কলকাতাকে কেন পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক পুনর্জাগরণের ‘মাস্টার কি’ হিসাবে ধরা হয়

ভারতের প্রতিটি নির্বাচন ই হ’ল ছোটখাটো একটা উৎসবের মতো— যুক্তিবাদী ভারতীয়দের কাছে স্বাভাবিকের চেয়ে আরও বেশী করে জীবন, পৃথিবী এবং সমস্ত বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সাথে বাগবিতণ্ডায় জড়ানোর সময়। পশ্চিমবঙ্গের​ আসন্ন নির্বাচনও এর ব‍্যতিক্রম নয়। বিতর্ক এবং বিবাদের মূল বিষয়বস্তু​ অবশ্যই হবে বর্তমান সরকারের অর্থনৈতিক কর্মদক্ষতার মূল‍্যায়ন।

রাজ্যের অর্থনৈতিক কর্মসম্পাদনের স্বাভাবিক সমালোচনার​ বিষয়গুলি মূলত এ’গুলির মধ্যেই থাকে — ১৯৬০ এর দশকে শিল্প ও অর্থনৈতিক দিক থেকে ক্ষমতার সর্বোচ্চ শিখরে থাকা রাজ‍্যটির অবস্থার অবনতি ঘটেছে ধীরে ধীরে এবং বর্তমানে পশ্চিম ও দক্ষিণের রাজ্যেগুলির তুলনায় তা আরও বেশী খারাপ জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে।

তবে, বাংলার অতীতের কার্যাবলীর দিকে তাকালে এটা স্পষ্টভাষায় বলা যায় যে আজ রাজ‍্যের অর্থনৈতিক অবস্থা প্রায় মুখ থুবড়ে পড়েছে। কিন্তু অন‍্যদিকে গত দুই দশকে​ প্রতিবেশী দেশ, বাংলাদেশের অগ্ৰগতি লক্ষ্যনীয় ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশ কোনও সাধারণ প্রতিবেশী দেশ নয় – ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, জনসংখ্যার এবং ভৌগলিক অবস্থানের দিক থেকে কমবেশী তারতম্য থাকলেও সাদৃশ্যও রয়েছে প্রচুর।

ঐতিহাসিকভাবে, বাংলার পশ্চিম অংশ (অবিভক্ত) সবসময়ই পূর্ব অংশের তুলনায় সম্পদ এবং অগ্রগতির দিক থেকে অনেক বেশী এগিয়ে রয়েছে।

যদিও গত ১০-১৫ বছরে বাংলাদেশ, সাধারণ মূল্যায়িত অর্থনৈতিক সূচকের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই​ পশ্চিমবঙ্গকে ছাপিয়ে গেছে — মাথাপিছু আয় (পশ্চিমবঙ্গের ১,৫০০ ডলার, সেখানে বাংলাদেশের​ প্রায় ২,০০০ ডলার), উৎপাদন (বাংলাদেশের​ জিডিপি বা গ্ৰস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট ৩৪ শতাংশ অন‍্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের​ জিডিপি ২০ শতাংশ)। জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি ( বাংলাদেশে, গত দশ বছরে গড়ে ৭ শতাংশ এবং পশ্চিমবঙ্গ সেখানে ৫ শতাংশে রয়েছে)।

অর্থনৈতিক বৃদ্ধির​ মান ধরা হয় মানব উন্নয়ন সূচক (এইচডিআই)-এর মাধ্যমে —এবং সেদিক থেকে দেখতে গেলে আজ বাংলাদেশ পশ্চিমবঙ্গের মতো আরও অনেক দেশের থেকেই​ অনেকাংশে এগিয়ে রয়েছে। সাংস্কৃতিকভাবে​ অনেক দিক থেকে পিছিয়ে থাকা সত্ত্বেও আজ ঐতিহ্যবাহী বাঙালি শক্তি-সমীকরণের এই উলোট পুরান বাংলাদেশকে একটি পৃথক দেশ হিসাবে বিশ্বের মানচিত্রে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। অন‍্যদিকে দীর্ঘকাল ধরে পশ্চিমবঙ্গের দীর্ঘসূত্রিতার ফলে প্রতিবেশী দেশের থেকে এক সম্পূর্ণ ভিন্ন ছবি এখানে দেখা যায়।

ন্যায়সঙ্গতভাবে বলতে গেলে, বাংলাদেশ শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গের জন্য বরং সমগ্ৰ ভারতের পক্ষেই ঈর্ষার কারণ হয়ে উঠেছে।

