ডিএ (মহার্ঘ ভাতা) নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের কাছে আরও ছ’মাস সময় চাইল রাজ্য সরকার। রাজ্য সরকারি এবং সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের বকেয়া ডিএ-র ২৫ শতাংশ মিটিয়ে দেওয়ার জন্য রাজ্যকে সুপ্রিম কোর্ট যে ছ’সপ্তাহ সময়সীমা দিয়েছিল, তা শুক্রবার শেষ হয়েছে। এ বার সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানিয়ে রাজ্য জানিয়েছে, তাদের এখন আর্থিক সঙ্কট রয়েছে। তাই বকেয়া ডিএ-র ২৫ শতাংশ মেটানোর জন্য আরও সময়ের প্রয়োজন। সুপ্রিম কোর্টের অন্তর্বর্তী নির্দেশ পুনর্বিবেচনারও আর্জি জানিয়েছে রাজ্য। এ-ও জানিয়েছে, তারা বকেয়া ডিএ-র ২৫ শতাংশ সরাসরি আদালতের তহবিলে জমা দিতে প্রস্তুত।
কেন তারা এখন বকেয়া ডিএ-র ২৫ শতাংশ দিতে পারছে না, তা-ও আদালতে জানানো হয়েছে। রাজ্যের দাবি: এক, লক্ষ লক্ষ কর্মচারীকে বকেয়া ডিএ-র ২৫ শতাংশ দিতে গেলে বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন। ২০২৫-২৬ অর্থবর্ষের বাজেটে এমন কোনও বরাদ্দ নেই। রাজ্যকে যদি এই অর্থ দিতে হয়, তা হলে ঋণ নিতে হবে, যার জন্য কেন্দ্রের অনুমতি দরকার। এই প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ। দুই, ডিএ বাধ্যতামূলক নয়। ঐচ্ছিক বিষয়, এটি কর্মীদের মৌলিক অধিকার নয়। তাই কেন্দ্রীয় হারে ডিএ দিতে বাধ্য নয় রাজ্য। তিন, রাজ্য সরকার একটি নিজস্ব নিয়মাবলি চালু করেছে— আরওপিএ ২০০৯। এই নিয়ম অনুযায়ী, কত হারে ডিএ বৃদ্ধি পাবে, তা রাজ্য নির্ধারণ করে থাকে। কেন্দ্র যে হারে ডিএ দেয়, তা রাজ্যের উপর প্রযোজ্য নয়, কারণ, কেন্দ্র ও রাজ্যের আর্থিক কাঠামো ভিন্ন। চার, কেন্দ্রীয় সরকার বিভিন্ন প্রকল্পে (১০০ দিনের কাজ, জাতীয় স্বাস্থ্য অভিযান, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা) অনুদান কমিয়ে দিচ্ছে। এতে রাজ্যের উপর আরও আর্থিক চাপ পড়ছে। জিএসটি সংক্রান্ত বকেয়াও কেন্দ্র এখনও দেয়নি, যার পরিমাণ প্রায় ১.৮৭ লক্ষ কোটি টাকা। পাঁচ, রাজ্য শুধু সরকারি কর্মচারী নয়, সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় প্রশাসন, স্কুল, কলেজের কর্মীদেরও ডিএ দেয়। সে কারণে কেন্দ্রের হারে ডিএ দেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। রাজ্যের আরও দাবি, তারা কর্মীদের পেনশন দেয়। এ রাজ্যে স্বাস্থ্যপ্রকল্প, এলিটিসি (ভ্রমণের ভাতা) রয়েছে। এই পরিষেবা অন্য রাজ্যে নেই। রাজ্যের আরও বক্তব্য, ‘‘আমরা কেন্দ্রের মতো উচ্চ হারে ডিএ দিতে না পারলেও, রাজ্যের কর্মচারীরা ছুটির ক্ষেত্রে অনেক বেশি সুবিধা পান। এই সুবিধাগুলি মুদ্রাস্ফীতির চাপ থেকে তাঁদের রক্ষা করে।’’
১৬ মে সুপ্রিম কোর্ট ডিএ সংক্রান্ত মামলায় নির্দেশ দিয়েছিল, ২০০৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত যে পরিমাণ ডিএ রাজ্য সরকারি কর্মীদের বকেয়া রয়েছে, তার ২৫ শতাংশ রাজ্য সরকারকে মিটিয়ে দিতে হবে পরের ছয় সপ্তাহের মধ্যে। সেই সময়সীমা শেষ হয়েছে ২৭ জুন, শুক্রবার। আগামী অগস্ট মাসে এই মামলার পরবর্তী শুনানি হওয়ার কথা।
