দক্ষিণ কলকাতা l রাজ্যের সবচেয়ে অভিজাত মানুষের বাস l স্বাধীনতার পর প্রায় সব সরকারের বেশিরভাগ ক্ষমতাবান নেতা, আমলা, প্রযুক্তিবিদের বাস l শিক্ষা স্বাস্থ্য সবকিছুতেই এগিয়ে l বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক থেকে কর্পোরেট ব্যক্তিত্ব সবাই স্বাধীনতার পর আস্তানা বানায় এই দক্ষিনেই l হাতিবাগান, ফরিয়াপুকুরের অভিজাত থেকে সফল উদ্বাস্তু পরিবারের মানুষের নতুন ঠিকানা হয় লেকের ধার থেকে ভবানীপুরের বনেদীপাড়ায় তৈরি হওয়া বহুতল l
এরসঙ্গে শহর ছাড়ে উষা, বেঙ্গল ল্যাম্প, সুলেখার শ্রমিক এবং সেখানে জায়গা পায় টালিউডের অভিনেতা, অভিনেত্রী থেকে বন্ধ হওয়া কারখানার ফুলে ফেঁপে উঠা শিল্পপতি l
একসময় পাঞ্জাবী, গুজরাটিরা ভবানীপুরে এবং দক্ষিণভারতীয়রা রাসবিহারীতে এসেছিলেন কাজের আশায় l আজ কলকাতায় কোন সর্দারজিকে ট্যাক্সি চালাতে দেখা যায় না l বন্ধ হয়ে গেছে শরত বোস রোডের সাউথ ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট l তাঁর বদলে অবশ্য খুলেছে আয়ূধ বিরিয়ানি কিংবা ঢাকাই বিরিয়ানির ঢালাও দোকান l পশ্চিমবঙ্গের দেনোগ্রাফি পরিবর্তনের একটা ক্ষুদ্র সংস্করণ দক্ষিণ কলকাতার রেস্টুরেন্টের চরিত্র পরিবর্তন l
কিন্তু আজ দক্ষিণ কলকাতার সেই কৌলিন্য বৃদ্ধাশ্রমে পরিণতি পায় l কেন?
1966 তে ইন্দিরা গান্ধীতে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের তাড়িয়ে যখন স্বদেশী মধ্যসত্ত্বভোগীদের হাতে ডানলপ, শা ওয়েলস থেকে হাজার হাজার পাট কল থেকে চা বাগান তুলে দিলেন, সবার প্রথমে কমতে শুরু করলো শিক্ষিত মানুষের চাহিদা l দেশি শিল্পপতিদের কাছে ব্যাবসার প্রশাসন চালানোর জন্য আর প্রেসিডেন্সি বা শিবপুরের স্নাতকের দরকার হল না l তাঁদের ভাগ্নে, ভাইপো, পুত্ররাই ব্যাবসার দায়িত্ব নিল l সঙ্গে হারালো আন্তর্জাতিক বাজার l সংকুচিত হতে থাকল তাঁদের সংস্থা ও ব্যবসা l শ্রমিক অসন্তোষ বাড়লো l উচ্চপদস্থরা রাজ্য ছাড়ল l বাকিদের অবস্থা জানতে হলে জনঅরণ্য, ইন্টারভিউ, চৌরঙ্গী কিংবা কলকাতা 71 দেখলেই বোঝা যাবে l এই বিপদের দিনে রাজ্যে উঠে এলো চারটি নতুন নায়কের নাম l জ্যোতি বসু, চিত্তব্রত মজুমদার, ( সিপিম ) সুবোধ ব্যানার্জী(Suci ) এবং চারু মজুমদার ( নক্সাল ) l শুরু হল ব্রেন ড্রেন l
যে রাজ্যকে কেন্দ্র সরকার প্রথম IIT, IIM দেবার পরেও, গত 20 বছরে গড়ে 5% ক্যাম্পাস চাকরিও এক শহরে হয় না, সেখানে অভিজাত এলাকা তো বৃদ্ধাশ্রম হবেই l প্রতিটি বাড়িতে বয়স্ক মানুষ অপেক্ষা করেন কখন ক্যালিফোর্নিয়া, লন্ডন, দিল্লি বা ব্যাঙ্গালোর থেকে তাঁদের সন্তানের ফোন আসবে একবার l কেমন আছো বাবা? কেমন আছো মা? ভয় হয় মৃত্যুর পর তাঁরা সৎকারের জন্য উপস্থিত হতে পারবে তো? সঙ্গে আছে এমন কিছু বাবা মা, যাদের