#পর্ব_১ : সনাতনী অরুণাচল
অরুণকান্তি কে গো যোগী ভিখারী
নীরবে হেসে দাঁড়াইলে এসে
প্রখর তেজ তব নেহারিতে নারি ৷৷
রাস বিলাসিনী আমি আহিরিণী
শ্যামল কিশোর রূপ শুধু চিনি ,
অম্বরে হেরি আজ একি জ্যোতিঃপুঞ্জ হে গিরিজাপতি !
কোথা গিরিধারী সম্বর সম্বর মহিমা তব ,
হে ব্রজেশ ভৈরব , আমি ব্রজবালা ,
হে শিব সুন্দর ,বাঘছাল পরিহর , ধর নটবর-বেশ …
অরুণ + অচল …অরুণ অর্থাৎ উদীয়মান সূর্য , অচল অর্থাৎ নিশ্চল পর্বত। সেই খানে সবার আগে সূর্য আসেন রক্তআভা ছড়িয়ে। সেখানে পর্বতমালা মৌন যোগীর ন্যায় তপস্যায় লীন আছে সেই কোন সুপ্রাচীন কাল হতে। সেটা সূর্য দেবতার বাসভবন। সে এক প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য বুনটে বোনা বিস্ময়কর স্থান। পাহাড় – নদী- জঙ্গল , কত যে নাম জানা ও না জানা প্রাণীর বাস, তার মধ্যে মানুষের ভাষা -সমাজরূপ – সংস্কৃতির বহুবিচিত্র ধারা এখানে প্রবাহিত।বিচিত্র পত্র মর্মর, ঝোরা , ডুংরী , নদী প্রস্রবণ এর বিচিত্র জলধ্বনি , কর শত পাখির কত বিচিত্র সুরেলা কুজন, ভ্রমরের গুঞ্জন , প্রাণীদের বহু স্বর সেখানে মুখরিত হয়ে সকাল সন্ধ্যায়। সে এক আজব স্থান। তাই এই স্থান “land of the dawn-lit mountains”। ভারতের সাত বোনের রাজ্য নাম না জানা অর্কিডের ভূমি। এই উদীয়মান সূর্যের এলাকা তার মধ্যে অন্যতম।এখানে এত রকমের অর্কিড পাহাড়ে, বনে ফুটে থাকে ও তাদের এত রকমেরই ঔষধি গুন যে এই সূর্যের পর্বতকে অর্কিডের স্বর্গরাজ্য বলা হয়।
এ কী হরষ হেরি কাননে।
পরান আকুল, স্বপন বিকশিত মোহমদিরাময় নয়নে॥
ফলে ফুলে করিছে কোলাকুলি, বনে বনে বহিছে সমীরণ
নবপল্লবে হিল্লোল তুলিয়ে– বসন্তপরশে বন শিহরে।
কী জানি কোথা পরান মন ধাইছে বসন্তসমীরণে॥
ফুলেতে শুয়ে জোছনা হাসিতে হাসি মিলাইছে।
মেঘ ঘুমায়ে ঘুমায়ে ভেসে যায় ঘুমভারে অলসা বসুন্ধরা–
দূরে পাপিয়া পিউ-পিউ রবে ডাকিছে সঘনে॥
সেখানের নাম কি? সেখানের নাম অরুণাচল প্রদেশ। এই রাজ্যের সাধারণত Tibeto-Burman উদ্ভূত জনগোষ্ঠীর বাস।অরুণাচল প্রদেশে প্রায় ২৬ টি জনজাতিগোষ্ঠীর বাস। তার মধ্যে ৭০ টি উপগোষ্ঠীর বিভাগ আছে। যেমন -এখানে #তানি বা Tani উপজাতি ,পাঁচ উপগোষ্ঠীতে বিভক্ত , তাগিন, নিশি, আদি, গালো এবং অপাতানি। মনে করা হয় যে এই জনগোষ্ঠীর আগমন অবতানি থেকে। সেভাবে দেখলে অরুণাচলের ইতিহাস সেভাবে নথিবদ্ধ নেই।কিছু তিব্বতীয় নথি থেকে জানা যায় যে এই তানি উপজাতি একটা সময় তিব্বতের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। তাঁরা ধাতু ও তরবারীর রপ্তানি করতেন। বদলে তিব্বতীয়দের থেকে পেতেন মাংস ও পশুর লোম। তিব্বতীয় নথি ও উপকথায় এই তানিদের লোহভাস বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ দক্ষিণের মানুষ। লোহ অর্থাৎ দক্ষিণ এবং ভাস অর্থাৎ মানুষ।
