ঘটনা ১— হাওড়ায় বালিতে রবিবার রাতে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী পামেলা অধিকারীর (১৪) অস্বাভাবিক মৃত্যু হল। নিজের ঘরেই ঝুলন্ত অবস্থায় তার দেহ উদ্ধার হয়। জাতীয় স্তরে ক্যারাটে প্রতিযোগিতায় অংশ নিত পামেলা। ইউটিউবেও নিজের চ্যানেল ছিল। হাসিখুশি, প্রাণোচ্ছ্বল কিশোরীকে এলাকায় প্রায় সকলেই চিনত। পরিবারের অভিযোগ, তিন বন্ধু মিলে তাঁদের মেয়েকে ব্ল্যাকমেল করত। তার জেরেই ‘আত্মঘাতী’ হয়েছে ওই কিশোরী।
ঘটনা ২— এটিও রবিবার রাতের। দক্ষিণ ২৪ পরগনার ঢোলাহাট থানার রবীন্দ্র গ্রামে। পুরোনো সম্পর্ক ফিরে পেতে নাবালিকা প্রেমিকাকে চাপ দিতে শুরু করে প্রেমিক। অভিযোগ, সম্পর্কে ফিরতে রাজি না হওয়ায় সোশ্যাল মিডিয়ায় ওই নাবালিকা ছাত্রীর অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি ছড়িয়ে দেয় অভিযুক্ত। ঘটনার কথা জানাজানি হতেই অপমানে আত্মঘাতী হয় ওই নাবালিকা।
এ দুটো উদাহরণমাত্র। মাঝে মাঝেই এ ধরণের খবর আসছে প্রচারমাধ্যমে। সূত্রের খবর, ২০১৯ সালে কলকাতা পুলিশ এলাকায় আত্মঘাতী হয়েছিলেন প্রায় ৩০০ জন। কিন্তু লকডাউন শুরু হওয়ার পরেই আত্মহত্যার ঘটনা বাড়তে থাকে। পুলিশের এক শীর্ষ আধিকারিকের কথায়, ‘‘২০২০-র এপ্রিল থেকে নভেম্বর পর্যন্ত কলকাতা পুলিশ এলাকায় আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ৪৫০টির মতো। এর পর ছ’মাসে হারটা বেড়েছে বই কমেনি। এর একটা বড় কারণ করোনা।’’
মাঝে মাঝেই কিশোরীদের আত্মহত্যার খবর একটু বেশিমাত্রায় আসে। করোনা, মুঠোফোন কি এর নেপথ্যের কারণ হয়ে উঠছে? প্রতিকারের পথ কী? কী বলছেন মনস্তত্ববিদ, চিকিৎসক, অভিভবকরা? যদিও বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, করোনাই একমাত্র কারণ নয়। আরও নানাবিধ কারণ রয়েছে আত্মহত্যার এই প্রবণতার পিছনে। যেমন পারিবারিক বন্ধনের শৈথিল্য। অনেক সময় আত্মহত্যার নেপথ্যে মানসিক অবসাদ বলে চালিয়ে দিই। চরম হতাশা, অবসাদ যে কোনও বয়সে হতে পারে। অবশ্য তার সামান্যই আত্মহত্যায় পর্যবসিত হয়।
১৯১৪ সালের গ্রীষ্মে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হিমাচল প্রদেশের রামগড়ে ছিলেন। সে সময় কবি নোবেল পেয়েছেন, সারা বিশ্বে তিনি সম্মানিত৷ মাতৃবিয়োগ, নতুন বৌঠানের চলে যাওয়া, স্ত্রী-পুত্র-কন্যার মৃত্যুও যাঁকে টলাতে পারেনি, কর্মজীবনের ব্যর্থতাই সম্ভবত তাঁকে তাঁর ধ্যান থেকে সরিয়ে দিয়েছিল৷ জীবনে বহু শোক পেয়েছেন৷ কিন্তু শোককে কখনও জীবনের উপর জায়গা দেননি৷ মৃত্যু, শোক দহনের পরেও যে অনন্ত জাগে তারই সন্ধান করেছেন কবি৷ আমৃত্যু বিশ্বাস রেখেছেন। হঠাৎ অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন কবি৷ বিশ্বের পরিস্থিতি হোক, কিংবা অন্তর্দ্বন্দ্ব, কবির মন যেন বিষাদের ঘন মেঘে ঢাকা৷ রামগড় থেকে ফেরার পর পুত্র রথীন্দ্রনাথকে লেখা এক চিঠিতে ‘মরবার ইচ্ছা’ কীভাবে তাঁর মনকে গ্রাস করেছিল সে কথা জানিয়েছিলেন কবি৷ নিজেকে ‘আগাগোড়া ব্যর্থ’ মনে হয়েছিল তাঁর৷ জানিয়েছিলেন, ‘নিজের উপর এবং সংসারের উপর আমার গভীর অশ্রদ্ধা ঘনিয়ে আসছিল৷’ নিজের আদর্শকে বাস্তবে রূপ দিতে পারেননি বলেই ব্যথিত ছিলেন৷ নিদারুণ এই হতাশা অতিক্রম করেও কী করে যে জীবনে আদর্শের সাফল্যে পৌঁছানো যায়, তাও দেখিয়েছিলেন তিনিই৷