সন্তান PSC, SSC পরীক্ষার জন্য বোসে আছে বহুবছর, কিন্তু পরীক্ষা আর হল না l সঙ্গে আছে এমন কিছু মাঝবয়সী যুবক যুবতী, যারা একসময় নিজের উদ্যোগে ব্যবসা শুরু করেছিল বটে, কিন্তু পেমেন্ট না পেয়ে ভিখারী হয়ে বাবার তৈরি বাড়িতে ব্যাংকের জমা টাকার সুদে মাস চালাচ্ছে l গত পাঁচ বছরে টিভিতে রাইস মইএস বা জর্জ টেলিগ্রাফের বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়ে গেছে l বহু বেসরকারী ইঞ্জিনারিং কলেজ বন্ধ l IIT ইঞ্জিনিয়ার থেকে চাষী, সবাই পরিযায়ী l
তবে এরা ছাড়াও একদল মানুষ আছে যারা সফল l তাঁরা রাজনীতি, অবৈধ প্রোমোটারি, সিন্ডিকেট, টালিগঞ্জ ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে তোলাবাজি, কলেজে ছাত্র ভর্তি করে কাটমানি কিংবা 2014 তে টেট কেলেঙ্কারিতে ঠিক লোককে ঠিক দক্ষিনা দিয়ে পাওয়া সরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষক l গত দশ বছর কোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাইমারী কোথাও কোন লোক নেয়া হয় নি l তাঁর মধ্যে যারা সুযোগ পেয়েছে, তাঁদের নেপোয় দৈ l
এরমধ্যে আছে টালিগঞ্জ ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি l নায়ক নায়িকা থেকে টেকনিসিয়ানদের কাজ করিয়ে পয়সা না দেয়া এই ইন্ডাস্ট্রিতে স্বাভাবিক ঘটনা l ” চান্স তো দিলাম, পয়সাও চাই” l পুরোটাই দুজনের নিয়ন্ত্রণে l জেলে থাকা শ্রীকান্ত মোহতা এবং অরূপ বিশ্বাস l যখন মমতা ব্যানার্জী খবর পায় দেব একটা সমান্তরাল চিন্তা করছে, দেবকে বাধ্য করা হয় তৃণমূলের হয়ে ভোটে দাঁড়াতে l ফিরহাদ হাকিমের একটা টেপ থেকে জানা যায়, দেব নাকি মমতার পায়ে ধরেছিল.l উনি বলেন, “ভোটে না দাঁড়ালে আমাকে দিদি বলো না”, অর্থাৎ তোমার জন্য টালিউডের দরজা বন্ধ l গত কয়েকবছর বাংলা চলচ্চিত্রের বিপণন এরাই নিয়ন্ত্রণ করে l মেগা হিট ছবি চাঁদের পাহাড় বা আমাজন অভিযান বানিয়ে, সেটিকে মোহতার কাছে বিক্রি করতে হয় দেব কে l কারণ মোহতা তো নামে মালিক l পিছনে তো অন্য কেউ l
এবার আসা যাক পরিকাঠামো l গড়িয়া-এয়ারপোর্ট মেট্রো 12 বছরেও একটা স্টেশন পুরো বানাতে পারলো না l কলকাতা বন্দর মাফিয়াদের হাতে মৃত l রুবি বজবজ মনোরেলের গল্প প্রতিবার ভোটের আগে আসে, ভোটের পর গায়েব l দক্ষিণ কলকাতা থেকে নিউটউন দৈনন্দিন যাতায়াত এক বিরাট সময় সাপেক্ষ ব্যাপার l গাড়িয়া থেকে ঢাকুরিয়া ওভারব্রিজ তৈরি হল না l গত 12 বছরে দিল্লিতে দেড়শো মেট্রো স্টেশন তৈরি হয়েছে l.কিন্তু দিদির জামিনীতির জন্য এখানে মাত্র 11 l