২০২০ সালে, মাথাপিছু আয়ে বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে। প্রায় এক দশক পর ভারতের আয়ের বৃদ্ধির হার এইভাবে হ্রাস পেয়েছে।

সর্বোপরি এটা পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে আকস্মিক পতনের মত কারন মাথাপিছু আয়ের এই পরিসংখ্যানে ৩৩টি রাজ‍্যের মধ‍্যে একদা প্রায় শীর্ষে​ থাকা রাজ‍্যটিকে বর্তমানে একধাক্কায় একুশতম স্থানে নামিয়ে এনেছে।

রাজ্যের জন্য এটা অনেকটা “ভালুকের কেস”-এর মতো, তাই খুব সহজেই তৈরি করা হয়। যদিও এখনো সবটা শেষ হয়ে যায়নি।

ঐতিহাসিকভাবে, রাজ্যের বৃহত্তম সম্পদটি হল কলকাতা শহর। শিল্পকলা, বাণিজ্য, রাজনীতি এবং আরও অনেক কিছুর কেন্দ্রস্থল হয়ে রয়েছে এই শহর – মূলত (অবিভক্ত) বাংলার জন্য এবং সর্বোপরি বাঙালিদের​ জন্য।

জিডিপির দিক থেকে বিচার করলে আশ্চর্যজনকভাবে কলকাতা এখনও ভারতের অন্যতম ধনী শহর – একটি সার্ভে তে দেখা গেছে যে বর্তমানে মুম্বই ও দিল্লির পরেই দেশের তৃতীয় ধনী শহর হ’ল কলকাতা এবং পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতির পুনর্জাগরণের ক্ষেত্রে মূলভিত্তি হ’ল এই শহর।

প্রকৃতপক্ষে, শহরকে উন্নয়নের মাপকাঠি হিসাবে ধরা হয় আর সারা দেশের নগরায়নের মাধ্যমে বোঝা যায় যে গোটা বিশ্বের মধ্যে একটা দেশের​ কতটা অগ্ৰগতি ঘটেছে। এই একই কথা ভারতেও জন‍্যেও প্রযোজ্য। বৃহত্তর নগরায়ণ দেশকে করে তোলে আরও বেশী সমৃদ্ধশালী।

রাজ্যের​ পুনরুজ্জীবনের সমস্ত কলকব্জা রয়েছে​ কলকাতা এবং তার আশেপাশের অঞ্চলে। পুরো ব‍্যাপারটা শুধুমাত্র বাহ‍্যিক পরিকাঠামো নিয়ে নয় কারণ দেশের বেশ কয়েকটি তথাকথিত উন্নত বা প্রগতিশীল শহরে পরিকাঠামোগত অনেক সমস্যা রয়েছে – যেমন বেঙ্গালুরুর ট্র্যাফিকের​ অবস্থা ভীষণ খারাপ, দিল্লির আইনশৃঙ্খলার অবস্থা আরও খারাপ, সমানভাবে মুম্বাইয়েরও গণপরিবহন অত‍্যধিক চাপযুক্ত।

একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর হিসাবে কলকাতা তার মূল বৈশিষ্ট্যগুলি ধরে রেখেছে এবং সেটা শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গের​ জন্য নয়, বরং পুরো “কানপুরের পূর্ব” অংশ এবং সম্ভবত মেকং নদীর বদ্বীপ পর্যন্ত।

কলকাতা এই অঞ্চলের একমাত্র শহর যেখানে প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পের​ পরিকাঠামোসহ, অর্থনৈতিক এবং অন্যান্য সমস্ত রকমের সুবিধা রয়েছে।

কলকাতায়​ দেশের কয়েকটি সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে – ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট, ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইনস্টিটিউট, ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ জুরিডিকাল সায়েন্সেস, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (খড়গপুরে, মাত্র কয়েক মাইল দূরে)।

পূর্বাঞ্চলের অন‍্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর হওয়ার দরুণ এখানে শীর্ষস্থানীয় আর্থিক পরিষেবা সংস্থাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও জাতীয় বানিজ্যিক সংস্থা রয়েছে।

এর পাশাপাশি রয়েছে ভূ-অর্থনীতিতে বিভিন্ন সিস্টেমেটিক পরিবর্তন – আঞ্চলিক সংযোগস্থলে জিএসটি ড্রাইভিং একীকরণ, বাংলাদেশ ও মায়ানমারের সাথে সংযোগ প্রকল্প এবং ভারতের “লুক ইস্ট” প্রকল্প – এই সমস্ত পরিবর্তনের কেন্দ্রস্থল হিসাবে কলকাতার ভূমিকা অনস্বীকার্য।