প্রসঙ্গত বলে রাখি সেভাবে অরুনাচলের ইতিহাস একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত নথিবদ্ধ না থাকলেও বিভিন্ন হিন্দু পুরান ও মহাকাব্যে এই উদীয়মান সূর্যের পর্বতের কথা বলা হয়েছে।কালিকা পুরান ও রামায়ন, মহাভারতে এই অরুণাচল প্রদেশকেই বলা হয়েছে #প্রভু_পর্বতমালা। অরুণাচল প্রদেশ সেই স্থান যেখান পরশুরাম নিজের প্রায়শ্চিত্ত করে ভগবান পরশুরাম হয়েছিলেন। অরুণাচল প্রদেশ সেই পবিত্র ভূমি যেখানে ব্যাসদেব সিদ্ধি লাভ করেছিলেন। এই সেই ভুখন্ড যেখানে ভীষ্মক নিজের রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই ভূখণ্ডেই ভগবান শ্রী কৃষ্ণ দেবী রুক্মিণীর পাণি গ্রহণ করেছিলেন। এই অরুণাচল প্রদেশ, প্রভু পর্বতমালার ভুখন্ড বহু শক্তিশালী রাজা ,রাজ বংশ দ্বারা শাসিত। তার কিছু ঐতিহাসিক সাক্ষ্য আজও হেতায় বাহিত হয় নদী , ঝোরা, বন পাহাড়ের মাঝে।
যদিও প্রাক-আধুনিক অরুণাচল প্রদেশের ইতিহাস রহস্যের মধ্যে আবদ্ধ রয়েছে। সেখানে এখন সেই সুপ্রাচীনতা কে পরিত্যাগ করে , সেখানের লৌকিক উপজাতীয় ধর্মকে পরিত্যাগ করে বর্তমান ঐতিহাসিকগন কেবল খ্রিস্টধর্ম ও চৈনিক মতবাদ নিয়ে আলোচনায় অভিভূত হয়ে রয়েছেন। একটা সময় অবধি সনাতনী সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় বিষয়গুলির নথি সুপ্রাচীন গ্রন্থগুলিতে পাওয়া যায়। অস্তিত্ব রেকর্ড করেছেন। পুরাণ সাহিত্য এই প্রমাণকে শক্তিশালী করেছে বারংবার। অরুণাচলের পরশুরাম কুন্ডের সঙ্গে যুক্ত লোহিত নদী পুরাণকালে লৌহিত্য নামে পরিচিত ছিল।
কালিকা পুরানে উল্লিখিত প্রভু পর্বতমালার উপত্যাকাকে সুবানসিরি উপত্যকা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। Sadiyaর নিকট বর্তী স্থানে বর্তমানে বেশ কিছু ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গিয়েছে। যা রুক্মিনী পিতা ভীষ্মক দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ভীষ্মকা নগরীর সাক্ষ্য বহন করে। এই ধ্বংসাবশেষ ভাগবত পুরাণে বর্ণিত #ভীষ্মাকার রাজবাড়ির প্রতিনিধিত্ব করে বলে জানা যায়। ভীষ্মকানগরের প্রমান স্বরূপ এই স্থান হতে সংস্কৃতলিপি সহ দুইটি তাম্র ফলক আবিষ্কার করা হয়েছে।যার থেকে প্রমাণিত হয় ওই স্থানে দুইটি তামার মন্দির ছিল।