শিক্ষা? একসময় যাদবপুর, আশুতোষ, বালিগঞ্জ বিজ্ঞান কলেজ থেকে, APC পলিটেকনিক, ITI বালিগঞ্জ এই এলাকাকে ভারতের শিক্ষার মানচিত্রে উজ্জ্বল জায়গা করে দিত l শিল্পহীন রাজ্যে আজ সব ম্লান l তারসঙ্গে বহুবছর সেই এক মান্ধাতার আমলের সিলেবাস এবং রাজনৈতিক ভাবে নিযুক্ত শিক্ষক l এর উপর দিদিমনি অধ্যাপকদের অবসরের বয়স বাড়ালেন l শিক্ষিত সমাজ রাজ্যের বাইরে l শিক্ষা মধ্যবিত্তের হাতের বাইরে l মমতা ব্যানার্জী বেসরকারী স্কুলগুলিকে ডেকে ফী কমাতে বলেন l পরের মাসেই গড়ে 10% ফি বাড়ায় অধিকাংশ বেসরকারী স্কুল l কারণ ওটা হরিশ মুখার্জী রোডের জন্য বরাদ্দ হয় l অনলাইন ভর্তি চালু করতে গিয়ে শিক্ষামন্ত্রী পদ হারান ব্রাত্য বসু l এখন অবৈতনিক কলেজে ভর্তির জন্য কাটমানি লাখ ছুঁই ছুঁই l
আর স্বাস্থ্য l পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম এই বৃদ্ধাশ্রমের ভরসা বাইপাসের পাশের হয় কসাইখানা, নয় ভেলোর l সরকারি স্বাস্থ্যব্যাবস্থা ভেঙে পড়েছে l তবু, এদের পয়সা আছে l গ্রামবাংলার মত অসহায় মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়তে হয়না l রাজ্যে মাত্র একটা ট্রমা কেয়ার l অর্থাৎ রাস্তায় দুর্ঘটনা হলে হয় মৃত্যু নয় বাইপাসের পাশের হাসপাতালে ঘটি বাটি বেচো l কয়েক বছর আগে আপেলোতে মারা যায় এক যুবক l তাঁর স্ত্রীকে সরকারি চাকরি দেয় দিদি l এরপর বাইপাসের প্রতিটি হসপিটাল তাঁদের রেট এতটাই বাড়ায় যে প্রত্যেক কলকাতাবাসীকে তাঁদের ইন্সুরেন্স প্রিমিয়াম বাড়াতে হয় l
দক্ষিণ কলকাতা বরাবর কংগ্রেসিদের গড় l এতটাই যে হৈমী বসুর মৃত্যুতে শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় বারুইপুর ছেড়ে চলে আসেন রাসবিহারীতে l চৌরঙ্গীতে হেরে তৃণমূলে ফিরে সুব্রত মুখার্জী বেছে নেন বালিগঞ্জ l মমতা ব্যানার্জী বাছেন ভবানীপুর ও কলকাতা পোর্ট ববি হাকিম l তাহলে এবার শোভনদেব সরে গেলেন কেন রাসবিহারী থেকে? কেন সরে গেলেন মমতা ভবানীপুর থেকে? দক্ষিণ কলকাতা অন্যভাবে ভাবছে l 1991 পর্যন্ত দক্ষিণ কলকাতা একজন সাংসদকে দুবার জেতায় নি l কিন্তু 1991 এর পর থেকে তো দক্ষিণ কলকাতা মমতার l
কিন্তু কি পেল 1991 এর দম্পতি? কেন তাঁর সুখের গৃহপরিণত হল বৃদ্ধাশ্রমে? 2019 শেও তাঁরা ফেরেননি তৃণমূলকে l কিন্তু এবার বিধায়করা সবাই পালালেন l কেন? তৃণমূলের নেতারা কি ধরে বুঝতে পেরেছে যে দক্ষিণ কলকাতার মানুষের মনের কথা? যে দক্ষিণ কলকাতা অসীমকৃষ্ণ দত্ত, বীরেন সেন, রণেন সেন, প্রিয়দাশমুন্সি, গণেশ ঘোষ, দিলীপ চক্রবর্তী, ভোলা সেন, সত্যসাধন চক্রবর্তী, বিপ্লব দাশগুপ্তদের মত তাবড় নেতাদের দ্বিতীয়বার জায়গা করে দেয় নি, তারা মমতার দলকে সাতবার জায়গা করে দেয় l এমনকি 2004 এ যখন সবাই হারে, তখনও একা মমতাকে লোকসভায় পাঠায় দক্ষিণ কলকাতা l.তাঁর বদলে উপহার এই বৃদ্ধাশ্রম? এবার সম্ভবতঃ মন পরিবর্তন করেছেন দক্ষিণ কলকাতার মানুষ? আর তাই বিধানসভা কেন্দ্র পরিবর্তন করতে উদ্ধত তৃণমূলের বিধায়করা।
- সুদীপ্ত গুহ