এই শহরটি পূর্বের চিকিৎসা-পর্যটনের অন‍্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র— বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের রোগীরাও উন্নত চিকিৎসার জন্য কলকাতায় আসেন।

পরিশেষে বলা যায় যে, কলকাতা হ’ল সংগীত, চলচ্চিত্র, শিল্পকলা তথা সাস্কৃতিক-বিনোদনের পীঠস্থান। সংক্ষেপে বলতে গেলে, কলকাতা আসলে রাজ‍্য তথা দেশের শক্তির উৎসস্থল।

রাজ্যের এখন যা সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন তা হ’ল লক্ষ্য স্থির করা এবং বিনিয়োগই হবে তার মূল সম্পদ।

স্টিল প্লান্টের পাশাপাশি গুদামগুলিকে করের ব‍্যাপারে ছাড় দেওয়া বা অন্য একটি উদাহরণ হিসাবে বলা যায় যে মহাসড়ক বা বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের উচিত পক্ষপাতিত্ব বন্ধ করা। শিল্প নীতিকে যথাযথ ভাবে প্রয়োগ করার পাশাপাশি কলকাতায় ” নিউ ডেভেলপমেন্ট ফিনান্স ইনস্টিটিউট” (ডিএফআই) স্থাপনের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে মামলায় জড়িয়ে না পড়া— রাজ্যের মধ্যে শহরের ভীত মজবুত করার জন্য এইসব বিষয়গুলির​ দিকে বিশেষ নজর দেওয়া একান্ত প্রয়োজন।

উপযুক্ত জায়গায় সঠিক বিনিয়োগ পশ্চিমবঙ্গের বৃহত্তম সম্পদ ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করবে। একবার যদি কলকাতায় সমস্ত বাঙালি প্রতিভারা আবার একত্রিত হয় তাহলে অগ্ৰগতি হবে স্বাভাবিক ছন্দে এবং পথও হয়ে উঠবে মসৃণ।

দীর্ঘদিন ধরে, রাজ্যের নীতিনির্ধারকরা অর্থনীতিকে সুদৃঢ় করার জন্য মূল চালিকাশক্তি​ হিসাবে উৎপাদন শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করার কাজে মনোনিবেশ করেছেন। যদিও সেক্ষেত্রে পরিকাঠামোগত বেশ কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।

উর্বর জমি সহ একটি ঘন-জনবহুল রাজ‍্যে অনেক বেশি পরিমাণে জমি-অধিগ্রহণ করার কাজটি বর্তমানে একটা বড় রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সাম্প্রতিক অতীতের অভিজ্ঞতাগুলি থেকে স্পষ্ট ভাবে বলাই যায় যে তেমন কোনো রাজ‍্যই আদপে বেসরকারী কর্পোরেট সেক্টরে​র জন্য অনুকূল বা “ইন্ড্রাস্ট্রি ফ্রেন্ডলি” নয়।

বৃহৎ কল্যাণমূলক প্রতিশ্রুতি, রাজ্যের​ সীমাবদ্ধতা​ এবং সরকারী খাতের উপর নির্ভরশীলতা মূলত কম সংস্থানের​ দিকেই ইঙ্গিত করে।

সংক্ষেপে বলা যায় যে, কলকাতায় এবং আশেপাশের অঞ্চলে নতুন গাড়ি উৎপাদনকারী ইউনিট বানানোর সাথে সাথেই শিল্প স্থাপনের ক্ষেত্রে নতুন ধরনের কৌশল অবলম্বন করা আরও বেশী বাস্তবসম্মত হবে।

বাংলার গৌরবময় দিন বলতে সেইসব দিনগুলোকে বোঝায় যখন ভারত অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক দিক থেকে ছিল সমৃদ্ধশালী। তখন বড় বড় শিল্পপতিরা কলকাতায় বসবাস করতেন, তাঁদের কর্মস্থল ছিল এখানে, যারফলে রাজ‍্য তথা দেশ হয়ে উঠেছিল উন্নত, উন্নয়নশীল। অতীত গৌরবের​ পুনরুদ্ধারের জন্য আবারও শহরের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করা প্রয়োজন।

সোমনাথ মুখার্জী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.