১ জুন থেকে পশ্চিমবঙ্গে মুখ্যসচিব ও স্বরাষ্ট্রসচিব পদে কোনও ‘ভূমিপুত্র’ থাকছেন না। প্রশাসনের উর্দ্ধতম দুটি পদেই ‘বহিরাগত’ আমলা এই প্রথম। অবশ্যই নিয়ম মেনে এঁরা পশ্চিমবঙ্গ ক্যাডারের আইএএস অফিসার। কিন্তু বাঙালি আইএএস-আইপিএস অফিসারের সংখ্যা কমতে কমতে যে অবস্থায় চলে এসেছে, তাতে এই ছিল বুঝি ভবিতব্য। ভারতের সব রাজ্যেই প্রশাসনের শীর্ষস্তরে ভিন রাজ্যের আমলা মোতায়েন হন। এটা নতুন কিছু নয়। ভারতের প্রথম আইসিএস ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। এর পরেও কিছু নামী বাঙালি আইসিএস হয়ে সর্বভারতীয় স্তরে প্রশাসনে সুনাম কুড়িয়েছেন। ১৯৫০-এর ২১ মার্চ থেকে ১৯৫৮-র ১৯ ডিসেম্বর দেশের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার ছিলেন সুবিমল সেন।  কী গভীর নিষ্ঠা ও প্রত্যয়ের সঙ্গে ভারতের প্রথম নির্বাচনের কাঠামো তৈরি করে বিষয়টিকে গ্রহণযোগ্য করেছিলেন, তা নিয়ে নানা কাহিনী আছে।এর পরেও অন্তত ২৫ বছর ভারতে কেন্দ্রীয় স্তরে বাঙালি প্রশাসকদের আধিপত্য ছিল। স্বাধীনতার পর থেকে রাজ্য প্রশাসনে বাঙালি আইএএস-দের দাপট ছিল। অতীতে পশ্চিমবঙ্গে অবাঙালি মুখ্যসচিব হিসাবে দু’জনের নাম মনে করতে পারলেন বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০১২ থেকে ‘১৫ তিন বছর পশ্চিমবঙ্গের স্বরাষ্ট্রসচিব  এবং ‘১৫ থেকে ‘১৭ মুখ্যসচিব ছিলেন বাসুদেববাবু। তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, “জ্যোতি বসুর আমলে নারায়ণন কৃষ্ণমূর্তি স্বরাষ্ট্রসচিব থেকে মুখ্যসচিব হয়েছিলেন। এছাড়া তৃণমূল আমলে মুখ্যসচিব হয়েছেন রাজীব সিনহা।“ সুপরিচিত আমলা জহর সরকারের কথায়, “আমি যখন নিতান্তই তরুণ, তখন তিন জন রায়-এর নাম শুনতাম নিয়মিত— এ কে রায়, কে কে রায় এবং এইচ এন রায়। কেন্দ্রে অত্যন্ত সম্মানিত সচিব ছিলেন তাঁরা। প্রবাদপ্রতিম সুবিমল দত্ত ও অশোক মিত্র তো ছিলেনই। গোপাল দত্ত বা বিশ্বেশ্বর চট্টোপাধ্যায়ের মতো বাঘা আইপিএস অফিসার ছিলেন। কাশ্মীর ক্যাডারের সুশীতল বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিরক্ষা মন্ত্রকে সচিব পদে ছিলেন। সুবোধ ঘোষ, অমল দত্ত, এবং অতি অবশ্যই ডি বন্দ্যোপাধ্যায়, নীতীশ সেনগুপ্ত আর ভাস্কর ঘোষের কথা মনে পড়ছে। পঞ্জাবের আধা-বাঙালি এন কে মুখোপাধ্যায় সত্তরের দশকের মাঝামাঝি অন্যতম ক্যাবিনেট সচিব ছিলেন। টি এন সেশন এসে তাঁর স্মৃতি মুছে দেওয়ার আগে পর্যন্ত দোর্দণ্ডপ্রতাপ নির্বাচন কমিশনার হিসেবে এস পি সেন বর্মার নামও দিল্লিতে বহুআলোচিত ছিল। এ ছাড়াও ছিলেন দুই শর্মা সরকার ভাই, এক জন ইউপিএসসি-র চেয়ারম্যান, আর অন্য জন দেশের আইন শাখার শীর্ষে।“বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় এই প্রতিবেদককে বলেন,“১৯৮৩ সালের ব্যাচেও বাঙালি আইএএস ছিলাম সাত জন। আমি ছাড়াও রঞ্জনা (মুখার্জি) ছিলাম প্রেসিডেন্সির। দেবাশিস সোম আইআইটি খড়্গপুরের। চার জন প্রবাসী। পরে প্রশাসনের উচ্চস্তরে বাঙালির সংখ্যা কমে আসে।“ কেন তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, “ক্রমে নানা কারণে বাঙালি মেধাবীরা ক্রমেই বেশি মাত্রায় গবেষণা এবং বিজ্ঞান-প্রযুক্তির বিভিন্ন শাখায় ছড়িয়ে পড়তে থাকে। সর্বভারতীয় প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বসার প্রবণতা কমে যায়।“২০১৪-তে এ রাজ্যের অন্যতম সুপরিচিত আইএএস জহর সরকার জানিয়েছেন, “বছর কয়েক আগে আমি যখন ভারত সরকারের সংস্কৃতি সচিব ছিলাম, তখন পশ্চিমবঙ্গ ক্যাডারের তিন জন অফিসার কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রকে সচিব পদে ছিলেন। বাঙালি, কিন্তু অন্য রাজ্যের ক্যাডারের অফিসার, এমন কয়েক জন ছিলেন অর্থ মন্ত্রকে, যোজনা কমিশনে। উত্তরপ্রদেশ ক্যাডারের পুলক চট্টোপাধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর সচিব হয়েছিলেন। ফিকি-তে ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র। সিআইআই-এর প্রধান ছিলেন তরুণ দাস। দু’জন নন-আইএএস সচিব ছিলেন বিজ্ঞানবিষয়ক মন্ত্রকে— এক জন পারমাণবিক শক্তি দফতরের খুবই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে, আর অন্য জন সিএসআইআর-এ। বস্তুত, সে সময় আমার এক বন্ধু দিল্লিতে বিভিন্ন দফতরে ক্ষমতার শীর্ষে থাকা বাঙালিদের একটা তালিকা তৈরি করেছিলেন। এক ডজনেরও বেশি নাম ছিল সেই তালিকায়। আর, কেন্দ্রীয় সরকারের দ্বিতীয় সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী হিসেবে প্রণববাবু তো ছিলেনই। অনেকে অবশ্য ‘দ্বিতীয়’ শব্দটির বদলে বলবেন, বহু বছর ধরে তিনিই ছিলেন মন্ত্রিসভার সবচেয়ে ক্ষমতাবান সদস্য। প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি ছিলেন, ছিলেন আরও জনাছয়েক বাঙালি প্রতিমন্ত্রী।“এর পর সাত বছরে প্রশাসনের শীর্ষে বাঙালিদের পরিস্থিতির আরও নেতিবাচক হয়েছে। কেন এই হাল? বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, “আইএএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়াটা কিন্তু সত্যি খুব কঠিন। ৪ লক্ষ জন হয়ত বসছে প্রিলিতে। তার তেকে ১৫ হাজার মেনে। তার থেকে বাছাই করে ৭০০। তারও মধ্যে হয়ত ১০০ আইএএস, বাকিরা অন্য সার্ভিসে। এই ১০০-র মধ্যে হয়ত ৫০ সংরক্ষিত পদ। তার মানে কতটা শক্ত এবং প্রস্তুতির প্রয়োজন ভেবে দেখুন!