পূর্বেই বলেছি অরুণাচল প্রদেশের বিভিন্ন প্রাচীন উপজাতির বাস। এনাদের মধ্যে এমন বহু উপজাতি আছেন যাঁরা নিজেদের রামায়ণের অংশ বলে মনে করেন। যেমন- কার্বি উপজাতি, নিজেকে বালি এবং সুগ্রীবের বংশধর হিসাবে বিবেচনা করেন। তিবারা উপজাতির মানুষজন দেবী সীতার বংশধর হিসাবে গর্ব বোধ করেন।
মিশ্মী উপজাতি সম্প্রদায় তাঁদের অতীত ঐতিহ্য খুঁজে পান তাদের পূর্বপুরুষহিসাবে কিংবদন্তি রাজা ভীষ্মক এবং তাঁর তাঁর কন্যা রুক্মিণী এবং শ্রীকৃষ্ণের মাধ্যমে। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা এবং তাওয়াংয়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলের, সীমান্তবর্তী উপ-পাহাড়গুলিতে ফালিক উপাসনার সাথে শৈববাদের প্রভাবের উপস্থিতিও স্পষ্ট। শুধু তাই নয় এই সপ্ত বোন রাজ্য শাক্ত তথা তান্ত্রিক উপাসনায় তন্ত্র শাস্ত্রে বিশেষ ভাবে উল্লিখিত হয়েছে।
উনিশ শতকে ব্রিটিশ প্রশাসকগণ এবং পণ্ডিতগণ বিভিন্ন উপজাতির মৌখিক ইতিহাস লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে তাঁদের নিকট হতে ভীষ্মকনগর, তমেশ্বরী মন্দির, ভালুকপং, রুক্মিণী নগর, ইটা দুর্গের ন্যায় স্থান আবিষ্কার করেন।
রাজ্যের গবেষণা অধিদপ্তরের প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগটি বিংশ শতাব্দীর পরবর্তী দশক এবং একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে খনন এবং অনুসন্ধান চালায়। ১৯৬৫ — ১৯৬৭ সালে চলাকালীন খননকালে লোহিত জেলায় একটি বিশাল শিব লিঙ্গম আবিষ্কার করা হয়। পরের দশকগুলিতে ভীষ্মনগর, মলিনিথন, বিজয়নগর, রুক্মিনীনগর ও নাক্সা পর্বতে একের পর এক খননকাজ শুরু হয়।
উল্লেখ্য তমেশ্বরী মন্দির এবং ভীষ্মকনগর দুর্গে প্রাপ্ত শিলালিপিগুলি সংস্কৃত, অসমিয়া এবং বাংলা লিপিতে লেখা হয়েছিল। একটি শিলালিপিতে উৎখনন ছিল ‘শ্রী শ্রী লক্ষ্মী নারায়ণ জপ’। লোহিত জেলার তেজুর নিকটে অবস্থিত পরশুরাম কুন্ড দীর্ঘকাল থেকেই হিন্দু ভক্তদের সমাগম হয়। কালিকা পুরাণে বর্ণিত কিংবদন্তীতে উল্লেখ করা হয়েছে যে প্রভু পরশুরাম এই স্থানেই স্নান করে প্রায়শ্চিত্ত করেছিলেন।
নিম্ন দিবাং উপত্যকা জেলার রোয়িংয়ের নিকটে অবস্থিত ভীষ্মকনগর সম্পর্কে কালিকা পুরাণে উল্লেখ পাওয়া যায়। এই স্থানটির রাজা ছিলেন ভীষ্মকা, শ্রীকৃষ্ণের স্ত্রী রুক্মিনীর পিতা। মলিনিথান হল মন্দিরের জটিল নকশার ধ্বংসাবশেষ। এটি পশ্চিম সিয়াং জেলার পাদদেশে অবস্থিত। কয়েক বছর ধরে ক্রমাগত খননকার্যে চারটি পৃথক মন্দিরের ভিত্তি এবং প্রচুর ভাস্কর্য এবং হিন্দু দেবদেবীদের দেবমূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে।