ডিএ মামলার শুনানিতে রাজ্য সরকার সুপ্রিম কোর্টকে জানিয়েছিল, রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের মোট বকেয়া ডিএ–র পরিমাণ ১১ হাজার ৮৯০ কোটি ১৮ লক্ষ টাকা। এ ছাড়া পেনশন প্রাপকদের জন্য মোট বকেয়া ১১ হাজার ৬১১ কোটি ৪৫ লক্ষ টাকা। এ ছাড়াও শিক্ষক, পুরসভা, পঞ্চায়েত–সহ স্বশাসিত সংস্থা ও রাজ্য সরকার পরিচালিত সংস্থার কর্মীদের পাওনা ১৮ হাজার ৩৬৯ কোটি ৩২ লক্ষ টাকা। সব মিলিয়ে অঙ্কটা ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি। তাই রাজ্য সরকারের আইনজীবী অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি দেশের সর্বোচ্চ আদালতকে জানিয়েছিলেন, পুরো ডিএ দিতে গেলে রাজ্য সরকারের আর্থিক অবস্থা বেহাল হয়ে যাবে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের অন্তর্বর্তী নির্দেশ মেনে এর ২৫ শতাংশ, অর্থাৎ প্রায় ১০ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা ২৭ জুনের মধ্যে মেটাতেই হবে।
পশ্চিমবঙ্গের সরকারি কর্মচারীরা বর্তমানে ১৮ শতাংশ হারে ডিএ পান। কয়েক মাস আগে বাজেট বক্তৃতার সময়েই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চার শতাংশ ডিএ বৃদ্ধির কথা জানিয়েছিলেন। তার পর ১৪ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ডিএ হয় ১৮ শতাংশ। সেই বর্ধিত ডিএ কার্যকর হয় ১ এপ্রিল থেকে। যদিও কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের সঙ্গে এ রাজ্যের কর্মীদের মহার্ঘভাতার ফারাক এখনও ৩৭ শতাংশ। কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মীরা ৫৫ শতাংশ হারে ডিএ পান। গত ১৬ মে সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়ে জানিয়েছিল, কর্মীদের বকেয়া ডিএ-র ২৫ শতাংশ পরের ছ’সপ্তাহের মধ্যে মিটিয়ে দিতে হবে। রাজ্য এখন সময় চাইল।
এই প্রসঙ্গে বঙ্গীয় শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী সমিতির সাধারণ সম্পাদক স্বপন মণ্ডল বলেন, ‘‘সরকার সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশকে অমান্য করে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বকেয়া ডিএ-র ২৫ শতাংশ তো দিলই না, উল্টে সুপ্রিম কোর্টে সময় চেয়ে মডিফিকেশন অ্যাপ্লিকেশন করেছে বলে শোনা যাচ্ছে। সরকার কি তা হলে আইন, আদালত কিছুই মানে না?’’ মূল মামলাকারী কনফেডারেশন অফ স্টেট গভর্নমেন্ট এমপ্লয়িজ়ের সাধারণ সম্পাদক মলয় মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘রাজ্য সরকার এই পদক্ষেপ করতে পারে বলে আমরা আগাম অনুমান করেই বৃহস্পতিবার রাত ১২টার পরে মুখ্যসচিবকে একটি নোটিস পাঠিয়েছি। আমরা যে আগামী দিনে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আদালত অবমাননার মামলা করব, সে কথা রাজ্য সরকারকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।” সিপিএমের রাজ্য সরকারি কর্মচারী সংগঠন কোঅর্ডিনেশন কমিটির নেতা বিশ্বজিৎ গুপ্ত চৌধুরী বলেন, “রাজ্য সরকার রাজ্যের সরকারি কর্মচারীদের অধিকারের টাকা আটকে রেখে মোচ্ছব করে বেড়াচ্ছে। যতই কৌশল করে আমাদের অধিকার কেড়ে দেওয়ার চেষ্টা করুন মুখ্যমন্ত্রী, তাতে আমাদের লড়াই থামবে না।’’ তৃণমূল সমর্থিত রাজ্য সরকারি কর্মচারী ফেডারেশন এ প্রসঙ্গে কোনও মন্তব্য করতে চায়নি। সরকারি কর্মচারীদের একাংশের আইনজীবী ফিরদৌস শামিম বলেন, ‘‘এই পদক্ষেপ আদালত অবমাননাকারী পদক্ষেপ। রাজ্য সরকারের উচিত সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশকে মান্যতা দেওয়া। আমার টাকা নেই বলার যুক্তি নেই। কারণ, কর্মচারীদের বেতন, পেনশন হচ্ছে স্থায়ী খরচ। মেলা-খেলা করে স্থায়ী খরচের অর্থ নষ্ট করেছেন তিনি।’’