ভারত এমনিতেই আত্মহত্যার নিরিখে পৃথিবীর এক নম্বরে রয়েছে। আরও স্পষ্ট করে বললে, এ দেশের ১৫-৩০ বছর বয়সিদের মধ্যেই আত্মহত্যার প্রবণতা সব চেয়ে বেশি বলে নানা সমীক্ষায় উঠে এসেছে। তবে চলতি বছরে সংখ্যাটা অনেকটাই বেড়ে যাবে বলে মনে করছেন মনোরোগ চিকিৎসকেরা।পশ্চিমঙ্গের ক্ষেত্রে বিষয়টা চিন্তনীয়, কারণ সর্বভারতীয় মানচিত্রে আত্মহত্যার নিরিখে মহারাষ্ট্র ও তামিলনাডুর পর এই রাজ্য তৃতীয়। এর পর মধ্যপ্রদেশ এবং কর্ণাটক। গোটা দেশে বড় শহরগুলোর মধ্যে এদিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে আছে পশ্চিমঙ্গের আসানসোল। দেশে মোট আত্মহত্যার ৩২.৪ শতাংশের নেপথ্যে পারিবারিক কারণ।
মাঝে মাঝেই আত্মহত্যার নেপথ্যে আসছে উঠতি বয়সের সম্পর্কের জটিলতার কথা। এসএসকেএম হাসপাতালের ইন্সটিট্যুট অফ সাইকিঅ্যাট্রির অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ডাঃ সুজিত সরখেল অবশ্য এই প্রতিবেদককে বলেন, “না, ওরকম সরলিকরণ করলে হবে না। অনেক সময় ঘটনার পর অন্যতম সম্ভাব্য কারণকে আমরা স্বতসিদ্ধ বলে ধরে সেটিকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করি।“ অনেক সময় নেপথ্যের কারণ হয় বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে ‘মাল্টিফ্যাক্টোরিয়াল’।”
সমস্যাটা কোথায়? মুঠোফোনের ব্যবহার কি এর অন্যতম কারণ? অভিজ্ঞ মনস্তত্ববিদ তথা ‘ক্রিস্টাল মাইন্ড’-এর কর্ণধার রিমা মুখার্জির কথায়, “ছোট কথায় এটা ব্যাখ্যা করা মুস্কিল। মুঠোফোন অবশ্যই একটা কারণ। করোনাকালে আমরা মুঠোফোনে বন্দি হয়ে গিয়েছি। ফলে সাইবার অপরাধ থেকে অপরিচিত মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ—এর মাধ্যমে সবই বাড়ছে।“ সমাধানের পথ কী? জবাবে তিনি এই প্রতিবেদককে জানান, “অভিভাবক এবং শিক্ষক-শিক্ষিকাদের একটু সতর্ক থাকতে হবে। অপরিণত মন যাতে ঝামেলায় না পড়ে, তাদের সেই চেতনা আনা দরকার। এ কারণে আমরা এবং অনেকেই সচেতনতা-শিবির করছি।”
২০২০-তে প্রকাশিত ’১৯ সালের ‘ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরো’ (এনসিআরবি)-র রিপোর্টও জানাচ্ছে, ওই বছর ভারতে আত্মহত্যার মোট সংখ্যা ছিল ১ লক্ষ ৩৯ হাজার ১২৩। ২০১৮ সালে সেই সংখ্যাটাই ছিল ১ লক্ষ ৩৪ হাজার ৫১৬। ২০১৭, ২০১৬ ও ২০১৫-তে ওই সংখ্যা দাঁড়ায় যথাক্রমে ১ লক্ষ ২৯ হাজার ৮৮৭, ১ লক্ষ ৩১ হাজার ৮ ও ১ লক্ষ ৩৩ হাজার ৬২৩।
