বা কৌমের আদিপুরুষের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়ে ছিল। সেই আদি পুরুষ সেই সব জায়গায় জঙ্গল কেটে প্রথম মানুষের বসত বসিয়েছিলেন আর সেই জন্য সেই সব জমি- জল- জঙ্গলের আদি স্বত্ব তাঁদের। সেই আদিপুরুষের বংশধররাই উত্তরাধিকার সূত্রে সেই জল ,জমি,জঙ্গলের স্বত্বের অধিকারী ।
অন্য কোনো কৌমের মানুষ যদি পরে এসে এই গ্রাম এলাকায় বসতি স্থাপন করতে চান তবে তাঁরা জমি জঙ্গলের ব্যবহারের অধিকারী হতে পারে একমাত্র সেই আদি সত্ত্বাধিকারী কৌমের অনুমতি ক্রমে।
বাস্তবে যখন কোন আদি স্বত্বাধিকারী কৌম ভিন্ন অন্য কোন কৌমের মানুষ গ্রামে গ্রামে থাকার অনুমতি দেয়, তখন সে পরিবারকে বলা হয় জঙ্গল পরিষ্কার করে নতুন করে বসত ভিটে গড়ে নিতে।
যদি বেশ কিছুদিন অব্যবহারে পড়ে থাকা পুরনো বসতভিটেতে নতুন করে বাসা বাঁধেতে বা আদি স্বত্বাধিকারী কৌমের কোনো পরিবারের দখলে ব্যবহার অতিরিক্ত জমি থাকে তাহলে সেটা ধার নিতে। যেটাই হোক না কেন , এই অন্য কৌমের অধিবাসীদের ততদিন অবধিই এই দখলীস্বত্বের অধিকার দিয়েছেন যতদিন অবধি তিনি নিজে সেখানে জীবিত অবস্থায় বাস করছেন। তিনি মারা গেলে, তার বংশধররা সেই স্বত্ব ভোগ করবেন যদি গ্রামের কেবাঙ বিচার করে তার অনুমতি দেন তবেই ।আর তিনি গ্রাম ছেড়ে চলে গেলে তাঁর সম্পত্তি গ্রামের সাধারন সম্পত্তিতে পরিণত হবে ।
#ক্রমশঃ
#দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ তামাঙ , ডয়া, আদি, আপাতনি জনজাতি কথা