একুশে ফেব্রুয়ারির আবেগ ও বাস্তবতাঃ

একুশে ফেব্রুয়ারী নিয়ে আমরা পশ্চিমবঙ্গের মানুষও আবেগে ভাসি। একুশে ফেব্রুয়ারী বললেই পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ বুদ্ধিজীবি আবেগে কেঁদে ফেলেন। “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্র‌ুয়ারী আমি কি ভুলতে পারি?” বা “আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্র‌ুয়ারী আমি কি ভুলতে পারি?”…… এজাতীয় লেখায় বিশেষ ঐ দিনে সোশ্যাল মিডিয়া বা প্রিন্ট মিডিয়া প্লাবিত হয়। কিন্তু সাধারণ বাঙালির কাছে একুশে ফেব্রুয়ারী কি ভাষা দিবস নাকি প্রতারণা-বেইমানি বা উপেক্ষার দিবস? এরাজ্যে জয় বাংলা স্লোগান নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ির পরিপ্রেক্ষিতে একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে প্রকৃত সত্যের পরাকাষ্ঠায় নতুন আঙ্গিকে বিশ্লেষণের সময় এসেছে।

পূর্ব বঙ্গের মুসলিম সমাজের সেকুলার জাতীয়তাবোধ কি ভাষা আন্দোলনের পেছনে কাজ করেছে নাকি সার্বিক সাংস্কৃতিক আগ্রাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায় এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের আকাঙ্খা থেকেই নতুন দেশ গঠনের রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের বীজ রোপিত হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের মোড়কে; কারণ সেকুলার জাতীয়তাবোধে যদি পূর্ববঙ্গের মুসলিম সমাজ-মনন সত্যি সত্যিই জারিত থাকতো তবে ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগের প্রয়োজনীয়তা টাই তো অপ্রাসঙ্গিক হ’ত। ১৯৩৭ সালে মুসলিম লীগের লক্ষ্মৌ অধিবেশনে বাংলার সভ্যরা উর্দুকে ভারতের মুসলিমদের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা মনোনয়নের প্রস্তাব পেশ করলে মুসলিম লীগের বাংলা ভাষার সমর্থকরা তা প্রত্যাখ্যান করেন ঠিকই কিন্তু তারা ভাষার ভিত্তিতে পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থার দাবি না তুলে সোচ্চারে ধর্মের ভিত্তিতে পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থার দাবি কে সমর্থন করে সেকুলারিজমের মুলেই কুঠারাঘাত করেছিলেন। ভাষা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি প্রভৃতি প্রায় সবকিছুর উপরে ধর্ম কে স্থান দেওয়া মানুষ গুলো হঠাৎই আরবি-ফারসি বা উর্দু কে ব্রাত্য করে সংস্কৃত ভাষা থেকে সৃষ্ট হওয়া বাংলা ভাষার টানে রক্তক্ষয়ী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করবে এরকম ভাবা টা একটু কষ্টকল্পনীয় অবশ্যই।