রিমা মুখার্জির মত মনোরোগ চিকিৎসক সুজিত সরখেলও এই প্রতিবেদককে বলেন, “ছেলেমেয়েদের ওপর নজর রাখতে হবে। আচমকা কেউ আত্মহত্যা করে না। ভালমত নজর রাখলে একটা সঙ্কেত পাওয়া হয়ত সম্ভব। কারণ, কেউ আত্মহত্যা করার আগে তার একটা মানসিক দ্বন্দ্ব হয়।“ আত্মহত্যার নেপথ্যে
মুঠোফোন কতটা দায়ী? এর জবাবে সুজিতবাবু বলেন, “এটা ঠিকই মোবাইল ফোন আমাদের অভ্যাস বদলে দিচ্ছে। যন্ত্র কিছু ক্ষেত্রে আবেগ কেড়ে নিচ্ছে। আমরা মানবিক যোগাযোগে পরস্পরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। আমাদের পারস্পরিক পারিবারিক বন্ধনটা আরও নিবিঢ় করতে হবে। অভিভাবক, শিক্ষক সকলকেই নজর রাখতে হবে। পড়ুয়াদের সঙ্গে যদি বন্ধুর মত মেশা যায় অনেক মনের কথা ওরা বলে হালকা হতে পারবে। সমস্যা সমাধানের পথও খোলা থাকবে।“
গৃহবধূ মিষ্টুনি সেনগুপ্ত এই প্রতিবেদককে বলেন, “আমার ধারণা আর্থিক অস্বচ্ছল পরিবারে জটিল সম্পর্কের প্রতিক্রিয়ায় বয়সন্ধিতে আত্মহত্যার আশঙ্কা বেশি থাকে। আমার পরিচারিকার মেয়ের মোবাইল ফোনে ডিপি-তে কখনও দেখেছি কাটা হাত দিয়ে রক্ত পড়ছে। আবার মন প্রফুল্ল থাকলে ডিপি বদলে যায়। পড়াশোনা বা সৃজনশীল কাজে যে কোনও বয়সের পড়ুয়া ডুবে থাকলে মোবাইল ফোন সহজে বিপথগামী করতে পারবে না। তবে, ছেলেমেয়েদের ওপর সতর্ক নজর রাখার কথা বলছেন। তত্বগতভাবে ঠিক, তবে অভিভাবকরাও অনেক ক্ষেত্রে অসহায়!“
মনোরোগ চিকিৎসক অনিরুদ্ধ দেবের মতে, “লকডাউন ওঠার পরে অনেকেই আসছেন তীব্র মানসিক উৎকণ্ঠার চিকিৎসা করাতে। সেই উদ্বেগ এতটাই যে, তাঁরা অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। তবে সব চেয়ে চিন্তার বিষয় হল, অনেকে নিজের মানসিক সমস্যা রয়েছে বুঝেও চিকিৎসকের পরামর্শ নিচ্ছেন না। যাঁরা আসছেন, তাঁরা অন্তত চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ হওয়ার সুযোগটুকু নিজেকে দিচ্ছেন। যাঁরা আসছেন না, তাঁদের ঝুঁকিটাই বেশি।“ উন্নত দেশগুলোয় তো আর্থিক চরম অনিশ্চয়তা না থাকলেও মানসিক চাপের নানা উৎস থাকে। তাহলে ভারত এবং এ দেশে পশ্চিমবঙ্গ আত্মহত্যায় কেন এগিয়ে? মনোরোগ চিকিৎসক সুজিত সরখেল এই প্রতিবেদককে বলেন, “এর একটা কারণ, ওই সব দেশে গোড়াতেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে মনোরোগ চিকিৎসকের সহায়তা নেওয়া হয়। এখানে ধীরে হলেও সেই চেতনা বাড়ছে।“
এই সঙ্গে বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, “অতিমারির এই পরিস্থিতিতে গোটা বিশ্বেই আত্মহত্যার সংখ্যা বেড়েছে। তার পিছনে কয়েকটি কারণও আছে। যেমন, অনেকেই কাজ হারিয়ে রোজগারহীন হয়ে পড়েছেন। অনেকে কাজ হারানোর পথে। ফলে তীব্র হতাশা চেপে ধরছে তাঁদের। আবার যারা কমবয়সি, সেই সব ছেলেমেয়ে স্কুলে যেতে বা বাইরে বেরোতে না পেরে মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। তাদের মধ্যেও এই প্রবণতা বেড়ে গিয়েছে।“
হিন্দুস্থান সমাচার/ অশোক
অশোক সেনগুপ্ত