প্রস্তর নির্মিত মন্দির মনিলিথন।সুসজ্জিত প্রস্তর কাঠামোর উপরে অপূর্ব খোদিত অলঙ্করণ।সেই অপরূপ ভাস্কর্য গৌরবময় অতীতের কথা নীরবে বলে যায়।কালিকা পুরান অনুসারে শ্রী কৃষ্ণ তাঁর স্ত্রী রুক্মিনীর সঙ্গে যখন ভীষ্মক নগরে ফিরে আসেন তখন এই স্থানেই বিশ্রাম গ্রহণ করেছিলেন। সেই দৈবিক নব দম্পতিকে স্বাগত জানিয়ে ছিলেন স্বয়ং মহেশ্বর ও মহামায়া। দেবী মহামায়া পার্বতী তাদের সুগন্ধিত পুষ্প, মাল্য ,চন্দনে আপ্যায়িত করেছিলেন। শ্রী কৃষ্ণ দেবীকে তাই মালিনী বলে সম্বোধন করেছিলেন। সেই থেকে এখানে দেবী মালিনী নামে পূজিতা হয়ে আসছেন। তাই এই মন্দির মলিনিথন বা মালিনীর আবাস নামে সুবিখ্যাত।
মলিনিথনের খনন কার্য থেকে একথা প্রমানিত হয়েছে যে এটি নবম শতকের পূর্বে নির্মিত। এখানে ৭০০ থেকে ৯৫০ খ্রিস্টাব্দের আসামের শাসকগনের প্রভাব কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিক ভাবে উল্লিখিত হয় নি। এই স্থানে অনেক ভাস্কর্য / প্রস্তর কাঠামো উন্মুক্ত স্থানে পড়ে আছে। বেশ কিছু বা মন্দিরের অংশ, দেব-দেবদেবীদের মূর্তি, ঋষি, গন্ধর্বস, অপসার এবং অন্যান্য মানবিক ও প্রাণীর ভাস্কর্য ও প্রস্তর চিত্র জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে।
মলিনিথন মন্দিরের প্রধান দেবী দুর্গা দুর্গতিনাশিনী (মালিনী)। খননের সময় প্রাপ্ত ভাঙা টুকরো থেকে দেবীর বর্তমান চিত্র পুনর্গঠন করা হয়েছিল। দুর্গা ছাড়াও মন্দির পরিধির মধ্যে নন্দী, ইন্দ্র, সূর্য, ব্রহ্মা, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী, বরাহ, রাধা, কৃষ্ণ, শিব লিঙ্গ এবং অসংখ্য পাথরের মূর্তির অবস্থান আছে।
মলিনিথানের নিকটে অবস্থিত আকাশীগঙ্গা দেবী সতীর কিংবদন্তীর সাথে সম্পর্কিত ৫১ টি পবিত্র শক্তি পীঠের মধ্যে একটি হিসাবে বিবেচিত হয়। জনশ্রুতিতে বলা হয়েছে যে সতীর মাথা এই জায়গায় পড়েছিল। মলিনিথন ও আকাশীগঙ্গায় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বিপুল সংখ্যক তীর্থযাত্রী এবং পর্যটকদের সমাগম ঘটে ।
প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের সর্বশেষ উল্লেখযোগ্য আবিষ্কারটি হ’ল নিম্ন সুবানসিরি জেলার জিরোতে বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘতম শিব লিঙ্গ। অলৌকিকভাবে শিব লিঙ্গের আবিষ্কারটি ২০০৪ সালের পবিত্র শ্রাবণ মাসে ভরা বর্ষায় গহীন অরণ্যের মধ্যে ঘটেছিল। এটি বিশ্বাস করা হয় যে এই স্থানের