“এই প্রস্তুতির ব্যাপারটা যে যথেষ্ঠ গুরুত্বপূর্ণ, তা মনে করিয়ে দেন ১৯৭৫ ব্যাচের আইপিএস তথা রাজ্যের প্রাক্তন অতিরিক্ত ডিজি চয়ন মুখোপাধ্যায়। এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, “দিল্লিতে প্রচুর কোচিং সেন্টার। গোটা দেশের উচ্চাকাঙ্খী অনেক ছেলেমেয়ে আইএএস হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে আসে। এই সমাবেশ একটা ইতিবাচক ও প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব তৈরি করে। যার অভাব রয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। তাছাড়া, প্রশাসনের উচ্চতম স্তরে প্রাদেশিকতা নয়, কটা শূন্য পদ রয়েছে, সরকারি নিয়মকানুন, দক্ষতা— এ সব বিষয় প্রাধান্য পায়। এই যেমন আলাপন যখন মুখ্যসচিব হয়, তখন আরও এক বাঙালি আমলা ওই পদের যোগ্য এবং ‘কন্টেন্ডার’ ছিলেন— দেবাশিস সেন। মুখ্যমন্ত্রী আলাপনকে বেশি যোগ্য মনে করেছেন। সেটা হতেই পারে।“চয়নবাবুর মতই আমলাতন্ত্রে ভিন রাজ্যের আইএএস থাকা, না থাকার বিষয়টিকে খুব একটা বিচার্য নয় বলেই মনে করেন অন্তরা আচার্য। অপেক্ষাকৃত নবীন, ২০০৬-এর আইএএস অন্তরা এই প্রতিবেদককে বলেন, “এটা ঠিক মাঝে বেশ ক’বছর আইএএস পরীক্ষায় বাঙালিদের আগ্রহ কম দেখা গিয়েছে। এখন পরিস্থিতি অপেক্ষাকৃত ভাল হয়েছে।“সব মিলিয়ে প্রশাসনে বাঙালিদের কৌলিন্য উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে।রাজ্যে কর্মরত বেঙ্গল ক্যাডারের কোনও আইএএস-আইপিএসকে কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রকের সচিব বা ডিজি পদমর্যাদার পদে নির্বাচিত করেনি কেন্দ্রীয় সরকার। গত ১১ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার নিয়োগ সংক্রান্ত কমিটি যে তালিকা প্রকাশ করে, তাতে দিল্লিতে আধা সামরিক বাহিনী বা অন্য কেন্দ্রীয় পুলিশ বাহিনীর ডিজি পদে উন্নীত হন ১৯৮৮ ব্যাচের জুলফিকার হাসান এবং রামফল পাওয়ার। এঁরা দু’জনেই রাজ্য ক্যাডারের আইপিএস হলেও পশ্চিমবঙ্গে কর্মরত নন। এই রাজ্যে কর্মরত ১৯৮৮ ব্যাচের অন্য আইপিএসরা রাজ্যে ডিজি হলেও দিল্লিতে সেই পদের যোগ্য বলে বিবেচিত হননি।আইএএসদের ক্ষেত্রেও কেবলমাত্র ১৯৮৯ ব্যাচের এস কিশোর কেন্দ্রীয় মন্ত্রকের সচিব পদের জন্য নথিভুক্ত হন। ওই ব্যাচের আর এক অফিসার চন্দন সিংহ সচিবস্তরের কোনও পদের জন্য নথিভূক্ত হন। এই দু’জনেও রাজ্য ক্যাডারের আইএএস হলেও তাঁরা রাজ্যে কর্মরত নন। রাজ্যের অন্য কোনও অফিসার কেন্দ্রীয় পদের জন্য বিবেচিত হননি। গত তিন বছর ধরে রাজ্যের আইপিএসরা স্বাধীনতা দিবস বা প্রজাতন্ত্র দিবসে রাষ্ট্রপতির পুলিশ পদকও পান নি। মূলত তৃণমূল স্তরের অফিসারদের একাংশ পদক পেলেও আইপিএস অফিসারদের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়েনি। অভিজ্ঞরা মোটামুটি একমত দুই শীর্ষ আমলার পদ প্রাদেশিকতা বা রাজনীতির উর্দ্ধে। বাসুদেববাবুর মত, “সাধারনত একটা নির্দিষ্ট অনুপাত নিজস্ব রাজ্যের আমলাদের জন্য বরাদ্দ রাখার চল। কিন্তু সেরকম অফিসার না এলে বা না পেলে আর কী করার?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.