১৯৪৭ সালের ১৭ই মে খলীকুজ্জমান এবং ঐ বছরের জুলাই মাসে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডঃ জিয়াউদ্দিন আহমেদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা করার প্রস্তাব প্রদান করেন। ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে করাচি তে অনুষ্ঠিত এক শিক্ষা সম্মেলনে উর্দু কে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে অসন্তোষ সৃষ্টি হয় বটে কিন্তু সার্বিক প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ গড়ে ওঠে না। ব্যতিক্রম ছিল পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দু সমাজ। তাদের মধ্য থেকেই প্রতিবাদের ভাষা উঠে আসে। পাকিস্তান গণপরিষদের ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ তারিখের অধিবেশনে গণপরিষদের ভাষারূপে ইংরেজি ও উর্দুর সঙ্গে বাংলা ভাষা সংযোজনের জন্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রস্তাব তোলেন কিন্তু স্পিকার মৌলবি তমিজুদ্দিন খান ভেটো দিলে সেই প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায়। প্রস্তাবের সপক্ষে ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত বলেছিলেন “এই দেশে বসবাসকারী ছয় কোটি নব্বই লক্ষ মানুষের মধ্যে চার কোটি চল্লিশ লক্ষ মানুষ বাংলায় কথা বলেন। অতএব, মহোদয়, এই দেশের রাষ্ট্রভাষা কী হয় উচিৎ? দেশের রাষ্ট্রভাষা সেটাই হওয়া উচিৎ যে ভাষায় অধিকাংশ মানুষ কথা বলেন, এবং তার জন্য মহোদয়, আমি মনে করি বাংলা ভাষাই আমাদের রাষ্ট্রের ‘লিংগুয়া ফ্রাঙ্কা‘।“ বিস্ময়করভাবে তদানীন্তন পূর্ব বাংলা থেকে নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম লীগের বাঙালি সদস্যরা বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে সেদিন ভোট দিয়েছিলেন। পাকিস্তান গণপরিষদের ওই অধিবেশনে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের ঐতিহাসিক প্রস্তাব কে সমর্থন করে বক্তব্য দেন পূর্ব বাংলার সাধারণ আসন থেকে নির্বাচিত হয়ে আসা সদস্য প্রেমহরি বর্মণ। প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান চরম বাংলা ভাষা বিরোধী বক্তব্য রাখলে তার প্রতিবাদ করেন পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ আসন থেকে নির্বাচিত হয়ে আসা আর এক হিন্দু সদস্য ভুপেন্দ্র কুমার দত্ত অথচ পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত পাকিস্তান গণপরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাভাষী মুসলিম লীগ সদস্যরা বাংলা ভাষার প্রতি তাচ্ছিল্য ও চরম অপমানের সামনে শুধু মুখে কুলুপ এঁটেই বসে থাকেন না বরং সেদিন ধীরেন্দ্র নাথ দত্তের উত্থাপিত প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিলেন পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন সহ প্রত্যেক বাংলাভাষী মুসলিম লীগ সদস্য।

ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত কর্ত্তৃক উত্থাপিত বাংলা ভাষার দাবী এবং প্রেমহরি বর্মণ ও ভুপেন্দ্র কুমার দত্তের সমর্থন এবং একইসাথে উর্দু ভাষা কে রাষ্ট্র ভাষা করা হলে রুজি রুটি হারানোর আশঙ্কা পূর্ব পাকিস্তানের জনমানসে অসন্তোষ উদ্রেক করে। বাংলাভাষী মুসলিম লীগ সদস্যরা নিজেদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব কে ভবিষ্যৎ অপ্রাসঙ্গিকতা থেকে বাঁচানোর তাগিদে এই অসন্তোষে ইন্ধন দিতে শুরু করেন। ঠিক এইসময়ে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক সরকারের পক্ষ থেকে ভাষা সমস্যার গভীরে পৌঁছানোর জন্য মৌলানা আকরাম খানের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলা ভাষা কমিটি গঠন করে একটি প্রতিবেদন জমা করতে বলা হয়। এই প্রতিবেদনেই বাংলা ভাষা প্রীতি নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের দ্বিচারিতা পরিস্ফুট হয়। বাংলা ভাষার প্রতি তাদের প্রেম দেখলে করুণা উদ্রেক হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। প্রতিবেদনে বাংলা কে আরবি অক্ষরের মাধ্যমে লেখার সুপারিশ করা হয়েছিল!
অর্থাৎ ঘুরেফিরে সেই আরবি, উর্দু বা ফারসির প্রতি অমোঘ টান পূর্ব পাকিস্তানের বৃহত্তর সমাজ কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারছিলেন না। প্রকৃতপক্ষে উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকেই উর্দু ভাষাটি অধিকাংশ মুসলিম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও ধর্মীয় নেতা খাজা সলিমুল্লাহ, সৈয়দ আহমদ খান, নবাব ওয়াকার-উল-মুলক মৌলভী‎‎ এবং মৌলভী আবদুল হক প্রমুখদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আক্ষরিক অর্থেই ভারতীয় মুসলমানদের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কায় উন্নীত হয় কারণ এর পারসিক-আরবি লিপির দরুন উর্দুকে ভারতীয় মুসলিমদের ইসলামী সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হ’ত; যেখানে সংস্কৃত ভাষা ভিত্তিক হিন্দি বা বাংলা কে মুলতঃ হিন্দুধর্মের উপাদান রূপে বিবেচনা করা হ’ত।
নতুন সৃষ্টি হওয়া রাষ্ট্রের পূর্ব ভাগে পশ্চিম পাকিস্তানের উর্দুভাষীরা ধর্মের দোহাই দিয়ে উপনিবেশবাদী ভাবধারায় উর্দু কে আশ্রয় করে যখন প্রায় সম্পূর্ণরূপে রাজনৈতিক ভাবে করায়ত্ত করতে অগ্রসর হ’ল কেবলমাত্র তখনই পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাভাষী মুসলিম লীগ সদস্যরা ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক অপ্রাসঙ্গিকতা থেকে নিজেদের বাঁচাতে ভাষা আন্দোলনের পথিকৃৎ ধীরেন্দ্র নাথ দত্তের পথ অবলম্বন করতে একপ্রকার বাধ্য হয় এবং ছাত্র সমাজ কে প্ররোচিত করতে থাকে। অপরদিকে উর্দুর প্রাধান্যে কর্ম সংকোচনের অশনিসংকেত বাংলাভাষী ছাত্রসমাজ কে রাজপথে নামতে বাধ্য করে।

আন্দোলনের স্বাভাবিক ফলস্রুতিতেই আসে সেই রক্তক্ষয়ী দিন; ১৯৫২ সালের ২১ই ফেব্রুয়ারী। জব্বার, বরকত, রফিক, সালাম ভাষা শহীদ হিসাবে অধুনা বাংলাদেশে উজ্জ্বলতম নাম হিসাবে প্রতিষ্ঠা পায়। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের পথিকৃৎ ধীরেন্দ্র নাথ দত্তের নাম আজও রয়ে গেছে অন্তরালে উপেক্ষিত হয়ে। অথচ ধর্মান্ধ পাক শাসকেরা কাফের ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত কে কিন্তু ক্ষমা করে নি। তাঁর দেখানো পথ ধরেই যে পরবর্তীকালে পাকিস্তান দ্বিখণ্ডিত হয়েছিল তা পশ্চিম পাকিস্তানিরা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। দেশ ভাগের আন্দোলন শুরু হ’লে পাক রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে অপারেশন সার্চলাইট চলাকালীন কাফের ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত কে পাক সেনা তাঁর বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। হাত পা ভেঙ্গে জীবন্ত অবস্থায় চোখ দুটি উৎপাটিত করে অশীতিপর ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত কে হত্যা করা হয়। ভাষা আন্দোলনের পথিকৃৎ হওয়ার দরুন এমন চরম আত্মত্যাগের পরেও একাত্তরের স্বাধীনতার পরবর্তীকালে মিথ্যে ও খোকলা বাঙালি জাতীয়তাবাদের খোলস ত্যাগ করে বাংলাভাষী মুসলিমরা শত্রু সম্পত্তি আইনের প্রয়োগে শহীদ ধীরেন্দ্র নাথ দত্তের স্থাবর সম্পত্তির একাংশ দখল করে নেয়। এভাবেই উপেক্ষা, অবহেলা ও বেইমানির একটা অধ্যায় শেষ হয়।

পশ্চিমবঙ্গের যুবসমাজ একুশে ফেব্রুয়ারির সঠিক ইতিহাস জানুক। একুশে ফেব্রুয়ারী নিয়ে জিহাদী জনসমাজ এবং স্বার্থান্বেষী মহলের ছলনাশ্রয়ী মিথ্যে আবেগের উপর প্রতিষ্ঠিত বিকৃত ন্যারেটিভের মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গের যুব-মনন কে ষড়যন্ত্রমূলক খোকলা জাতীয়তাবাদের বিষ বাষ্পে জারিত করা অনতিবিলম্বে বন্ধ হোক।

ডঃ তরুণ মজুমদার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.