উক্ত লিঙ্গটির সম্পর্কে শিব পুরাণের রুদ্র খন্ডের ১৭ অধ্যায়ে উল্লিখিত হয়েছে। শিব লিঙ্গটি ২৫ ফুট দীর্ঘ ও ২২ ফুট প্রস্থ। লিঙ্গের নীচে নিরবিচ্ছিন্ন জলের ধারা প্রবাহিত হয় । মহাকাল রুদ্র মহাদেব পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের দ্বারা পরিবৃত রয়েছেন। ভগবান গনেশে প্রথম দিকে এবং পার্শ্ববর্তী স্থানে দেবী পার্বতী এবং ভগবান কার্তিকেয় ছোট লিঙ্গ আকারে পিছনে অবস্থান করছেন।
প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ যেসকল স্থানে খনন করে হিন্দু দেবদেবীদের মূর্তি এবং চিত্র আবিষ্কার এবং খোজ খবর পেয়েছে তার বেশ কিছু সংরক্ষিত হয়েছে। তবে কিছু মূর্তি বা মন্দিরের অংশ স্থানীয় লোকেরা তাদের বাড়িতে বা নতুন নির্মিত মন্দিরে কিছু প্রতিমা স্থাপন করে উপাসনা করছেন। প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণগুলি বহু শতাব্দী ধরে প্রচলিত পৌরাণিক কাহিনী ও বিশ্বাসকে প্রমাণিত করে।
স্বাধীন উত্তর-পরবর্তী ভারতে অবস্থিত ‘নেহেরুভিয়ান নীতি’ রাজ্যের বিভিন্ন উপজাতিগুলিকে তাদের নিজস্ব প্রতিভা এবং ঐতিহ্য অনুযায়ী বিদ্যমান সংস্কৃতিগত নীতি বিনষ্ট হওয়ার বিপদকে অগ্রাহ্য করার জন্য উৎসাহিত করেছিল। তবে, প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ এবং অনুসন্ধানে সাম্প্রতিক অতীতে বহু শতাব্দী ধরে অরুণাচল প্রদেশে সনাতন ধর্মের উপস্থিতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রাজ্যের প্রাচীন ইতিহাস পুনর্গঠনের জন্য এই অনুসন্ধানগুলি ঐতিহাসিকভাবে মূল্যায়ন ও যথাযথভাবে সংহত করার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
এর পরবর্তী পর্যায় Chutiya রাজত্বের সময় কাল হতে অরুণাচল প্রদেশের ইতিহাস নথি বদ্ধ হয়। মনপা ও শেরডুকপেন স্থানীয় শাসকদের সময়কালের ইতিহাস সমেত প্রায় উত্তরপূর্ব ভারতের ইতিহাস সংরক্ষণ করা হয়েছিল।এই সকল স্থানের উত্তরপশ্চিমাংশে মনুউলের মনপা বংশ রাজত্ব করেছিল প্রায় ৫০০ খ্রিস্টপূর্ব থেকে ৬০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। মায়ানমারের ও ভারতের সীমানাস্থ এলাকায় Chutiya বংশদের রাজত্ব ছিল।
তো এহেন সুপ্রাচীন অরুণাচল প্রদেশে ২৬ টি জনজাতি ও তাদের ৭০ টি উপবিভাগের কথা আমি পূর্বেই উল্লেখ করেছি। এই প্রদেশে ৮২ টি মূল ভাষা রূপ আছে ও ১৬৫০ টি কথ্য ভাষা আছে। এর মধ্যে আজ আমি আদি জনজীবনের কথা উল্লেখ করব। তাঁদের ইতিহাস, গ্রাম, সমাজ, ভাষা, সংস্কৃতি , লোকপ্রজ্ঞার সম্পদ ইত্যাদি আলোচনা ও পর্যালোচনার মধ্যে দিয়ে সমৃদ্ধি লাভ করব। যে উপত্যকার মাঝে দাঁড়িয়ে রয়েছি, তার চার পাশে পাহাড়, পাহাড়, পাহাড়৷ বহু দূর থেকে দেখলে ভ্রম হয়, একটা ডিঙিয়ে আর একটা, আর একটা ডিঙিয়ে পরের পাহাড়ে চলে যাওয়া যায় বুঝি। বর্ষা
এলে এই সময়টা সবুজ পাহাড় পৃথিবীর সব সবুজ রং নিয়ে জেগে ওঠে৷ ওড়াওড়ি শুরু করে ফড়িংয়ের দল৷ কোথা থেকে যে ওরা আসে হঠাত্ ! যেন পাহাড়ি কুয়াশা৷ কোথায় তাদের বাড়ি কেউ
জানে না৷
আদি ও আপ্তানি এই দুজন হল অরুনাচলের দুই গুরুত্বপূর্ণ জনজাতি। বলা যেতে পারে ২৬ টি জনজাতির মধ্যে যে উপবিভাগে আছে তার দুইটি। প্রধানত তানি উপজাতির উপবিভাগ হলেন এনারা। নৃতত্ত্বের দৃষ্টিকোন থেকে ইংরেজি ভাষায় এই দুই জাতি নিয়ে বহু কাজ আছে। অবশ্যই বাংলায় তেমন কিছু হয় নি। আদি জনজাতির বাস অরুনাচল প্রদেশের মাঝ বরাবর অবস্থিত সিয়াঙ জেলায় ও সিয়াম নদীর অববাহিকাকে পরিবেষ্টন করে। সেখানে পাহাড় নদী আর বৃষ্টির জলে স্নান করে। সেই সেখানে হয় কেউ নাও যেতে পারত । কিন্তু গেছে সকলে ….তারপর সুখের সেই বন পাহাড়ের নীরবতা ভেঙেছে।
সেই উপত্যকায় , সেই পাহাড় কোলে , সেই নদীর জলে , সেই কুয়াশা মাখার শিশির ভেজা কিংবা বৃষ্টির ফোঁটা সিক্ত একটা পাখি হঠাৎ ঝুপ করে লাফিয়ে পড়ে নদীর জলে। তারপর উড়তে উড়তে চলে যায় সেই অজানা কোন বনের দিকে কিংবা পাহাড়ের কোনে। সেখানে মাথায় শুকনো কাঠ পাতার স্তুপ নিয়ে নদী পার হয়ে যান নানা বয়সের কিছু নারী, পশু নিয়ে পার হন কত পুরুষ। এই নদীর পারাপার কিছু দিনের জন্য। নদীর জল বাড়লে আর তো যাওয়া হবে না। এই যে কাঠ বা পশুর পাল নিয়ে যান উদীয়মান পাহাড় কোলের জনজাতিরা এঁদের নাম আদি জনগোষ্ঠী।
সেই ওই যে দূরের যে পাহাড় বা ওই দূরে লি লি করে যে গাঁ ওখান হতে দেখা যায় এই প্রান্তর এখন জেগে উঠেছে বটে কিন্তু প্রবল বর্ষণে আর এই উপত্যাকাকে চেনা যাবে না। আগে ইংরেজরা, ঐদিকে অসমের লোকেরা আর অনেক আগের সেই লাল চোখের জমিদার শাসকরা এই জনগোষ্ঠীকে আবোর বলত। আবোর মানে? আবোর মানে অবাধ্য, অদম্য বা বিশৃঙ্খলা। তবে এই উপত্যকার আদি জনজাতি কোনোদিনই এই নামে নিজের পরিচয় দিত না এখনো দেয় না। কিন্তু এটা যে সেই যে ব্রিটিশরা এল , জমি দখল করল সেই তাদের দেওয়া।
অবোর এই নামটির পিছনে লুক্কায়িত রয়েছে এক ইঙ্গিত। কি সেই ইঙ্গিত? ব্রিটিশদের চক্ষে যাঁরা অবাধ্য,অদম্য বা বিশৃঙ্খল , তাঁরা নিশ্চিত শাসকদের সঙ্গে কোনও দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের মধ্যে দিয়ে গেছেন। কি হয়েছিল?
