‘সোনা’ বলতে কী বুঝি? সোনা মানে উত্তম গুণ, সোনা মানে শ্রেষ্ঠত্ব৷
প্রাচীন বঙ্গের নিদর্শন চর্যাপদে পাচ্ছি — “সোনা ভরিতী করুণা নাবী/রূপা থোই নাহিক ধাবী।” সোনায় নৌকো ভরেছে, রূপার জন্য আর স্থান নেই।
আমরা বলি ‘সোনার ছেলে’, ‘সোনার মেয়ে’। লৌকিক ছড়ায় শিশু হয়ে যায় ‘সোনা’। সেই রকম সোনার মাটি, সোনার ফসল, সোনার গৌর। “হৃদ্ মাঝারে রাখবো ছেড়ে দেবো না।” সেই থেকে ‘সোনার বাংলা’।
আছে কী সেই বাংলা? কেমনই বা ছিল বাংলার ঐতিহ্য? বাংলার অর্থনীতি, বাংলার নিজস্ব দেবার জিনিস, বাংলার সাহিত্য, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ভাবনা, দেশাত্মবোধ? বাংলার বর্তমান পরিস্থিতিই বা কী? এই বাংলা কী পারবে অগ্রগামী ভারতবর্ষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে? তারজন্যই কী ‘ডবল ইঞ্জিন’ দরকার?
তার আগে আলোচনা করে নিই সোনার দিব্যানুভূতির কথা, গীতাঞ্জলির ‘কৃপণ’ কবিতা থেকে —
“আমি ভিক্ষা করে ফিরতেছিলেম
গ্রামের পথে পথে,
তুমি তখন চলেছিলে
তোমার স্বর্ণরথে।
অপূর্ব এক স্বপ্ন-সম
লাগতেছিল চক্ষে মম–
কী বিচিত্র শোভা তোমার,
কী বিচিত্র সাজ।
আমি মনে ভাবতেছিলেম,
এ কোন্ মহারাজ।”
স্বর্ণরথে চলেছেন তিনি। ভাবলাম আজ আমার কী ভাগ্য! তিনি ধনধান্য ছড়িয়ে দেবেন, আমি কুড়িয়ে নেবো। আমাকো আর দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করতে হবে না। আমার কাছে এসে রথ গেল। দেবতা নামলেন। ‘আমায় কিছু দাও গো’ বলে হাত বাড়িয়ে দিলেন। আমি মাথা নিচু করে রইলাম। তোমার কী-বা অভাব? কোন দীনতা? ঝুলি থেকে ছোট এক কণা তুলে দিলাম। তারপর ঘরে ফিরলাম।
“যবে পাত্রখানি ঘরে এনে
উজাড় করি– এ কী!
ভিক্ষামাঝে একটি ছোটো
সোনার কণা দেখি।
দিলেম যা রাজ-ভিখারীরে
স্বর্ণ হয়ে এল ফিরে,
তখন কাঁদি চোখের জলে
দুটি নয়ন ভরে–
তোমায় কেন দিই নি আমার
সকল শূন্য করে।”
এবার ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আবহে চিত্রকল্পটি স্মরণ করুন। এক সন্ততুল্য রাষ্ট্রনায়ক উন্নয়নের দিগ্বিজয়ের রথ নিয়ে রাজ্যে প্রবেশ করেছেন। আর উন্নয়নহীন ‘বিশ্ববাংলা’-য় ১০০ দিনের কাজ-ভিক্ষা পাওয়া বাঙালি, দু’টাকা কেজি চালের ভিক্ষার ঝুলি ভরানো বাঙালি, পরিযায়ী শ্রমক্লিষ্ট বাঙালি চালচোরেদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ‘ক্ষমতায় ফিরলে সকলের রেশন ফ্রী’ — এ তো উন্নয়ন না করে সকলকে ভিখারী বানানোর ভোটবাদ্য। রাজ্যে শিক্ষা নেই, উন্নয়ন নেই, কর্মসংস্থান নেই, শিক্ষান্তে চাকরি নেই, শিল্প নেই, সুস্থ সংস্কৃতি নেই, ঘুষের দামে মেধার মূল্য নেই। বেকারি, বে-রোজগারের অন্ধ ভিখারিরা চারিদিকে গিজগিজ করে বেড়াচ্ছে। ‘জয় বাংলা’ আক্রান্ত চোখে সত্যকে না দেখতে পাবার ন্যাবা রোগ ধরেছিল গোটা রাজ্যে। ঘুষপেটি রোহিঙ্গার দল আগাছার মতো ঢুকেছিল মালঞ্চে। কুসুমোদ্যানে অবৈধ অনুপ্রবেশে ছারখার বঙ্গভূমি। চারিদিকে ভয়ানক জতুগৃহ, ফতোয়ার ফন্দি। খাগড়াগড় বিস্ফোরণ, দেগঙ্গা, উস্থি, মন্দিরবাজার, কালিয়াচক, জুরানপুর, হাজিনগর, ধূলাগড়, অসংখ্য নাম। কামদুনির ঘটনা, খড়গপুরে রোহিত তাঁতির খুন হয়ে যাওয়া, মৌ রজকের মৃত্যু, তেহট্টের স্কুলকান্ড, মা-বোনেদের লাঞ্ছনা। রাজ্যের মানুষ অজানার ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত। তবুও আমি ভিক্ষালব্ধ ধনে প্রতিপালিত হতে বাধ্য হওয়া এক ভিখারি-নাগরিক। ভাবলাম, ভর্তুকির স্বর্ণরৌপ্য মুঠো মুঠো ছড়িয়ে দেবেন গোল্ডেন চ্যারিওটের দেবতা। ‘স্টিকার দিদি’ বাংলা নামে মাত করে নিজের লেবেল বসিয়ে তা কাউকে কাউকে উপঢৌকন দেবেন। আমি বিনা আয়েসে, খেলামেলার সরকারের কাছ থেকে কুড়িয়ে নেবো বঙ্গভূমে বসেই।
কিন্তু না! ঐশীরথ আমার পাশে এসে থেমে গেল, সাধু নামলেন। বিশ্ববরেণ্য নেতার পদে আসীন তিনি, সাংগঠনিক শক্তির অপরূপ সৌকর্য, মনের সৌন্দর্য। সেই রাজভিখারী এসে আমার বোধ, আমার বিবেক, আমার বিকিয়ে যাওয়া মনের কাছে ভিক্ষা চাইলেন। ‘সোনার বাংলা’ গড়ার ভিক্ষা, উন্নয়নের যজ্ঞ সংঘটিত করার ভিক্ষা। অন্যায় অবিচার দূর করার ভিক্ষা। অপশাসন দূর করার ভিক্ষা।
যদি মনে করেন এটা ভোট ভিক্ষা, তবে তাই! যদি মনে করেন বাংলাকে রিকনস্ট্রাকশন করার ভিক্ষা, তবে তাই! যদি মনে করেন বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা বাঙালির দিল্লি যাত্রার শুল্ক, তবে তাই। অন্তরকে পুরোপুরি দান না করলে বাংলা সোনার হবে না। অন্তর উজার করে সবটুকু দিতে না পারলে বাংলা সোনার হবে না। জয় বাংলার জীবাণুতে আক্রান্ত চোখ নিয়ে এই ভিক্ষার সংজ্ঞা-স্বরূপ-বৈশিষ্ট্য আমরা ধরতে পারবো না। বুঝতে পারবো না স্বর্ণবঙ্গ করে দেবার জন্যই আমার কাছে হাত পেতেছেন ভারত-সম্রাট। ২০২১-এ যদি এ ভিক্ষা না দিই, যদি ক্ষণিকের দ্বিধায় কুড়ি টাকার পাউচের নেশায়, ডিম্ভাতের লোভে আকুল হই, তবে ভুল হয়ে যাবে আমার জীবন, আমার পরবর্তী প্রজন্ম, আমার উত্তরাধিকার, আমার ঐতিহ্য, আমার লোকসংস্কৃতি।
তাই ২০২১-এ সমস্ত ভিক্ষাকণাগুলি অর্থাৎ আমাদের মতদানগুলি সোনা করে নেবার সুযোগ আমি হাতছাড়া করবো না। কেন্দ্র ও রাজ্যে একই সরকার বা ডাবল ইঞ্জিনের সরকার গড়তে দিল্লিগামী-শকটে আমি আমার সামর্থ্য, অন্তরাত্মা, আকাঙ্খা, শক্তিকে নিয়ে যোগদান করাবো। এটাই হবে প্রকৃত ‘যোগদান মেলা’।
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী।