আগাম পরিকল্পনা, প্রস্তুতি ওড়িশায় কাড়তে দিল না একটিও প্রাণ! ঘূর্ণিঝড়ের ‘দুর্বলতা’ও রক্ষার কারণ

ওড়িশার বুকে বুধবার রাতে ঘণ্টায় ১১০-১২০ কিলোমিটার গতিতে আছড়ে পড়েছিল ঘূর্ণিঝড় ‘ডেনা’। শুক্রবার সকাল ৭টা পর্যন্ত সেই ঝড়ের দাপট চলে। সেই দাপট কিছুটা কমতেই রাজ্যের কোথায় কত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, কোনও প্রাণহানি হয়েছে কি না, তার খোঁজখবর নেন মুখ্যমন্ত্রী মোহনতরণ মাঝি। তার পর তিনি জানিয়ে দেন, এই দুর্যোগে কারও প্রাণহানি হয়নি। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কতটা সে সম্পর্কে পুরো খতিয়ান না পেলেও, প্রাণহানি যে রুখে দিতে পেরেছেন, সেই বার্তাই দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।

কিন্তু কী ভাবে এই দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করে এই সাফল্য এল? এর নেপথ্যে কারণ বা কী? কী ভাবেই বা প্রাণহানি রুখতে প্রস্তুতি নিয়েছিল ওড়িশা সরকার? ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে ওড়িশার ‘দোস্তি’ নতুন বা বিচ্ছিন্ন কোনও ঘটনা নয়। পূর্ব ভারতের এই রাজ্য এর আগে অনেক ঘূর্ণিঝড়ের সাক্ষী থেকেছে। মূলত অক্টোবরেই বেশির ভাগ ঘূর্ণিঝড়ের সাক্ষী থেকেছে এই রাজ্য। পরিসংখ্যান বলছে, দেশের যে সব উপকূলীয় রাজ্য রয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়েছে ওড়িশায়। সেই সব দুর্যোগে অনেক মৃত্যুও দেখেছে পূর্বের এই রাজ্য। কিন্তু সময় যত গড়িয়েছে, আগের দুর্যোগ থেকে শিক্ষা নিয়ে পরে দুর্যোগে প্রাণহানি রুখতে চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছে প্রশাসন। একেবারে রুখে না দেওয়া গেলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রাণহানির সংখ্যা কমেছে।

১৯৯৯ সালের সুপার সাইক্লোনে ১০ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। কিন্তু তার পরবর্তীতে যে সব ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়েছে ওড়িশার বুকে, সেই দুর্যোগে মৃত্যু দুই সংখ্যার মধ্যেই থেকেছে। ২০১৩ সালে ঘূর্ণিঝড় ‘ফাইলিন’-এ ওড়িশায় মৃত্যু হয়েছিল ২৩ জনের। ২০১৪ সালে ঘূর্ণিঝড় ‘হুদহুদ’-এ মৃত্যু হয়েছিল তিন জনের। ২০১৮ সালে ‘তিতলি’র হানায় মৃত্যু হয়েছিল ৬২ জনের। ২০১৯ সালে ‘ফণী’তে মৃত্যু হয় ৬৪ জনের। কিন্তু ‘ডেনা’য় কারও মৃত্যু হয়নি বলেই দাবি করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মোহনচরণ মাঝি।

প্রশাসন সূত্রে খবর, বঙ্গোপসাগরে একটি ঘূর্ণাবর্ত সৃষ্টি হচ্ছে, এই বার্তা পাওয়ার পর থেকেই তৎপরতা শুরু হয় ওড়িশায়। জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী, রাজ্য বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী, দমকল, পুলিশ এবং জেলা প্রশাসনগুলির মধ্যে প্রস্তুতি নিয়ে বৈঠক হয়। শুধু তা-ই নয়, ঘূর্ণিঝড় যদি ওড়িশার দিকেই ধেয়ে আসে, এলে কোন কোন এলাকায় সেই ঝড়ের আছড়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকবে, সব কিছু পর্যালোচনা করে, দুর্যোগপ্রবণ এলাকাগুলিতে উদ্ধারকারী দল মোতায়েন করা হয়। এবং তা ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হওয়ার পাঁচ দিন আগেই। ফলে দুর্যোগপ্রবণ এলাকাগুলি থেকে দ্রুত মানুষজনকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে আশ্রয়শিবিরে নিয়ে যাওয়ার অনেকটাই সময় হাতে পেয়েছে প্রশাসন এবং উদ্ধারকারী দলগুলি।

প্রশাসন সূত্রে খবর, ঘূর্ণিঝড়ে কোনও প্রাণহানি যাতে না হয় তার জন্য যে পরিকল্পনা করা হয়েছিল, তার প্রথম বিষয়টিই ছিল দুর্যোগপ্রবণ জেলাগুলিকে চিহ্নিত করে সেখান থেকে মানুষজনকে নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠানো। সেই পরিকল্পনামাফিক ১০টি জেলাকে চিহ্নিত করা হয়। দেখা গিয়েছে, যতগুলি ঘূর্ণিঝড় হয়েছে ওই জেলাগুলিই বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে। প্রাণহানিও হয়েছে। ফলে ওই জেলাগুলিতে জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর ২০টি দল, রাজ্য বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর ৫১টি দল আগেভাগেই মোতায়েন করা হয়। শুধু তা-ই নয়, সেই ১০ জেলার মধ্যে যে জেলাগুলির উপর ঘূর্ণিঝড়ের সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ার আশঙ্কা ছিল তার সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরি করা হয়। সেই জেলাগুলি হল ভদ্রক, কেন্দ্রাপড়া, জগৎসিংহপুর, পুরী, বালেশ্বর এবং ময়ূরভঞ্জ। এই জেলাগুলিতে তদারকি করতে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ছ’জন আমলাকে। আর সেই ছয় আমলাকেই বাছা হয়েছিল জেলাশাসক হিসাবে যাঁদের এর আগেও ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলা করার অভিজ্ঞতা ছিল। ঘূর্ণিঝড় ‘ডেনা’র জন্মের পর সমুদ্র ধরে যত এগিয়েছে, অভিমুখ ধীরে ধীরে ওড়িশার দিকেই হয়েছে। ঘটনাচক্রে, সেই অভিমুখ ছিল কেন্দ্রাপড়া এবং ভদ্রকের দিকে। কেন্দ্রাপড়ার ভিতরকণিকা এবং ভদ্রকের ধামারার মাঝে বুধবার রাতে আছড়ে পড়ে ‘ডেনা’। যে জায়গায় আছড়ে পড়ে ‘ডেনা’ সেই এলাকা ঘনবসতিপূর্ণ। ঘটনাচক্রে, ওই এলাকা থেকে অনেক আগেই বাসিন্দাদের সরিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠানো হয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, রাজ্যের উপকূলবর্তী জেলাগুলি থেকে অন্তত ৬ লক্ষ মানুষকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ক্ষয়ক্ষতি এবং প্রাণহানি রুখতে আগেই ৮৩২২টি সাইক্লোন সেন্টার প্রস্তুত রেখেছিল ওড়িশা প্রশাসন। বৃহস্পতিবার রাত ১০টার মধ্যে দুর্গতদের অন্তত ৬০০৮টি সেন্টারে রাখা হয়।

প্রশাসনিক উদ্যোগ তো ছিলই, তার সঙ্গে ঘূর্ণিঝড় ‘ডেনা’র ‘দুর্বল’ গতি ‘ল্যান্ডফল’-এর প্রক্রিয়াটাও মৃত্যু এবং ক্ষয়ক্ষতির কম হওয়ার অন্যতম কারণ বলেও মনে করছেন আবহবিদেরা। সাধারণত ‘ল্যান্ডফল’-এর প্রক্রিয়া ৫-৬ ঘণ্টার মধ্যে শেষ হয়ে যায়। কিন্তু ‘ডেনা’র ক্ষেত্রে সেই প্রক্রিয়া চলেছে ৮-৯ ঘণ্টা ধরে। ফলে দীর্ঘ সময় ধরে এই প্রক্রিয়া ঝড়ের অভিঘাতকে অনেকটা ‘দুর্বল’ করে দেয়। তা ছাড়াও দু’টি বিপরীত ঘূর্ণাবর্ত পূর্ব এবং পশ্চিমে থাকায় ‘ডেনা’ খুব বেশি শক্তি সঞ্চয় করে উঠতে পারেনি।

ঝোড়ো হাওয়ার দাপটে অনেক সময়েই বড় বড় হোর্ডিং ভেঙে মৃত্যু কিংবা জখম হওয়ার ঘটনা ঘটে। সেই অভিজ্ঞতাকেও এখানে কাজে লাগানো হয়। উপকূলীয় জেলাগুলি থেকে সমস্ত বড় বড় হোর্ডিং, বিলবোর্ড খুলে নেওয়া হয়েছিল সতর্কতামূলক পদক্ষেপ হিসাবে। সরকারের তরফে গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে স্থানীয়দের দুর্যোগ সম্পর্কে নানা রকম ভাবে সচেতনতার পাঠ, কী ভাবে এই সময়ে উদ্ধারকাজ চালাতে হবে, নিরাপদ স্থানে সরে যেতে হবে, তারও প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। ফলে সেই অভিজ্ঞতাও এখানে কাজ করেছে। বছরে দু’বার এ বিষয়ে মহড়াও দেয় রাজ্য বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী। শুধু তা-ই নয়, উপকূলীয় জেলাগুলির ১২০০ গ্রামে সাইরেন বাজিয়ে ঘূর্ণিঝড় সম্পর্কে সচেতন করার ব্যবস্থাও রয়েছে। সব মিলিয়েই এ বার ‘ডেনা’র মোকাবিলায় আগেভাগে ভাল ভাবে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল ওড়িশা সরকার। যার জেরে প্রাণহানি রোখা সম্ভব হয়েছে বলেই মনে করছে রাজ্য প্রশাসন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.