১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে প্রথম এই জনগোষ্ঠীর ছবি তোলেন এডওয়ার্ড এইচ হিগস। ইনি একজন রেভারেন্ড মানে ওই খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারক ছিলেন। সেই ছবিটি ছিল আবোর ওরফে আদি গোষ্টিপ্রধামের কন্যার ছবি। সেটি তোলা হয় ডিব্রুগড়ের উত্তরে পাহাড়ি অঞ্চলে।
এরপর ১৯০৯ সালের একটি ছবি প্রকাশিত হয় এবং সংরক্ষিত হয় । সেটি হল কেবাঙ গ্রামের গ্রাম পরিষদের দৃশ্য। সেটি তুলেছিলেন অভিযাত্রী ডুগালড ম্যাকটাভিস লুমসডেন।সেখানে দেখা গেছিল গ্রামপরিষদের একটি সভা হচ্ছে ও বক্তব্য রাখছেন গ্রামপ্রধান। গ্রামপ্রধান এখানে গম নামে অভিহিত হন।কেবাঙ গাঁ আদি জনজাতির জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি গ্রাম বলে বিবেচিত হয়।
স্তব্ধতা উচ্ছ্বসি উঠে গিরিশৃঙ্গরূপে,
ঊর্ধ্বে খোঁজে আপন মহিমা।
গতিবেগ সরোবরে থেমে চায় চুপে
গভীরে খুঁজিতে নিজ সীমা।
সেই যে সিয়াম নদী মানস সরোবর থেকে উৎপন্ন হয়ে আসা সিয়াং নদীর সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল সেই কেবাঙ ও আদি জনগোষ্ঠীর গ্রাম গুলোকে চুল থেকে নখ ভিজিয়ে দিয়ে চলে যায়।সেই নদীর জলে পাহাড়ি আদি মেয়ে হাত ডুবিয়ে ভাবে কোন সে সুদূর পর্বত থেকে সে নদী ঝমঝমিয়ে নামে। সে শব্দ যেন সেই প্রাগৈতিহাসিক শব্দ। সেই শব্দ সেই পাহাড়ি গুল্মলতাকে ছুঁয়ে দেখতে তার অনুমতি লাগে না । সে যে গিরি কন্যা।এই সূর্যের বাসস্থান পাহাড় , তার ফাঁকে পড়তে পরতে জড়িয়ে থাকে কত শত নদী। পাহাড়ি নদী বড়ই রহস্যময়ি। সে দূর হতে সরু বেনী বাঁধার ফিতের মতো কাছে এলে প্রবল ….এই নদীর ধারের কেবাঙ গাঁয়ের একটা ঝলসানো বিধ্বস্ত ছবি আজও একটা ভয়াল ট্রাজিডির কথা বলে। ১৯১১ সালের ৯ ডিসেম্বর সে ছবি তোলা হয়।সেটি সামরিক বাহিনীর কর্তা ক্যাপ্টেন ডি এইচ আর গিফোর্ড এই তোলা । এই ছবি হল ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর দ্বারা ঘটানো কুখ্যাত আবোর এক্সপিডিশনের। ব্রিটিশদের পরিকল্পিত আবোর এক্সপিডিশনকে বাস্তবায়িত করার জন্য কেবাঙ গাঁ করে পুড়িয়ে ছারখার করে দেওয়া হয়।
এই আবোর এক্সপিডিশনের পর কয়েক হাজার আদি জনজাতির নরনারী এমনকি শিশুকে বন্দী করে হয়েছিল। ১৯১২ সালের জানুয়ারী মাসে সেরমই একটি আলোক চিত্র ফ্রেম বন্দী করে হয়। এই ছবিটি ছিল সিয়াং এর রিগা ক্যাম্পের ছবি।
#ক্রমশঃ
#দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ তামাঙ , ডয়া, আদি, আপাতনি জনজাতি কথা